আবার দেখা হবে
আবার দেখা হবে


বহুদিন পরে বিষ্ণুপুরে ফিরছে প্রমিত।সেই বসন্তকাল,দখিনা বাতাসে প্রেমের ছোঁয়া,ফুটে উঠেছে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া শাশ্বত প্রেমের বার্তা নিয়ে,বাতাসে ভাসছে মহুয়ার মন মাতাল করা গন্ধ,পলাশ যেন ঋতুরাজের আগমনী বার্তা নিয়ে প্রকৃতিতে প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই লালমাটির দেশে শাল সেগুন শিমূল বনে ভরা প্রকৃতি আজ প্রেমের গান গাইছে।
মেঘমুক্ত সুনীল আকাশ আর দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের কূজনে যেন কামনার সঙ্গীত বেজে উঠেছে। এই সময়টাই প্রেমিকদের সময়,প্রেমের সময়,বিরহীদের প্রেমিকাকে মনে করার সময়।তাই তো মহাকবি কালিদাসের প্রেমের উপন্যাস তা সে 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম' হোক বা 'মালবিকাগ্নিমিত্রম'-তাতে আছে এই ঋতুরাজ বসন্তের অপার সৌন্দর্যের কথা। প্রমিত ভেসে গেল প্রিয়াঙ্কার চিন্তায়। সেই প্রিয়াঙ্কা যাকে সে প্রথম দেখেছিল মাধ্যমিকের টিউশন ব্যাচে।সেদিন যখন দুই লাজুক চোখ এক হয়েছিল সেই সময়টাও তো বসন্তকাল ছিল না-দূর থেকে কোকিল ডাকছিল।বিকেলবেলা। রোদ পড়ে আসছিল। এক দু দিন আগেই হয়ে গিয়েছিল হোলি। প্রিয়াঙ্কার চন্দ্রালোকিত মুখমণ্ডল থেকে সেই আবিরের রক্তিম আভা তখনও অদৃশ্য হয় নি।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে সেই রক্তিম মুখমণ্ডল অপূর্ব লাগছিল। এরপর প্রিয়াঙ্কার সাথে দেখা হয় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। লাল মাটির দেশে,শাল মহুয়ার সন্নিবিড় ছায়ায় একসাথে সময় কাটানো,প্রথমবারের জন্য ঘনিষ্ট হয়েছিল দুটি মন। আজও ভুলতে পারে না প্রমিত বসন্ত উৎসবের সেই শিহরণের কথা। যখন সে আর প্রিয়াঙ্কা একে অপরকে রঙ মাখিয়ে দিয়েছিল। প্রথমবারের জন্য অনুভব করেছিল প্রিয়াঙ্কার শরীরের উষ্ণ ছোঁয়া।অনুভূতির বন্যা নেমেছিল শরীরে। থেমে গিয়েছিল সময়। বইছে বসন্তের দখিনা হাওয়া। হঠাৎই কি মনে হতে,আবির আঙুলে করিয়ে পরিয়ে দিয়েছিল প্রিয়াঙ্কার কপালে । নির্নিমেষ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে ছিল প্রিয়াঙ্কা। এটা কি ছিল-ক্ষণিকের প্রগলভতা নয় তো চিরন্তন প্রেমের কথা বলা।
হয় তো প্রিয়াঙ্কা বুঝতে পেরেছিল,কিন্তু প্রেমের কথা বলা তখনোও হয় নি। আর সেই প্রেমকে কখনোই আর প্রকাশ করা হল না। হৃদয়ের কথা হৃদয়েই থেকে গেল। সেদিনের লাল পাড়ের হলুদ শাড়ীতে আবির মাখা প্রিয়াঙ্কাকে অপূর্ব লাগছিল,যেন বনের চঞ্চল হরিণী। এখনোও যখন প্রমিত নিদ্রার জন্য নয়ন বন্ধ করে,প্রমিতের চোখে প্রিয়াঙ্কার ঐ অপূর্ব অপরূপ রূপই ভেসে ওঠে। দেখা হয় না,মাঝে মাঝে কথা হয়। তাও আজ প্রিয়াঙ্কা প্রমিতের স্বপনচারিণী। এই তো টেরাকোটার শহর ছাড়িয়ে মল্লভূমের লাল মাটির ধূলোওড়া পথ এসে গেছে। প্রিয়াঙ্কা প্রেমের প্রভা আজও প্রমিতের মনে প্রতিভাত।
শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় থেকেই টুকটাক কবিতা লিখত প্রমিত। কিন্তু তার ভাষার বর্ণন ও ছন্দের বুনটে মুগ্ধ ছিল অনেকেই। প্রিয়াঙ্কা একটা কথা তাকে বলেছিল,"আর তুই যাই করিস,এই লেখালেখিটা কিন্তু ছাড়িস না-দেখবি একদিন তুই অনেক দূর যেতে পারবি।যাই হয়ে যাক,এটাকে চালিয়ে যাস।" বিরহী কোকিলটা দূরে ডেকেই চলছে। রোদ পড়ে আসছে। কয়েকজন দেহাতী লোক ট্রাক্টর নিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছে। একটু পরেই পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে আবিরের ছোঁয়া। হয়তো প্রিয়াঙ্কা আজ বিবাহিতা,প্রিয়াঙ্কা আজ অন্য কারোও। তাও ভালোবাসা মৃত্যুহীন। প্রিয়াঙ্কার প্রতি তার আগেও যেমন ভালোবাসা ছিল,তেমন ভালোবাসা আমৃত্যু থেকেই যাবে। হয়তো প্রিয়াঙ্কার থেকে আজ বেশি খুশি কেউ নয়।
লেখালেখির জন্য প্রমিত সারা দেশ জুড়ে নাম করেছে। আজই রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। সব ভালোবাসার অনুভূতিরা পাবার জন্য নয়। আজ পলাশ প্রেমের গান গাইছে। রাস্তার দুপাশে ধু ধু মাঠ। প্রমিত ফিরছে ঢ্যাঙারতলা গ্রাম,তার নিজের দেশের বাড়ি। কতোদিন পর মায়ের হাতের রান্না খেতে পারবে! প্রিয়াঙ্কার উদ্দেশ্যে প্রমিত বলে উঠল,"আবিরের রাঙা পরশ মাখিয়ে দিয়েছিলে কথা একদিন/ বন্ধু হয়ে রবে মনে আমার তুমি চিরদিন।" এবার এক নিঃসঙ্গ নয়,কুহু কুহো করে ডেকে উঠল কোকিলযুগল।মিষ্টি দখিনা হাওয়া হয়তো বা প্রেমের দূত হয়ে এই কথা নিয়ে গেল নিঃসঙ্গ বাতায়নে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়াঙ্কার কাছে।হয়তো বা নিঃশব্দে নিয়ন্তাও বলে উঠল,"আবার দেখা হবে!"