STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Tragedy

আত্মসম্মান

আত্মসম্মান

5 mins
306

আত্মসম্মান, আত্মজ্ঞান, আত্মনিয়ন্ত্রন- এই তিনটি বিষয় মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখে; সেইসাথে জীবন যাপনে নিজ ইচ্ছায় এবং নিজ সিদ্ধান্তে সুনির্দিষ্ট পথরেখাও তৈরি করে দেয়। এই তিনটি বিষয় নারী পুরুষ সকলের জন্য প্রযোজ্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে আত্মবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখে না, দেখে পরনির্ভর, দুর্বল এবং অবলা রূপে। যুগের পর যুগ এভাবে চলতে চলতে পুরুষের ভেতর নারীর প্রতি বৈরী ভাব বদ্ধ হয়ে আছে। এমন দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপটে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারী শত চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে ঠিকই মাথা উঁচু করে চলে এবং নারী পারে বিদ্যাবুদ্ধিতে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে; হতে পারে আত্মমর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সম্পূর্ণ এক মানুষ হতে।


নারী যতদিন নিজেকে বুঝতে না পারবে ততদিন তাকে পুরুষের অধীনেই থাকতে হবে। নারীকে আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলতে হলে জন্ম থেকেই তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে সে একটি একক সত্তা। তার নিজস্বতা আছে, আছে স্বকীয়তা। পুরুষতান্ত্রিকতায় কুঠারাঘাত করতে হলে নারীকেই সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। পৃথিবীর সকল নারী আত্মসম্মানবোধে বলীয়ান হয়ে নিজ সত্তায় বাঁচবে , সেই প্রত্যাশাই সবসময় হওয়া উচিত ।


পুরো সপ্তাহ ব্যস্ততার মধ্যে কাটে ইরাবতীর । সকালে উঠেই কাজে লেগে পড়ে । একার হাতেই সব দায়িত্ব সামলাতে হয় তার। ইরাবতী সরকারি অফিসে চাকরি করে। তাই তাকে বাড়ি থেকে ন'টায় বেরিয়ে পড়তে হয়, তা না হলে দশটার মধ্যে অফিসে পৌঁছোতে পারবে না। তাই তার সকালটা ঘরে থাকা মেয়েদের মত অলস ভাবে কাটে না। ইরাবতী বিয়ের মত একটা গতানুগতিক প্রথায় নিজেকে জড়ায়নি বা বলতে পারো জড়াতে চায়নি। নিজের আত্মসম্মান বোধ নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে একাই। মেয়েরাও যে একা ভালো ভাবে থাকতে পারে তার প্রমাণ করে দিয়েছে সে ।


নিজের রোজগারের টাকায় শহরের অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে। গাড়ি চালানো ছিল তার একটা প্যাশন। মন খারাপ বা কাজের একঘেয়েমি থেকে মনকে ফুরফুরে রাখতে লংড্রাইভ হলো তার একমাত্র উপশম। আরেকটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি, ইরাবতীর বাঁচার অক্সিজেন ছিল গান। সব রকম গান নয়, গানেরও কিছু রকমফের ছিল। এই সময়ের আর্টফিল্ম গুলির কিছু গান, গজল ও রবীন্দ্র সঙ্গীত দখল করে নিয়েছিল তার মোবাইলের মিউজিক ফোল্ডার। বলা যায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গানই তাকে কাজের উৎসাহ দিয়ে থাকে। ইরাবতীর মুড ভালো রাখতে বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া আর তার সাথে পছন্দের গান হলেই চলে। এমন ভাবেই ওর দিন কেটে যেতো। কোনো অভিযোগ ছিল না তার কারোর উপরেই। নিজের মত করে বাঁচতো সে।


কিছুদিন হলো নতুন ভালো লাগারা এসে ঘর বেধেছে ইরাবতীর মনে। প্রকৃতির রোজকার জীবনকে ক্যামেরাবন্দি করা, আবার ব্যালকনি কে শীতের মরসুমী ফুল দিয়ে সাজানো। নতুন ভাবনারা ভিড় জমায় তার গোপন আস্তানায় । ইরাবতীর ক্যামেরায় কত কত ছবিরা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে ফটোগ্রাফিটা বেশ ভালোই রপ্ত করেছে । ভোরে উঠে গাছগুলোতে জল দিয়ে, আদর করে ঘুম ভাঙায় তাদের। হঠাৎ একদিন ইরাবতী আবিস্কার করলো তার ব্যালকনিতে দুটো চড়ুই পাখি আপন মনে রেলিংয়ের একটা ধারে বসে আছে। সে অপলক দৃষ্টিতে পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন থেকে নিয়ম করে ওর বারান্দার এক কোণে তাদের জন্য ছোট্ট পাত্রে জল রাখে। ঐ সুখ পাখির জোড়া এসে জল খেতো, কিছুক্ষণ জল নিয়ে খেলাও করতো আবার উড়ে যেত। ইরাবতী তাদের গোপন প্রেমের মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করে রাখতো। কি জানি ওই জোড়া পাখি ওর জীবনে এক নতুন বসন্ত নিয়ে আসবে কিনা? নাকি আবার সব এলোমেলো করে দেবে?


রবিবারটা আসলে ইরাবতী একটু রিলাক্স থাকে। অফুরান সময় থাকে নিজের ভালো লাগাদের সাথে সময় কাটানোর। ঠিক আজকের দিনের সকালটাও শুরু হলো তার পছন্দের গান দিয়ে- " তুমি হয়তো বহুদূর, তবুও তোমার কথার সুর, দেখো বাজছে আমার বেসুরো জীবনে"। এই আদুরে দিন গানটি হল "সোয়েটার" সিনেমার গান। গানটি গেয়েছেন রনজয় ভট্টাচার্য। গানটা শুনতে শুনতে, ব্যালকনিতে চা নিয়ে আনমনা হয়ে তাকিয়ে রইল তার নিজের হাতের তৈরি সখের ছোট্ট ফুল বাগানে। হঠাৎ তার ভাবনায় ছন্দ পতন ঘটল কলিংবেলের শব্দে। সে দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেখল একজন ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়ানো। লোকটা বলল " ম্যাডাম আপনি কি ইরাবতী বোস?" উত্তরে বলল, হুমম আমিই ইরাবতী । আপনার জন্য আমাদের ডিরেক্টর স্যার এই গিফট্ টা পাঠিয়েছেন। এই বলে লোকটা চলে গেল। ইরাবতী ঠিক কিছুই বুঝতে পারলো না। দরজা বন্ধ করে ঘরে এলো। কতক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর আস্তে আস্তে উপহারটা খুললো। দেখল একটা বাক্স, তাতে রয়েছে ইরাবতীর কয়েকশো ছবি। ইরাবতী যা একেবারে মুছে ফেলেছিলো জীবন থেকে, ঠিক দশ বছর পরে আবার সেই মানুষটা এসে কড়া নাড়লো তার মনের দরজায়। মনে মনে ভাবল অর্ক আজও দিনটা ভোলেনি। দীর্ঘ দশ বছর পরেও মনে হয় সেইদিন ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। তাদের স্কুলে, কলেজে, ইউনিভার্সিটি'তে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত। একসাথে কাটানো সব স্বপ্নীল দিনগুলো কেমন এক লহমায় ধুয়ে-মুছে শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তারপর যা ঘটেছিলো সেটা ছিল ইগো বা অহং - র লড়াই। দুজনের মধ্যে ইগো বা অহং নামক তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশে তাদের সম্পর্কের ভাঙ্গন ধরেছিলো। যা কখনো জোড়া লাগানোর চেষ্টাই করেনি ইরাবতী। হয়তো বা ভুল বোঝার হিসেবটা অর্কই কষেছিলো। তাই অংকের সঠিক যোগফলটা ইরাবতীর কাছে আজও অধরা। একটা চিঠি ও ছিল তার জন্য। তাতে লেখা ছিল- দুজন মিলে হারানো সূত্র মেলাবো বলে দীর্ঘ দশ বছরের অপেক্ষায়। তোমার চেনা ঠিকানা আজও আছে শেষ প্রতীক্ষায়... ।


ইরাবতী সযত্নে তার শূন্য ফুলদানি সাজিয়ে তুললো অর্কর ভালোবাসায়। সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি ইরাবতী। পরের দিন ঘুম ভাঙতেই বেড়িয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। গাড়ির কাঁচ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছিল কুয়াশায়। তাও ইরাবতী ছুটে যাচ্ছিল কিন্তু কেন? দশ বছরের অপেক্ষার ইতি টানবে বলে? নাকি অর্কর ওপর জমে থাকা একরাশ অভিমানের হিসেবে চাইবে বলে? ঠিক তখনই তার মোবাইলটা বেজে উঠল। ওপার থেকে পুরুষ কন্ঠে কেউ বলল- " ম্যাডাম! স্যারকে শেষ দেখাটা দেখবেন না" ?


কথাটা শোনার পর ইরাবতী চমকে উঠল, তবে কি তার জেদের জন্য এই অঘটন ঘটল। শান্ত মাথায় চিন্তা করে দেখল না সে কোন ভুল করেনি কারণ আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কখনই সে ভালো থাকতে পারতো না। আবার তার ভালবাসাটাও মিথ্যে ছিল না, তাই সে মাথা উঁচু করে চলল অর্কর শেষ যাত্রায় সামিল হতে নিজের আত্মবিশ্বাসকে সাথী করে।মৃত্যুর সঙ্গে সহজ না হতে পারলে, জীবনের স্বাধীনতাও ধরা যায় না।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy