Debasmita Ray Das

Drama

3.2  

Debasmita Ray Das

Drama

আরাধনা

আরাধনা

7 mins
2.2K


বেলা তিনটের দিকে সুজাত পৌঁছালো আরাধনার গেটের সামনে। বর্ধমান জেলায় অবস্থিত হরিশপুর গ্রামে প্রায় ছয় কাঁটা জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে খুব সুন্দর প্রায় প্রাসাদসম আরাধনা।

খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছিল সুজাতর.. বাড়ি থেকে শুধু দুটো পাউরুটি খেয়ে বেরিয়েছে। অরিন্দমের কাল আসার কথা.. এত বড় বাড়িতে যদি আর কেউ না থাকে তবে তো অসুবিধা। তার চিন্তা শেষ হতে না হতেই বাড়ির পুরোনো আর্দালি রামদীন বেরিয়ে এল।

'আসুন আসুন বাবু। আপনার আসার কথা বাবু আমায় কালই জানিয়ে দিয়েছেন। অনেক দূর থেকে এয়েছেন আগে একটু হাত পা ধুয়ে দুটো মুখে দিয়ে নিন।

এইরকম গ্রাম্য পরিবেশে এরকম ধোপদুরস্ত আর্দালি দেখে বেশ অবাকই হল সুজাত.. তবে ভাবল আরাধনার সাথে বেশ মানিয়েছে।বাইরের সাথে পাল্লা দিয়ে ভেতরটাও ঠিক তেমনই সুন্দর আরাধনার। তিনতলা বাড়ি উপর নিচ মিলিয়ে মোট বারোটা ঘর। দোতলায় পূব দিকের ঘরটা তাকে খুলে দিল রামদীন। বিশাল ঘর দুদিকে দুটো খাট ড্রেসিং টেবিল সোফা সবই আছে। দেখল তার বাক্সদুটো আগেই রামদীন সঠিক জায়গায় রেখে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকতেই চমক লাগল সুজাতর। সাবান তোয়ালে সব ঠিকঠাক জায়গায় তো আছেই পুরো বাথরুমটাই মার্বেলের তৈরী। ব্যাবস্থাপনা আর রামদীনের ব্যবহার দেখে মন ভাল হয়ে গেল সুজাতর।

লাঞ্চ করতে নিচে নেমে পুরো জায়গাটা একবার পাক খেয়ে নিল সে। এমন সুন্দর জায়গা খুব বেশী একটা কোথাও চোখে পড়েছে বলে সে মনে করতে পারলোনা.. যেমন সুন্দর বাগান তেমনি সুন্দর চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। প্রাণভরে বাতাস নিয়ে খুব খুশী হল সুজাত। মনে মনে শুধু ভাবতে লাগলো প্রিয় বন্ধু কখন আসবে.. এমন সুন্দর পরিবেশে তার সাথে আড্ডা দেওয়ার মজাই আলাদা।

খাওয়ার টেবিলে এসে সুজাতর আবার চমক লাগার পালা। এতো রকম খাবার আর এতো আয়োজন কোলকাতার নামী রেস্তোরাতেও দেখা যায়না। খুব তৃপ্তিসহকারে খেতে খেতে সে শুধু একটাই কথা ভাবতে লাগলো যে শুধু আর একটা যদি কথা বলার সঙ্গী পাওয়া যেত....

খেয়ে নিয়ে বিছানায় একটু গড়াতে গিয়ে ঘুমিয়েই পড়ছিল সে.. ঘুম ভাঙ্গল একটি বাচ্চা মেয়ের কান্নার শব্দে। ধড়মড় করে উঠে বসল সুজাত.. ভেবেই পেলোনা এখানে বাচ্চা কোথা থেকে আসতে পারে.. সবথেকে অদ্ভুত সে যখন রামদীনকে এ কথা বলতে গেলো সে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললো..

"কই বাবু আমি তো কিছুই শুনতে পাইনি। ও আপনার মনের ভুল হয়ে থাকবে।।

মনের ভুল?? নিজের মনে ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে ফিরে এলো সুজাত। পিছন থেকে শুনতে পেলো রামদীনের গলা.. "আপনি ঘরে যান আমি আপনার জন্য চা করে নিয়ে আসছি।

ঘরে এসে কিন্তু মনের অস্বস্তিটা মন থেকে একরকম ঝেড়ে ফেলেই দিল সুজাত। সত্যিই তো সারাদিনে কি কম ধকলটাই গেছে, মনের ভুল তো হতেই পারে। বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করতে লাগলো সে। বরঞ্চ সারাদিনের ডামাডোলে বাড়িতে একটাও ফোনও করা হয়নি তাই মায়ের সাথে দশ মিনিট কথা বলে নিল সে।

অরিন্দম আর সুজাত একই অফিসে কাজ করে.. পাশাপাশি কেবিন হওয়ার সুবাদে দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে দুজনের মধ্যে। আরাধনার খবরটা অরিন্দমই দেয়.. তার কোন মামার বন্ধুর বাড়ি। বিদেশে থাকেন দেখভালের জন্য রামদীনকে রেখে দিয়েছেন।বেড়াতে আসবার প্রস্তাবটা পেয়ে সুজাতর মন খুশীতে ভরে উঠেছিল একঘেয়ে পরিবেশ থেকে একটু মুক্তি পাওয়ার আনন্দে।

চা খেয়ে এলাকায় একটু হাঁটতে বেরোয় সুজাত। গল্পকথায় যেরকম গ্রামের কথা শোনা যায় সে দেখে হরিশপুরও তারি ছায়া বহন করে।আরাধনার গেট দিয়ে বেরিয়েই ডান দিকে একটা বড়ো মাঠ বাচ্চারা খেলাধূলা করছে সেখানে। সুজাত দেখলো একদম শেষ প্রান্তে একটা বাচ্চা একা মাথা নিচু করে বসে আছে। কেমন যেন অন্যমনস্ক মনমরা। কাছে এগিয়ে গেল সে..

"তুমি খেলছোনা কেন খোকা?

ছলছল চোখে তাকালো বাচ্চাটা.. কিছু বললোনা। তবে তার পাশের জায়গাটা দেখিয়ে সুজাতকে বসতে বললো।।

বিস্মিত হল সুজাত তার কথা শুনে। একটু অবাকও হল তাকে বিশ্বাস করে কানু সব বলতে পেরেছে দেখে। কানুর খুব প্রিয় বন্ধু বিক্রম, দুজনে সারাক্ষণ একসাথেই খেলা করতো। গত পাঁচ দিন হল তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। থানায় জানানো হয়েছে এখন কোনো উপায় পাওয়া যায়নি। আরো চমক লাগলো সুজাতর শুনে যে কানুর ইঙ্গিত আরাধনার দিকে.. বিক্রম নাকি তাকে অনেকবার বলেছে আরাধনার ভিতরে ঢুকবার কথা। কানু রাজি হয়নি। যেইদিন থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছেনা সেইদিন কানু ছিলনা.... ও পাড়ার হারু তাকে ওইদিকেই যেতে দেখেছিল।।

সে একথা বড়দের বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছে কেউ পাত্তাই দেয়নি। যদি সুজাত তাকে সাহায্য করে।

বিশ্বাস সুজাতরও পুরোপুরি হলনা.. কেমন যেন বাচ্চার কল্পনা মনে হল.. কিন্তু মনে একটা দাগ থেকে গেল। আপাতত কানুকে ভেবে দেখবে কথা দিয়ে বাকি গ্রাম ঘুরে দেখবার উদ্দেশ্যে বেরোলো সাথী পেল কানুকে। কিছু সময়েই প্রায় তার ভক্ত হয়ে উঠল কানু হয়ত প্রথম কাউকে পেয়ে যে তার কথায় একটু হলেও গুরুত্ব দিয়েছে। সমস্ত জায়গা যতোটা পারে তাকে ঘুরিয়ে দেখালো কানু.. তাদের স্কুল.. বিপ্লব স্যারের ক্লাস.. বাঁশবনের ধারে পুকুরপারের আমগাছটা যেখানে তাদের সারাক্ষণ দাপাদাপি.. পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা.. পল্টুদের বাড়ির পাশে সেই গা ছমছমে বাগানবাড়িটা.. সবশেষে তার নিজের বাড়িতেও নিয়ে গেল। তার বাবা মা ও ছোট্ট বোন তিন্নি.. সকলের মুখেই অবাক বিস্ময় তার অসমবয়সী শহুরে বন্ধু দেখে। তবে যারপরনাই আদরযত্ন পেল সেখানে সুজাত।

ফিরবার পথে অরিন্দমের ফোন পেল.. সে জানালো পরেরদিন সকাল দশটা নাগাদ ঢুকে যাবে। আনন্দিত হল সুজাত তার প্রিয় বন্ধুর আগমন সংবাদে। মনের কথা গল্প সব মন খুলে করতে পারবে। অরিন্দম নামকরা ব্যবসায়ী রঞ্জিত রায়ের একমাত্র সন্তান। বরাবরি একটু জেদী চাকরীটার নাহলে তার করার দরকার ছিলনা। বাবার সাথে খুব বেশী তার জমেনা তাই হয়তো সুজাতর সাথে তার এতো ভাব হয়েছে।

রাতে খাওয়ার সময় কেন যেন সুজাতর বারবার দুপুরের ঘটনার কথা মনে পড়ছিল। একটা অস্বস্তি মনের মধ্যে লেগেই ছিল.. কানুর বা বিক্রমের কথা রামদীনকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করলোনা। কিছু না দেখতে পেয়েও তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিল অন্য কিছুর যা তার মন খুঁজে বের করার জন্য উদগ্রীব ছিল।।

খেয়ে উঠে সারা বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাইছিল সুজাত। রামদীন হল সঙ্গী। ঘুরে দেখতে গিয়ে সুজাত উপলব্ধি করল সত্যি বিরাট বাড়ি আরাধনা। তিনতলায় শেষের দুটো ঘর তালাবন্ধ.. কারণ জিজ্ঞেস করাতে জানা গেল পুরোনো জিনিসপত্র দিয়েই ভর্তি। আজকের মতো অনেক রাত হয়েছে সারাদিনের ধকলে ঘুমও পাচ্ছে.. নিচে এসে সুজাত ঘুমিয়ে পরাই স্থির করল।

রাত তখন কটা খেয়াল নেই প্রায় মাঝরাত.. হঠাৎ সুজাতর ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। গাটা যেন কেমন ছমছম করে উঠল.. ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত তখন তিনটে।

একটু যেন ঘেমেই গিয়েছে সে। একে জায়গাটা ঠান্ডা তায় পাখা চলছে এর তো কোনো কারণই খুঁজে পায়না সে। ঘরের মধ্যে একটু পায়চারি করে কি ভেবে বাইরে বেরোলো.. সাথে একটা টর্চ।শুনশান পরিবেশ.. কি ভেবে ছাদের দিকে পা বাড়ালো সুজাত। মাঝে তিনতলায় উঠে কি ভেবে ওই ঘরদুটোর দিকেই পা বাড়ায়.. কোথায় যেন কি গন্ডগোল এই ঘরদুটোর মধ্যেই আছে। হঠাৎ পিছন থেকে জামায় টান পরায় আঁৎকে ওঠে সে.. পিছনে কানু ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল..

ওদিকে যেওনা ওই দুটো ঘরে কিছু আছে.. সবাই বলে.. রাতে নানানরকম আওয়াজ শোনা যায়।

সুজাত বলে..

কানু আগে বল তুমি এখানে কি করে এলে??

পিছনের দরজা দিয়ে.. ওটা খোলা ছিল।

অবাক সুজাত মনে মনে ভাবে.. যে বাড়িতে একজন আর্দালি শুধু এতো বড় বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করে সে বাড়ির দরজা খোলা কেন থাকে।

কানুকে বলে..

ওসব বাজে কথা কিচ্ছু হবেনা.. তুমি এসো আমার সাথে।

প্রথম ঘরটায় একটা মাঝারি সাইজের তালা.. দুমিনিট দাঁড়িয়ে ভাবছে কি করা যায়.. একটা চেনা কন্ঠস্বরে বুক কেঁপে উঠল।

আরে মেট যে একেবারে শেষ দরজায় পৌঁছে গেছে.. কি বল রামদীন।

পিছনে রামদীন কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে..

আজ্ঞে কি করব কর্তা বাচ্চাটা যে হঠাৎ কেঁদে উঠল তাতেই ওনার সন্দেহ হয়ে গেল।

আর তোমরাও সব গাধা হয়েছ এক একটা। কটা বাচ্চা সামলাতে পারোনা। বাবাকে বলে সব বের করে দেব তোমাদের। ভেবেছিলাম কটা দিন একটু আনন্দ ফূর্তি করব মেটের সাথে তা আর কপালে নেই.. বাবা কি বলে দেখি সেরকম হলে এদের এখানেই সরিয়ে ফেলতে হবে....

বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে সুজাতর প্রাণের বন্ধু অরিন্দম।।

সুজাতর তখন বাকরোধ অবস্থা.. বন্ধুকে একদিন আগে আর এই অবস্থায় দেখে তার আর মুখে কথা সরছেনা।

অতো অবাক হয়ে কি দেখছো মেট.. কাল তুমি আসার অনেক আগেই আমি এখানে চলে আসি। আসতেই হয় মাঝেমাঝে অনেক ঝক্কির কাজ তো। কাজটা এই বেশী কিছু না জোগাড় দিনুই দেয় আমরা শুধু মাঝরাতে পাচার করে দিই বন্দরে আর সেখান থেকে বাইরে।

চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে থাকে সুজাত। হঠাৎ এদিক ওদিক তাকিয়ে কানুকে কোথাও দেখতে পায়না। এই তার বন্ধু অরিন্দম.. মজা করে তাকে সারাক্ষণ মেটই বলতো।

অরিন্দমও খেয়াল করল..

সাথে থাকা ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল.. এই খুদে শয়তানটা কোথায় গেল দেখ তো। এসো মেট তোমায় ততক্ষণ যেখানে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত ছিলে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি চলো। বলে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজাটা খুললো.. বিশাল বড়ো হলঘর মতোন চারদিকে প্রায় পঁচিশটা চাটাই মতোন পাতা। প্রত্যেকটায় একটা পাঁচ থেকে দশ বছরের বাচ্চা। সুজাত প্রস্তরমূর্তি.. বুঝতে পারে না বুঝে শুনে এখানে ঢুকে পড়ে কি ভুলই সে করেছে। কিন্তু কানু কোথায় গেল তাকে পেলেই বা এরা কি করবে কে জানে।

হঠাৎ বাইরে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায় আর রামদীনের আর্তনাদ..

আমি কিছু জানিনা স্যার আমায় ছেড়ে দিন.. আমি এসবের কিছুই জানিনা।

বাইরে এসে দেখল পুলিশে ছেয়ে গেছে পুরো আরাধনা.. হতভম্ব সুজাত বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে অরিন্দম.. কি করে কি করে জানতে পারলো পুলিশ....??

কানু আর কে। সে যখন রাতে আরাধনায় আসে বন্ধুদের বলেই রেখেছিল কিছুক্ষণের মধ্যে সে যদি না ফেরে তারা যেন তার বাবা মাকে নিয়ে পুলিশের কাছে যায়। দেখলো কানু হাসিমুখে তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আর থানার ওসি বিমলবাবু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সুজাতকে দেখে বললেন..

ধন্যি আপনার সাহস.. এরকম কান্ডের মধ্যে দুইদিন কাটিয়ে দিলেন.. আপনার আর কানুর সাহসের জন্যই এতো বড়ো কান্ড ধরা পড়ল। রঞ্জিত রায় বহুদিন থেকে এই ব্যবসায়.. বাইরে অন্য ব্যবসার আড়ালে এই ব্যবসা করছে বহুদিন। প্রমাণের অভাবে কোনোদিনই ধরা যায়নি। বাচ্চাগুলোকে রাখার জায়গাটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলোনা।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সুজাত। কখনো ভাবেনি বেড়াতে এসে এইরকম অভিজ্ঞতা হবে.. সেইদিনই ফিরে যাবে ভাবছিল। কানু ছাড়লোনা.. তার বন্ধু বিক্রমের অবস্থা ভাল নয়.. এতোদিন এভাবে ওষুধ খাইয়ে বন্ধ করে রেখেছিল। তাকেও অন্য বাচ্চাদের সাথে শহরে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তার খুব মনখারাপ তাই সুজাতকে সে কোনোমতেই ছাড়লোনা.. তার বাড়িতে নিয়ে গেল। সুজাতও ভাবলো মন্দ না.. গ্রামটা প্রায় সেভাবে ঘুরে দেখাই হয়নি। তাই আরাধনাকে বিদায় জানিয়ে কানুর হাত ধরে রওনা হয়ে পড়লো সুজাত।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama