অবু
অবু
প্রেম আসলে প্রেমই, "অন্যরকম" হয় শুধু তার ভাবনায়, তার মরমী মনের গভীরতায়। ছোট থেকেই আমার প্রেম, "অপেক্ষা"র সাথে। ছোটোবেলায় বাবা যখন বেড়াতে নিয়ে যেতেন, তখনও যাওয়ার আগে , সেই দিনটার জন্য "অপেক্ষা"ই আমার বেশি প্রিয় ছিল। যাওয়ার দিন, মনে হতো, "যাঃ ! এসে গেল দিনটা!" রবিবার বিকেলে নাচের ক্লাসের অপেক্ষা, কলেজে বারিন স্যারের ক্লাসের অপেক্ষা,রেজাল্টের অপেক্ষা.... সিনেয়ার টিকিট...প্রিয় মানুষের চিঠি....
বোধহয় তাই, পাওয়ার থেকে, না-পাওয়াগুলোই আমার কাছে বেশি আপন হয়ে ওঠে..….
*************
চলেছিলাম বর্ধমান। বিশেষ কাজ ছিল। লোকাল ট্রেন। ট্রেনের জানলার ধারে সিট পেলাম। ছোটো থেকেই জানলার বাইরে তাকালে কেমন আনমনা হয়ে যাই। কতোবার হয়েছে, ভুলে গিয়ে চলে গিয়েছি, নিজের স্টেশন ছাড়িয়ে। বেশ লাগে, জানেন ! বেশ লাগে। গন্তব্য ছাড়িয়ে গিয়ে......
যখন মনে পড়ে! মনে হয়,"বিশ্ব নিখিল, দু'বিঘার পরিবর্তে" হয়তো পেয়েই গেলাম ! কিন্তু অতোটা আর যাওয়া হয় কই ! গন্ডিটা বৃহত্তর হয়, কিন্তু মোছেনা যে !
ফাঁকা ফাঁকাই ছিল, ট্রেনটা। কখন যেন একজন এসে বসেছেন, আমার সামনের সিটে। লক্ষ্য করিনি। কাঁচাপাকা চুল, খানিকটা অবিন্যস্ত। কপালের ওপর একটা চুলের গুচ্ছ অবহেলায় পড়ে আছে। চোখদুটো সুদূরে নিবদ্ধ। শ্মশ্রু-গুম্ফে ঢাকা ঠোঁটে যেন কৌতুকের হাসি। সে হাসি বিশ্ব-জগৎকে অবলীলায় অস্বীকার করতে পারে..... ডেনিম জিনসের ওপর সাদা পঞ্জাবী তাঁর ব্যক্তিত্বে আরোও খানিকটা অসামান্যতা দিয়েছে।
কিছুতেই মানুষটির প্রতি অমনোযোগী থাকা গেলনা।
সুযোগ পেতেই চোখে হাসি নিয়ে তাকালাম। উনি হাসলেন। বললেন,
----- পাল্টাসনি বেশি।
নিশ্চয়ই আমার মুখটা তৎক্ষণাৎ ভেবলে গেছে! চোখদুটো গোলগোল আর ঠোঁটদুটো নির্ঘাৎ ফাঁক হয়ে গেছে।
প্রায় তুতলিয়ে বললাম,
----"মানে?"
আমাকে অবাক করে বলল,
----"আমাকে মনে রাখবিনা, জানতাম।"
তারপর একটা সিগারেট বার করে, নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,
----"কোরোলা কালীবাড়ি মনে আছে ? বিশ্বনাথ বাহ্মণ !"
হঠাৎ বিদ্যুৎঝলক মাথায় !! পেছিয়ে গেলাম, প্রায় চল্লিশ বছর। দেখলাম একটা চওড়া লাল পাড়ের শাড়ি, হাতে থালাভর্তি ফল-মিষ্টি নিয়ে ডাকছেন,
----" বিশ্বনাথ, অনেক বেলা হলো, কখন তো পুজো করেছো। একটু খেয়ে নাও।"
আমার পিতামহী, মনোরমাদেবী। বিশ্বনাথকাকা পূজারী ছিলেন। কোরোলা কালীবাড়ির। বাবাকে "দাদা" বলে ডাকতেন। বললাম,
----"হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। উনি আমাদের বাড়ি চুঁচুড়ায় আসতেন, ওঁর একটা ছেলে ছিল অবনীন্দ্রনাথ। আমারই বয়সী, আমি অবু বলে......
তুই অবু ? আরে আরে !!!
উদাত্ত দ্বৈত হাসিতে ভরে গেল, কামরাটা।
----" তুই আমায় চিনলি কিকরে ?
----" বললাম না ! পাল্টাসনি বেশি...
----"ধ্যাৎ, তাই আবার হয় নাকি !!"
----"মনে আছে? তুই একদিন.......
----......
----.......
কথায় কথায় ছোটোবেলাটা উঠে এলো চোখের সামনে। মাঠঘাট ছুটে চলেছে, গতির উল্টোদিকে,
আমাদের গল্পও.......
হঠাৎই উঠে দাঁড়ালো অবু।
স্টেশন এসে যাচ্ছে। বললাম,
-----" তোর ফোন নাম্বর দে...."
----" আমি করবো। ফেসবুকে তোর লেখা পড়ি। আমাকে চিনতে দিইনি। হা হা হা....নামতে হবে রে ! একদিন ঘুরে আসিস। জানিস, তোর দেওয়া, সেই......খেলনা.....
নেমে গেল ও। আমার ছেলেবেলা, অবু.....
***********
ক'দিন থেকেই, মনটা টানছিল। সেদিন ট্রেনে চড়ে বসলাম। ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমে দেখলাম, বেশ কিছু টোটো রয়েছে। জিগ্যেস করলাম,
----- কোরোলা কালিবাড়ি যাবেন ?
রাজি হলেন, এক তরুণ।
কিছুই আর স্মৃতির সাথে মেলেনা। গ্রামাঞ্চল, কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায়, যেন আধাশহর। রাস্তার দুপাশের সেই বাঁশ ঝাড় অনেক পাতলা এখন। এখন আর আগের মতো, যেখানে সেখানে ফুল ফুটে নেই। দেখা নেই সেইসব মাথায় শুকনো কাঠি বা পাতার বোঝা নিয়ে, বনবালাদেরও। সাইকেলরিক্সার সেই মেঠো পথ এখন পাকারাস্তা। তবু চোখে ভাসে......
কখন যেন এসে গিয়েছিল, কালীবাড়ি। নেমে দেখলাম, বাঁধানো চত্বরে, ঝাঁচকচকে মন্দির এখনকার মূর্তি, নীলবর্ণা। যতোদূর মনে পড়ে, মূর্তি ছিল, কুচকুচে কালো। পাশের সেই বটগাছ হয়তো বাহুল্যবোধে বিতাড়িত এখন।
পুকুরঘাটটা কোথায় গেল ? এখানেই তো......
একটু এগোতেই, খুঁজে পেলাম। একইরকম আছে এখনও। পুকুরের পাড় ঘেঁষে পায়েচলা রাস্তা, এগোলাম ওটা দিয়ে। সরু রাস্তাটা যেন অন্য এক পৃথিবীতে পৌঁছেছে......ঐ তো ঐখানে ছিল শ্মশান। একটা দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে থাকত, কালুডোম। এখন আর নেই সে শ্মশান। আরোও একটা পুকুর ছিল। আছে সেটা, তার পাড়ের তেঁতুল গাছটাও। এতক্ষণ একজন মানুষেরও দেখা পাইনি।
হঠাৎই একটা বাঁক ঘুরতে, হলুদ দেওয়াল চোখে পড়লো, একটা ছোট্টো বাড়ি। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন একজন।
-----"কাকে চাইছেন দিদি ?"
----" এখন এখানে পূজারী কে ?"
----" আমি, লক্ষ্মণ ! আপনি ?"
পূর্ব পুরুষের পরিচয় দিতে, খাতাপত্তর খুলে বসলো লক্ষ্মণ। ওর ছোট্টো মেয়ে, খেলা করছে, একটু দূরে। ব্যাগে একটা বিস্কুটের প্যাকেট ছিল। দিলাম। মার দিকে তাকিয়ে, সম্মতি পেতে, নিল সে। বলল,
----" তুমি আমার সাথে খেলবে ?"
এ আহ্বান কী অস্বীকার করা যায় ? বসে গেলাম, ওর ঘরকন্নায় .......
----"কী নাম তোমার?"
----"টুটুল"
মাথায় হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিলাম চুল।
লক্ষণ খুঁজে বার করছে আমাদের পারিবারিক পরম্পরা। ----" দিদি ! পেয়েছি ! "
হাসি আমি......উঠে পড়ি। লাল মাটির অতিথিশালাটা এখনও তেমনি আছে। শুনতে পেলাম, ঠাকুমার গলা,
----" এসো সবাই! প্রসাদ নিয়ে যাও। "
আমাদের প্রতিটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে চুঁচুড়া থেকে প্রায় গোটা চার-পাঁচটা সাইকেল রিক্সা করে এখানে পুজো দিতে আসা হতো। পরপর অতোগুলো সাইকেল রিক্সা, বেশ জমজমাট ক্যারাভান ছিল।
দেওয়ালে হাত ছুঁইয়ে, যেন প্রিয়জনের ছোঁয়া পেলাম।
টোটোর ছেলেটি, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। উঠে পড়লাম। পিছনে তাকাই, শৈশবের দিকে। দেখি, টুটুল ছুটে আসছে। ওকে কোলে তুলে নিলাম।
বলল,
----" তুমি ভালো। এটা নাও।"
দেখি, রঙ্ ওঠা বিবর্ণ একটা ছোট্টো গাড়ি। কোনোওদিন হলুদ রঙ্ ছিল তাতে। আরে !!!! এটা তো আমি অবুকে......
খুব আদর করলাম টুটুলকে। বললাম,
---"তুই আগলে রেখেছিস আমার ছোটোবেলা রে মা, ওটা তোর কাছেই থাক।"
ও ---"আচ্ছা"--- বলে ঘাড় নেড়ে ছুট দিলো....
আমি, টোটোর খোলে ঢুকে, ছোটোবেলা থেকে পালাই...
তারপর থেকেই অপেক্ষা করি, অবু যদি কখনোও ফোন করে ! তটস্থ থাকি, অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলে, ধুকধুক করে বুক, এই বুঝি, অবু! ভয়ে ভয়ে "হ্যাল্লো" বলি। অবু নয় শুনে স্বস্তি পাই! ফেসবুকের সব অনামী প্রোফাইল অবুর মনে হয়।
না অবু, কখনও ফোন করিসনা ! দেখা দিসনা আমায় ! তুই আমার অপেক্ষার অবনীন্দ্রনাথ হয়েই থাক না অবু