SHUBHAMOY MONDAL

Drama Thriller Others

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Thriller Others

আত্মকথা - ৩ (রাহুমুক্তি)

আত্মকথা - ৩ (রাহুমুক্তি)

5 mins
168



মিত্রসাহেবের ঐ বাজখাঁই আওয়াজে, আমার তো ভয়ে হাত থেকে পিস্তল খসে পড়ার জোগাড়। তাই, আমি ওকে চুপি চুপি বললাম - বোনটি, তুমি প্লীজ বলে দাও কেউ নেই। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার কোন ক্ষতি করবো না। তুমি আমাকে বাঁচাও। 


কিরণ যে কতখানি সাহস আর উপস্থিত বুদ্ধি রাখে - আমি তার আগে কল্পনাও করতে পারিনি। দুরু দুরু বক্ষে, আমার তখন মনে একটাই সংশয় - এই বুঝি, ওর বাবা এসে ঘরে ঢোকে। আর... 


"আমার ঘরে কেউ নেই, বাবা" - বলে, ঘরের দরজার ছিটকিনিটা ভালো করে ভিতর থেকে আটকে দিলো কিরণ। তারপর আমার সঙ্গে ফিরে এলো - ওর পড়ার টেবিলে। 


বললো - বলুন, কিজন্য আপনি এই রাতে আজ আমাদের বাড়িতে এসেছেন? দেখে তো খুব কম বয়স বলেই মনে হচ্ছে - এখন থেকেই টাকার এত লোভ? জীবন বাজি রেখে ডাকাতি করতে বেরিয়ে পড়েছেন?


আমি - বোনটি, তুমি আমায় বাঁচিয়েছো। তাছাড়া তুমি আমার বোনেরই বয়সী। তোমায় আমি সব খুলে বলছি আমার অবস্থা - শুনলেই তুমি বুঝতে পারবে, কেন আমি আজ এখানে এসেছি?


এরপর, আমার সব কথাই তাকে খুলে বললাম। পকেট থেকে বের করে তাকে ফেরত দিলাম তার ঘড়িটাও। কি ভাবলো, কি বুঝলো সে জানিনা - শুধু আমার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো!


মনে হল, যেন বিশ্বাসও করলো আমার কথাগুলো! তবু বললাম - বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? সে বললল - সবই তো বুঝলাম জ্যোতিদা, এখন বলো তো এত ভালো রেজাল্ট করেও তুমি একটা কোন ছোট মোট সরকারী চাকরিও পেলে না, কেন?


আমি বললাম - বুঝেছি। তুমি এখনও পুরোপুরি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারোনি। তাইতো? হঠাৎই মনে পড়লো, সেদিনই মিউনিসিপ্যালিটির অপিসে পিওন পদে চাকরির জন্য দরখাস্ত দিতে গিয়েছিলাম। দুটো বেজে গিয়েছিলো বলে আর ওরা জমা নেয়নি। পকেটেই ছিলো সেটা তখনও।


সেটাই বের করে, ওর হাতে দিয়ে বললাম - চাকরির চেষ্টা তো করছি, কিন্তু পাচ্ছি আর কই? এই দেখো না, কাল পূর্তবিভাগে ক্লার্ক পদের জন্য দরখাস্ত দিতে গিয়ে, ওদের বড়সাহেব আমায় ডেকে যা বললেন - তা'তে, সরকারী চাকরি আর আমার কপালে জুটবে বলে তো মনে হচ্ছে না।


কিরণ - কি বললেন উনি?


আমি - বললেন, ষাট হাজার টাকা দিতে পারবে? তাহলে এই চাকরিটা তোমার নামে পাকা করে দেবো। রেজাল্ট ভালো আছে তোমার, অসুবিধা হবে না।


ভাবো! যার ষাট পয়সা রোজগার নেই, সে দেবে ষাট হাজার টাকা ঘুষ! না না, ওসব সরকারী চাকরি বাকরি আমাদের জন্য নয় গো। ও আমি বুঝে গেছি!


কিরণ - তুমি তাঁকে তোমার অবস্থার কথা বলো নি? তোমার রেজাল্টও তো দারুণ ভালো ছিল!


আমি - সেও তো দেখিয়েই ছিলাম। কিন্তু, তাতে হিতে বীপরীত হলো। কি বললেন জানো?


কিরণ - কি?


আমি - বললেন, এরকম কত স্টার পাওয়া ছেলে এলো, গেলো। আরে বাবা, ওসব মার্কস টার্কস দেখিয়ে লাভ হবে না এখানে। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। তুমি কি আমার পর?


কিরণ - এসব সত্যি?


আমি - হ্যাঁ, সত্যি। কালও যদি টাকাটা দিতে পারি ওনাকে, তবে হয়তো চাকরিটা পেয়ে যাবো। কিন্তু উনি ওনার ওপরওয়ালার কাছে গিয়ে এই বলে সাবাশি নেবেন যে, একটা ভালো রেজাল্ট করা ছেলেকে উনি নিয়োগ করেছেন - কত স্বচ্ছভাবে!


কিরণ - আচ্ছা জ্যোতিদা, তোমার একটা বোন আছে বলছিলে না? কি নাম তার? বিয়ে দিয়ে দিয়েছো বোনের?


আমি চুপ করে থাকি। কোন উত্তর দিই না তার এই প্রশ্নের। বোন যে আমার সবথেকে আদরের, ভীষণ প্রিয়। তার নাম আমি ঐ অবস্থায় কি করে নিতে পারতাম?


কিরণ বোধ হয় আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলো। তাই, আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো - আর যে যাই বলুক, আমি তো তোমায় চিনেছি! ভুল বুঝো না, তার নাম আমায় বলতে পারো নিঃসংকোচে। আমি কোনো দিন তাকে চোর বা ডাকাতের বোন বলে অপবাদ দেবো না, কথা দিচ্ছি।


আমি আমতা আমতা করে বললাম - আমার বোনকে তুমি চেনো। তোমারই তো ক্লাসমেট - অরূপা।


কিরণ শুনে একগাল হাসি দিয়ে বললো - যেমন দাদা, তার তেমনই বোন। ওরও তো মাধ্যমিকের রেজাল্ট খুব ভালো, আমাদের স্কুলে হায়েস্ট।


আমি করুণ স্বরে বললাম - হ্যাঁ, কিন্তু ও পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছে।


কিরণ - তাই ও স্কুলে আসে না, না? আমিও ভাবছিলাম সেইকথা। ও তো স্কুল কামাই করে না! কিন্তু পড়া ছাড়লো কেন? 


আমি - আমার সামর্থ্য নেই বলে। কি করে পড়বে ও? কে খরচ চালাবে? বাবার জমানো টাকা, সব তো আমাদের উচ্চমাধ্যমিক আর মাধ্যমিক পাস করতে করতে আর মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে!


কিরণ আবার আমায় অবাক করে দিয়ে বললো - আমি যদি দিই, তুমি নেবে আমার সাহায্য?


আমি - তোমার?


কিরণ - হ্যাঁ, আমার। আমাদের অবস্থা যে নেহাত মন্দ নয়, সে তো তুমি জানোই! আমি তোমাকে কালই ষাট হাজার টাকা দেবার ব্যবস্থা করছি। তুমি ঐ চাকরিটা জয়েন করো। তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তোমাদের!


আমি - না কিরণ, তা হয় না।


কিরণ - কি হয় না?


আমি - হয়না তোমার কাছ থেকে টাকা নেওয়া। কারণ, আমি এখানে এসেছিলাম তোমাদের সর্বনাশ করতে। তবু, তুমি আমায় বাঁচিয়েছো। আমার সব ব্যাপারটা শুনেছো বন্ধুর মত। আমি এর জন্যই তোমার কাছে অনেকখানি কৃতজ্ঞতার বাঁধনে আটকেছি। আর বেঁধো না।


কিরণ - কিন্তু জ্যোতিদা, এভাবে তোমাদের জীবনও তো বেশিদিন চলবে না! কিছু তো তোমায় রোজগারের রাস্তা করতেই হবে!


আমি - তা হয়তো হবে। তবে আজকের ঘটনার দ্বিরুক্তি হবে না আর, কথা দিচ্ছি।


কিরণ - তাহলে? তুমি ঐ চাকরিটা করবে না কেন তাহলে?


আমি - দেখো কিরণ, আমি গরীব সে তো আগেই বলেছি তোমায়। কিন্তু ঐ ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটাকে আমি খুব ঘৃণা করি। তাতে আমার চাকরি হোক বা না হোক!


কিরণ - বেশ। তুমি যদি কোন প্রাইভেটে চাকরি পাও, তাহলে?


আমি - তাহলেও দেখবো, তা যদি অসামাজিক অন্যায় না হয়, তবেই করবো। হুঁহ্, ভাবছো, একটা ডাকাতের মুখে আবার - ন্যায় অন্যায় সামাজিক জ্ঞান, মূল্যবোধ - তাই না?


কিরণ - না জ্যোতিদা। বরং উল্টোটা ভাবছি। ভাবছি, এত সুন্দর মানসিকতাকে চেপে রেখে তোমায় কিনা ঢুকতে হয়েছিলো - ডাকাত দলে, হ্যাঁ? এটা বোধ হয় ভগবানও চাননি, তাই তুমি ধরা পড়ে গেলে - আমার কাছে!


যাক গে, এবার শোনো - তোমার জন্য একজোড়া সারপ্রাইজ থাকবে, কাল সকালে। তুমি আজ বাড়ি যাও, কাল আসবে।  


আর একটা কথা তোমায় বলে রাখি, তুমি কবিতা লেখো, গল্প লেখো, লেখক হবার স্বপ্ন দেখো - এসব কথা তো আমি অরূপার মুখে অনেক আগেই শুনেছি। আরে! তাই তো! তুমি এখানে, সে কোথায়? এত রাত হয়ে গেছে, তোমার জন্য সে চিন্তা করবে না?


আমি - না। সে আজ রুনুর বিয়েতে গেছে, ওদের ওখানেই থাকবে। হ্যাঁ, কি সারপ্রাইজের কথা বলছিলে তুমি?


কিরণ - শুনবে?


আমি - হ্যাঁ।


কিরণ - একটা হলো, তোমাকে আমায় পড়াতে হবে। মানে, আমার টিউটরের চাকরি জুটলো তোমার, মাইনে পাবে - মাসে পাঁচশো টাকা। বাবা আজ রাতেই, টিউটর দেখার কথা বলছিল আমায়!


আর একটা - না থাক, সেটা কালকেই বলবো। চলো, এখন বাড়ি চলো। আমি তোমায় এগিয়ে দিয়ে আসছি।


আমরা ঘর থেকে বের হলাম। দেখি, সারা বাড়ি অন্ধকার। আকাশে তখন, কালো মেঘের ফাঁকে, একফালি চাঁদ হাসছে। কিরণ খিড়কির সেই দরজাটা খুলে দিয়েই বাইরে পাঠালো আমায়। যাবার আগে আবার বলে গেলো - কাল এসো কিন্তু! 


আমার জীবনে সেই রাতটা ছিল সবথেকে চমকপ্রদ রাত। সেই রাতের শিহরণ আমি আজও অনুভব করতে পারি, আজও খুঁজে পাই সেই উত্তেজনা।


সেই রাতে, পুলিশ যখন তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেললো মিত্রবাড়ির আগা-পাশ-তলা, কি কারণে যে তারা কিরণের ঘরে আসে নি একবারও, তা জানি না!


অবশ্য আমার সমস্ত চমক, উত্তেজনা এখানেই শেষ হয়নি - সেই রাতে। বাইরে আরও অভূতপূর্ব চমক, অপেক্ষা করছিল আমার জন্য!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama