অন্ধকার রাত্রি
অন্ধকার রাত্রি
আজ যে ঘটনাটি আপনাদের বলতে যাচ্ছি সেটি একটি নিছক গল্প নয়, আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটা বাস্তব ঘটনা। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যেও আমার শরীরে হিমশৈলের রেখা ফুটে উঠেছিল। সেই অভিজ্ঞতার কথা আমি আজও ভুলতে পারিনি।
সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। বাইরে প্রচন্ড গ্রীষ্মের দাবদাহ চলছে। স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গিয়েছে। শহরের ধুলো,ধোঁয়া,আওয়াজের থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি পেতে ভাবলাম মামারবাড়ি থেকে ঘুরে আসি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বেরিয়ে পড়লাম মামারবাড়ির উদেশ্যে।
আমার মামারবাড়ি শহর থেকে অনেকটাই দূরে, একটা গ্রামে। যেখানে যাওয়ার জন্য বাস ধরতে হয়, আজও ট্রেনের ব্যাবস্থা নেই। বাসে দুই ঘণ্টা লাগে। রাস্তার দুদিকে সারি সারি গাছ। আর তার পিছনে সবুজ ধানের মাঠ। আহা কি আনন্দই না লাগে গ্রামের এই পরিবেশকে দেখতে।
সেদিন দুই ঘণ্টা ধরে বাসে যাওয়ার পর নির্দিষ্ট স্থানে বাস থেকে নেমে পড়লাম। তারপর পায়ে হাঁটা পথ, কোনো গাড়ির ব্যাবস্থা নেই। মিনিট চল্লিশেক হাঁটতে হয়। যাইহোক প্রচন্ড উত্তপ্ত রোদকে মাথার উপরে নিয়ে হেঁটে হেঁটে অবশেষে গিয়ে পৌঁছালাম। অনেকদিন পর মামারবাড়ি গেছি তাই ওরাও খুব খুশি আমাকে দেখে। সারাদিন সবার সঙ্গে হৈচৈ করতে লাগলাম। অনেক ভালো ভালো রান্নাও হয়েছিল আমার পছন্দের সব খাবার। সারাটাদিন বেশ ভালোই কাটলো।
কিছুদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল না। মাঠ ঘাট সব খাঁ খাঁ করছিল। মাটি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। দিনের বেলায় গ্রীষ্মের প্রচুর দাবদাহ থাকে বলে বেশির ভাগ চাষীরাই দিনেরবেলায় মাঠে না গিয়ে রাতের বেলায় ঠান্ডা পরিবেশে মাঠে জল দিতে যায় ধান রুইবার জন্য। আমার মামারাও তার ব্যতিক্রম নয়।
সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমার সেজ মামা আমায় বললো "চল মাঠে যাবো জল দিতে"। আমি বললাম "এত রাতে"। সেজমামা তখন বললো "এই গরমে কেউ দিনের বেলায় যায় না, রাতেই যায়,চল,ভয় নেই,আমি আছি তো"। আমি আর অগত্যা কথা না বাড়িয়ে সেজ মামার সঙ্গে চললাম। সেই প্রথম রাতের গ্রামকে খুব কাছ থেকে দেখলাম। কি সুন্দর তার রূপ। উফস অতুলনীয়।
আমার সেজ মামা প্রচন্ড সাহসী আর গম্ভীর রাশভারী লোক। আর আমি ঠিক তার উল্টোটা। তাই ভয়ে ভয়ে মামার সঙ্গে চলতে লাগলাম। সেজ মামা বললো "আমার সঙ্গ ছাড়বিনা,ভয় পেলে আমার হাত ধরে থাকবি"। আমি বললাম "সেজ মামা ভয় দেখাচ্ছিস কেন? তাহলে কিন্তু আমি যাবো না"। সেজ মামা হেঁসে বললো "চলনা ভয় নেই"। আমিও মামার সঙ্গে হাত ধরে হেঁটে হেঁটে যেতে লাগলাম।
মাঠে পৌঁছাতে প্রায় কুড়ি মিনিট লেগে গেল। পাইপ,মেশিন ফিট করে মামা মাঠের এককোনে পাইপের মুখটা রেখে দিলো যাতে ওর থেকে পুরো মাঠটা জলে ভোরে যায়। আর আমাকে নিয়ে যেখানে মেশিন চলছিল সেখানে গিয়ে বসে পড়ে। ঐখানে খড় দিয়ে ছাউনি করে একটা ছোট্ট চালা মতো করা আছে, আর তিনদিকে দরমা দিয়ে ঘেরা।
"কিরে ভয় পাচ্ছিস নাকি"?
"তা একটু করছে বটে"।
"আধঘন্টা হলেই পাইপ, মেশিন নিয়ে বাড়ি চলে যাবো । ভয় পাসনি তাহলে আরও ভয় করবে, মনকে শক্ত কর"।
দুজনে বসে বসে যখন এইসব কথা বলছি, তখন মাঠের উল্টো প্রান্তের জমির আল দিয়ে একজনকে যেতে দেখলাম। তার উচ্চতা হবে প্রায় নয় ফুট। মাথায় মুসলিম মৌলবিদের মতো টুপি, সাদা পাঞ্জাবি আর নীল রঙের লুঙ্গি পড়ে একমনে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
"এত রাতে কে বলতো ওটা?"
"যেই হোক তোমায় দেখতে হবে না।"
"যাচ্ছেই বা কোথায় ?"
"আমি কি করে জানবো বলো। তুমি যেখানে আমিও সেখানে"।
এইসব কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার সেজ মামা আমাকে অবাক করে দিয়ে জোরে হাঁক দিল-
"কে গো? এত রাতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে ?"
লোকটি একবার থমকে দাঁড়ালো, তারপর আবার একই রকমভাবে চলতে শুরু করলো। পুকুরের অন্যপাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরাও আর কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম। জমি প্রায় জলে ভরে এসেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে যাবে, আর আমরাও বাড়ি চলে যাবো।
কিন্তু ঘটনার শুরু তো হলো তখন থেকেই। হঠাৎ করেই ঘরটা যেন প্রচন্ড হাওয়ায় দোলনার মতো দুলতে লাগলো। আমরা দুজন বাইরে ছুটে বেরিয়ে এলাম, কিন্তু বাইরে কোনো হাওয়া নেই। যেই ভিতরে যাচ্ছি, প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়ে যাচ্ছে আর গোটা ঘরটা দুলছে, কিন্তু যেই বাইরে আসছি আর কিছুই নেই।
আমার প্রচন্ড ভয় হতে লাগলো। মামার হাতটা শক্ত করে ধরে রইলাম। মামা বললো-
"চল,মেশিন বন্ধ করে বাড়ি চলে যাই"।
"তাই ভালো,আমার খুব ভয় করছে"।
"গতিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। মেশিন,পাইপ থাক,কাল নিয়ে যাবো"।
এইকথা বলে দুজনে যখন মেশিনটা বন্ধ করবো বলে এগিয়েছি তখন সামনে হঠাৎ করেই সেই নয় ফুটের লোকটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ে,আবার অদৃশ্যও হয়ে যায়। আমি ছুটে গিয়ে মেশিনটাকে জড়িয়ে ধরে বসে পড়ি। সেজমামা পাইপটা আস্তে আস্তে করে গুটিয়ে নেয়। তারপর মেশিন বন্ধ করে মাথায় তুলে নিয়ে আমায় তার সঙ্গে সঙ্গে মেশিনে হাত ঠেকিয়ে যেতে বলে। আমিও সেই রকম ভাবেই চলতে থাকি।
হঠাৎ করেই আমাদের চমকে দিয়ে কেউ বলে ওঠে-
"কিরে চলে যাচ্ছিস যে? আমাকে তো ডাকলি গল্প করবিনা।"
সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর হিমশৈলের থেকেও ঠান্ডা হয়ে গেল। আর প্রচন্ড ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। দরদর করে শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেছি।
"ভয়পাসনা,মেশিন থেকে হাত ছাড়বিনা, আমার সঙ্গে সঙ্গে আসবি।"
আমি কোনো কথা না বলে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি আর মেশিনটাকে শক্ত করে ধরে মামার সঙ্গে একসঙ্গে বাড়ির দিকে হু হু করে চলেছি। আর সেও আমাদের পিছনে বারবার একই কথা বলতে বলতে আসতে লাগলো।
কিছুদূর আসার পর আর আওয়াজটা শোনা গেল না। কিন্তু দুজনে আবিষ্কার করলাম আমাদের পিছনে পিছনে একটা কুকুর আসছে কান ঝটকানোর আওয়াজ করতে করতে।
"পিছনে ঘুরবিনা। সামনে দেখে চল"।
কিন্তু আমি কুকুরে ভয় পাই। যদি কামড়ে দেয় তাই থাকতে না পেরে পিছনে ঘুরে যা দেখলাম সেই রকম জন্তু আমি আজও কোনোদিন দেখিনি, আর কোনো বইয়ের পাতাতেও পড়িনি। সাদা ধবধবে একটা বিশাল বাঘের মতো জন্তু। যার কানগুলো কুকুরের মতো। জিভটা বিশাল বড়। মুখ থেকে মাটি পর্যন্ত লুটিয়ে আছে। সে আমাদের পিছনে কান ঝটকাতে ঝটকাতে আসছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে আবার সামনের দিকে ঘুরে পড়ি আর মেশিন সমেত মামাকে জড়িয়ে ধরে ফেলি। সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে, গা দিয়ে অঝোর ধারায় ঘাম বেরোচ্ছে, আর প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেও আমার শরীরটা হিমশৈলের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে মৃত্যু আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
"আমি তোকে পিছনে ঘুরতে বারণ করলাম, তাও তুই ঘুরলি?"
ভয়ে মুখ দিয়ে আমার কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। কাঁপতে কাঁপতে মামার সঙ্গে বাড়ির উদেশ্যে চলতে লাগলাম।
আবার হঠাৎ করেই সামনের দিকে বাঁশঝাড়ের উপর দেখলাম দুটো বিশাল অতিকায় লাল চোখ। টুনি ল্যাম্পের মতো জ্বলছে আর নিভছে। আমরা যত যাচ্ছি সেই চোখও আমাদের পাশে পাশে তত যাচ্ছে। আমি ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে গেছি। কিন্তু মামার মুখে ভয়ের বিন্দুমাত্র লেস দেখতে পাচ্ছি না। সে যেন কিছুই হয়নি এইরকম ভাব করে হাঁটছে আমার সঙ্গে।
বাড়ির সামনাসামনি আসতেই সেই জন্তু আর চোখ দুটোই যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলো। বাড়ির ভিতরে ঢোকার পর সেজ মামা আমাকে ধমক দিতে লাগলো।
"তোকে বারবার বারণ করলাম পিছনে দেখবিনা, কথাটা তোর কানে যায়নি? তাও তুই পিছনে ঘুরে দেখলি?"
আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছিল না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উল্টে পড়ে গেলাম।
জ্ঞান ফিরলো পরেরদিন রাতে। প্রচন্ড জ্বর। উঠতে পারছিনা। আমার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে বাবা,মাও ছুটে গেছে সেখানে। কোনো ওষুধেই কিছু কাজ হচ্ছে না। ডাক্তার সবসময় পাশে বসে আছে। শেষে ডাক্তার বললো-
"গতিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। তোমরা শহরে বড় হসপিটালে নিয়ে চলে যাও। "
পরেরদিন আমায় কলকাতার হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানেও একই অবস্থা। জ্বর কিছুতেই নামছেনা। এরইমধ্যে সেদিন রাতে আমার সেজ মামা স্বপ্নে দেখেছিল ওই লোকটি মামার কাছে এসেছে আর বলছে -
"তোর ভাগ্নাকে আমায় দিয়ে দে। ওকে কিছুতেই ভালো করতে পারবিনা।"
আমাদের বাড়িতে যুগযুগ ধরে কালিপুজো হয়। খুব জাগ্রত। বিপদে আপদে সবাই ছুটে আসে মায়ের কাছে। সুবিচারও পায় সবাই। আমার ঠাকুমা প্রতিদিন সেই ঠাকুরের পুজো করতেন। সবকিছু শুনে আমার ঠাকুমা কালি মায়ের ফুল, বেলপাতা দিয়ে মন্ত্রপুত করে একটা মাদুলির ভিতরে ভড়ে আমার হাতে পরিয়ে দেয় আর ঠাকুরের চরণামৃত আমার মুখে দিয়ে দেন।
মাদুলি পড়ার তিন ঘন্টার মধ্যে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠি। তারপর আমার ঠাকুমা আমাকে নিয়ে তাড়াপীঠের মহারাজের কাছে যান। তিনি দুদিন ধরে হোম যজ্ঞ করে সেই মৌলবী আত্মাকে বশ করেন এবং আমাকে মুক্তি দেন সেই বিপদ থেকে। তারপর থেকে আর কোনদিন আমাকে এই রকম বিপদের মধ্যে পড়তে হয়নি।

