STORYMIRROR

Rima Goswami

Drama Thriller

4  

Rima Goswami

Drama Thriller

অঘোরীর অভিশাপ

অঘোরীর অভিশাপ

32 mins
660

          

পরিত্রাহি চিৎকার করে সব গ্রামবাসী ছুটছে রেল স্টেশন এর দিকে । বুড়ো , বাচ্চা , নারী , পুরুষ সকলেই আছে সে দলে । আর যাদের ছুটে পালানোর ক্ষমতা নেই তাদের নিজের নিজের বাড়িতে তাদের কাটা মুন্ড গুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে । রক্তে ভরে গেছে উঠানগুলো । গ্রামের নাম হেতডোবা , এক পাড়া গা যেখানে নেই বিদ্যুতের সংযোগ নেই পাকা রাস্তা , আছে দুর্বিষহ ভয় । ঘটনার সূত্রপাত গত বছর সে বার গ্রামে এলো দুই অঘোরী তান্ত্রিক । গ্রামের মোড়ল কবি ঘোষের বাড়িতে পৌষ সংক্রান্তি র রাতে ঠক ঠক । তা মোড়ল এত রাতে কে জ্বালাতে এলো এই ভেবে যেই দোর খোলে সামনে পায় দুই অঘোরী কে । তারা সে রাতে মোড়লের বাড়িতে অন্ন গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন । মোড়ল তাদের অসময়ে বিরক্ত করার অপরাধে যা না তাই বলে অপমানিত করে তাড়িয়ে দেয় । ফিরে যাওয়ার আগে দুই অঘোরী অভিশাপ দিয়ে যায় যে গ্রামের মোড়লের মধ্যে অতিথির সেবা করার ভাব নেই , সংবেদনশীল ব্যবহার নেই সেই গ্রাম বিনষ্ট হতে থাকবে প্রতি অমাবস্যার রাতে । যেদিন মোড়ল পরিবর্তন হবে সে দিন গ্রামে শান্তি ফিরে আসবে । এই বলে তারা ফিরে যায় । সে রাতেই গ্রাম ছাড়ার আগে তারা স্থাপন করে দামোদর নদের পাশে এক ভয়াবহ মূর্তি দেবী কাটভি র । সকাল বেলা গ্রামবাসী রা আবিষ্কার করে এই ভয়াল দেবী মূর্তি । ভয়ই হোক বা শ্রদ্ধা তারা এই দেবীর নিত্য পূজা আরম্ভ করে । এর প্রতিষ্ঠাতা কে ? প্রতিষ্ঠানের কারণ কি তা না জেনেই । বলা বাহুল্য নিজের ভুল বুঝতে পারলেও মোড়ল কবি ঘোষ নিজের মুখ বন্ধ রাখাই সমীচীন মনে করে । তার পর আসে সেই প্রথম ভয়াল রাত ।


অভিশাপ ফলবে কি ফলবে না এই নিয়ে কিছু দিন দ্বিধা থাকলেও পরে কবি ঘোষ সব ভুলেই গিয়ে ছিল প্রায় । তার পর আসে সেই ভয়াল রাত যা তার সেই সংক্রান্তি র দিন করা ভুলের মাশুল হয়ে ফিরে আসে । পৌষ সংক্রান্তি র দিন মানুষ কুকুর বিড়াল কে তারায় না আর গ্রামের মোড়ল হয়ে কবি ঘোষ কি না দুই অঘোরী তান্ত্রিক দের অপমানিত করে তাড়িয়ে দেয় । কামরূপে তন্ত্রচার করা দুই ভাই তেমু আর বলিষ্ঠ অঘোরী সন্ন্যাসী । অমর নাথ দর্শন করে তারা বঙ্গে প্রবেশ করে এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে তারা সে দিন এসে পড়ে ছিল হেতডোবা গ্রামে । দীর্ঘ পথ চলার ফলে ক্ষিদে র তাড়নায় তারা ভাবে রাত টুকু তারা গ্রামেই কাটিয়ে দেবে । গ্রামে অতিথি এলে তার সত্কার মোড়লের দায়িত্ব সেই ভেবে তারা পথ খুঁজে উপস্থিত হয়েছিল কবি র বাড়ি । তার পর যা যা ঘটে তাতে আকস্মিক রাগে অন্ধ হয়ে তারা গোটা গ্রামকে অভিশাপ দিয়ে যায় ।  তাদের চলে যাওয়ার কদিন পর আসে অমাবস্যার রাত । সে রাতে হটাৎ করেই শুরু হয় ঘূর্ণি ঝড় , কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় মৃত্যুর তান্ডব । দামোদর এর পাশে আকস্মিক প্রতিষ্ঠা হওয়া ভীষণ দর্শনা অজানা দেবী মূর্তি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে । ঘোর কালো গাত্র বর্ণ , জিওহা ললনা ভীষনা , উলঙ্গ , চতুর্ভূজ। দেবী র হাতে খাড়া এক হাতে ছিন্ন মস্তক এক হাতে তরোয়াল আর এক হাতে পাত্র । সন্ধ্যে থেকেই চার দিকে এক গুমোট ভাবের শুরু হলো , বাতাসে যেন মৃত্যুর গন্ধ । আস্তে আস্তে শুরু হলো ঘূর্ণি ঝড় আকাশ বাতাস বিদীর্ন করে বাজ পড়তে আরম্ভ হলো । তার মধ্যেই দেখা গেল এগিয়ে আসছে ভয়াল মূর্তি দেবী কাটভি র । দেবী যাকেই সামনে পায় তারই মুন্ডু উপরে ফেলতে শুরু করলেন । সারা গ্রামে ত্রাহি ত্রাহি শুরু হয়ে গেল । প্রাণ বাঁচাতে সবাই গ্রামের বাইরে ছুটতে লাগলো । এ ভাবে সেই রাতে দেবীর প্রকোপে প্রায় সত্তর জন নিহত হলো । ভোর বেলায় তটস্থ গ্রামবাসী সাহস সঞ্চার করে যখন গ্রামে প্রবেশ করলো । দেখা গেল সব কিছু শান্ত হয়ে গেছে । দেবী মূর্তিও যথা স্থানে রয়েছে । শুধুমাত্র মৃত মানুষগুলো র শরীর গুলো প্রমান দিচ্ছে গত রাতের বিভীষিকার । 

তার পর ......


অমাবস্যার পরের দিন সকালে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সব দেখে ও এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো অজানা বন্য প্রাণী র হাত থাকার কথা মনে করে কেস বন্ধ করে দেয় । এই ঘটনার ফলে গ্রামবাসী দের মধ্যে তিব্র ভয়ের সূচনা হয় । পঞ্চায়েত বসে , আলোচনা সভায় প্রধান মোড়লই যে এই ঘটনার জন্য দায়ী তা কেউ জানতো না । কি কারণে এই ঘটনা ঘটেছে ? কি ভাবে এর থেকে মুক্তি মিলবে এই নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে কবি ঘোষ নিদান দিলো যে মূর্তিটি এই নর হত্যা র কারণ তাকে বিসর্জন দিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে। যুক্তি সকলের মনোমত হওয়ায় সময় নষ্ট না করে গ্রামের ছেলে ছোকরা রা ছুটলো দামদরের দিকে । নদের পারে পৌঁছেই সকলে মিলে ভয়াল মুর্তিটিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করলো । যাতে তারা মূর্তিটা নদে বিসর্জন দিতে পারে । আশ্চর্য র বিষয় গ্রামের জোয়ান জোয়ান ছেলেরা এক চুল নড়াতে পারলো না মূর্তি টি । তারা হাল না ছেড়ে নদ থেকে এবার কলসি কলসি জল আনতে শুরু করলো আর মূর্তির দিকে ছুড়তে লাগলো যাতে ওখানেই সেটি গলে যায় । এবারেও এত পরিশ্রম বিফলে গেল । মূর্তি যথাস্থানে বিরাজিত রইলো । ভয় আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে তারা সে স্থান ত্যাগ করলো । যে ভাবেই আবার অমাবস্যা উপস্থিত হলো । গ্রামে ভয়ের সঞ্চার হলো , আবার থমথমে চার দিক , বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ । কবি ঘোষ এটা বুঝে গেছিলো যে গ্রাম এখন অঘোরী র অভিশাপে অভিশপ্ত । তাই গ্রামের বাইরে বের হয়ে গেলে এই ভয়াল নাম না জানা দেবী তার কিছু করতে পারবে না । সে বিকাল বিকাল গ্রাম ছেড়ে স্টেশনে গিয়ে বসে থাকে । গ্রামে খবরটা রোটতে দেরি হয় না এবং কবি ঘোষের দেখা দেখি সবাই রাতটুকু র জন্য গ্রাম ত্যাগ করে স্টেশনে র উদ্দেশ্যে রওনা হয় । যারা গ্রামে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা অসুস্থ চলার ক্ষমতা নেই তারা সাহস সঞ্চয় করে গ্রামেই পরে থাকে । রাত আসে সাথে দেবী কাটভি ও আসে ধ্বংসলীলা শুরু হয় । তীব্র ঘূর্ণি ঝড় আর আতঙ্কের চিৎকার সারা গ্রামে ঘুরে বেড়ায় সারা রাত । ভোর বেলা সব শান্ত দেবী যথাস্থানে মৃন্ময়ী মূর্তি ধারণ করে স্তব্ধ হয়ে যান । গ্রামবাসী গ্রামে ফিরে আসে দেখে আগের বারের মতই  রক্তের হোলি খেলা হয়েছে সারা গ্রামের ঘরে ঘরে । 

তার পর ....


তৃতীয় অমাবস্যা তে গ্রাম সন্ধের আগেই পুরোপুরি খালি করে দেওয়া হয় । সবাই গ্রাম ছেড়ে স্টেশনে আশ্রয় নেয় আর কোনো ভাবে রাত টুকু পার করে গ্রামে ফেরে । মনে ভয় বাসা বেঁধেছিল যে দেবী এই রাতে একটিও বলি পাননি তাই নিশ্চই তিনি ক্রুদ্ধ । হয়তো দিনের বেলাতেও তিনি অপেক্ষমান গ্রামবাসীদের নিধনের জন্য । তবে গ্রামে ফিরে দেখা গেল আর এক ছবি । সারা গ্রামে একটাও পশুপাখি জীবিত নেই । কুকুর , বেড়াল , গাই বাছুর , খাঁচার তোতা পাখি , ছাগল , ভেড়া , মুরগি , হাঁস কিছুই জীবিত নেই সবকিছুকেই যেন খুবলে খেয়েছে কেউ । সারা গ্রামে তীব্র ৺আসটে গন্ধ শুকিয়ে যাওয়া রক্তের । দামদরের তীরে যেতে আর কেউ সাহস পেলো না । দূর থেকেই দেবীর অবস্থান দেখে তারা আরও একমাসের স্বস্তি লাভ করলো সব পশুর জীবনের বিনিময়ে । তান্ত্রিক , ওঝা সব করা হলো কেউ কিছু যখন করতে পারলো না , তখনই ঘটনার সূত্রপাত কিসে তা গ্রামবাসী উদ্ধার করলো । অমাবস্যা পার হওয়ার তিন দিন পর গ্রামে সব পশুর মৃত্যু হওয়ায় এক পওয়া দুধও অমিল । গ্রামের বাইরে থেকে দুধ , ডিম এসবের যোগান আনতে যেতে হলো সবাইকে । সেদিন মোহন বলে চাষী তার দু বছরের ছেলের জন্য গরুর দুধ আনতে পাশের গাঁয়ে গেছিলো । পাশের গাঁয়ের গোয়ালা হেনু তখনই চুপি চুপি মোহনকে বলে যে তাদের হেতডোবা তে যেই সংক্রান্তি র দিন দুই অঘোরী এসেছিল তার পরের অমাবস্যা থেকেই এই অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে । মোহন আকাশ থেকে পড়ে কারণ কোনো অঘোরী আসার কথা সে কেন কোনো গ্রামের লোকই জানে না । হেনুর কথা সে গা করে না , সে গ্রামে ফিরে আসে । কথায় কথায় সে এ কথাটি তার সাথে যারা কাজ করে তাদের বলে । ও ভাবেই যখন কথা ছড়ায় তখন সকলে হেনু কে গ্রামে ধরে নিয়ে আসে । সে জানায় সংক্রান্তি র দিন মোড়লের ঘরে দুধের জোগান দেয়ার কাজ ছিল তার । সেদিন যখন দুধ দিয়ে হেনু তার সাইকেল করে বাড়ি ফেরার পথে , তার সামনে এসে হাজির হয় দুই অঘোরী সাধু । তারা হেনুকে আশীর্বাদ করে আর এই গ্রামের মোড়লের বাড়ি কোথায় জানতে চায় । হেনু তাদের পথ দেখিয়ে দিলে তারা কবি ঘোষের বাড়ির অভিমুখে যাত্রা করে আর হেনুও বাড়ি ফিরে যায় । এর বেশি সে কিছু জানে না । সবাই হেনুকে নিয়ে মোড়ল কবি ঘোষের বাড়িতে যায় । সেদিন রাতে ঘটা ঘটনা এত কিছুর পরেও মোড়ল কাউকে কেনই বা বলে নি সবাই জানতে চায় । এত দিন মুখ বন্ধ করে রাখলেও আর কবি পারছিল না এ ধ্বংসলীলা সহ্য করতে । তাই সে সব খুলে বলে সেদিন অঘোরী দের অন্ন গ্রহণের অগ্রহ , কবির তাদের অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া , অঘোরী দের দেওয়া অভিশাপ সব কিছু । সব শুনে গ্রামবাসী রা ক্ষেপে ওঠে তারা কবি ঘোষকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় দামদরের তীরে অবস্থিত সেই দেবী মূর্তি টির কাছে । তারা মোড়ল কে সেখানেই একটা খুঁটির সাথে বেঁধে রেখে চলে আসে । কারণ অঘোরী রা বলেই গেছে মোড়ল পরিবর্তন হলে গ্রামে অভিশাপ ও শেষ হবে , সেই মত যদি কবি ঘোষকে একা পেয়ে রাতের অন্ধকারে ওই ভয়াল দেবী নিজের বলি হিসেবে গ্রহণ করেন তা হলে দেবীও তুষ্ট হবেন আর কবি ও মরবে । গ্রাম তার নতুন মোড়ল খুঁজে নেবে আর অভিশাপ ও শেষ হয়ে যাবে । রাত আরম্ভ হতেই সবার মনে হাতুড়ি পড়তে শুরু হলো । ভয়ে সবাই অস্থির , ছুঁচ পড়লেও শব্দ হবে এমন অবস্থা । এমন সময় এক তীব্র চিৎকার শোনা গেল ..... 


সে বিভীষিকাময় রাত পার করে যখন গ্রামের সকলে দামদরের পারে ছুটলো , সবার মনে একটাই প্রশ্ন মোড়ল কবি ঘোষের কি হলো ? তারা সেখানে গিয়ে দেখে এক অঘোরী সন্ন্যাসী দেবী মূর্তির পাশে বসে আছেন আর তার কোলে শায়িত মোড়ল । গ্রামবাসী দের দেখে অঘোরী হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন । সবাই প্রচন্ড ভয় পেলেও কেউ পালালো না । পঞ্চায়েত এর আর এক বৃদ্ধ সদস্য বাবুরাম সাপুই প্রণাম করলো অঘোরী কে তার পর বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করে " বাবা আপনি কে ? আপনার এখানে আগমনের হেতু কি ? বাবা এই পাপী টা কি এখনো বেঁচে আছে ! এর জন্য আমরা এই অজানা দেবীর রোষে পড়েছি বাবা , আপনি আমাদের পথ দেখান ।" একটানা এতগুলো কথা বলার পর বাবুরাম হাঁপাতে লাগলো । অঘোরী আবার হুঙ্কার ছেড়ে উঠলেন , তার পর তিনি বললেন ....

আমি বলিষ্ঠ ভুজঙ্গম , কামরূপে বাস করি । আমি আর আমার দাদা তেমু দুজনই অঘোরী তান্ত্রিক ছিলাম । ছিলাম কেন বলছি ভাবছো ? হা আমি এখনও এক অঘোরী তবে দাদা আর নেই । এই বলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন । তার পর নিজের ভেতরের কোনো একটা কষ্টকে গিলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন । আমি আর দাদা তেমু দুজনে যমজ ভাই ও আমার থেকে কিছু ক্ষনের বড় , জন্ম থেকেই আমরা দুজনে একসাথে বড় হয়েছি । সেবার আমরা দুজন সতী পিঠ দর্শন করতে বেরিয়ে ছিলাম , বৈশ্ন দেবী দর্শন করে চলে গেলাম অমর নাথ এর পথে । দাদা বললে চল বশিষ্ঠ তারা পিঠ , কালীঘাট দর্শন করি বঙ্গে যাই । মায়ের দর্শন করে আমরা ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিলাম এই গাঁয়ে । আমার কোলে পরে আছে এই অভাগা টার বাড়িতে রাতের অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম । হতভাগা আমাদের দূর করে দিলো , আর আমরাও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে গোটা গ্রামকে অভিশাপ দিয়ে ফেললাম । তার পর মোড়লের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে দেখলাম দামদরের পাড় । সেখানেই সারা রাত ধরে তৈরি করলাম এক প্রাচীন ভয়াল উপদেবী কাটভি র মূর্তি । নিজেদের ঝোলা থেকে পঞ্চ মুন্ডির আসন বের করে তন্ত্র র ছক এঁকে দামদরের পাড়ের মাটি দিয়ে তৈরি করলাম দেবী কাটভি র মূর্তি  । নিজেদের রক্ত দিয়ে আরও তন্ত্র উপাচার সমেত দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলাম । এ দেবী শুধু অমাবস্যা র রাতেই প্রকট হয়ে তান্ডব করবেন অন্য দিনগুলি শুধুমাত্র চিন্মই মূর্তি হয়ে থাকবেন । এক অঘোরী র জন্য এই ভয়াবীহতা , ক্রোধ একেবারেই অনুচিত কাজ । আমি আর আমার দাদা তেমু রাগের বশবর্তী হয়ে যা কিছু করেছি তা ঘোর অন্যায় । 

তার পর আমাদের জীবনেও শান্তি ফিরে আসেনি , সওম্ভু মহাদেব আমাদের ক্ষমা করেননি , সেদিন....



কাম , ক্রোধ , লোভ , ক্ষুধা , তৃষ্ণা এই সকল রিপুর তাড়না কে জয় করে তবেই অঘোরী র মতো সন্ন্যাসী হওয়া যায় । আমি বশিষ্ঠ আর দাদা তেমু দুজন আসামের ছেলে সেই এগারো বছর বয়সে আমরা ঘর ছাড়ি অনন্ত কে জানার আকাঙ্খা নিয়ে । সওম্ভু শিবের আরাধনা তে নিজেকে বিলীন করে দীর্ঘ সাতাশ বছর পর আমরা অঘোরী হই । তার পর বেশ চলছিল আমাদের সাধনার পথ । ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমরা নিজেদের শক্তি হারালাম । সেদিন এ গ্রামের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে যখন কামরূপ ফিরে যাই , তার পর দিন দিন আমরা উপলব্ধি করতে থাকলাম যে আমরা আমাদের সঞ্চিত শক্তি হারাচ্ছি । মা কামাখ্যা আর মহাকাল আমাদের প্রতি বিরূপ । এক দিন মধ্যে রাতে দাদা স্বপ্নে দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে উপদেবী কাটভি , তিনি ক্রুদ্ধ আর উত্তেজিত । তিনি স্বপ্নে জানান তিনি সমগ্র হেতডোবা গ্রাম উজাড় করে আমাদের প্রাণ নাস করবেন , কারণ তার ধ্যানমুদ্রা আমরা যেচে ভঙ্গ করেছি । ভীষণ ভয় পেয়ে দাদার ঘুম ভেঙে যায় আর তার পর এক রাতে দাদাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করি । দাদার মুখটা থেঁতলে গেছিলো , সারা শরীর নখে চেরা , পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছিল । উফফ কি ভয়ঙ্কর মৃত্যু দাদা পেলো । এত সব বলে অঘোরী কাঁদতে লাগলো । এমন সময় তার কোলে শুয়ে থাকা মোড়ল জ্ঞান ফিরে পেয়ে উন্মাদের মতো চিৎকার করতে শুরু করলো । সবাই ভয় পেয়ে অঘোরী কে জানতে চাইল কাল রাতে কি হয়েছিল ? রাতে সবাই এক অজানা স্বরের চিৎকার শুনতে পায় । সারা রাত এই দেবী মূর্তির কাছে বাঁধা  থাকা সত্ত্বেও কবি ঘোষ কি ভাবে বেঁচে আছে ? অঘোরী বা আবার কেন এসেছেন এ গ্রামে ? অনেক প্রশ্ন গ্রামবাসীদের মনে । উত্তর তো অঘোরীই জানে । 


মোড়ল কবি ঘোষ কিছুক্ষণ উন্মাদের মতো চেঁচামেচি করে আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে । সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে অঘোরী র জন্য । সে কেন ফিরে এসেছে ! কি হতে চলেছে পরবর্তী পদক্ষেপ এই অঘোরী র । কবি র বউটা পায়ে পরে গেল অঘোরী র , কাঁদতে কাঁদতে বললো " বাবা ও অন্যায় করে ফেলেছে জানি কিন্তু আপনি ওকে বাঁচান , ও যদি মরে যায় আমার ছেলেটা অনাথ হয়ে যাবে বাবা" । কবির বউয়ের কথা শুনে কেমন চক চক করে উঠলো অঘোরী র দুই চোখ । যেন দপ করে একবার জ্বলে ই নিভে গেল । তার পর দীপ্ত কণ্ঠে তিনি বলতে শুরু করলেন ------

আমি নিজের ভুল শোধরাতে ফিরে এসেছি । হয়ত বা নিজে বাচঁতেও । যেমনটা আমি আগেও বলেছি তোমাদের আমার দাদা তেমু স্বপ্ন দেখে ছিল এই বিরাজিতা উপদেবী কাটভি র । তার পর তার কি হয়েছিল তা তো সবার জানা  । দেবী নিজেই জানিয়েছেন তিনি রক্তের পিপাসু , তিনি শীঘ্রই এ গ্রামের প্রত্যেক ব্যাক্তি কে শেষ করে শেষে আমায় হত্যা করবেন । এখন তোমারা ভাবছ যে গ্রাম থেকে বেড়িয়ে গেলেই দেবী আর তাদের প্রতি প্রকোপ বর্ষণ করেন না কিন্তু তোমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল । দেবী যদি চান তোমারা যেখানেই থাকো না কেন সেখানে উপস্থিত হয়ে তোমাদের নিধন করবেন । আসলে উনি সময় নিচ্ছেন , ধীরে ধীরে মৃত্যুর তান্ডব কে জিয়ে রাখছেন আগামী কৌশিকী অমাবস্যা র জন্য । ওই দিন দেবীর শক্তি চরমে পৌঁছাবে আর নারী পুরুষ শিশু নির্বিচারে সকলকে এক সারি দিয়ে তিনি হত্যা করে নিজের বলি নিজেই গ্রহণ করবেন । এই বলে অঘোরী চুপ করে গেলেন । আগামী বিভীষিকার কথা ভেবে সবাই শিউরে উঠলো । তখন গ্রামের বৃদ্ধ ব্যক্তিরা করজোড়ে আবেদন করতে লাগলো অঘোরী র কাছে যাতে তিনি এদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করে । 

অঘোরী বললেন বিসর্জন দিতে হবে এই মূর্তিকে তবে জলে না রক্তে । পারবে দিতে ? 



বাবুরাম সাপুই পঞ্চায়েতের বৃদ্ধ সদ্যস্য , সে অঘোরীর রক্ত বিসর্জন এর কথা শুনে বললো " এ এমন কি কথা বাবা ! আপনি হুকুম করলে গাঁয়ের বাইরে থেকে আমরা হাজার একটা পাঠা কিনে আনবো , বলি দিয়ে সেই রক্তে রঞ্জিত করে দেবেন এই উপদেবীর মূর্তি" । হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন অঘোরী বশিষ্ঠ । বললেন অতই সোজা রে বুড়ো ? সাড়া গ্রাম কটা মুন্ডু আছে তা  গুনে রেখেছে কাটভি । তুই কি ওকে মূর্খ পেয়েছিস যে মানুষের রুধীর বদলে হাজারটা পাঠার রক্তে দেবীকে রঞ্জিত করে মুক্তি পাবি ? তিব্র অট্টহাসিতে আবার অঘোরী ফেটে পড়লেন । এমন সময় কবির বউ বলে উঠলো বাবা আপনিই তো বলে গেছিলেন মোড়ল বদলে গেল অভিশাপ ও শেষ হয়ে যাবে , তো সেই মতো আমার স্বামীর বদলে অন্য কাউকে মোড়ল নির্বাচন করে নিলে তো হয় তাই না ! আর আমার স্বামী যে ভাবেই হোকনা কেন কাল সারা রাত এখানে কাটানোর জন্য বা অন্য কিছু প্রচন্ড ভয়ে ও তো পাগল হয়েই গেছে । ও নিজের কর্মের শাস্তি পেয়ে গেছে , এবার আপনি আমাদের মাফ করবেন না বাবা ? এত অবধি বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলো কবির বউ । সবার মন এবার নরম হলো কবির প্রতি তারও মিনতি করতে লাগলো অঘোরী র কাছে । 

অঘোরী বললো ঠিক রে মা আমি বলেছিলাম মোড়ল বদলালে অভিশাপ ও শেষ হবে কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই । উপদেবী কাটভি কে প্রতিষ্ঠা করার আগে আমরা ওই কথা বলি কিন্তু রাগের মাথায় পথে আসতে আসতে আমরা যে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করি তাতে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে সব কিছুই বেরিয়ে যায় । না হলে আমার দাদা তেমুকে মরতে হতো ? 

যদি আমরা মূর্তি প্রতিষ্ঠা না করতাম তা হলে কথামতো মোড়ল বদলে তোমরা অভিশাপ মুক্ত হতে পারতে । এই দেবীকে তন্ত্রচার রে প্রতিষ্ঠা করা মানে বিপদ ডেকে আনা । একে পুনরায় যোগমুদ্রাতে পাঠাতে হলে তিন মানব কে বলি দিয়ে তাদের রক্ত দিয়ে দেবীর মূর্তিকে স্নান করাতে হবে ।  তার পর বলি দেওয়া শরীর গুলি দিয়ে হোম করতে হবে । আর নর মুন্ড গুলো দিয়ে দেবীর কোমর বন্ধনী বানিয়ে দিতে হবে । 



সেদিনের শাপমুক্তি র উপায় শুনে আর এক মুহূর্ত সেখানে কেউ দাঁড়ায় না । সকলে হতাশা , ক্ষোভ প্রকাশ করে ফিরে আসে সঙ্গে নিয়ে আসে কবি ঘোষকে । ওর প্রতি সবার দয়া হয় , ওকে আর ওই ভয়ঙ্কর স্থানে কেউ রেখে আসে না । সেদিনই নতুন মোড়ল নিয়োগ করা হয় হারান মন্ডল কে , যে এতদিন পঞ্চায়েত এর সদস্য ছিল । নিজেদের ক্ষমতার মধ্যে যা যা ছিল সব করেও গ্রামবাসী রা নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না কারণ এর সাত দিন পর কৌশিকি অমাবস্যা । কি হতে পারে ? সত্যি কি অঘোরী র দেওয়া উপায় ছাড়া আর কিছু নেই যা এই নিরীহ মানুষ গুলোকে বাঁচাতে পারে ? কি হতে চলেছে ? এই চিন্তায় গ্রাম যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে । আর ছয় দিন বাকি , অঘোরী গ্রামবাসী দের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে নদের তীরে । একটা করে দিন কমছে আর উৎকন্ঠা বাড়ছে । গ্রামের বাসিন্দা রা সিদ্ধান্তে সম্মতি দিলে অঘোরী এদের মধ্যে থেকেই বেছে নেবে তিন বলি । যাদের বাছা হবে তারা বাধ্য নিজেদের জীবন দান করতে । কারণ এরা জীবন বলি না দিলেও এদের মরতেই হবে কৌশিকি অমাবস্যা র দিন আর সাথে সব গ্রামবাসীদের । ছয় দিনের দিন হঠাৎ করে গ্রামের যত মন্দির ছিল সব মন্দিরের দরজা আপনি বন্ধ হয়ে গেল হাজার চেষ্টা করেও দেবলয়ের দার খোলা গেল না । মানুষের শেষ আসা ঈশ্বর ও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে যেন । এমন সময় গ্রামে ঢুকতে দেখা গেল এক বৃদ্ধ , সৌমকান্তি চেহারা ঋজু দেহতে ধারিত উপবিত , মুখে স্মিত হাসি যেন লেগেই আছে । অজানা ব্যাক্তিকে দেখে সবাই কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে । ব্যাক্তি নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন ওনার নাম কাত্যায়ন সর্বজ্ঞ মহারাজ , কেদারনাথ থেকে এসেছেন । কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই উনি বলতে শুরু করলেন ,

আমি সওম্ভু দেবাধিদেব মহাদেবের এক তুচ্ছ সেবাইত ভক্ত কাত্যায়ন সর্বজ্ঞ । আমার বাস কামরূপে তবে বর্তমানে আমি কেদারনাথে বাস করছি । সেখান থেকেই আসছি এই হেতডোবা গ্রামে । বাবা মার আদেশ পালন করতে এসেছি আমি । এই গ্রামে যে ক্রুর খেলা শুরু হয়েছে তা বন্ধ করার জন্য এসেছি । 

কাত্যায়ন সর্বজ্ঞ মহারাজ এর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছিলো না গ্রামের বাসিন্দারা । পাঁচু গোপাল বলে এক ব্যক্তি বললো বাবা মার আদেশ মানে কাদের কথা বলছেন আপনি ? গ্রামে কি হচ্ছে আপনি কি করে জানলেন ? আর আপনি বৃদ্ধ মানুষ এই উপদেবীর সাথে অঘোরী লড়তে পারছেন না আপনি লড়বেন ? 

কোনো রাগ নেই অহংকার নেই ,সেই স্মিত হাসি মুখে রেখে আবার বলতে শুরু করলেন :::::

তোমাদের ভয় , সরল বিশ্বাস কে কাজে লাগিয়ে তোমাদের ঠকানো হচ্ছে । আরও বেশি বিপদ তোমাদের সামনে তাতে তোমরা অঘোরী র কোথায় সম্মত হও বা না হও । অঘোরী তোমাদের না নিজেকে বাঁচাতে তোমাদের বলি দিচ্ছে । ত্যাগ স্বীকার করেও তোমরা দেবী কাটভি কে বিসর্জন দিতে পারবে না । বশিষ্ঠ নিজে ওর ভাইয়ের হত্যা করেছে তার পর এখানে এসেছে তোমাদের ধ্বংস করার জন্য । 

দুই দিকে দুরকম কথার দ্বিধা ছলে গ্রামবাসীরা বৃদ্ধ র থেকে ক্ষমতাবান অঘোরী র উপর বিশ্বাস রাখাই শ্রেয় মনে করল । 

অঘোরী কে নির্বাচন করা বা তার উপর নির্ভরশীল করাটা শ্রেয় বলে মনে হলো হেতডোবার বাসিন্দাদের । তারা আর সময় নষ্ট না করে দামদরের পারে গিয়ে উপস্থিত হলো । অঘোরী তখন উপদেবী কাটভি র আরাধনায় রত । সকলে মিলে তাকে এটাই জানাতে গেছিলো যে অঘোরী র কথায় তারা রাজি , তারা গ্রামকে বাঁচাতে সহযোগিতা করবে । কিন্তু নতুন মোড়ল হারান মন্ডল দূর থেকে অঘোরী র কার্যকলাপ দেখে সবাইকে সেখানেই দাঁড়িয়ে যেতে বলে । সকলে জানতো হারান বিচক্ষণ মানুষ তাই কেউ কোনো প্রশ্ন না করে হারানের সাথে ফিরে আসে । হাটতলাতে সবাইকে জড়ো করে হারান বলে " আমাদের আর একবার ভেবে দেখা দরকার , আমরা কি নিশ্চিত যে অঘোরী আমাদের বাঁচবে ? শাস্ত্র সমন্ধে বহুল জ্ঞান না থাকলেও এটুকু আমরা সবাই জানি অঘোরী মানে উঁচু দরের সন্ন্যাসী । তারা দশমহাবিদ্যা মহা কালী আর মহাকালের ভক্ত । তারা কখনো অন্য কোনো দেবদেবীর পুজো করেন না । তা হলে আজ আমরা কি দেখলাম ! এক অঘোরী উপদেবীর পুজোয় রত , যেই দেবী কি না ওনার প্রানের পিপাসী  ? কোথাও একটা কিছু গোপন তথ্য নিশ্চিত আছে যা আমরা জানি না । " 

এত অবধি বলে মোড়ল চুপ করে গ্রামবাসীদের মতামতের অপেক্ষায় রইল । তা করতে করতেই আগের মোড়ল কবি ঘোষের বউ উন্মাদের মতো ছুটে আসে আর ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায় । সবাই তাকে উঠিয়ে সামনের চণ্ডী মণ্ডপে বাসায় আর জল খাওয়ায় । একটু ধাতস্থ হয়ে সে বলে " সব শেষ হয়ে যাবে , কিছু থাকবে না আর , আমার সব শেষ হয়ে গেল গো ।" এই বলে সারা শরীরে ভয় , যন্ত্রণা নিয়ে সে ফোঁপাতে লাগলো । সবাই মিলে তাকে জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে ? কিন্তু কবির বউ কিছুই বলে উঠতে পারে না শুধুই কষ্ট ফোঁপাতে থাকে । এমন সময় সেখানে হাজির হন সেই বৃদ্ধ কাত্যায়ন মহারাজ । উনি ভিড় ঠেলে এগিয়ে যান কবির বউয়ের দিকে । নরম স্বরে ধীরে ধীরে উনি জিজ্ঞাসা করলেন বৌটাকে " মারে তোর সর্বনাশ যা হবার তা হয়েই গেছে কিন্তু মা তুই যদি এখন কি হয়েছে তা এই মানুষগুলোর সামনে না বলিস তা হলে যে মা আরও সর্বনাশ হয়ে যাবে "।

প্রচন্ড ভয় কষ্টে দুমড়ে যাওয়া মানুষটা একটা স্নেহের পরশ পেয়ে মুখ তোলে আস্তে আস্তে সব খুলে বলে । কবির বউয়ের মুখে সব শুনে সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে যায় । সে যা বলে তা তার ভাষায় প্রকাশ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো ....



সেদিনের পর আমার স্বামী টা তো পাগল হয়ে গেছে । সারা দিন প্রলাপ বকে , তো তাই নিয়েই অপেক্ষা করছিলাম যে কি হয় আগামীদিনে । তার পর কাল রাতে আমি আমার ছেলে পকু আর আমার লোকটা শুয়ে ছিলাম । তখন রাত তিনটে দেখি ফিস ফিস করে শব্দ । ভাবলাম যে মানুষটার মাথার ঠিক নেই তাই হয়তো ঘুম ভেঙ্গে গেছে বকবক করছে আপন মনে । কিন্তু সেটা আমার ভুল ছিল । একটু পড়ে সব চুপচাপ দেখি পাশে কেউ নেই না পকু না লোকটা । বাইরে গিয়ে দেখি দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে আমার স্বামী কোলে ঘুমন্ত পকু , ছুটে গেলাম ওদের আটকাতে কিছুটা গিয়ে যা সামনে দেখলাম তাতে আমি ভয়ে কিছুক্ষণ নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলি । স্বামী পকুকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর ওনার আগে আগে চলছে ওই দামদরের পাড়ে র ভয়াল দেবী জ্যান্ত । ওহ কি ভয়ানক চারটে হাত , কালো অন্ধকার রং , জটা জটা চুলের ঢাল মাথায় মুণ্ডুহীন , নিজের মুন্ডটা নিজের হাতে । তীব্র ৺আসটে গন্ধ চার দিকে । কিছুক্ষণ জ্ঞান হারালে , তার পর হুঁশ ফিরে এলে আমি দেখি সামনে কেউ নেই । ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেলাম নদের পারে । ওখানে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার ভয় ও যেন শেষ হয়ে গেল , সব হারানোর দোরগোড়ায় পৌঁছে আমি দেখলাম ,পুকুর মাথাটা চেপে ধরে আছে হাঁড়িকাঠে ওর বাপ ও মা মা বলে চিৎকার করে যাচ্ছে । আর অঘোরী একটা বড়ো চন্দ্রহাস খাড়া ওর উপরে তুলে কি সব বির বির করে বলে চলেছে । হোমাগ্নি প্রজ্বলিত , সামনে দাঁড়িয়ে আছে জ্যান্ত ভয়াল দেবী । জিভ তার রক্তের জন্য লক লক করছে , মুখে কুটিল হাসি । আমি চিৎকার করে উঠলাম অঘোরী আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও । আমার দিকে মুখ ঘুরলো অঘোরী , তিব্র রাগে চিৎকার করে বললো " ফিরে যা । তোর ছেলে মায়ের ভোগ হবে  । মা অপেক্ষা করছে । যা পালা । " আমি বললাম ছেড়ে দে ওকে আমাদের গ্রামবাসী কে প্রথমে তুই অভিশাপ দিলি এত লোকের প্রাণ গেল , তবু তোকে বিশ্বাস করলাম আমরা । আর তুই অঘোরী হয়ে এই বেইমানি করলি । এ সব বলতে বলতে খেয়াল করি নি ওই ভয়াল দেবীর একটা হাত লম্বা হয়ে এগিয়ে এসেছে আমার দিকে । নিমেষে অজগর সাপের মত আমাকে জড়িয়ে ধরে শুন্যে তুলে ধরলো । তাতেও আমি দমে যাই নি আমি ছটপট করতে করতে পুকুর বাপের হুঁশ ফেরাতে চেষ্টা করলাম ওকে বার বার বললাম , ও তোমার একটা বেটা পুকু গো , তুমি ওকে বাঁচাও ওকে মরতে দিও না । কিন্তু ও যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না । তার পর চোখের সামনে ওই খাঁড়ার কোপ পড়লো পুকুর ওপর । রক্তে ভরে গেল চারদিক , এত বড় জিভ বার করা , চোখ দুটো খোলা পুকুর মাথাটা গড়াগড়ি খেতে লাগলো মাটিতে । ওর ছোট্ট শরীর টা ছটপট করতে করতে থেমে গেলো । তার পর আমিও জ্ঞান হারাতে হারাতে অনুভব করলাম ওই লম্বা হাত আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো নদের দিকে । আজ এই একটু আগে আমি জ্ঞান ফিরে নিজেকে ওই বালুর পারে পাই । তার পর কোথাও না গিয়ে ছুটে আসি গ্রামে  । এই অবধি বলে বউটা আমার কাঁদতে শুরু করে । তার পর .....



তার পর গ্রামের জোয়ান ছেলে গুলো রাগে অন্ধ হয়ে চললো অঘোরী র কাছে তার সাথে এই নৃশংসতা র জবাব চাইতে । ওদের পথ আটকে দাঁড়ালো কবির বউটা , ওদের অপেক্ষা করতে বললো । সবাই দেরিতে হলেও বুঝলো বৃদ্ধ কাত্যাওন মহারাজ ই পারে তাদের বাঁচাতে । উনি বললেন রাতের বেলা কিছু জোয়ান ছেলের দল নিয়ে তিনি একবার নদের ওদিকে ঘুরে আসবেন আর অঘোরী র অবস্থান ও দেখে আসবেন । তার আগে এগুলো কি কেন হচ্ছে কি জন্য হচ্ছে তা জানা দরকার সবার তাই উনি মন দিয়ে ওনার সমস্ত বিবরণের কথা সকল গ্রামবাসীদের শুনতে বললেন । উনি শুরু বলতে করলেন ক্রুর অঘোরী বশিষ্ঠ র বিষয়ে :

