Susmita Sau

Drama Fantasy

1  

Susmita Sau

Drama Fantasy

আত্মম্ভরিতা

আত্মম্ভরিতা

6 mins
1.2K


সকাল দশটা সবে| এই সময়ে সব পত্রিকা অফিসই একটু অলস গতিতে চলে| সুপ্রভাত অফিসও তার ব্যতিক্রম নয়| অভি অফিসে এসে দেখলো চারদিকে সব গোল টেবিল হয়ে কালকের নিউজ টা নিয়ে জোরদার আলোচনা হচ্ছে| রিনির টেবিল কিন্তু ফাঁকা, অথচ রিনির ল্যাপটপ টা টেবিলে খোলা রয়েছে| অভি জানে রিনি এই মুহূর্তে কোথায়|  বারো তলা বিল্ডিং এর এই কাঁচ দিয়ে ঘেরা ব্যালকনিটা রিনির ভীষণ প্রিয়| রিনি বলে জানিস অভি এখানে এসে দাঁড়ালে মনে হয় সমস্ত কলকাতা শহর টা বোধহয় আমার পায়ের তলায়| অভি হেসে রিনির মাথার চুলটা ঘেঁটে দেয় বলে পাগলি তোর পায়ের তলায় নয় তোর কলমের তলায় হলেও হতে পারতো| এমনি ডাকসাইটের রিপোর্টার মিস্ রিনিকা দত্ত| 

    আজও অভি এসে দেখলো রিনি ওখানে দাঁড়িয়ে| অভি বললো কি হয়েছে বলতো তোর?

  -কই কিছুনা|

 -দেখ রিনি আমায় লুকিয়ে থাকতে পারবিনা| বরং বলে একটু হাল্কা হতেই পারিস| আমি দেখছি গতকালের ঐ নিউজটার পর তুই কেমন মনমরা| কি হয়েছে? আমার থেকে বেশি ভালো তোকে আর কেউ বোঝেনা ডিয়ার| 

 -একটু কফি খাবি?

 - চলুন ম্যাম্|

দুজনে গিয়ে বসলো দু কাপ কফি নিয়ে| অভি বললো এবার তো বল|

রিনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললো কাল যে নিউজ্ টা হাইলাইট হয়েছে সেটার সাথে আমি পরোক্ষভাবে জড়িত| মানে ঐ নিরুদ্দেশ হওয়া সাহিত্যিক অতনু বিশ্বাস আমার বায়োলজিকাল ফাদার|

  -মানে???আঁতকে উঠলো অভি| আমি তো জানি আন্টি মানে মিসেস জয়িতা দত্ত স্বামী প্রকাশ দত্ত মারা যাওয়ার পর তোকে সিঙ্গেল মাদার হিসেবে মানুষ করেছেন|

  দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিনি বললো শুনবি সব?

আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা এক বর্ষার দিনে কফি হাউসে আলাপ হয়ে ছিল সবে একটু নাম যশ হওয়া সাহিত্যিক অতনু বিশ্বাসের সাথে কলকাতার বড় ব্যারিস্টার গগন মিত্রের একমাত্র আদুরে কন্যা জয়িতার|

প্রথম আলাপেই দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে|

আস্তে আস্তে সেই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নেয়| না একমাত্র আদুরে কন্যার কোনো আবদারেই কোনো অমত করেনি দাদু| বিয়ে হয়েছিল খুব ধুমধাম করেই| এতটা দাদু বলে গিয়েছিলেন|

বাকি টা মার মুখে শোনা| জন্মদাতা বাবা কোনোদিনই মাকে ভালোবাসেনি| মার ওপর মানসিক অত্যাচার চলতো| এর মধ্যেই আমি আসি মায়ের কোল জুড়ে| দাদু মাকে আর আমাকে প্রায়ই নিজের কাছে নিয়ে রাখতেন| এমনি এক দিনে মা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে হঠাত্ করে বাড়ি যায়| আর তখনই মা আবিষ্কার করে বাবার আর একটা চরিত্র| আমাকে মানুষ করার জন্যে একজন আদিবাসী মহিলা আয়া রাখা হয়েছিল | তার সাথে বাবাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় মা আবিষ্কার করে| তারপর আর ঐ নোংরা লোকটার সাথে মা সম্পর্ক রাখেনি| সেই থেকে আমরা দাদুর বাড়ি থাকতাম |

   অভি বললো একটা নোংরা লোক তার জন্য অত চিন্তার কি আছে রিনি?তার থেকে বরং জীবনের ঐ অধ্যায় টা তুই ভুলে যা আর তুই তো প্রকাশ দত্তর মেয়ে হিসেবে পরিচিত|

তবে অত চিন্তার কি আছে?

   সেটাও যে আমার আরও লজ্জা অভি,জল ভরা চোখে স্বগোতোক্তির মতো কথা গুলো বললো রিনি| যেন অনেক দূর থেকে অনেক বেদনা সাথে নিয়ে বহু কষ্ট করে কথা কটা উচ্চারণ করল| 

    অভি অনেক আদরে অনেক ভরসা নিয়ে রিনির হাত টা ছুঁলো, বললো থাক রিনি যে কথা তোকে এতো কষ্ট দেয় সে কথা আমি শুনতে চাই না| আলতো করে নরম আদরে রিনির কপালে ঠোঁট টা ঠেকালো অভি| 

    রিনি বললো না অভি এটাও আমার মায়ের হঠকারিতা আর ভুল ডিসিশন| প্রকাশ দত্ত লোকটা মাকে নয় মায়ের সম্পত্তি কে বিয়ে করে ছিল| মার থেকে বছর সাত আট ছোটো ছিলো ঐ জানোয়ার টা| একবার মা দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ার বাড়ি গিয়েছিল| রাতে কোনো কারণে আটকে যায়| আর এই সুযোগ টা নিয়ে জানোয়ার টা সারা রাত আমার ওপর অত্যাচার করে| তখন আমি বারো কি তেরো| সকালে মা ফিরে সব বুঝতে পারে| সেই রাতেই জানোয়ার টা মারা যায়| তার মৃত্যুটা আজও আমার কাছে রহস্যময় থেকে গেছে|

      অভি রিনির মাথাটা নিজের বুকে নিয়ে বললো পাগলি ওটা দুঃস্বপ্ন| আজ থেকে আমায় কথা দে আর ওসব মনে রাখবি না|

তার চেয়ে চল আমারা সত্যিটা উদ্ঘাটন করি|

সাহিত্যিক অতনু বিশ্বাস কোথায় নিরুদ্দেশ হলো|

    এরপর কটাদিন ঐ সাহিত্যিকের সব ইনফরমেশন জোগাড় করতেই কেটে গেলো| জানা গেলো সম্প্রতি লেখক কলকাতা ছেড়ে পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকতেন| লেখা থেকে বেশ কয়েকবছর হল নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন| তবে উনি আর কোনোদিনই বিয়ে করেননি| 

     একদিন রবিবার দেখে অভি রিনিকে নিয়ে বেড়িয়ে পরলো পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে|

অনেক খুঁজে যখন ওরা লেখকের বাড়ী পৌঁছায় তখন সূর্য পশ্চিম আকাশ লাল করে অস্তরাগে বসেছে| বাড়িটির পিছনে ছোটো টিলার মাথার ওপরটা পড়ন্ত সূর্য্যের আলোয় নতুন কনের লজ্জায় রাঙা মুখ টা র মতো রাঙিয়ে উঠেছে| সেই দিকে তাকিয়ে রিনি উদাস হয়ে গেল| অভি আলতো করে রিনির কাঁধে হাত রাখলো| রিনি জানে এটা অনেক ভরসার হাত| এ হাত সহজে বেইমানি করবে না| 

      ওরা বাড়ির দরজায় এসে বেল বাজালো| একজন সত্তর ঊর্ধ বৃদ্ধ এসে কাঁপা হাতে দরজা খুললো| বললো তোমারা তো পুলিশের লোক নয় তবে কেন এসছো| আমি তো বলেছি বাবু কোথায় আমি জানি না| অভি বললো আমরা খবরের কাগজের লোক | তোমার বাবুকে খুঁজে দিতে চাই| 

      বৃদ্ধটি অসহায় ভাবে বললো যে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যায় তাকে কি খুঁজে পাওয়া যায়?

  রিনি বললো তুমি সাহায্য করলেই পাবো|

বৃদ্ধটি অসন্তুষ্ট হয়ে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করতে গেলো, এবার রিনি তার ব্রহ্মাস্ত ছুঁড়লো| সে বললো আমায় চিনতে পারছো রঘুনাথ দাদা?

 -কে ও?

 -আমি তোমার রিনি দিদিভাই|

 -অবাক হয়ে বৃদ্ধটি তাকিয়ে রইলো,তারপর হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো| সেই তুমি এলে এতো দিন পর?কোথায় ছিলে এতো দিন? সে যে অনেক বেদনা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে|

 -কিন্তু যে মানুষ টা আমার মাকে কষ্ট দিয়েছিল তাকে আমি ক্ষমা করি কি করে?

 -না দিদিভাই না,ওমন কথা মুখে এনোনা|

তুমি কিছুই জানো না তাই বলছো| ভিতরে এসো সব বলছি|

   অভি আর রিনি ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলো | সারা ঘরে জয়িতা আর রিনির ছোট্ট বেলার ছবি| 

   বৃদ্ধটি বলতে শুরু করলো এগুলো ছিলো দাদাবাবুর সারা জীবনের সঙ্গী| তোমার মা ছিলেন অত্যন্ত দাম্ভীক আর জেদী | দাদাবাবুর রোজগার নিয়ে সব সময় কথা শোনাতেন | সাহিত্য চর্চা কে উনি বিলাসিতা এবং কুঁড়েমি বলে মনে করতেন| তুমি হবার পর দাদাবাবুকে ফেলে বাপের বাড়ি থাকতেন| তোমায় দেখাশোনা করতো শেফালি নামে এক আদিবাসী মেয়ে | সে দাদাবাবুর ও দেখভাল করতো| একদিন দাদাবাবুর ধুম জ্বর তোমরা নেই, শেফলি আমায় জিজ্ঞেস করে দাদাবাবুর ঘরে যায় দাদাবাবুর সেবা করতে| তখনই বৌদিমনি ফিরে আসেন আর ঐ অবস্থায় শেফালিকে দেখে ভুল বোঝেন|

এরপর সব তোমার জানা| কিন্তু সেদিনের পর শেফালি চলে যায় তার গ্রামের বাড়ি|

আর দাদাবাবু তোমাদের স্মৃতি আঁকড়ে সারা জীবনটা কাটিয়ে দেয়|

    রিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা| কান্নায় ভেঙে পরে| অভি রিনিকে বুকে জড়িয়ে বলে রিনি এটা কাঁদার সময় নয়| আমরা ওনাকে খুঁজে বের করবো| আমাদের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবো|

    সেদিনের মতো ওরা ওখানে থেকে যায়| সারা রাত রিনি ওর জন্মদাতা বাবার সব লেখা দেখে| বাবার স্মৃতি মাখা প্রতিটি জিনিসের ঘ্রাণ নেয়| তারপর ভোর হওয়ার সাথে সাথে বেড়িয়ে যায় রঘুনাথের থেকে ঠিকানা নিয়ে | যাবার সময় বৃদ্ধ টি রিনিকে বলে বড় দেরী করে এলে দিদিমনি দাদাবাবু যে বড় অসুস্থ,তারপর মাথায় হাত রেখে বলে আশীর্বাদ করি তুমি জয়ী হও|

     ঘাটশিলার আগের স্টেশন ধলভুমগড়| সেখান থেকে আধা ঘণ্টার রাস্তা কোপপাড়া | সুবর্ণরেখার তীরে কয়েক ঘর আদিবাসীর বাস ওরা যখন পৌঁছায় তখন দুপুর শেষে বিকাল নামছে সুবর্নরেখার জলে| আদিবাসী মেয়ে বৌ রা কলসী নিয়ে নদীতে নেমেছে| মিয়ম্রান সূর্য্যের আলো নদীর জলে মিশে জলে কতো আলপনা দিচ্ছে| ওরা জিজ্ঞেস করে করে শেফালির ঘরে যখন পৌঁছালো তখন আর একটা দিন শেষ হওয়ার জন্যে প্রস্তুত|

   রিনি ঐ দশ ফুট বাই দশ ফুট দরমার ঘরে যখন ঢুকলো তখন ঐ ঘরের সব আলো নিভে গেছে| রিনি দেখলো মেঝের বিছানায় সাদা চাদরে চির নিদ্রায় শুয়ে জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক ক্লান্ত পথিক, আর তাঁর পায়ের কাছে বসে সেই মহিলা যিনি হেলায় সব ঐশ্বর্য ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন|

        রিনিকে ক্ষমা চাওয়ার কিছুমাত্র সুযোগ না দিয়ে তিনি চলে গেলেন| শুধু রিনির ওপর রয়ে গেলো দুটি অসহায় মানুষের দ্বায়িত্ব| 

     রিনি বাবার সব কাজ মিটিয়ে শেফালীকে নিয়ে ফিরে গেলো বাবার বাড়ি|

অভি তাকে আস্বস্ত করল সে খুব তাড়াতাড়ি কলকাতা থেকে ফিরে আসবে রিনির পাশে সারা জীবন থাকবে|


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama