Sayandipa সায়নদীপা

Drama

0.6  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

আকাশচুম্বী

আকাশচুম্বী

4 mins
1.1K


দিদানকে যখন ওরা শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল তখন গির্জার বিকেলের ঘন্টাটা ঠিক এইভাবেই বেজে উঠেছিল ঢং ঢং করে। বৈভবকে শ্মশানে যেতে দেয়নি মামারা, পারত পক্ষে দিদান চলে যাওয়ার পর দিদানের নিথর দেহটার কাছেও ওরা ঘেঁষতে দেয়নি ওকে। বৈভব জানে ওরা ভয় পেয়েছিল, ভয় আগেও পেতো কিন্তু ওই মুহূর্তে আরও বেশি করে পেয়েছিল। পাছে দিদানের মুখাগ্নি করার অধিকার চেয়ে বসে ও…! পাছে সেই আছিলায় আরও বেশি কিছু চেয়ে বসে ও…!


  মা নিজের ইচ্ছেয় পালিয়ে বিয়ে করেছিল; বৈভবের অটো চালক বাবাকে দিদান মেনে নেয়নি কোনোদিন। লোকে বলে একটা বাচ্চা হয়ে গেলে নাকি সবাই মেনে নেয়, দিদান বাচ্চাটাকে মেনেছিল কিন্তু বাবাকে নয়। মাকেও দিদান ক্ষমা করেনি কোনোদিনও, তবুও নিশ্চয় মনের সঙ্গোপনে লুকিয়ে থাকা মাতৃ সত্তাটাকে অস্বীকার করতে পারেননি বলেই হয়তো মায়ের কাছ থেকে ছোট্ট বৈভবকে নিয়ে চলে এসেছিলেন দিদান। মানুষ করছিলেন নিজের মত করে, নাম দিয়েছিলেন বৈভব। দিদানের সাহচর্যে অভাব জিনিসটা কোনদিনও অনুভব করতে পারেনি ও, বরং কখনও কখনও ছুটিছাটায় মা বাবার কাছে গেলে দমবন্ধ হয়ে আসতো ওর। ওই টুকু ঘুপচি ঘরে গাদাগাদি করে থাকা, খাবার দাবার দেখলেও গা গুলোতো বৈভবের, দু তিন দিন কোনোমতে কাটিয়েই পালিয়ে আসতো দিদানের কাছে। বৈভব বেশ বুঝতো মায়ের অসহায়তাটা, কিন্তু ফিরে আসার মুখ ছিলো না মায়ের তাই কোনদিনও ওই দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্তি পায়নি মা। অবাক লাগতো বৈভবের… সবাই তো আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে, যে যেখানে থাকে তার থেকে উঁচুতে আরও উঁচুতে উঠতে চায় কিন্তু মা কেমন করে সিঁড়ি ধরে স্বেচ্ছায় নীচে নেমেছিলেন অতখানি! বাবা কিন্তু সিঁড়ি ধরে ওপরেই উঠতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বোঝেননি সিঁড়িটাই অমন ভেঙে পড়বে হুড়মুড়িয়ে। বৈভব বাড়ি গেলে বাবা ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করতো ঠিকই কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর থেকে মায়ের শরীরের কালসিটে গুলো দেখে বেশ বুঝতো সিঁড়ির ওপর নিজের হতাশাটা বাবা দিব্যি ঝাড়েন রোজ। নতুন সিঁড়ি তৈরির চেষ্টায় মগ্ন বাবা বৈভকে খাতির করতেন খুব। সবই বুঝতো বৈভব। 


  এসবের মাঝখান থেকেই দিদান আচমকা চলে গেলেন একদিন, কাউকে লাভবান করে আর কাউকে পথে বসিয়ে। মামারা খুশি হয়েছিল খুব কিন্তু অন্যদিকে বৈভব প্রাসাদ থেকে এসে পড়েছিল পথে। মামারা আর থাকতে দেয়নি ওকে, বাবার বাড়িতে এসে থাকতে পারেনি বৈভব নিজে। ওই এক কামরার ঘরটাকে বৈভবের মনে হত ঠিক যেন একটা কফিন যে কফিনে করে দিদানের বাড়ির কাছের গির্জার পেছনে মৃতদেহগুলো বন্দি থাকতো। বৈভবের মনে হত জীবিত অবস্থাতেই সে বন্দি কফিনে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হত, দমবন্ধ হয়ে আসতো। সতেরো বছর বয়সেই বৈভব জানতো তাকে বেরোতে হবে এই কফিন থেকে, যে কোনো ভাবেই হোক একটা সিঁড়ি খুঁজে পেতে হবে আকাশ ছোঁয়ার। বাবার রক্ত বইছিল তার শরীরে। সবাই বলে রক্ত কথা বলে, বাবার মতোই বৈভবও চেয়েছিল চটজলদি একটা সিঁড়ি পেতে যা দিয়ে সোজা আকাশের কাছে পৌঁছাতে পারে সে, কিংবা উঠতে পারে আকাশের চেয়েও উঁচুতে। তবে সে জানতো বাবার মত নড়বড়ে সিঁড়ি ধরলে হবে না, চাই একটা শক্ত সিঁড়ি।


  কথায় আছে না যে খায় চিনি যোগায় চিন্তামণি। কলেজে ঢুকতে না ঢুকতেই বৈভবের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল হ্যারির। হ্যারিই সন্ধান দিয়েছিল বাড়িতে বসেই অনেক রোজগার করার এক সহজ পন্থার। নিজের আগের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পেতে বৈভবের দরকার ছিলো অনেক অনেক টাকার, তাই প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছিল সে। যদিও মনে মনে সন্দেহ ছিল অনেকখানি তাও আকাশ ছোঁয়ার লোভ যে বড় মারাত্মক। হ্যারি বলেছিল কাজটা নাকি কল সেন্টার জবের মত অনেকটা, তবে পার্থক্য হল এখানে ফোনের পরিবর্তে ম্যাসেজের মাধ্যমে কাস্টমারদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। ল্যাপটপটা দিদানই বেঁচে থাকতে কিনে দিয়েছিলেন, সেটা দিয়েই ওপর ওয়ালাদের নির্দেশ মত অনলাইনে ম্যাসেজ আদান প্রদানের কাজ করতো বৈভব। কোড ল্যাঙ্গুয়েজে লেখা ম্যাসেজের অর্ধেক মানে বুঝতো না বৈভব। মনটা মাঝেমাঝে খচখচ করে উঠতো কিন্তু মাস গেলেই মোটা টাকাটা যখন একাউন্টে এসে ঢুকতো তখন মনের সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব এক লহমায় দূর হয়ে যেত। বছরখানেক এভাবেই বেশ চলেছিল কিন্তু তারপর আচমকা একদিন…


  পুলিশ বাড়িতে ঢুকতেই পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে ছিল বৈভব, সোজা এসে পৌঁছেছিল হ্যারির আস্তানায়। হ্যারির সাহায্যে ওর দেওয়া এই ব্যাগটা নিয়ে এই গির্জায় চলে এসেছিল সে, কথা ছিল ওদের কোম্পানির কেউ ওকে ওখান থেকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেবে কোনো নিরাপদ জায়গায়। সেখানে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে, তারপর এদিকে পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার দেখা যাবে নাহয়। বৈভব বুঝেছিল এক গভীর চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছে সে যেখান থেকে বেরোবার পথ ওর জানা নেই। তাই ওদের নির্দেশ অমান্য করার উপায় ছিলো না তার। সেই মতো গির্জার সামনে অপেক্ষা করছিল সে। গির্জার ভেতরে তখন প্রার্থনার জন্য ভীড়, সামনের বাজারে তখন রবিবারের সরগম; একটা গাড়ি মাইক নিয়ে নতুন বিউটি পার্লারের প্রচারে পঞ্চমুখ, অন্যদিকে বাসে নিত্যদিন “সফল হওয়ার ১০১ টি কৌশল” বেচা হকারটা ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে রাস্তার ট্যাপ তেষ্টা মেটাতে ব্যস্ত; একটা বাচ্চা খেলনা কিনে দেওয়ার বায়নায় মায়ের হাত টেনে প্রায় শুয়েই পড়ল মাটিতে, আর তখনই বৈভবের মনে হল ওর খুব কাছেই কোথাও যেন একটা বিপ করে আওয়াজ হল। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুম করে একটা শব্দ, চারিদিক কালো ধোঁয়ায় ধূমায়িত…


   বৈভব খুব সহজে আকাশটাকে ছুঁতে চেয়েছিল।


                               শেষ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama