যোগ্যতা
যোগ্যতা
সেবার একটা কাজের ইন্টারভিউ দিতে গেছি।বড় রকম লিমিটেড কারখানা।প্যাকেট দুধ তৈরি করা হয়।ছমাস ধরে কাজ-ছাড়া অবস্থায় বাড়িতেই বসে ছিলাম।স্ত্রী গর্ভবতী ছিল।তাকে অনবরত দেখাশুনো এবং ভরসা দিতে হত।প্রথম সন্তান।তাই আমিও খুব চিন্তায় ছিলাম।
সব ঠিকঠাক চুকে যাওয়াতে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। বাবা হওয়ার খুশিটা দিন-দিন অনটনের অত্যাচারে মিলিয়ে যেতে লাগল।আগের কাজটি আর পাওয়া যাবে না জানি।একদিন স্ত্রীই রাতের বেলা বুকের উপর কনুয়ের ভরে চিন্তিত মুখে বলে উঠল,
"আর বসে থাকলে চলবে না। ব্যাঙ্কের বইটা একদম খালি করে দিলে চলবে?নতুন একটা কাজের সন্ধান করো।আমি সংসারটা সামলে নেব।"
স্ত্রীর কাছ থেকে এতবড় সাহস পেয়ে একদিন রবিবারের কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখতে শুরু করলাম।তখনি কারখানার ওই অ্যাডটা নজরে পড়ল।কয়েকজন হেল্পার চায়।কাজের অভিজ্ঞতা তেমন কিছুই নেই।আগে একটা টায়ার কারখানায় দিল্লীতে কাজ করেছি।সেই অভিজ্ঞতা এখানে কোন কাজে লাগবে না।কারণ এটা একটা দুধের কারখানা।হাতে লিখেই একটা বায়োডাটা তৈরি করে ফেললামকোয়ালিফিকেশন মাধ্যমিক পাশ।এইটুকু বিদ্যেই কী আর সি.ভি তৈরি করে রাখা যায়?বায়োডাটায় কী লিখতে হয়,তাও মনে আসছিল না। শেষমেষ যাহোক কাটাকুটি করে একটা সাপের ঠ্যাং লিখেই দিলাম।
পরের দিন তাদের কোলকাতা অফিসের সামনে হাজির হয়ে গেলাম।বুকে একরাশ উত্তেজনা আমাকে ঠিকঠাক টুলটায় বসে থাকতে দিচ্ছিল না।তিনজন হেল্পার চায়।মোটামুটি পনেরো জনের লাইন।বোঝাই যাচ্ছে কি হারে কাটছাট হবে?আমি ধরেই নিয়েছি।এ যাত্রায় হল না।ওদিকে বউ-এর কথা আর ব্যাঙ্কের অবশিষ্ট ব্যালেন্স রাশিটুকু মনে-মনে ভাবছি।সবকটা ছেলেকেই একদম চৌখস লাগছে।তাদের সামনে নিজেকে কেমন যেন মিনমিনে লাগল।কাজটা ওদের কপালেই নাচানাচি করছে, জেনেও অপেক্ষা করতে লাগলাম।যদি ম্যানেজারের দয়া হয়।
কিছুক্ষণ পর অনেক কষ্টে পাশের একজনকে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলাম,"আপনার কোয়ালিফিকেশন?"
উত্তরে ছেলেটি একটু কাশল।তারপর চোখের আটা চশ্মাটা নাকের খাপে ঠিকমত সেট করে বলে উঠল, "বি.এ।"
আমি আবার ঘুরে বললাম,"বিয়েটা কী কোন কোয়ালিফিকেশন হল?সে তো আমিও করেছি।আপনার পড়াশুনো জানতে চাইছি।"
ছেলেটি এবার একটু হেসে জবাব দিল,"আপনি নিশ্চয়ই মাধ্যমিক অব্দি গড়াননি?"
আমি একেবারে হা হয়ে গেলাম বিস্ময়ে! এ কোন গুপ্ত বিদ্যে-টিদ্যে জানি নাকি?না হলে একজন অপরিচিত ব্যক্তির মুখ দেখে তার লেখাপড়ার যোগ্যতা বুঝে যায়?এ সব তো আমাদের দেশের একমাত্র বড়-বড় "বাবা" আর "মা" রাই ভাল বলতে পারেন!
আমি সামান্য ভুলটুকু শুধরে দিয়ে বললাম,"পাশটা করেছিলাম।"
ছেলেটা পা নাচিয়ে বলে উঠল,"ওই হল।আসলে আপনি যখন বি.এ'র মানে যে স্নাতক, সেটুকুও জানেন না।তখনই বুঝলাম।আপনি এসবের সাথে পরিচিত নন।"
আমি চোখ,মুখ বন্ধ করে দমে গেলাম।আর অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না।উঠতেই যাচ্ছিলাম।ততক্ষণে দরজার ছেলেটা আমার নামটা ঘোষণা করল।অগত্যা তড়িঘড়ি যেতে হল।
---বিয়ে করেছেন?
---আজ্ঞে না স্যার।আমি কোনরকমে মাধ্যমিক পাশ।
----আরে ভাই...আমি সে বিয়ের কথা বলছি না। আপনি কী বিবাহিত?
আমার বুকটা ধুক করে কেঁপে উঠল ।একবার ভাবলাম যাকগে! মিথ্যেই বলে দিই,'না'।পরক্ষণেই স্ত্রী আর সন্তানের মুখদুটো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল।আবার ভাবলাম,মিথ্যে কথা বললে যদি শাপ লাগে?আর সত্যি কথা বললে,কাজটা নির্ঘাৎ হাত থেকে গেল।কারণ আজকাল কম্পানি নির্ঝঞ্ঝাট ছেলে,মেয়েদের বেশি সুযোগ দেয়।পিছনে হ্যাপা কম থাকে।ছুটির বাহানা থাকে না।এতকিছু জেনেও শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট করে বলেই ফেললাম।
---আজ্ঞে হ্যাঁ ।একটা সন্তানও আছে।
ম্যানেজার আর কোন কথাই জিজ্ঞাসা করলেন না।আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম।শুধু,শুধু কেন কেউ মুখের কথা খরচ করবেন?আমি একরকম নিরাশ হয়েই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম।যেতে-যেতে ম্যানেজার বলে উঠলেন,
----বাইরে অপেক্ষা করুন।সবার শেষে নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করা হবে।
আমি জানি এ শুধু সান্ত্বনাবাক্য।সবাইকেই বলা হয়।তবু যেন কিছুতেই পালিয়ে যেতে মন চাইছিল না।একবার নিচের চা দোকান থেকে ঘুরেও এলাম।এই 'আশা' নামক জিনিসটা বড্ড বেয়াড়া।না হলে আরো একঘন্টা সবার উজ্জ্বল মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে বসে থাকি?একদম শেষে আমার নামটা ঘোষণা করা হল।আমি তো রীতিমত অবাক।ছেলেটা যে নামে ভুল মেরেছে,এ ব্যাপারে আমি অন্তত নিশ্চিত!মনে-মনে একটু হাসিও পেলাম।মানুষ অতি দুঃখে কখন হাসে?এইটুকু বিদ্যে আমি তা জেনে গেছি।যখন কেউ পাগল হয়।আমি পাগল হতে একদম চাই না।ঘরে এমন মিষ্টি চোখের একজন স্ত্রী এবং 'বাবা' বলে ডাকার জন্য সন্তানও আছে। পাগল হলে তাদের অবস্থা যে কতটা ভয়ানক হবে..সেটা আমি খুব ভাল করেই জানি।
পাশের ছেলেটি উঠে দাঁড়াল।সেই স্নাতকধারী।ওর নামটা ঘোষনা হয়নি।ওটা ওর নামই হবে।আমি দেখলাম, আমার নাম আর ওর নামে শুধুমাত্র একটা অক্ষরের উল্টো-পাল্টা।
এ রকম হয়!
ঘোষনাকার,আবার জোর গলায় বলে উঠল,পাঁচজনের নাম আর একবার বলছি।সবাই ভেতরে ঢুকে যাবে।এবারেও সব শেষে আমার নাম!আমি আবার অবাক হলাম।আমার নামের সাথে মিলের ছেলেটা নিজের নামটা শোনার অপেক্ষায় কপাল চুলকোচ্ছে।নাম যখন ডেকেছে উঠতেই হল।ভাবলাম,যাই হোক!দরজা থেকেই না হয় ঘুরে আসব।
ঘোষনাকারীর হাতে দেখলাম আমারই বায়োডাটা।আমি তখনো ঘোর কাটাতে পারছি না।এটা কী করে সম্ভব?একজন স্নাতক,কম বয়সি,অবিবাহিত ছেলেকে বাদ দিয়ে আমাকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কীসের যুক্তিতে?মনটা এক রাশ তাজা হাওয়া পেয়ে নাচ করে উঠল।বাতাসটা অবশ্য এসির।তবে আনন্দটা আমার।
আজ পাকা তিন বছর পর আমি এই কারখানার একজন অপারেটর ম্যান।হেল্পারে মাইনে ছিল মাত্র পাঁচ হাজার।এখন সেটা দাঁড়িয়েছে পনেরো হাজারে।দু-তিন মাস পর-পর দিন সাতেকের ছুটিতে বাড়ি ঘুরে আসি।ছেলেটি এখন নার্সারি স্কুলে পড়ছে।আজ আমি বুঝতে পেরেছি।ম্যানেজার সেদিন কেন আমাকে এত কম কোয়ালিফিকেশন জেনেও নির্বাচন করেছিলেন?
এখানে আজ পর্যন্ত যে কজন অবিবাহিত, স্নাতক ছেলে, কারখানা জয়েন করেছে তাদের মধ্যে কেউ বেশিদিন টেকেনি। কেউ একমাস কেউ বা পনেরো দিনের মাথায় সুখের হাওয়া খেয়ে পালিয়ে গেছে।ভুল বললাম,ওটা সুখ হবে না।হবে,পচা দুধের দুর্ঘন্ধ আর গরম ভাপের ফোস্কা খেয়ে পালিয়েছে!
আমি পারিনি।কারণ পিছনে অনটনের যে বাষ্প ফুটছিল তাতে তো ভেতর পর্যন্ত ফোস্কা পড়ে যেত।এ তবু সহ্য করার মত অবস্থা।
স্ত্রীকে একদিন ফোন করে বললাম,"বড্ড গরম আর দুর্গন্ধ।থাকতে ইচ্ছে করছে না।"
ও বলল,"তাহলে আমি গিয়ে কাজ করি ওখানে।তুমি ঘর সামলাও।"
এক-দু জন মহিলাও কারখানায় কাজ করে।শুধুমাত্র ঝাঁট দেওয়া তাদের কাজ।ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম,
"না থাক।তারথেকে বরং আমিই করি।"
(সমাপ্ত)