বশিষ্ঠ আর তেমু বড় মাপের অঘোরী তারা যমজ ভাই । তবে ভোলা সওম্ভু মহাদেব যেন আর এক ভোলা তেমুর উপর বেশি সদয় হয়ে ছিলেন । সে তাই আধ্যাত্মিক বিষয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী ছিল ভাই বশিষ্ঠ র থেকে । সেদিন এ গ্রামে এসে  ক্ষনিকের ক্রোধ ওদের দিয়ে বড় অন্যায়ের জন্ম দেয় । ওরা অভিশাপ দিয়ে ফেলে , মুখের কথা আর ধনুক থেকে বেরোনো তীর ফেরানো যায় না । তবু অভিশাপ দিয়ে ফেলেই নিজের কর্মে অনুতাপ হয় তেমুর তাই সে এ ও বলে যায় মোড়ল কবি কে যে মোড়ল যদি পরিবর্তন করা হয় অভিশাপ শেষ হবে । পরে নিজের আসন হারানোর ভয়ে কবি তা লুকাতে চেয়ে গ্রামের ক্ষতি ডেকে আসে তাও সত্যি । কিন্তু যদি কাটভি র মূর্তি স্থাপন না হতো তা হলে হয়তো অভিশাপের ফলে প্রতি অমাবস্যা তে না না বিপদ আসতো গ্রামে প্রাণ হানিও হতে পারতো কিন্তু একসাথে এত বিভীষিকা , তা হতো না । সেদিন ওই কাণ্ডের ফলে অনুতপ্ত তেমু যখন দামদরের পার হয়ে ফিরছিল সাথে ভাই বশিষ্ঠ ছিল । বশিষ্ঠ তখন অন্য ফন্দি আটছিলো বরাবর সে জানতো একসাথে জন্ম , একসাথে বেড়ে ওঠা , একসাথে তপস্যা করলেও দাদা বরাবরই উন্নত তার সাথে , সে দাদাকে টপকাতে পারবে না । সব এক তবু গুণমানে র তারতম্য তাকে ক্ষনিকের জন্য হলেও অস্থির করে তুলেছিল আর এক গ্রামের অভিশাপ কে ঘিরে সে নিজের আখের গোছানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠে । আচমকা হামলা করে দাদা তেমুকে সে বেঁধে ফেলে , আর দামোদর এর চড়ে তৈরি করে উপদেবী র মূর্তি সাথে তন্ত্রের সমস্ত সরঞ্জাম তো ছিলই । পঞ্চমুন্ডির আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে দেবীর আরাধনা শুরু করে সে । দাদা তেমু তাকে বার বার বারণ করে সে বুঝে গেছিলো ভাই কি চায় । সে সাবধান করে যদি দেবী জেগে ওঠে সর্বনাশ হয়ে যাবে , দেবীকে রক্তের জোগান দিতে অজস্র মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত , যোগমুদ্রা ভঙ্গ হলে ফের যোগমুদ্রাতে পাঠাতে প্রচুর নর বলি দিতে হবে । কিন্তু শয়তান একবার মনে ঠাঁই পেলে তাকে হটানো অত সোজা না । সব জেনে শুধু শক্তি অর্জনের জন্য বশিষ্ঠ উপদেবী র প্রতিষ্ঠা করে আর প্রথম বলি প্রদান করে তার সহধর তেমুর । তেমু উচ্চ বংশের সন্তান , মহা অঘোরী তাই তার বলি পেয়ে কাটভি সহজেই জেগে ওঠে আর বশিষ্ঠ তার প্রিয় পাত্র হয়ে যায় । দেবীকে নিজের ভাইয়ের বলি প্রদান করে সে দাদার শরীরটা দেবীর পায়ের তলায় পুঁতে দেয় প্রমান লোপ করতে । তার পর তন্ত্রচার করে সারা গ্রামকে দেবীর ভোগ বানিয়ে সে ফিরে যায় কামরূপ সাথে নিয়ে যায় কাটভি র দেওয়া অনেক শক্তি । কামরূপ পৌঁছে সে সবাইকে এটাই জানায় তেমু অঘোরী আর নেই সে কোনো বঙ্গের নারীতে মজে সংসারী হয়ে যায় । উচ্চ মার্গের অঘোরী হয়ে সংসার এক ওছা কাজ বলে মনে করে অঘোরী সম্প্রদায় তাই বশিষ্ঠ র কথা শুনে তেমুকে সকলে ভুলে যেতে চায় । কেউ তার খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করে না । এত সবের মধ্যেও একটা কাজ নিজের অজান্তেই ভালো করে গেছিলো বশিষ্ঠ তা হলো তেমুর শরীর টা সে কাটভি র বেদির তলায় পুঁতে রেখেছিল । তাইতো মরে গিয়েও সে এই গ্রামকে রক্ষা করছে তার ভাইয়ের কৃতকর্মের ফল এই ভয়াল দেবীর হাত থেকে ...

বৃদ্ধ বলতে শুরু করলেন :

মৃত্যুর পূর্বে তেমু এক বড় মাপের ক্ষমতাশীল অঘোরী সন্ন্যাসী ছিল । সে তার সাথে এক ভালো মানুষও ছিল । ক্ষনিকের জন্য ধৈর্য হারিয়ে , ক্রোধের বসে সে একটা অন্যায় করে ফেলে । ভুল শোধরাতে সে পারতো কিন্তু সে সুযোগ তাকে ভাই বশিষ্ঠ দেয়নি । তবে অপঘাতে মৃত্যু ও সৎকাজ না হওয়ায় তেমু মরেও সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায় নি । বশিষ্ঠ হেতডোবা গ্রামকে বিপদের মুখে ফেলে ফিরে যায় । আর তেমুর প্রেত তার শক্তি দিয়ে রুখে রাখে উপদেবী কাটভি কে কিন্তু অমাবস্যাতে শক্তির চরম সীমাতে পৌঁছনো কাটভি কে রোখার ক্ষমতা তেমুর ছিল না । তাই শুধু অমাবস্যা ছাড়া উপদেবী খুনের হোলি অন্যদিন খেলতে পারেনি । আর তেমুর অভিশাপ গ্রামে র জন্য আশীর্বাদ হয়ে ওঠে কাটভি গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তার বাইরে গিয়ে কাউকে হত্যা করতে পারে না । আর এই সুযোগে গ্রামের লোক রাতে গ্রামের বাইরে গিয়ে বেঁচে যায় প্রতিবার । তবে এতে উপদেবী ক্ষুদ্ধ হন বশিষ্ঠ র উপর । বশিষ্ঠ কাটভি র কাছে গোটা গ্রামকে নৈবেদ্য দিয়েছিল আর কাটভি কিছুতেই সেই নৈবেদ্য উপভোগ করতে পারছিল না । তখন বশিষ্ঠ কে স্বপ্নাদেশ দেয় কাটভি যদি সে আগামী কৌশিকি অমাবস্যা তে বলির ব্যবস্থা না করে তা হলে বশিষ্ঠ কেই বলি হিসাবে গ্রহণ করবেন । কুটিল বশিষ্ঠ খুব ভালো করেই জানত কথা মতো কাজ না হলে কি হতে পারে তাই জান বাঁচাতে সে এই গ্রামে রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করে । সেদিন রাগে সকলে কবিকে বেঁধে এসেছিল নদের চড়ে আর ভয়ে সে বসে ছিল মৃত্যুর অপেক্ষায় । ওখানে পৌঁছে বশিষ্ঠ কবিকে পায় আর নিজের পরিকল্পনা কে বাস্তবায়ন করার মাধ্যম পেয়ে যায় । ওকে গলা টিপে হত্যা করে ওর প্রেতকে তন্ত্রের মাধ্যমে ওর শরীরের মধ্যেই রেখে দেয় । আর সকালে ভাল সেজে গ্রামবাসীর হাতে ওকে তুলে দেয় । যখন কবির বউ অঘোরী কে বলে তার ছেলের কথা তখনই প্রেত রূপী কবিকে ইশারায় জানিয়ে দেয় কি করতে হবে তাকে । গ্রামে ফিরে সেই রাতেই কবি র প্রেত অঘোরী র আদেশ মত নিজের ছেলেকে নিয়ে গিয়ে সপে দেয় , তাকে বলি দিয়ে দেয় অঘোরী কাটভি র পায়ে । কাটভি যখন ওই ছোট্ট শিশুর রক্ত অস্থি মজ্জা খেয়ে শেষ করে তার পর প্রেত হয়ে যাওয়া কবির পচন ধরে আসা শরীরটাকে ও ভক্ষণ করে নেয় । এত অবধি বলে কাত্যাযন মহারাজ চুপ করে যায় । এবার তা হলে কি করতে হবে আমাদের বাবা মোড়ল হারান মন্ডল বলে ওঠে । বৃদ্ধ বলে "কাল আমার কথা বিশ্বাস করলে কবির ছেলে টা মরত না আর তন্ত্রচার করে টাটকা বলি পেয়ে কাটভি র শক্তি ও বাড়ত না তবে কিছু তো উপায় আছে , আমি আজ রাতেই যজ্ঞে র আগুন জ্বালাবো এ গ্রামে । আসলে উপদেবী র সাথে সরাসরি লড়াই অঘোরী পর্যন্ত করতে পারে না সধারণ মানুষ তো দূরে থাক । এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে আমাদের জাগ্রত করতে হবে মা চণ্ডী কে , ঈশ্বরই পারেন এখন রক্ষা করতে " ।

কৌশিকি অমাবস্যা আসতে পাঁচ দিন , অঘোরী যদিও বুঝে গেছে তার চালে ভুল হয়ে গেছে কবির বউ মরে নি সে গ্রামে গিয়ে সব বলে দিয়েছে । তবু সে জানে পাসার দান চালা হয়ে গেছে তার গ্রামবাসী ওকে ভরসা করুক না করুক আর পাঁচদিন পর সবাই মরবে আর উপদেবী কাটভি তাকে প্রভূত শক্তি দান করে পুনরায় যোগমুদ্রাতে চলে যাবে । এতে অঘোরী র প্রাণ ও বেঁচে যাবে আর শক্তিও মিলবে  । 


সন্ধ্যে হলো অমাবস্যা আসতে চার দিন মাত্র বাকি , সারা গ্রাম শুদ্ধ বস্ত্রে বৃদ্ধ কাত্যায়নএর পাশে বসে ,  তিলের তেলে প্রদীপ জেলে উনি বসে বসে গঙ্গা মাটি দিয়ে দেবী চন্ডীর মূর্তি বানাচ্ছেন । সঙ্গে উচ্চারণ করে যাচ্ছেন গায়েত্রী মন্ত্র । বাতাসে আবার ভারী হচ্চে মৃত্যুর গন্ধ । অঘোরী নদের চড়েই বসে সব বুঝতে পারছে । তবে সে এই যুদ্ধ সে প্রায় জিতে বসে আছে তো ভয়ের কোনো কারণ নেই । রাতেই মূর্তি বানানোর কাজ শেষ হয়ে গেল । সারা গ্রামের মন্দিরের কপাট গুলো নিজেথেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাই গ্রাম এত ক্ষণ দেবতা হীন হয়ে ছিল । মুর্তিটুকু গড়ে ওঠা তে সকলে আশায় বুক বাঁধলো । বৃদ্ধ কাত্যাযন বললেন পদব্রজে সতেরো কিমি দূরে অবস্থিত গঙ্গা নদী থেকে দেবী চন্ডীর ঘট আনতে যেতে হবে । কালই বেরোতে হবে আমাদের আর কৌশিকি অমাবস্যা লাগার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘট এই চণ্ডী মণ্ডপে এসে ঘটের প্রতিষ্ঠা করতেও হবে । মাথায় করে ঘট আনবে গ্রামের মোড়ল হারান মন্ডল । হারান সে কথা শুনে বলে সে জাতিতে শুদ্র  কি করে মায়ের ঘট সে আনবে ? বৃদ্ধ হেসে বলেন তোমার চণ্ডী মায়ের সন্তান তুমি হলেই বা অব্রাহ্মণ তাছাড়া এই গ্রামের মোড়ল মানে পিতা সম তুমি । তোমার মা ভক্তি চায় , সন্তানের ভালোবাসা চায় আর কিছু দাবি ওই হিমালয় এর বেটির নেই রে পাগল ! মূর্তি কে ঘিরে কিছু ছেলে পাহাড়া দিতে লাগলো সারা রাত । এদিকে অঘোরী দামদরের চড়ে মহা যজ্ঞ করে চলেছে । মুরগি , পেঁচা , শিয়াল বলি দিয়ে তাদের মাথা হোমের আগুনে সমর্পণ করছে । ওম হিং ক্রি৲° ভট স্বাহা , নমামী নমঃ স্বাহা ...

পাপের চরম সীমায় অঘোরী ।

মোড়ল বৃদ্ধকে আবার  জিজ্ঞাসা করলো বাবা আমাদের গ্রামেই বয়ে চলেছে দামোদর নদ তো আমরা গঙ্গা পর্যন্ত কেনই বা যাচ্ছি ? আর আপনি মা চন্ডিকে মা না সম্বোধন করে হিমালয়ের বিটি বললেন কেন ?

বৃদ্ধ হাসেন , বলেন : কোবার্নের মতে, চণ্ডিকা হলেন ভয়ংকরী ও ক্রোধন্মত্তা দেবী।  তুই জানিস না হারু চণ্ডী হিমালয় কন্যা পার্বতী র দশমহাবিদ্যার এক উগ্র রূপ । আর দামোদর থেকে আমরা ঘট প্রতিষ্ঠান করবো না কারণ এটি একটি নদ , দেবীর ঘট নদীর জলে ই প্রতিষ্ঠান হয় আর যেখানে কাছে গঙ্গা আছে তো আমরা গঙ্গা জলেই ঘট প্রতিষ্ঠান করব । দামদরের মাটিতে তৈরি করা হয়েছে উপদেবী কাটভি র মূর্তি  দামদরের উপর তার আধিপত্য এখন চরমে তাই দামদরের মাটি বা জল কিছুই ব্যবহার করা মানে কাটভি কে পুজো পন্ড করার  সুযোগ দেওয়া । বৃদ্ধ আরও বলেন শনিবার সন্ধ্যে সাতটা বেজে তিন মিনিটের মধ্যেই অমাবস্যা লাগবে তার আগেই আমাদের পৌঁছে যেতে হবে গঙ্গা জলে পূর্ণ ঘট নিয়ে সাথে থাকবে এগারো টি ঢাক , কাসর । শঙ্খ আর উলু দেবে গ্রামের মেয়েরা । অমাবস্যা লাগার সাথে সাথেই উপদেবী এসে উপস্থিত হবে তবে আমাদের ভয় পেলে চলবে না আমরা আমাদের কাজ করে যাব । দেবী র সামনে উপদেবী র ক্ষমতা হবে না কারও ক্ষতি করার । তবে অঘোরী আর কাটভি এর একমাত্র চেষ্টা হবে পুজোতে বাধা দেওয়া । আমরা দেবীকে জাগ্রত না করতে পারলে ওরা জিতে যাবে নিমেষে সকলে উপদেবীর বলি হয়ে যাবে । সবাই তৈরি হয়ে গেছে এইবার লড়াই নিরীহ গ্রামবাসী বনাম পথভ্রষ্ট অঘোরীর । 

শনিবার সকাল সকাল বৃদ্ধ কাত্যাযন , মোড়ল হারান মন্ডল , বাবুরাম সাপুই , গ্রামের পুরোহিত কৃষ্ণ গোস্বামী সাথে কিছু ছেলের দল চলে গেল ঘট আনতে । এদিকে গ্রামে র মেয়ে রা পূজোর জোগারে লেগে গেলো । চার দিকে সাজো সাজো রব । দুপুরে হাজির হলো অঘোরী বিশিষ্ঠ , হুংকার ছেড়ে উঠলো সে । বলল যারা আর চার প্রহরের মধ্যে মরবে তাদের এত সাহস আসে কি করে যে তারা অঘোরী র পায়ে না পড়ে এই উগ্র চন্ডীর পুজোর জোগারে ব্যস্ত ? ছেলে স্বামী মরাতে শোকাতুর তথা অশৌচ এর কারণে জোগারে যোগদান না করা কবির বউ পদ্ম তেড়ে আসে অঘোরী র দিকে তার দিকে থুতু ছিটিয়ে বলে " যে মায়ের সধনা করে অঘোরী হয়েছিস তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিস বশিষ্ঠ ঠাকুর , তুই মরবি এবার তুই মরবি , তোর মরণ পাখা গজিয়ে গেছে আমি দেখতে পারছি । তোকে বাঁচবে তোর নতুন আরাধ্যা কাটভি !" 

প্রচন্ড রাগে উন্মাদ হয়ে ওঠে অঘোরী সে বলে " তুই নীচ আমাকে শেখাবি ! আমি সমস্ত সাধনা করেছি তবে কাম সাধনা এখনো করিনি কারণ আমি এতদিন কামাখ্যা মার অঘোরী ছিলাম । কিন্তু এখন আমি মুক্ত আমার সাধনার পথ প্রসস্থ করতে আজ আমি অমাবস্যা পড়ার আগে এই চতুর্দশী চলাকালীন কাম সাধনা করবো আর আমার সাধনার মাধ্যম হবি তুই পদ্ম "। এই বলেই পদ্মকে তুলে নদের দিকে এগোতে যায় অঘোরী , ছেলেরা কবির বউ টাকে বাঁচাতে এলে অপহত পদ্ম নিজে তাদের বাধা দেয় বলে তার জীবনে আর কিছুই নেই তাই মরতে হলে মরবে তবে কেউ যেন অঘোরীকে এই শেষ পাপটা করতে বাধা না দেয় । নদের চরে পদ্মকে নিয়ে গিয়ে অঘোরী তাকে ধর্ষণ করে , নিজের ব্রহ্মচারীত্ব কে সে অহংকারের বসে শেষ করে দেয় । এর আগে সে কোনো দিন কোনো নারীতে গমন করেনি । ধর্ষিত পদ্মর সাথে পশুর মতো তিন বার মিলিত হয় সে । অত্যাচার এর সীমা অতিক্রম করলে পদ্ম র মৃত্যু হয় । তার পর তার শবের সাথে শব রতিক্রিয়া করে অঘোরী । শেষে পদ্ম র শরীরে র উপর বসে শব সাধনা করতে থাকে  । 

সময় : সাড়ে ছটা 

ঘট নিয়ে গ্রামের মুখে এসে হাজির হয় দলটা কিন্তু প্রবল এক ঘূর্ণি পাক খাচ্ছে গ্রাম ঢোকার মুখে । কিছুতেই প্রবেশ করা যাচ্ছে না গ্রামে । সামনে এলেন বৃদ্ধ ঘূর্ণির ভিতর ঢুকে গেলেন । সবাই হায় হায় করে উঠলো তাহলে কি তাদের শেষ আশা ও শেষ হলো ? না অবাক কান্ড বৃদ্ধ সামনে দাঁড়িয়ে ঘূর্ণি ঝড় কোথায় ! কোথাও কিছু নেই । সবাই বৃদ্ধ কে নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করল সাথে এগারোটি ঢাক । চণ্ডী মণ্ডপে প্রবেশের সাথে সাথে মেয়ে বউরা শঙ্খ বাজাতে ,উলু দিতে লাগল । 

সময় : সাতটা দুই 

তীব্র হওয়া বইছে , বাতাসে কটু গন্ধ কালো হয়ে গেছে চারদিক । বৃদ্ধ পুরোহিত কে আসন গ্রহন করতে বললেন । হাতে সময় নেই আর এক মিনিট পরেই অমাবস্যা লাগবে । সামনে ঘট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হারান বৃদ্ধ ইশারা করলেই ঘট প্রতিষ্ঠান হবে  । হওয়ার বেগ বাড়তে শুরু করেছে , সেখানে উপস্থিত হয়ে গেছে অঘোরী উন্মাদের মত তান্ডব শুরু করেছে সে । সবাই ভয় না পেয়ে বৃদ্ধের তৈরি সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে মা চন্ডিকে ডেকে যাচ্ছে । 

সময় : সাতটা তিন 

ঘট প্রতিষ্ঠা করছে পুরোহিত মন্ত্রচরণ হচ্ছে  ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে. 

ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে. 

যা দেবী সর্বভুতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।

যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।’

তখনই অঘোরী র নৃত্য র সাথে বাতাসে তীব্র গন্ধ মৃত্যুর চণ্ডী মণ্ডপে এসে দাঁড়িয়েছে উপদেবী কাটভি । হটাৎ ই বৃদ্ধ কাত্যাযন কে দেখে যেন ভয় খেলে উঠলো অঘোরী র মধ্যে । কাটভি হুঙ্কার ছাড়তে লাগলো । কিন্তু কিছুতেই সে সুরক্ষা বলয় কে ভঙ্গ করে দিতে পারছিলো না । পুজো শুরু হয়ে গেছে গ্রামবাসীদের চোখে হটাৎ ঘুম জড়িয়ে এলো , সবাই যেন কেমন নেশাগ্রস্থ র মত অবস্থা তে । তখনই চণ্ডী মূর্তিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করলো । ঘন ঘন বাজ পড়তে লাগলো নিকষ কালো আঁধারে অঘোরী দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাঘ্র চর্ম পরিহিতা অভূতপূর্ব ত্রিলোক-উদ্ভাসনকারী আলোক এক হয়ে নারীমূর্তি । তিনি ত্রিনয়না, তাঁর কপালে অর্ধচন্দ্র শোভিত। দেবীর বহু হাতে বহু প্রকার অস্ত্র, গাত্রে বহুমূল্য অলংকার ও মালা। অষ্টাদশভূজা, অক্ষমালা, পরশু, গদা, তীর, ধনুক, বজ্র, পদ্ম, কমণ্ডলু, মুদ্গর, শূল, খড়্গ, ঢাল, শঙ্খ, ঘণ্টা, মধুপাত্র, ত্রিশূল, অঙ্কুশ ও চক্রধার। তিনি রক্তবর্ণা ও পদ্মাসনা। 



দেবী আর উপদেবী সামনাসামনি । ভয়াল উপদেবী র সাথে এবার বিরোধ ভয়ংকরী ও ক্রোধন্মত্তা দেবীর । অঘোরী সামনে এসে প্রণাম জানায় মাকে বলে " মা তোর আর বাবা শঙ্করের সেবাইত আমি মা আমার প্রতিশোধ এর মাঝে তুই কেন আসছিস "। আমি তো কত পুজো করেছি তোর মা তুই আমাকে না আমার দাদাকে শক্তি দিয়েছিস । তাই আমি মন্দের দেবী কাটভি র সরণে যাই । উনি আমাকে শক্তি দিয়েছেন ।  ক্রোধন্মত্তা দেবী হুঙ্কার ছাড়তে লাগলেন কিছু বললেন না । অঘোরী দেখলো তার সামনেই বৃদ্ধ কাত্যাযন পরিবর্তিত হয়ে গেল এক তীব্র আলোক জ্যোতিতে । আলোর রেশকে সামলে নিয়ে অঘোরী দেখলো সামনে এগিয়ে আসছেন সওম্ভু দেবাদিদেব মহাদেবের কামাখ্যার কাল ভৈরব ।

সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার আদিতে পঞ্চমুখ ছিলেন। শিবও পঞ্চানন। ব্রহ্মা শিবের থেকে অধিক গুরুত্ব দাবি করেন এবং অসম্ভব অহঙ্কার প্রকাশ করতে থাকেন। ক্রুদ্ধ শিব ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তকটি কর্তন করেন। এতে শিবের উপরে ব্রহ্মহত্যার পাপ অর্পণ হয়। ব্রহ্মা-কপাল হাতে নিয়ে শিবকে একটি দীর্ঘ সময় ভ্রাম্যমান অবস্থায় কাটাতে হয়। এই ভ্রাম্যমান শিবরূপই ‘ভৈরব’। উপদেবী ভৈরবকে দেখেই সেখান থেকে পলায়ন করতে চায় কিন্তু দেবী চণ্ডী তাকে গিলে নেন । সব কিছু যখন অঘোরী র হাত থেকে বেরিয়ে গেল সে তখন বাধ্য হয়ে পায়ে পরে গেল তার আরাধ্য মহাকাল ভৈরব আর চন্ডীর । 


কিন্তু তার পাপের ভরা পূর্ণ হয়ে গেছিল এই দিন সকালেই । যখন সে নিজে যেচে নিজের ব্রহ্মচর্য কে নিজের হাতে শেষ করে দিয়েছিল এক বিধবার সাথে কাম সাধনা করে । মা চন্ডীর খাঁড়ার কোপ পরে অঘোরী বশিষ্ঠ র উপর দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় সে । সারা গ্রামের অভিশাপ শেষ হয় । উপদেবী র বেদির তলে মৃত পড়ে থাকা তেমু র আত্মা কে উদ্ধার করে যোগমুদ্রায় স্বয়ং সয়ম্ভু । তার সন্তানদের তো তাকেই দেখতে হবে । 


কালরাত্রির শেষ হয় ভোরের আলোয় । গ্রামবাসী রা জেগে ওঠে কিন্তু কোথায় কি কেউ নেই সামনে পরে আছে বাসী রক্তের দাগ আর হ্যা চণ্ডী মূর্তি পরিবর্তিত হয়ে গেছে হরগৌরী র মূর্তিতে । সব মন্দিরের কবাট খুলে গেছে । দামদরের চর ও স্বাভাবিক কিছু নেই সেখানে না কাটভি র মূর্তি না অঘোরী । গ্রামের লোক বৃদ্ধকে খুঁজতে লাগলো , কাল কি হয়েছে কেউ জানেনা । কিন্তু সেই বৃদ্ধ কই?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama