উত্তাল হয় উতলা এই মনটাও
উত্তাল হয় উতলা এই মনটাও


সাদা-নীল সামিয়ানার নীচে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা।
ছোট ছোট ছেলেমেয়ের হাতে রঙ তুলি আর আমি বৃদ্ধ বিচারক...
অপেক্ষায়। আবার কোন নতুন প্রতিভা উঠে আসবে,
কিংবা হয়তো বা কোন মুক্তিযোদ্ধা...
ঠিক তোমারই মতো...। বন্ধু সুলেমান।
দূরে সবুজ এবড়ো-খেবড়ো পাহাতার কোলে সূর্য্য ঢলছে,
সামনে ছড়ানো চায়ের বাগানের ভিতর দিয়ে
পথগুলি এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে...
আর্টপেপারের উপর মোম রঙে আঁকা
ছবিটা ছিল জীবন্ত, চিরসবুজ।
দেখে চঞ্চল মন ছুটে গেল...
সাতচল্লিশ বছর আগের সেই দিনটায়তুমি,
আমি দুজনেই ছিলাম বড়ো অবুঝ।
চোখের সামনে ছিল শিলং-এর সবুজাভ পর্বতমালা
পায়ের নীচে ছিল কাঁকড় বিছানো রাস্তা
আমি ও তুমি দাঁড়িয়েছিলাম পাশাপাশি
তুমি বলে উঠলে, “কি সুন্দর...তাই না...?”
আমি বিমোহিত শিলঙের সুন্দরতায়,
আমি আপ্লুত তোমার আতিথেয়তায়।
অস্ফুটে বলেছিলাম,
“অপূর্ব...! সুলেমান, আমি কৃতজ্ঞ... তোমার কাছে...”
“কেন বলোতো...এত সৌজন্যের কি খুব প্রয়োজন আছে?”
তুমি মৃদু বকা দিয়েছিলে। আমি হেসেছিলাম।
“এই চাকরীটা না যদি করিয়ে দিতে,
এত সুন্দর দেশটা যে দেখাই হত না...
তোমার কাছে, আমার থাকাই হতো না...”
“তুমিই ছিলে যোগ্যতম প্রতিযোগী...
আমি তো সুপারিশ করেছি মাত্র...”
মৃদু হাসি ছলকে দিয়ে বলেছিলে।
“সে তুমি যাই বল না কেন...
আমি ভাই কলকাতার মানুষ
ইট-কংক্রিটের জঙ্গলে উঠেছিলাম হাঁপিয়ে...
এখানে ভাগ্যিস এলাম,
তাই প্রাণ ফিরে পেলাম...”
শুনে তুমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলে।
আমার জন্যে তোমার ভাবনা,
সেই শুরুর দিন থেকেই,
যখন ছিলাম আমরা একসঙ্গে,
বোর্ডিংএর ঐ স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটায়।
সদ্য মা-হারা ছেলেটি লুকিয়ে কেঁদেছিল,
তুমি তাকে বুকে টেনে নিয়েছিলে,
সেইদিন থেকেই আমার পরম বন্ধু হয়েছিলে।
কলেজের দিনগুলি কাটছিল বেশ
গলির মোড়ে, লুকিয়ে ,দাঁড়িয়ে
একটা সিগারেট ভাগ করে টানার সেই প্রথম আবেশ,
ধরা পড়লাম আমি আর শাস্তি হল তোমার
তোমার হাতে কালশিটের দাগ মিলিয়ে যায় নি...
ইউনিভারসিটিতে হঠাৎ আমার বসন্তের ছোঁয়াচে
তোমার সেবার পরীক্ষাই দেওয়া হয় নি...
তবুও তোমার মুখের সেই ঝলমলে হাসি
কখনো ফুরিয়ে যেতে দাও নি।
আমাকে কখনো তুমি একলা ফেলে যাও নি।
জানি, আমায় কাঁদতে দিতে চাও নি।
কিন্তু সেদিন সেই কুয়াশা ভেজানো বিকেলবেলায
আমার চোখে জলের বান ডাকালে
যখন আমায় অবাক করে জানালে,
“বন্ধু...এবার যে আমার বিদায় নেওয়ার পালা...”
“মানে...? আমায় ছেড়ে চলে যাবে?“
"মুক্তি যুদ্ধের ডাক এসেছে...যেতেই হবে।
আমার বাংলাকে যে স্বাধীন করতে হবে...
আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি...”
অন্তরটা কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়
তবুও সাহস জুগিয়েছিলাম, বলেছিলাম,
“ব্রাভো...সাবাস! বন্ধু সাবাস!...
তুমি বীর, তুমি দেশপ্রেমিক,
আমি তোমার পাশেই আছি...”
তুমি আত্মহারা হয়েছিলে, বলেছিলে,
“জানি, তুমি আছো পাশে আমার,
ইন্দিরাজী আছেন সাথে, মুজিবর রহমানের
সেটাই তো বড়ো ভরসা..
.বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হবে স্বাধীন...
সেই স্বপ্নেই বিভোর হয়ে আছি।”
ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের জন্যে লড়েছিল...
শতকোটি ভারতবাসী ‘দোয়া’ জানিয়েছিল..
তুমিও এগিয়ে গিয়েছিলে..বীরদর্পে যুদ্ধ করেছিলে।
তবে, সেদিন তোমার চোখেও দেখেছিলাম
বিদায় যাতনার অশ্রুবিন্দু...বাকরুদ্ধ স্বরে বলেছিলে,
“বিদায় রাজ...জানিনা...আর দেখা হবে কিনা...কোনদিন...”
আমার চোখেও ছিল জল,
তবুও মুখে হাসি ধরে রেখেছিলাম,
আমি বলেছিলাম,
“বন্ধু...এমন শুভ লগ্নে চোখের জল ফেলো না...
পিছন ফিরে আর তাকিও না...
স্বাধীনতার যুদ্ধটা তোমরা জিতে নেবেই...
বিশ্বমাঝে বাঙালীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হবেই...”
তারপর...দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছিলাম...
সূর্য্য’টা তখন পাহাড়ের কোলে অস্ত যাচ্ছিল,
মাথার উপরের নীল আকাশটা তখন
বিপ্লবের রক্তিমতায় লাল হয়ে গিয়েছিল।
অন্তর থেকে অন্তর দিয়ে ভালবাসা ছড়িয়েছিলাম
সমস্বরে বলেছিলাম,“জয় বাংলা...”
“তোমার যাত্রা শুভ হোক...!”
তুমি চলে যেতেই ঝুপ করে
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছিল।
সেই আঁধারে আমি একাই পথ হেঁটেছিলাম।
পথের ধারে মাইল ফলকে লেখা ছিল,
“সিলেট:৪৬ মাইল’’। আমি একদৃষ্টে দেখছিলাম।
আর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে...
বন্ধু, আর তো ফিরে আসো নি...
বুকে জড়িয়ে ধরে আবার ভালবাসো নি...
তবুও তোমার বন্ধুত্ব রয়েছে মনের মণিকোঠায়...
আর তোমার-আমার সেই সাদা-কালো ছবিটা
রেখেছি মেহগনি কাঠের বাক্সে, চিলেকোঠায়।
স্মৃতির আবর্তে ঘুরে মরি এই শেষবেলায়
যখন আমি সত্তরে, সূর্যের ম্লান আলোয়...
আমি রাজনারায়ন, প্রিয়তম বন্ধুর ছবিটা
বুকে ধরে দাঁড়িয়ে পরম তৃপ্তিতে বলে উঠি...
“সুলেমান, আমরা তোমায় ভুলি নি...ভুলতে পারি না...।
ধরো আবার যদি কখনো এই বিশ্বে
নরখাদকের কালোছায়া পড়ে..
আবার যদি তোদের মরা গাঙে ঢেউ আসে
জয়মা...বলে যখন ভাসাবি তরী...
ডেকে নিস আমায়...মহান্দোলনের উৎসবে।
একছুটে চলে যেতে পারি, তোদের বাংলায়কাঁটাতারের ব্যবধান ঘুচিয়ে...
উত্তাল হবে এ হৃদয়...মাতাল হবে আমার দেশ, তোমার দেশ
রক্ত লালে একাকার হবে গঙ্গা-পদ্মার জল
উতলা, অবুঝ মনের কোন থেকে
এই অঙ্গীকারটুকু রইলো...
সাথী হবো বন্ধুর, ফিরিয়ে দেব না।।