Debdutta Banerjee

Drama

3  

Debdutta Banerjee

Drama

আলোর পরশ

আলোর পরশ

4 mins
1.9K


রাতের আঁধারে হিমালয়ের সুউচ্চ বরফের শৃঙ্গ গুলিকে অতিকায় দৈত্যর মত মনে হয়। আজ অমাবস্যা, একটা হালকা কালো চাদরে কেউ মুড়ে দিয়েছে রাতের আকাশ, মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে তারার দল। কিন্তু লাদাখের প্রত্যন্ত গ্ৰামটিতে দাঁড়িয়ে পরশ দেখে হাজার জোনাকির মত আশেপাশের পাহাড়ি গ্ৰাম গুলোতে ঝিকমিক করছে বিন্দু বিন্দু আলো। দু হাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে ও বলে ওঠে -''আমি পেরেছি, দেখো দাদু, আমি কথা রেখেছি। পাহাড়ের বুকে জ্বালাতে পেরেছি আশার আলো। ''

পরশ বড় হয়েছে জম্বু কাশ্মীরের পাহাড়ি এলাকায়, বাবা মিলিটারিতে থাকায় দেশপ্রেমের সাধারণ পাঠ শিখেছিল বাড়িতেই। পরশ স্কুল শেষে কি করবে, বড় হয়ে ঠিক কি হবে কিছুই ভাবেনি তখনো। বাবা বলতেন 'এমন কিছু করো যা দেশের কাজে লাগবে, মানুষের উপকারে আসবে, সবাই তোমায় মনে রাখবে।'

পরশ জানতো না সেটা ঠিক কী? হেসে খেলে আর পাঁচটা বাচ্চার মত বড় হচ্ছিল ও। কয়েক বছর আগে স্কুলের পরীক্ষা শেষে কলেজে ভর্তির আগে প্রাণের বন্ধুর সাথে ঘুরতে এসেছিল লাদাখের ‘সুমদা চেনমো’ ওদের গ্ৰামের বাড়ি । প্রায় দুদিন ট্রেক করে ১৩০০০ ফিট উচ্চতায় লাদাখের প্রত্যন্ত এলাকায় ছবির মত সুন্দর এই গ্ৰামে পৌঁছেছিল ওরা। দু হাজার বছর আগে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল এই গ্ৰামে, কিন্তু প্রকৃতির প্রতিবন্ধকতায় যাতায়াত ব্যবস্থার প্রতিকূলতায় উন্নত সভ্যতার থেকে পিছিয়ে পড়েছিল এই গ্ৰাম ধীরে ধীরে। দু হাজার বছরেও আধুনিক সভ্যতার আলো স্পর্শ করতে পারেনি এই গ্ৰামকে। দিনের আলো নিভে গেলেই গভীর অন্ধকারে ডুবে যায় গ্ৰামটি। বাধ্য হয়েই জন জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। এই প্রখর ঠাণ্ডায় এরা জানে না হিটারের ব্যবহার। গিজার বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক গেজেট তো দূর কৃত্রিম আলোই নেই এ গ্ৰামে। খুব অবাক হয়েছিল পরশ। সারাটা জীবন মানুষ গুলো এই অন্ধকারেই কাটিয়ে দিল!! ফোন টিভি তো দূর অন্ধকার নামলেই ঘুমিয়ে পড়ত গ্রামের লোক।

বন্ধুর দাদু বলেছিলেন -''এমন বহু গ্ৰাম রয়েছে লাদাখে। এ দেবভূমির বহু লোক বাল্ব বা কৃত্রিম আলো চোখেই দেখেনি। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষ কষ্ট করছে এখানে। জানি না এ পাহাড়ের বুকে কখনো আলো জ্বলবে কি না। ''

এরপর ফিরে ধীরে ধীরে ঘটনাটা স্মৃতির অতলে হারিয়েই গেছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে পরশ গুরগাঁওয়ে একটি মাল্টি ন্যাশনালে কাজও করেছিল কিছু দিন। কিন্তু তার মনের খিদে মেটাতে পারছিল না সেই ছাপোষা চাকরি। বাবার কথাটা মনে পড়ত, কি করলো সে দেশের জন্য!!

সেবার একটা সামান্য কেবল ফলট থেকে টানা দুদিন লোডশেডিংএ বিপর্যস্ত শহুরে জীবন, বিরক্ত লাগছিল পরশের। বোরিং জীবন, কোন কাজ করতে পারছিল না, মোবাইলে চার্জ শেষ। আঠার তলার বারান্দা থেকে অন্ধকারে মোড়া সারা শহরকে দেখে বহু দিন পর মনে পড়েছিল লাদাখের কথা। লোক গুলো সারা জীবন জানল না কৃত্রিম আলোর কথা। আর সে দুদিনেই বিরক্ত।

হঠাৎ কি যেন মনে হল, সে যদি আলো পৌঁছে দেয় ওখানে!! পারবে কি? না পারলে এত পড়াশোনা সব কিসের জন্য!! পরদিন চাকরিতে ইস্তফাই দিয়ে দিয়েছিল পরশ লুম্বা। হঠাৎ করে নিজের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছিল পরশ। সে বয়ে আনবে আলোর পরশ, রাতের পাহাড়কে সাজাবে নিজে হাতে। আরেকবার এসেছিল লাদাখের এক গ্ৰামে, পর্যটন শিল্প ধীরে ধীরে ডানা মেললেও রাতের আঁধার দূর হয়নি এই সব গ্ৰামের থেকে। আগুন ছাড়া আর কোনও শক্তির উৎস নেই। সেদিন রাতে ঐ অন্ধকার শীতল মরু পাহাড়ের মাঝে বসে বহু বছর আগে বলা দাদুর কথাটা বার বার মনে পড়েছিল সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছেলেটির।

কিন্তু ভাবা যতটা সহজ কাজটা ছিল ততটাই কঠিন। কারণ এই সব গ্ৰাম গুলোতে গাড়ি চলাচল করে না, হাটা পথে যেতে হয়। দুর্গম রাস্তায় ভারি যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া কষ্টকর। তবুও হাল ছাড়েনি পরশ। দুই বন্ধুকে নিয়ে সোলার প্যানেল সহ পরশ চলে গেছিল লাদাখের জাঁসকারে। পাদুমের কাছে ফুকতাল গুম্ফা নামের একটা ছোট্ট গুম্ফায় সোলার মাইক্রো গ্রিডস ইন্সটল করেছিল ওরা৷ ঝলমল করে উঠেছিল শতাব্দী প্রাচীন গুম্ফা, দেবতার বাসভূমি। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি পরশ। ততদিনে পাশে পেয়েছে দুই বন্ধু বরুণ আর জয়দীপকে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্ৰামে দিনের পর দিন পায়ে হেটে ওরা তিনজন পৌঁছে গেছিল আলোর রোশনাই নিয়ে। পথ বন্ধুর, পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি, কিন্তু কিছুই আটকাতে পারেনি পরশকে। সরকার যে সব গ্ৰামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে অপারগ পরশ পৌঁছে গেছিল সৌর আলোর পরশ নিয়ে। ট্রেক করে একের পর এক গ্রামে জ্বালিয়েছে সৌর আলো। আস্তে আস্তে এসেছে বিদেশি সাহায্য। গুগল ম্যাপেও অস্তিত্ব নেই যেই সব গ্ৰামের সেসব গ্রামগুলির দায়িত্ব নিয়েছে এই গ্লোবাল ইন্ডিয়া এক্সপিডিশন প্রকল্।একে একে বেশ কিছু দেশ এগিয়ে এসেছে ওদের সাহায্য করতে।

বদলে গিয়েছিল ছেলেটার জীবন। বদলে দিয়েছিল ও পাহাড়ের লোকেদের জীবনধারা। লে থেকে ৪২০ কিমি দূরে দুর্গম পাহাড়ি গ্ৰাম শাদেতে আলো জ্বালিয়েছে পরশের টিম। হাজার বলিরেখায় চামড়া কুঁচকে গেছে এমন বৃদ্ধ বৃদ্ধার চোখে আলো জ্বলেছে অবশেষে, মুখে ফুটেছে হাসি। হাসি ফুটেছে ওর বাবা মায়ের মুখে। পাহাড়ের অন্ধকার আচ্ছন্ন কুয়াশা ঘেরা দুর্গম অঞ্চলের দিকে তাকিয়ে পরশ বলে ওঠে -''আমরা আসছি, তোমাদের জন্য আলোর বন্যা নিয়ে আমরা আসবো খুব তাড়াতাড়ি। কোনও দুর্গমতা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা আমাদের পথের বাঁধা হবে না। এভাবেই পথ খুঁজে এগিয়ে যাবো আমরা। ''


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama