আমি সাগরের বেলা 8
আমি সাগরের বেলা 8
“আচ্ছা, তোমার ওই আড়াই বছরের কুকুর ছানাটার নাম কি...?”
রাতের খাবার এসে গেছিলো। তন্দুরি রুটি, ডিম তড়কা আর খাসির মাংস। বাংলার বাইরে গিয়ে বাংলা খাবার পেলে, সে যেন আর শতসহস্র গুন সুস্বাদু লাগে! শুভদীপ বেশ তৃপ্তি করেই খাচ্ছিল। দেখে মনে হোল বেশ অনেকক্ষণ অভুক্ত। কখন থেকে এই মারাত্মক পরিকল্পনাটার পিছনে পরে ছিল কে জানে। কথাবার্তা শুনে বুঝলাম সঙ্গে জিনিষ পত্তর যা ছিল, সেগুলো ওর সাথে সাথেই সলিল সমাধির পথে গমন করেছিল। ফোনটা পর্যন্ত নেই। কথা স্থির হোল আমার সাথেই কাল সকালে ও কলকাতার পথে রওনা হবে। আমি লিলুয়া নেমে যাবো, ও হাওড়া হয়ে বাড়ির দিকে বেরিয়ে যাবে। কয়েকবার আক্ষেপ করে বলল, যদি ফোনটা থাকত, কথাবার্তা বলে একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করতে পারত। কলকাতা ফিরে আমার যা যা উপড়ি খরচা হচ্ছে ওর জন্য, সেগুলো সব মিটিয়ে দেবে বলে আমার ফোন নম্বর টাও নিয়ে নিল। আমি আপত্তি করলাম না। সাধারণ আই টির চাকরি করে, সংসার চালিয়ে খুব বেশি জনকল্যানের জন্য ফান্ড যে বাঁচে না, সেটা বলাই বাহুল্য।
“রুমি।“ খেতে খেতেই জবাব দিলো শুভদীপ, “অনুই ওকে এনেছিল। আমাদের সন্তান ছিল না, তাই নিজের একাকীত্ব কাটানোর জন্যই রুমিকে কিনে নিয়ে চলে এসেছিল একদিন। খুব খামখেয়ালি গোছের স্বভাব ছিল ওর। এরকম যখন তখন যা কিছুর ভূত চাপত ওর মাথায়।“
আমাদের খাওয়া শেষ হলে আমি একটা সিগারেট ধরালাম। শুভদীপের দিকেও একটা এগিয়ে দিলাম। সে মাথা নাড়ল।
“ছেড়ে দিয়েছি কয়েক বছর হোল।“
আমি ঘরে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। শুভদীপ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনছিল। যান্ত্রিক সভ্যতার যে জাল আমাদের থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিস্তীর্ণ হয়ে আছে, সেই মুহূর্তে সেটাকে যেন মিথ্যে মনে হচ্ছিল। মানুষ যতই উন্নতি করুক, জীবনের পথে যে চিরন্তন মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপের মধ্যে দিয়ে সে যায়, তার প্রতি সকল যুগেই তার প্রতিক্রিয়া সমানই হয়। কাছের মানুষকে হারানোর বেদনার উপশম হয়না। মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সেই অভাববোধটার সাথে। যেমন আমিও হয়ে পড়েছিলাম আজ থেকে পনের বছর আগে...
নিনি আর আমি এক স্কুলে পড়তাম। নিনি আমার থেকে কয়েক বছরের ছোটই ছিল। ওর বাবা ছিল কলকাতার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম। আমি ছিলাম সরকারি কেরানির ঘরের ছেলে। নিনি ছিল স্কুলের সকল ছেলের চোখের মণি। আর আমি কি ছিলাম সেই সময়, তা নিয়ে ভাবার মাথাব্যাথা কারুর ছিল না। তা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হবে কেন? একদমই স্বাভাবিক প্রশ্ন। আসলে বন্ধুত্ব ছিল না। স্কুলে পড়া কালীন মুখ দেখাদেখির ঊর্ধ্বে খুব একটা কিছুই ছিল না। আসল ব্যাপার ঘটে যখন আমি কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে। ফেসবুক বলে বস্তুটি সবে বাজারে এসেছে। বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম, যে আমি... সারা একুশ বছরের জিবনে একুশটা বন্ধুও জুটিয়ে উঠতে পারি নি... সেই আমার ফেসবুক খোলা মাত্রই শখানেক বন্ধু হয়ে গেলো! আর তাদের মধ্যে একজন নিনি।