Chitta Ranjan Chakraborty

Romance

4  

Chitta Ranjan Chakraborty

Romance

আশ্রয়

আশ্রয়

9 mins
332



আশি ছুঁইছুঁই রনজয় বাবুর বয়স। এই বয়সেও বেশ শক্তপোক্ত তিনি। শুধু দুই হাঁটুতে আর কোমরে বাতের ব্যথা। নিয়ম করে ইউরিক এসিডের ওষুধ, হার্টের ওষুধ ও ক্যালসিয়াম খেয়ে যাচ্ছেন। আর হবেই বা না কেন? বয়স তো আর কম হয়নি। তবু একাই বাথরুমে যান, বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেন, কারো সাহায্য ছাড়াই। ডাক্তারবাবু বলেছেন, এখনো হার্ট ঠিক আছে।

দীর্ঘ চাকরি জীবনে নিয়ম মেনে অফিসে যাওয়া, অফিসের কাজকর্ম করা, সঠিকভাবেই করতেন। দীর্ঘ 35 বছর চাকরি করেছেন, তিনবার প্রমোশন নিয়েছেন। অবশেষে ডেপুটি ডাইরেক্টর হয়ে কর্মজীবন থেকে অবসর নেন।

তার জীবনের ক'টি ঘটনা আছে যা তাকে মনে হয় আরো শক্তপোক্ত করে তুলেছে।যখন তার ছেলে বাপির যখন বয়স পাঁচ বছর তখন তার স্ত্রী পরলোকগমন করেন। অনেকে বলেছিলেন, উঠতি বয়স, এ বয়সে আবার বিয়ে করতে। কিন্তু রনজয় বাবু বলেছেন তিনি বিয়ে করলে বাপির কষ্ট হবে। তিনি আর বিয়ে করবেন না, করেনও নি। বাপিকে একাই পিতৃ-মাতৃ স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন। কোনদিন বাপিকে বুঝতে দেননি তার মায়ের অভাব। রান্না আর ঘরের কাজের জন্য দুজন লোক রেখেছিলেন। ছেলেকে স্নান করানো, খাওয়ানো, স্কুল ড্রেস পরিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে রোজ বাপিকে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। বিকেলে কাজের মহিলা বাপিকে বাড়িতে নিয়ে আসত।


বাড়িতে এসে বাপিকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, পার্কে, খেলার মাঠে প্রতিদিন নিয়ে যেতেন। রাতের খাবার খাইয়ে দিয়ে বাপিকে ঘুম পারাতেন।

বাপিও বাবার ভালোবাসা আর স্নেহে মায়ের কথা ভুলে গিয়েছিল। বাপি মন দিয়ে বাবার কথা শুনত, আর সে মত কাজ ও করত। জেদী ছেলে ছিল না বাপি। পড়াশোনায় ও ভালো ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সে এখন ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে। তারপর বাপিকে বিয়ে দেন এক স্কুল শিক্ষিকার মেয়ে মৌমিতার সঙ্গে। মৌমিতার ছোট বয়সে তার বাবা মারা গেছেন।ওর মা সাবিত্রী দেবী ওকে মাতৃ পিতৃস্নেহে বড় করে তুলেছেন। লেখাপড়া শিখিয়েছেন তারপর বাপির সাথে মৌমিতার বিয়ে।


সাবিত্রী দেবী একাই থাকতেন তার স্বামীর হাতে তৈরি করা দোতলা বাড়িতে। নিচের তলায় দুজন ভাড়াটিয়া, আর ওপরে তারা থাকেন।বাপির বিয়ে সম্বন্ধ হওয়ার পর থেকেই রণজয় বাবুর কেমন যেন সাবিত্রী দেবীর প্রতি মায়ার টান বেড়ে যায়। সাবিত্রী দেবীর ও তাই।হয়তো দুজনের জীবনে একই রকম ঘটনার জন্য দুজনের দুঃখ আর দুজনের মাঝে ঘটে যাওয়া সময় তাদের খুব কাছের মানুষ করে তোলে।


রনজয় বাবু প্রতি সপ্তাহেই সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে যেতেন। সাবিত্রী দেবীও আসতেন। এই আসা যাওয়া মৌমিতা বা বাপির টানে নয়।দুই ভালবাসাহীন ক্লান্ত পথিক যেন একই ছায়ার নিচে বিশ্রাম নিতে চায়। মৌমিতা বাপি দুজনেই ভালো মনের মানুষ। তারাও ভীষণ খুশি হতো তাদের বাবা-মাকে খুশি দেখে। কিন্তু একদিন সমস্যা হলো, সাবিত্রী দেবী স্ট্রোক করলেন। বাপি তাকে ভালো হাসপাতালে ভর্তি করায় এবং ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে ওঠেন সাবিত্রী দেবী। কিন্তু ডান হাত আর পা অবশ হয়ে যায়। অনেক চিকিৎসার পরও ঠিক হয় না। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে সাবিত্রী দেবী চাকরি ছেড়ে দেন। অবসরের পর চাকরি জীবনে আয় করা সব টাকা মৌমিতার হাতে তুলে দেন। সাবিত্রী দেবী বাড়িতে তাকে একা রাখায় সমস্যা হবে বলে রনজয় বাবু বাপি আর মৌমিতাকে বললেন, সাবিত্রী দেবী কে পাকাপাকিভাবে তাদের বাড়িতে নিয়ে এসে তার চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করতে বললেন। এবং বললেন, একতলা ঘরে রনজয় বাবুর পাশের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে।আর তাকে দেখাশোনার জন্য একজন মহিলা কাজের লোক ঠিক করতে বললেন। রনজয় বাবুর প্রস্তাবে ওরা রাজি হয়ে যায়। এবং সেদিনই গাড়ি করে সাবিত্রী দেবীকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রথমদিকে সাবিত্রী দেবীর আপত্তি থাকলেও পরে পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজি হয়ে যান।

এমনিভাবে বেশ কিছুদিন চলতে থাকে। মৌমিতা বাপি আর কাজের মেয়ের যত্নে আর রনজয় বাবুর ও অজানা ভালোবাসার টানে সাবিত্রী দেবী অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। হাত পায়ের অবশতা কমে যায়। মনের দিক থেকে চনমনে হয়ে ওঠেন।

সময়ে অসময়ে প্রায় সবসময়ই রনজয় বাবু সাবিত্রী দেবী দুজনে গল্প গুজব, হাসি ঠাট্টা করে নিজেদের খুশি রাখতে। কখনো কখনো দুজনে একসাথে সুর করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, আবৃত্তি করতেন, গল্প পাঠ করতেন। রনজয় বাবু বাপি কে বলে, একটি হারমোনিয়ম আনিয়ে নেন। দুজনে হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন,"ভেঙে মোর ঘরের চাবি....."।


দুজনের বাবা-মার এত সুন্দর সম্পর্ক আর হাসিখুশি দেখে মৌমিতা বাপি খুব খুশি। তারাও বাবা-মাকে নিয়ে বিভিন্ন রকম হাসি ঠাট্টা করে।

এমন করে রনজয় বাবু আর সাবিত্রী দেবী দুজনে মনের দিক দিয়ে অনেক কাছে চলে আসেন। সম্পর্ক এমন হয় আপনি থেকে তুমি বলেই দুজনকে সম্বোধন করেন। আর দাদা দিদি নয় দুজনে দুজনের নাম ধরে ডাকেন। সাবিত্রী দেবী প্রতিদিন নিজে হাতে চা তৈরি করে রনজয় বাবুকে দেন। রনজয় বাবু যা যা খেতে ভালোবাসেন সব নিজের হাতে রান্না করে পাশে বসে খাওয়ান। নিজেও খান। পুরাই বিকেলে দুজনে মিলে পার্কে যান। শপিং মলে গিয়ে কেনাকাটা করেন।

রনজয় বাবু সাবিত্রী দেবী আগের চেয়ে অনেক ভাল প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন। বাপি আর মৌমিতা কে কাছে ডেকে বলেন, এখানে না এলে আমি সুস্থ হতাম না। আর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছি রনজয় এর জন্য। ওর স্নেহ ভালোবাসা গুলো আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া জায়গাগুলো ভরিয়ে দিয়েছে। তাইতো আমি এতটা সুস্থ হতে পেরেছি। বাপি আর মৌমিতা দুজনে একসঙ্গে হেসে বলেন বেশ তো ভালো কথা। এটা তোমার ও বাড়ি তোমরা দুজন একসাথে আছো থাকবেএমন ভাবে চলতে চলতে বেশ কিছুদিন পর অচেনা সমস্যা তৈরি হল। একদিন রাতে মৌমিতা বাপি কে বলে শোনো, বাবা-মা দুজনকে একসঙ্গে আর রাখা যাবে না। বাপি বলল, কেন? হঠাৎ কি হল? দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে? মৌমিতা বলে, না ওসব কিছু নয়, সমস্যা ওদের সম্পর্ক নিয়ে। বাপি বলে, মানে? মৌমিতা বলে, হ্যাঁ, তুমি তো রোজ বাড়িতে থাকো না। ওরা যে আপনি থেকে তুমিতে এসেছে। বাবা তো প্রতিটা সময় সাবিত্রী সাবিত্রী করে অস্থির। আর মা ও পাগলের মত বাবাকে খুশি করতে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়ে দিচ্ছেন নাম করে আসলে বাবার মাথা শরীর মুছে দিচ্ছেন ওসব বেশি হয়ে যাচ্ছে না? কাজের বউরা কানাঘুষো করে। সেদিন বোস বাড়ির কাকিমা আমাকে হাসতে হাসতে বললেন, এখন তোমার মা আর শ্বশুরের শরীর বেশ ভালো হয়েছে। দুজনে একসাথে ঘুরতে যান, হাসি ঠাট্টা করেন, বেশ ভালো লাগে। কেমন যেন শ্লেষের সুরে কথাগুলি বলল। আমার ভীষণ লজ্জা হল। বাপি বলল, চুপ করো, আমি আমার বাবাকে চিনি। তুমি তোমার মাকে চেনো। জীবনের শেষ সময় টুকু যদি ওরা সব হারা দুটো মানুষ একটু হাসি তামাশা করে খুশিতে থাকে তাতে কার কি?


একটু হাসি ঠাট্টা, পার্কে যাওয়া এতে দোষের কি দেখছো? আর মানুষ সবাই কোন কিছুর মধ্যে ভালো না খুঁজে শুধু খারাপ টুকুই খুঁজে পায়। মৌমিতা বলল, সবকিছু তোমাকে বলে বোঝাতে পারছি না। কাজের লোক পাড়ার লোকের কথা অমূলক নয়। আমিও প্রথমে বিশ্বাস করিনি, ওরে নিজের চোখে দেখেছি....। বাপি বলে কি দেখেছ? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি সবকিছুকে সহজ করে নিজের মতো করে ভাবো, ভাবনার মধ্যে প্রসারতা রাখো, স্বচ্ছতা রাখো, দেখবে মনে শান্তি পাবে। মৌমিতা বলে, ঠিক আছে কাল সকালে তুমি নিজে চোখে দেখতে পাবে, তবে তো বিশ্বাস করবে? বাপি চুপ হয়ে বসে থাকে।


পরদিন সকালে প্রতিদিনের মতো সাবিত্রী দেবী সবার জন্য চা করে মৌমিতা আর বাপির জন্য রেখে দুকাপ চা নিয়ে রনজয় বাবুর ঘরে যায়। রনজয় বাবুকে চা দিয়ে নিজে চা খেতে থাকেন। এদিকে বাপিকে চা দিয়ে বলে মৌমিতা, দেখবে এসো নীচের ঘরে যাই। ওরা যেন টের না পায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাপি মৌমিতার সঙ্গে পর্দার ফাঁক দিয়ে দুজনে তাকিয়ে থাকে। বাপির ভীষণ রাগ হচ্ছিল, এবং বাবার এমন কিছু খারাপ দেখবে নিজের চোখে ভাবতেও পারেনি। কিন্তু মৌমিতার জন্য দেখতেই হচ্ছে। দেখল,সাবিত্রী দেবী একটি টিফিন বাটির ঢাকনা খুলে একটি সন্দেশ হাতে নিয়ে রনজয় বাবুর মুখে তুলে দিলেন, রনজয় বাবু ওএকটি সন্দেশ নিয়ে সাবিত্রী দেবীর মুখে দিয়ে হাত ধরে বললেন বসো, অনেক কথা আছে। সাবিত্রী দেবী বলেন,-আঃ করছো কি এখন আর বসার সময় নেই। মিষ্টিগুলো মৌ কে দিই। আর বাপির অফিস যাওয়ার সময় হল, তাড়াতাড়ি রান্নার জোগাড় করতে হবে। তোমার তো আর এক বায়না, টেংরা মাছের ঝাল করে দিতে হবে। রনজয় বাবু বলেন, তুমি বসো, বৌমা রান্না করবে। সাবিত্রী দেবী বলেন, না তা হয় না। ও বাচ্চা মেয়ে, ওসব রান্না করতে পারবে না। বাপি আর অপেক্ষা করতে পারে না। পেছন ফিরে ওপরে নিজের ঘরে চলে আসে। মৌমিতা ও পেছনে পেছনে ঘরে আসে। মৌমিতা বলে, দেখলে তো কেমন করে মিষ্টি খাওয়ালো? বাপি রাগত স্বরে বলে, দেখেছি, কিন্তু খারাপ কি করেছে ওঁরা? মৌমিতা বলে, তুমি বুঝতে পারছ না। সারাদিন এমন আদিখ্যেতা চলতেই থাকে দুজনের মধ্যে। বাপি বলে, তাহলে কি করতে চাও? মৌমিতা বলে, কি আর করব, মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসো। বাপি বলে, কি বলছ, মাকে বৃদ্ধাশ্রমে? তোমার না মা, মেয়ে হয়ে এসব কথা বলতে পারলে? মৌমিতা বলে, কি করব উপায় নেই। ঠিক তখনই মিষ্টির বাটি হাতে ঘরে আসেন সাবিত্রী দেবী। তাদের দুজনের কথা বন্ধ হয়ে যায়।

তারপর বাড়িটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে যায়। মৌমিতা বাপি প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া আর কোন কথাই বলেনা। সাবিত্রী দেবী মৌমিতাকে বলেন, কিরে মৌ কদিন থেকেই দেখছি তোদের দুজনের মধ্যে বেশি কথাবার্তা নেই, মন ভার করে আছিস, শরীর খারাপ হয়েছে নাকি? নাকি বাপির সাথে তোর কোন ঝগড়া হয়েছে? মৌমিতা বলে, না, ওসব কিছু হয়নি। সাবিত্রী দেবী বলেন, না, কিছুতো হয়েছে, মায়েরা সন্তানের মুখ দেখেই সব বুঝতে পারে। মাকে ফাঁকি দিতে হয় না। আমাকে বল তোর কি হয়েছে। মৌমিতা বলে, না কিছুই হয়নি, তুমি মিছি মিছি ভাবছো। এই বলে মৌমিতা চলে যায়।


তার দুদিন পর রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর মৌমিতা আর বাপি দুজনে বাবার ঘরে গিয়ে বসে। সাবিত্রী দেবী কেউ ডাকে। রনজয় বাবু বলেন, কিরে তোরা কি কিছু বলবি? তোদের মধ্যে কিছু হয়েছে? বাপি মাথা নিচু করে বসে থাকে মুখে কিছুই বলেনা। মৌমিতা আলতোভাবে বলতে থাকে, না মানে বাবা আমাদের মধ্যে কিছু হয়নি। মাকে একটা কথা বলবো বলে এসেছি, তুমিও শোনো। সাবিত্রী দেবী বলেন কি কথা রে মৌ? মৌমিতা বলে, মা, তুমি তো এখানে অনেকদিন ধরে আছো, বয়স বাড়ছে শরীর ভেঙে পড়ছে। এই সময় তোমার অনেক সেবা যত্নের দরকার। এখানে আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনা। তুমি নিজেও সব কাজ করছ। তাতে তোমার শরীর বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা ঠিক করেছি,-বলে থেমে যায়। সাবিত্রী দেবী বলেন, কি ঠিক করেছিস? মৌমিতা বলে, তোমাকে একটি নামী বৃদ্ধাশ্রমে রাখবো। এই কথা শুনে সাবিত্রী দেবী আর রনজয় বাবু দুজনেই বলে ওঠেন বৃদ্ধাশ্রম? বৃদ্ধাশ্রমের রাখবি? দুজনে আর কোন কথা বলে না। চুপ করে বসে থাকে মৌমিতা আর বাপি। রনজয় বাবু বলেন, আমারও তো বয়স 80 হয়েছে। অসুস্থ আমি আমার জন্য বৃদ্ধাশ্রম ঠিক করিস নি? মৌমিতা বলে, না মানে...। রনজয় বাবু বলেন, মানে কি খুলে বল সব কথা, নইলে তোমাদের বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে দিতে হবে না। আমরাই বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে নেব। বাপি বলে, বাবা! রনজয় বাবু বলেন, এখন সাবিত্রী আগের চেয়ে অনেক সুস্থ ও সবল। যখন অসুস্থ ছিল তখন তো এসব কথা বলিস নি। আজ আবার এমন কি হল যে তোমার মাকে এ বাড়িতে রাখা যাবে না? মৌমিতা বলে, না, মানে- পাড়ার লোকে বিভিন্ন ধরনের কথা বলে, কাজের লোকেরা আপনাদের সম্পর্কে বাজে কথা বার্তা বলে তাই ভাবছি মাকে এখান থেকে সরিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রাখবো। রনজয় বাবু বলেন, পাড়ার লোকেরা আমাদের কি দেখেছে? তোমরা কি কোন খারাপ কিছু দেখেছ? বলতে হবে। একবারও ভাবলে না এভাবে দুটো অসহায় মানুষকে এ কথা বললে আঘাত পাবে। বাপি, তোর মা মারা যাবার পর একাকীত্ব জীবনে কত দুঃখ কষ্ট বুকে নিয়ে তোকে মানুষ করেছি, তোকে কোনদিন বুঝতে দিইনি মায়ের অভাব। যদি আমি চাইতাম তবে ওই বয়সে আবার বিয়ে করতে পারতাম কিন্তু করিনি। তোর কষ্ট হবে বলেই করিনি। ঠিক তেমনি সাবিত্রী চাইনি মৌয়ের কষ্ট হবে বলে। আর এতদিন পরে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দুটি প্রাণী অতীতের দুঃখ বেদনা ভুলে হাসি-তামাশা কথাবার্তায় নতুন করে বাঁচার সুস্থ থাকার রসদ পেয়েছে। আজ আমরা অনেক সুস্থ। আর মানুষের কথায় তোরা আমাদের সুস্থ থাকার জায়গা টা ছিনিয়ে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে চাস? কি এমন খারাপ কাজ আমরা করেছি যে তার জন্য তোদের মান-সম্মান ক্ষতি হচ্ছে। আজ এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে? এখনো আমি, সাবিত্রী দুজনেই নিজেদের পেনশনের সব টাকা তোদের হাতে তুলে দিই। তোর মায়ের সব গয়না মৌমিতার হাতে তুলে দিয়েছি। তোদের মন থেকে ভালবাসি তোদের মঙ্গল চাই। আর এমন সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাদের কথা, আমাদের মনের আবেগ ভাবার প্রয়োজন মনে করিস নি?পাড়ার মানুষ আপন হলো আর নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তোদের মানুষ করা বাবা-মা পর হয়ে গেল। দুজনেই শুনে রাখ, তোমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমরা থাকো আমি বলছি সাবিত্রীকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। যতদিন বাঁচবো ততদিন সাবিত্রী এবাড়িতেই থাকবে। প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধাবোধ করবো না। প্রয়োজনে আমি সাবিত্রী কে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে দুজনে চলে যাব।

মৌমিতা আর বাপি দুজনেই কাঁদতে থাকে। দুজনেই বাবা মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। তোমরা আমাদের ক্ষমা করে দাও।সাবিত্রী দেবী মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এমন বিপর্যয় এর মধ্যে রনজয় বাবু নির্বাক বসে থাকেন। ভাবেন কাঁদুক আরো বেশি করে কাঁদুক, তবে তো বুকের মধ্যে জমে থাকা নোংরা ময়লা গুলো চোখের জলে ধুয়ে যাবে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance