অভিমন্যু
অভিমন্যু
মহাভারতকে যদি দেখেন অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। যেন এক বিশাল দাবা খেলা। খেলছে সবাই আর খেলাচ্ছেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। একে একে গুটি কাটা পড়ছে আর ভরে উঠছে খালি বাক্স। তারপর বোর্ড খালি।
কে নেই এই কুরুক্ষেত্রে-
স্বয়ং নারায়ন উপস্থিত শ্রীকৃষ্ণ রূপে,
উপস্থিত ইন্দ্রদেব অর্জুন রূপে, ভীম রূপে বায়ু,
কর্ণ রূপে সূর্য্যদেব, অশ্বত্থামা রূপে রুদ্র,
যুধিষ্ঠির ধর্মদেবতা রূপে,
নকুল সহদেব রূপে অশ্বিনী কুমার,
অষ্টবসুর এক বসু ভীষ্মরূপে,
মহাকালী উপস্থিত দ্রৌপদী রূপে।
উপস্থিত স্বয়ম কলি দুর্যোধন রূপে
সাথে তার অনেক সাঙ্গপাঙ্গ দুঃশাসন, সমেত আরো ভাইয়ের দল আর বোন রূপে দুঃশলা, শলা অর্থাৎ উপদেশও দেবে দুঃ অর্থাৎ অসৎ।
এসবের মাঝে এলেন চন্দ্রদেব অভিমন্যু রূপে।
16 দিনে 16 কলায় রাঙিয়ে গেলেন কুরুক্ষেত্রের ময়দান। অভিমন্যুর 16 বছর আর চন্দ্রের 16 দিন। যেদিন চন্দ্র থাকেন না অর্থাৎ অমাবস্যার দিন সেদিন সবাই অনুভব করে তার অনুপস্থিতি। অভিমন্যু যাবার আগে ফেলে গেলেন তার সেই ছাপ যা আজও অমলিন।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্রে তার ভূমিকা আজও সমান উজ্জ্বল। একলা দাঁড়িয়ে শেষ মিনিট অব্দি লড়াই করে গেছেন মহা মহারথীদের সাথে। তার মৃত্যুর সাথে সাথে ঘুরে যায় যুদ্ধের সমীকরণ। তবে তার বীরত্ব বোধয় ততদিন থাকবে মহাভারত কাহিনী যতদিন থাকবে এই পৃথিবীতে।অভিমন্যুর এই অন্যায় মৃত্যু এরপরে যুদ্ধের সমস্ত নিয়ম নীতি শিকেয় তুলে দিয়েছিল। যেভাবে অন্যায় যুদ্ধে মারা হয়েছিল নিরস্ত্র অভিমন্যুকে, ঠিক সেভাবেই মারা গিয়েছিলেন দ্রোনাচার্য্য কর্ণ দুঃশাসন দুর্যোধন শকুনি সমেত অন্যান্যরা। বেঁচে গিয়েছিলেন শুধু কৃপাচার্য্য। মারা গিয়েছিলেন জয়দ্রথ, সেও আরেক অন্যায় যুদ্ধে।
অভিমন্যুর মৃত্যু অর্জুনের মধ্যে থেকে ঘুমন্ত যোদ্ধাসত্তাকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
অর্জুন এতদিন যুদ্ধ করলেও তার গুরু তার আত্মীয় আর ভাই কৌরবদের সাথে ঠিকমতো লড়াই করার মতো উৎসাহ পাচ্ছিলেন না। পুত্র অভিমন্যুর এই অসহায় মৃত্যু সেই নরম সত্তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। চরম প্রতিশোধ স্পৃহাকে জাগিয়ে তুলে এক অন্য অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রে দাঁড় করিয়ে দেয়।
মাতা শ্রীকৃষ্ণ শ্রীবলভদ্রের বোন সুভদ্রা আর পিতা অর্জুন। সেই হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ তার মামা। শিশুকাল তার কেটেছে দ্বারকাতে।
জন্ম:
তিনি যখন মাতৃগর্ভে সেই সময়ে অর্জুন শোনাচ্ছিলেন সুভদ্রাকে কে যুদ্ধের বিভিন্ন ব্যূহ রচনা করে শত্রুকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করার জন্য তৈরি করা বিভিন্ন কৌশল।
এই কৌশলে ব্যূহ হচ্ছে এক অপরিহার্য ব্যবস্থা। এতে অপরপক্ষে যে লক্ষ্য হয় তাকে ধরার জন্য সেরা ব্যবস্থা।
মকর ব্যূহ, কুর্ম ব্যূহ, মৎস্য ব্যূহ, সর্প ব্যূহ ইত্যাদি অনেক রকমের ব্যূহ রয়েছে। কিন্তু সবার সেরা আর জটিল ব্যূহ হল চক্র ব্যূহ। প্রবেশ সহজ যতটা, তত কঠিন বেরুন।
অর্জুন বর্ণনা করতে শুরু করেন কিভাবে প্রবেশ সম্ভব এই চক্রব্যূহে, পুরো বিস্তারিত বর্ণনা করার পরে অর্জুন যখন বর্ণনা শুরু করেন ব্যূহ থেকে বেরুনোর কথা সেই মুহূর্তে সেখানে আসেন শ্রীকৃষ্ণ। অর্জুনকে ডেকে নিয়ে যান। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় শিশু অভিমন্যু সব শোনেন মন দিয়ে। তিনি শিখে যান চক্র ব্যূহে প্রবেশের পদ্ধতি, কিন্তু বেরুনোর ব্যাপারে রয়ে যান অজানা।
আসল পরিচয়:
অভিমন্যু আসলে চন্দ্রদেবতার পুত্র ভ্রচ।
পৃথিবীতে চলা নিরন্তর এই সৃষ্টিচক্র দেখে একবার ভ্রচর মনে ইচ্ছে জাগে জন্মগ্রহণ করবেন পৃথিবীতে।
অনুভব করবেন পৃথিবীতে চলা সৃষ্টির অভিজ্ঞতা।
সেই অনুযায়ী তিনি তার পিতা চন্দ্রদেবকে বললে তিনি চুপ করে থাকেন।
কিন্তু ভ্ৰচর ইচ্ছে দেখে বলেন- নারায়ন খুব শীঘ্রই যাবেন পৃথিবীতে তখন যেও তুমিও।
তবে পৃথিবীতে 16 বছরের বেশি থাকার অনুমতি দেন নি চন্দ্রদেব।
জন্মের সময় দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে বিদায় প্রার্থনা করতে গেলে দেবরাজ ইন্দ্র তার নিজের অংশের থেকে জন্ম নেওয়া অর্জুনের ঘরেই জন্ম নেবার জন্য বলেন ভ্রচ কে। দেন আশীর্বাদ। সম্মুখ সমরে তার হাত থেকে তীর ধনুক কোনভাবেই নষ্ট করা শত্রুর সম্ভব হবে না।
এরপরে ইন্দ্রের মায়া শক্তি ধারণ ও মায়া শক্তি ভেদ করার সহজাত ক্ষমতা নিয়ে আর পিতা চন্দ্রদেবের তীর ধনুক চালনার সহজাত ক্ষমতা নিয়ে অর্জুন-শুভদ্রার ঘরে জন্মান অভিমন্যু নামে।
শিক্ষা:
ছোটর থেকেই তিনি সময় কাটিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ পুত্র প্রদ্যুম্ন'র সাথে। প্রদ্যুম্ন'ই ছিলেন তার প্রথম অস্ত্র গুরু।
এছাড়া তিনি অস্ত্রশিক্ষা করেছেন বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ এর কাছেও। শিখেছেন পিতা অর্জুনের কাছেও।
এরফলে তিনি বলরামের সমান গদা যুদ্ধে পারদর্শী। শ্রীকৃষ্ণ আর প্রদ্যুম্ন এর কাছে শেখা তরোয়াল চালনা। অর্জুনের কাছে তীর ধনুক চালনা শিক্ষা তাকে করে তুলেছিল সর্ব অস্ত্র চালনা ও জানা এক মহাবীর।
সাথে ইন্দ্রদেব ও চন্দ্রদেবের দেওয়া আশীর্বাদ তাকে করে তুলেছিল অপরাজেয়। সবে মিলে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য।
বিবাহ:
বিরাট রাজার ঘরে অর্জুন নিয়েছিলেন বৃহন্নলা সাজ। তিনি রাজকন্যা উত্তরার নৃত্য গুরু ছিলেন।
এইভাবে এক বছর তারা কাটিয়ে আসল পরিচয় যখন দেন- তিনি আসলে অর্জুন, তখন বিরাট রাজা বলেন উত্তরার সাথে বিবাহ করার জন্য।
কিন্তু যেহেতু উত্তরা শিষ্যা মানে কন্যা সমা তাই উত্তরার সাথে অর্জুন বিবাহ দেন পুত্র অভিমন্যুর।
পরে উত্তরার গর্ভে অভিমন্যুর এক সন্তান জন্ম নেন,তার নাম পরীক্ষিৎ । তিনিই হন পাণ্ডবদের উত্তরাধিকারী।
তবে ততদিনে অভিমন্যু ত্যাগ করেছেন পৃথিবীর মায়া।
কুরুক্ষেত্রে:
কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের বারতম দিনে কৌরব সেনাপতি দ্রোনাচার্য্য যখন পাণ্ডব পক্ষকে হারাতে পারেন না তখন দুর্যোধনের বাক্যবানে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিজ্ঞা করেন পরেরদিন তিনি পান্ডবপক্ষর কোন একজনকে বধ করবেনই।
সেই অনুযায়ী তিনি এক পরিকল্পনা করেন।
একদল কৌরবসেনা পাঠিয়ে দেন দ্বারকার দিকে যেন তারা দ্বারকা আক্রমন করতে যাচ্ছে।
তখন শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুন তাদের তাড়া করে কুরুক্ষেত্র থেকে সরে যান।
সেদিন গুরু দ্রোনাচার্য্য তৈরি করেছিলেন চক্র ব্যূহ।
মূল প্রবেশপথে ছিলেন পাহারায় জয়দ্রথ।
পাণ্ডবপক্ষে চক্রব্যূহ প্রবেশের পদ্ধতি জানতেন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন অভিমন্যু আর প্রদ্যুম্ন।
কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত রয়েছেন শুধুমাত্র অভিমন্যু।
ঠিক হয় অভিমন্যু প্রবেশ করবেন চক্রব্যুহ।
পেছনে থাকবেন ভীম,সাত্যকি,যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব সমেত অন্যান্য পান্ডবপক্ষ। ভেঙে দেওয়া হবে ব্যূহ।
কিন্তু অভিমন্যু প্রবেশ করতে চাইলে জয়দ্রথ নকল প্রতিহত করার চেষ্টা করে প্রবেশ করতে দেন শুধু অভিমন্যুকে। তারপরেই তিনি আটকে দেন ভীম সমেত অন্যান্য পান্ডবপক্ষ।
উল্লেখ্য কঠোর শিব সাধনা করে জয়দ্রথ আশীর্বাদ পেয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন বাদে সবাইকে তিনি একদিনের জন্য আটকে রাখতে সক্ষম।
সেইদিন জয়দ্রথ তার প্রাপ্ত আশীর্বাদের প্রয়োগ করেন।
ফলাফলে বাইরে রয়ে যান সমস্ত পান্ডবপক্ষ।
ভেতরে প্রবেশ করেন অভিমন্যু তার রথ নিয়ে।
সবে মিলে 7 টি স্তর থাকতো এই চক্রব্যূহর।
একদম সপ্তম স্তরে থাকতো কেন্দ্র।
পথে যেই প্রতিহত করতে এসেছে তাকেই বধ করেন অভিমন্যু। দুর্যোধনের ছেলে লক্ষণকে, শল্যর পুত্র রুকমার্থ্যকে, কৃতবর্মা পুত্র মৃত্তিকাবর্তকে। কৌরবদের বহু সেনানী বধ হন তার হাতে।এছাড়াও তিনি
বধ করেন শ্রীরামের বংশ ইক্ষাকু বংশের রাজা বৃহদবল্লভকে তিনি কোশল রাজ্যের রাজা ছিলেন।
তিনি কৌরবদের ধ্বংস করতে করতে পৌঁছে যান চক্রব্যূহর একদম কেন্দ্রে। সেখানে তিনি যুদ্ধে হারান একের পর এক মহারথীকে। কর্ণ,দুর্যোধন, দুঃশাসন,কৃপাচার্য্য,ভুরিশ্রবা অশ্বত্থামা,শল্য, শকুনি সমেত দ্রোনাচার্য্যকে।
এদিকে পুত্র লক্ষণের মৃত্যু দুর্যোধনকে বিচলিত করে তোলে। যুদ্ধের সমস্ত নিয়ম ভুলে গিয়ে সবাইকে বলেন আক্রমন করতে একসাথে।
সবার মিলিত আক্রমনে সারথি মারা গেলে
একহাতে ঘোড়া সামলিয়ে অন্যহাতে তরোয়াল চালিয়ে যুদ্ধ করে যান অভিমন্যু। তারপর রথ ভেঙে গেলে নেমে পড়েন অভিমন্যু রথ থেকে। তুলে নেন ধনুর্বান। সম্মুখ সমরে পেরে উঠে না কৌরব পক্ষের কেউই। কোন মহাবীর সামনে দাঁড়াতে পারেন না অভিমন্যুর। তখন
দুর্যোধন পেছন থেকে আক্রমন করে তীর ধনুক ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন কর্ণকে।
কারন সামনে থেকে যুদ্ধে কখনো নিরস্ত্র হবেন না অভিমন্যু। কর্ণ তাই করেন।
এরপরে ভাঙা রথের চাকা তুলে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। একহাতে তরোয়াল এক হাতে রথের চাকা তুলে আক্রমন চালিয়ে যান অভিমন্যু।
এরপরে আবার তরোয়াল ভেঙে গেলে নিরস্ত্র অভিমন্যুকে পেছন থেকে আক্রমন করা হয়।
রথের ভাঙা আরেকটি চাকা তুলে আবার যুদ্ধ শুরু করেন অভিমন্যু।
শেষ অব্দি পেছন থেকে তীর ছুঁড়ে সেই চাকা নষ্ট করা হলে খালি হাতে অভিমন্যু লড়াই চালিয়ে যান।
নিরস্ত্র কারুর সাথে লড়াই করা ছিল কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের নিয়ম নীতি বিরুদ্ধ । কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা না করে আক্রমন চালানো হয় অভিমন্যুকে গোল করে ঘিরে ধরে।
পেছন থেকে গদার আঘাত করেন দুর্যোধন অভিমন্যুর মাথায়, শকুনি তীর ছোঁড়েন আর কর্ণ করেন তরোয়াল এর আঘাত।
আহত অভিমন্যুকে এরপরে একে একে সমস্ত মহারথী মিলে আক্রমন করেন।
জয়দ্রথ এরপরে একের পর এক তরোয়াল আঘাত করে খুঁচিয়ে মারেন অভিমন্যুকে।
না সামনে থেকে নয় পেছন থেকেই দেন আঘাত।
সবার সম্মিলিত আঘাতে ক্রমাগত পেছন থেকে একের পর এক মারে শেষ অব্দি লুটিয়ে পড়েন অভিমন্যু।এভাবেই মারা যান সেই অদ্ভুত যোদ্ধা।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সর্ব কনিষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন তিনি। মাত্র 16 বছর বয়স হয়েছিল তার।
যদিও তার আয়ু ছিল 16 বছরই।
শ্রীকৃষ্ণ জানতেন তার আয়ুর কথা। সেই দিনে তার মৃত্যুযোগ ছিল লেখা। তাই তার মৃত্যু যাতে হয় বীরের মৃত্যু সেইজন্য সম্পর্কে মামা হয়েও তিনি অভিমন্যুর এই মৃত্যু তিনি স্বীকার করে নেন।
অভিমন্যুর মৃত্যু যেন এক অদৃশ্য জাদু ছোঁয়া,
সেই জাদু স্পর্শ এখনও কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে নির্ভীক অভিমন্যুর অসাধারণ বীরত্ব তাকে অমর করে রেখেছে।
এরপরের কথা:
ভাবছি অন্য কথা।
আবার হয়ত এই বোর্ড পাতা হবে অন্য কোথাও, অন্য কোন সময়ে, অন্য কোন পরিস্থিতিতে, আবার খেলা হবে জোরদার। কেউ ছেড়ে কথা বলবে না।
সবাই জানে খেলা শেষ হলে সবাই যাবে একটাই বাক্সে।তবে যতক্ষন খেলব, কেন খেলব না পুরোদমে...