আত্মকথা - ২ (সেদিন রাতে)
আত্মকথা - ২ (সেদিন রাতে)
আত্মকথা - ২ (সেদিন রাতে)
শুভময় মণ্ডল
কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হল চিনুদা। সেই সঙ্গে অপু, ঋজু, বাসু, সতু আরো জনা পাঁচেক ছেলের একটা দল। ওদের নিজেদের মধ্যে, আগেই সব প্ল্যান করাই ছিলো - এখন শুধু একবার ঝালিয়ে নিলো আমার সামনে।
যা বুঝলাম ওদের কথাবার্তা শুনে - আজ মিত্র-দের বাড়িতে 'অপারেশন' হবে!৷ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম - কিসের অপারেশন? চিনুদা বললো - সে পরে বুঝবি, এখন চল, সবাই মিলে প্ল্যানটা সাজিয়ে, নিজের নিজের কাজ বুঝে নিই।
চললাম তাদের সঙ্গে ঐ পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দিরের ভেতরে। দেখলাম - একটা সাদা এক তা' কাগজে একটা চৌকোমত ছবি আঁকা। তার ওপরে বিভিন্ন জায়গাকে ইঙ্গিত করে মার্ক করে রাখা। চিনুদা, একটা পেন্সিল নিয়ে, সেই চৌকো ঘরের - এক একটা জায়গার মার্ক ধরে ধরে, প্ল্যান বোঝাতে লাগলো।
এইটা হল - মেন গেট। একসময়, একটা বাঘা সাইজের কুকুরও ছিলো এখানে, যদিও এখন আর নেই। তার ওপর দেখবি, গেটটাও - বেশ বড়, লোহার তৈরী। আর পাঁচিলও বেশ উঁচু - মোটকথা যথেষ্ট অসুবিধাজনক।
তারপর ঐ চৌকোটার উল্টোদিকের একটা জায়গাকে মার্ক করে বললো - কিন্তু, এই এদিকটা দেখ। পিছন দিকের ঘাটে যাবার, কাঠের খিড়কি দরজা। পাঁচিলও অপেক্ষাকৃত কম উঁচু, মানে সহজেই টপকানো সম্ভব।
শুধু পুকুরটাই আছে পুরো এদিকটায়। তাই, লোকের যাতায়াতও কম। সুতরাং কারোর চোখে পড়ারও চান্স নেই। স্টার্টিংটা তাই এদিক থেকেই হবে। অপু, তুই ভিতরে ঢুকে, দরজাটা খুলে দিবি।
ও হ্যাঁ, জ্যোতি (আমার নাম), তুই যা পারিস তুলে নিয়ে, চলে আসবি - ভিতরে আটকে যাস না যেন! বাকিরা তো, সব জানিসই কাকে কি করতে হবে? এখন চল, এখানে আর দেরী করা যাবে না।
সব শুনে, আমার তো ততক্ষণে, ভিতরে ভিতরে শিহরণ ধরে গেছে (বলা ভালো, ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছিলাম ভেতরে, ভেতরে।)। ধরা পরলে, মিত্র সাহেব, গুলি করে মেরে ফেলবে - সে তো একদম নিশ্চিত।
তাঁর স্ত্রী, মধুবালা দেবীকেও - খুব মধুর স্বভাবের মহিলা বলেও তো, কোনোদিন মনে হত না আমার! তবে, ওনাদের একমাত্র মেয়েটাকে চিনি, আমার বোনের সহপাঠী। আমাকে এরা কেউ না চিনলেও, আমি তো ওদের সবাইকেই বেশ ভালো মতনই চিনতাম।
ধরা পরলে, কি হাল হবে - সেটা ভাবতেই, আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত, একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলো যেন। একবার ভাবলাম - ফিরে যাই। তারপর আবার মনে হলো - ফিরেই বা কি করবো? সেই তো না খেয়েই মরতে হবে! তার চেয়ে গুলি খেয়ে মরাই ভালো - কষ্টটা তো অন্তত কম হবে!
যাই হোক, মা কালি কে স্মরণ করে, 'জয় মা' - বলে, ঢুকে পরলাম সবাই রাত ন'টা নাগাদ - মিত্রবাড়িতে! ঝি চাকররাও কেউ ছিলো না তখন। সবাই সেদিনের মত কাজ সেড়ে, রাতে নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে। ঐ বাড়িতে তখন মানুষ বলতে - শুধু ওরা তিনজন।
চিনুদা, মধুবালা দেবীর ঘরে গেলো - সোনা দানা গুলো আনতে। মিত্রসাহেব আর ওনার মেয়ে তখন পাশের ঘরে কিসব আলোচনা করছিলো বাপ বেটিতে। আমার নজর গেলো - মেয়েটার পড়ার ঘরের দিকে। সেখানেই দেখলাম তার পড়ার এবং শোবার পূর্ণ বন্দোবস্ত রয়েছে!
আমি, ঐ ঘরটাতেই সোজা ঢুকে পরলাম। প্রথমেই নজর গেলো - পড়ার টেবলের ওপর রাখা, একটা সুন্দর হাতঘড়ির দিকে। বোধ হয় - সদ্যই সেটা কেনা হয়েছে, বাক্সের সীলটা তখনও খোলা হয়নি।
মনে পড়ে গেলো বোনের কথা। ওর আবদার ছিলো মায়ের কাছে - একটা ঘড়ি চাই তার, যেটা পড়ে সে, ইলেভেনে উঠলে, ক্লাস করতে যাবে! আবেগ তাড়িত হয়ে, আমি তখন, এইসব সাত পাঁচ পুরানো স্মৃতিকথা ভাবছি - ঘড়িটা হাতে নিয়ে, পরিবেশ পরিস্থিতি সব ভুলে!
হুঁশ ফিরলো - পিস্তলের গুলির আওয়াজে। আমিও, চিনুদার দেওয়া পিস্তলটা বের করলাম, পকেট থেকে। ঘড়িটা পকেটে ঢুকিয়ে, চুপচাপ ঘর থেকে বেড়োতে যাবো, দেখি - একটা ছায়া। এই ঘরের দিকেই কেউ আসছে!
চট করে দরজার পাশে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। ঘরে তো আলো জ্বলছিলই, দেখলাম - ঘরে ঢুকলো মিত্রসাহেবের মেয়ে, কিরণ! আমি ওর কানে পিস্তলটা ঠেকিয়ে, বললাম - চুপ, দরজাটা বন্ধ করে দাও। ও, আমার নির্দেশমত, দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
এমন সময়, মিত্রসাহেব দরজার বাইরে এসে হাজির হলেন। তারপর বললেন - একটাকে গুলিতে জখম করেছি। কিন্তু বেটা পালালো। তোর ঘরটা ভালো করে দেখ তো। কেউ নেই তো মা?
(তৃতীয় পর্ব শীঘ্রই)