Sayandipa সায়নদীপা

Drama

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

অজানা কন্ঠ

অজানা কন্ঠ

6 mins
6.3K


পেপার কাকু পত্রিকাটা দিয়ে যেতেই রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো সুবর্ণ। “মাসিক কথকতা” তার প্রিয় পত্রিকা, পত্রিকাটার প্রচ্ছদে চোখ পড়তেই দেখলো অন্ধকার আবহে জনৈক মডেল শার্লক হোমসের মত পোশাক মুখে চুরুট নিয়ে বিশেষ কায়দায় দাঁড়িয়ে আছে, বিশেষ রহস্য সংখ্যা। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে পত্রিকাটা খুলল সুবর্ণ, রহস্য গল্প তার প্রিয়। একটার পর একটা গল্প গোগ্রাসে গিলতে গিলতে হঠাৎ এসে হোঁচট খেলো একজায়গায়। গল্পটার শুরুর অনুচ্ছেদটা পড়তেই কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকলো, কৌতূহল নিয়ে বাকি আরও কিছুটা পড়তেই তার গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। এ কিভাবে সম্ভব! লেখকের নামটা এতক্ষণ খেয়াল করেনি, এবার দেখলো, সমীর কুমার পত্রনবিশ। আরেকবার চমকালো সুবর্ণ, এ কি করে হয়! ইনি তো বর্তমান সময়ের একজন জনপ্রিয় লেখক! হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো সুবর্ণর। মনে পড়ে গেল মাস তিনেক আগের কথা।

সুবর্ণ ছোটোর থেকেই টুকটাক লেখালিখি করে তবে লেখা জনসমক্ষে আনার সাহস সেভাবে হয়নি কখনও। ইদানিং ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রূপে লোকে লেখা দিচ্ছে দেখে উৎসাহিত হয়ে ফেসবুকে নিজের কয়েকটা পুরোনো লেখা দেয়, লাইক কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। সেই দেখে উৎসাহিত হয়ে সে তার প্রিয় পত্রিকা মাসিক কথকতার দপ্তরে ডাক মারফৎ পাঠায় নিজের সদ্য লেখা একটা রহস্য গল্প। বেশ কিছুদিন অপেক্ষায় কেটে যাওয়ার পরও পত্রিকা কতৃপক্ষ থেকে কোনো খবর না আসায় সে ধরে নেয় যে লেখাটি নিশ্চয় মনোনীত হয়নি। মনে মনে একটু কষ্ট পেলেও সুবর্ণ নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে সে বামন হয়ে চাঁদ ধরতে গিয়েছিল। কথকতায় বরাবর নামী লেখকদের লেখা ছাপা হয়ে থাকে সেখানে ওর মত একজনের লেখা পাঠিয়ে তা মনোনীত হওয়ার প্রত্যাশা করা উচিৎ হয়নি ওর। নিজের এই উচ্চাকাঙ্খার জন্য নিজেকেই মনে মনে দোষারোপ করতে থাকে, আবার কখনো মনে হয় গল্পটা বোধহয় এতোটাও খারাপ ছিলো না।

কিন্তু আজ এটা ও কি দেখলো! সমীর কুমার পত্রনবীশের নামের তলায় যে গল্পটা রয়েছে তাতে স্থান আর পাত্রের নাম বদলে দিলেই যে শতকরা নব্বই ভাগ তার সেই গল্পটাই, সামান্য হেরফের হয়তো করা হয়েছে কিছু জায়গায় কিন্তু প্লট থেকে শুরু ভাষার বিন্যাস সব তো হুবহু একই প্রায়! তাহলে কি…!

**********

মোবাইলে একটা মৃদু গতির গান চালিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন সমীর কুমার পত্রণবিশ। মাঝেমাঝে মেলোডিয়াস গান শুনলে মাথাটা খোলে ভালো। গানের মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো ঝনঝন করে। কলারের নাম দেখে একটা ঢোঁক গিলে নিয়ে ফোনটা ধরলেন সমীর বাবু, “হ্যালো।”

“হ্যাঁ নমস্কার দাদা। গল্পটা পাচ্ছি তো তাহলে?”

“হুঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। ওটাই লেখা চলছে।”

“আচ্ছা আচ্ছা। তা একটু তাড়াতাড়ি করবেন দাদা।”

“হুমম।”

“আপনার ওই ‘নীলপরীর রহস্য’ এর মত একটা গল্প চাই কিন্তু দাদা। ক্লাসিক পিস ছিলো ওটা, উফফ… এতদিন আমরা জানতেই পারিনি আপনি এমন চমৎকার রহস্য গল্প লেখেন! আর আপনাকে ছাড়ছি না দাদা।”

“হেঁ হেঁ সবই আপনাদের ভালোবাসায় আর কি…”

ফোনটা রেখে একটা স্বস্তির শ্বাস নিলেন সমীর বাবু। কিন্তু ডায়েরির পাতাটার দিকে চোখ পড়তেই স্বস্তি উধাও হলো। কিভাবে আর এক সপ্তাহের মধ্যে পাঠাবেন গল্পটা? দেখতে গেলে তাঁর তো একটা লাইনও লেখা হয়নি। শুধু লিখছেন আর কাটছেন, রহস্য দানা বাঁধছে কই! রহস্য গল্প লেখার শখ তাঁর বহুদিনের কিন্তু সেটা লেখা কোনদিনই তার আসে না। “নীলপরীর রহস্য” পড়ে বর্তমানে বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় রহস্য পত্রিকা “রহস্য গভীরে” এর সম্পাদক তাঁকে ধরেছেন ওই পত্রিকায় লেখার জন্য। কিন্তু কিভাবে লিখবেন তিনি! আর ওরকম একটা পত্রিকায় যা তা কিছু লিখে পাঠিয়ে দিলে তাঁর নিজেরই তো ইমেজের দফারফা হবে।

টেবিলের ওপর রাখা মাসিক কথকতাটার ওপর চোখ যেতেই ফোনটা তুলে একটা নম্বর ডায়াল করলেন সমীর বাবু, “হ্যালো অরিন, কোথায় তুই?”

“অফিসে।”

“ওহ… সেই ছেলেটার কি খবর রে? আর ঝামেলা করছিলো নাকি?”

“কোন ছেলেটা বলোতো?”

“ওই যে কি যেন নাম সুবর্ণ না কি…”

“আরে ছাড়ো তো দাদা ওসব। পাগল ছাগল লোকের কান্ড, যা ডোজটা দিয়েছি না আর জীবনে এরকম করার সাহস করবে না।”

“হুমম পাগলই হবে বোধহয়। তবে ওর বাড়িতে ওভাবে পুলিশ পাঠানোটা কি ঠিক হলো?”

“ঠিক ভুলের কি আছে দাদা! হয়তো লজিক্যালি পুলিশের এখানে কিছু করার নেই কিন্তু বেশিরভাগ মিডিল ক্লাস ফ্যামিলিই পুলিশকে যমের মত ভয় করে তাই অভয়কে বললাম ওকে একটু কড়কে দিতে।”

“কিন্তু…”

“দাদা তুমি ব্যাপারটা যত হালকা ভাবে নিচ্ছ ততটা হালকা ব্যাপার নয় মোটেও। ও যে আমাদের অফিসে এসে ঝামেলা করলো, ফেসবুকে পোস্ট দিলো এতে তো শুধু তোমার রেপুটেশন নয় আমাদের পত্রিকার কতটা ক্ষতি হচ্ছিল ভাবতে পারো। অভয়কে পাঠিয়ে ধমক ধামক দিতেই পোস্ট উধাও ফেসবুক থেকে, ঝামেলাও বন্ধ।”

“হুমম তুই হয়তো ঠিকই বলছিস।”

“আরে এসব ছাড়ো দাদা, কবে অফিসে আসছো বলো। নেক্সট ইস্যুর লেখা সিলেকশন তো শুরু করতে হবে এবার।”

“হ্যাঁ যাবো শিগগির।”

ফোনটা ছেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সমীর বাবু। তারপর কলমটা তুলে আবার লেখার চেষ্টা করতে যাবেন তখনই হঠাৎ করে কারেন্ট জাল চলে আর অন্ধকারেই কেউ যেন বলে উঠলো, “ছেলেটা তবে পাগল ছিলো?”

“কে!” চমকে উঠলেন সমীর বাবু।

“কে সেটা আপনার না জানলেও চলবে তবে ছেলেটা কি সত্যিই পাগল ছিলো নাকি…”

“এই কে আপনি! কোথায় আছেন?”

“হাঃ হাঃ … মাথা ঘুরিয়ে লাভ নেই, আমায় আপনি দেখতে পাবেন না। তা বলছি ছেলেটা পাগল ছিলো নাকি পাগল আপনি?”

“মানে?”

“যে অন্যের লেখা চুরি করে নিজের নামে চালাতে চায় তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি?”

“ক্ক… কি বলতে চাইছেন কি?”

“নীলপরীর রহস্য… আসল নাম কি ছিল যেন লেখাটার? রূপকথার সন্ধানে… লেখকের নাম সুবর্ণ বসু।”

“এই এই কে আপনি? এসব কি বলছেন?”

“মাসিক কথকতার সম্পাদক আপনার মাসতুতো ভাই আর সেই সুবাদেই লেখা নির্বাচনের দলে থাকেন আপনি। সেদিন যখন সুবর্ণর লেখাটা আপনি পড়লেন তখন ভাবলেন এতো চমৎকার লেখা, কিন্তু লেখক তো সম্পূর্ণ অনামী। বাকিরা কেউ তখন উপস্থিত ছিলো না রুমে আর সেই সুযোগটাই নিলেন আপনি। টুক করে লেখাটা ঢুকিয়ে নিলেন নিজের ব্যাগে। দপ্তরে আসা অসংখ্য লেখার ভিড়ে একটা লেখা যে হারিয়ে গেল জানতেও পারলো না কেউ।”

“আ… আপনি এসব জানলেন কি করে!”

“বহুদিনের সখ আপনার একটা রহস্য গল্প লেখার, মরিয়া ছিলেন আপনি। আপনি নামী লেখক, সবাই আপনার কথাই বিশ্বাস করলো। অনামী ছেলেটার লেখা চুরি করেই আপনি ক্ষান্ত হলেন না ছেলেটার প্রতিবাদ বন্ধ করতে পরিচিত পুলিশকে পাঠালেন পাড়ার মাঝে তাকে হেনস্থা করে আসতে। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে তাদের সম্মানের মূল্য সবচেয়ে বেশি, আপনি চক্রান্ত করে সেটাতেই আঘাত হানলেন। একে নিজের সন্তানকে চুরি হতে দেখার শোক, উপরন্তু পাড়ার মাঝে পুলিশের হাতে ওভাবে নিজের এবং নিজের পরিবারের লোকের হেনস্থা নিতে পারলো না ছেলেটা।”

“মা… মানে?”

“মানে আমি আর আপনাদের মাঝে নেই সমীর বাবু। এখন আমার প্রতিবাদের মুখ কিভাবে বন্ধ করবেন?”

“ত… তুমি… সুবর্ণ! আ… আমাকে প্লিজ ক্ষমা করো। প্লিজ।”

“সেটা তো আর হয়না মাননীয় লেখক মহাশয়।”

“প্লিজ সুবর্ণ… আয়াম সরি। রিয়েলি সরি।”

“আমার এখন আর এসবে কিচ্ছু যায় আসেনা।”

“না প্লিজ এরকম বোলো না। আমাকে কি করতে হবে বলো।”

“পারবেন সবার সামনে সত্যিটা স্বীকার করতে?”

“সবার সামনে? আচ্ছা… আচ্ছা তাই হবে। আমি বলবো যে নীলপরীর রহস্য তোমার লেখা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে লেখা।”

“অনুপ্রেরণা? হাঃ হাঃ… ইয়ার্কি করছেন? অনুপ্রেরণা নিয়ে লেখা কাকে বলে জানেন?”

“সরি সরি। আচ্ছা আমি বলবো যে লেখাটা তোমারই ছিলো, প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও।”

“বলবেন আপনি চুরি করেছিলেন, চোর আপনি চোর।”

“হ্যাঁ বলবো বলবো চুরি করেছিলাম লেখাটা। আমাকে মেরো না…”

“বাবা!”

ডাকটা শুনে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালেন সমীর বাবু। দেখলেন তাঁর একমাত্র মেয়ে রুমন একটা ইমারজেন্সি লাইট হাতে এসে দাঁড়িয়েছে কখন। ওর চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে নিজের বাবার দিকে, অথবা একজন চোরের দিকে। ওর দু’চোখ বেয়ে নামছে জলের ধারা। ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়লেন সমীর বাবু।

পরিশিষ্ট:

নিজের স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর সমীর বাবুকে ব্যান করে দিয়েছে বেশিরভাগ পত্রিকা। তবে সমীর বাবুর বিশেষ দুঃখ হয়না এজন্য, তিনি জানেন নিজের কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছেন তিনি। এখন ফেসবুকে তিনি লিখছেন নিয়মিত; গল্প চুরির নিন্দা করে বিভিন্ন সচেতনতা মূলক গল্প, নিবন্ধ, ছড়া লেখাই তার মূল লক্ষ্য। ফেসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রিকায় এখন প্রায়ই দেখতে পাচ্ছেন এক নবাগত লেখকের নাম, সুবর্ণ বসু। নামটা দেখলেই মনটা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে যায় সমীর বাবুর। হ্যাঁ, সুবর্ণ ঠিকই আছে।

তবে অনেক ভেবেও সমীরবাবুর মন থেকে একটা খটকা যাচ্ছেনা কিছুতেই। রুমন তো বলেছে সেদিন সন্ধ্যায় সে তাঁকে একলাই বকবক করতে দেখেছে অন্ধকারে, দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে দেখেনি বা কোনো গলা শোনেনি। কিন্তু সমীর বাবু স্পষ্ট জানেন আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গে সেই গলার স্বর তিনি শুনেছিলেন। সেই ব্যক্তি এমন সব কথা বলেছিল যা কারুর জানার কথা নয়। তাই সমীর বাবু অনেক ভেবেও কিছুতেই বুঝতে পারেননি কার ছিলো সেই অজানা কন্ঠ!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama