Indrani Bhattacharyya

Drama Fantasy Others

4.0  

Indrani Bhattacharyya

Drama Fantasy Others

যোগাযোগ

যোগাযোগ

9 mins
263


(১)


দেবদত্ত চৌধুরী কাঁপিয়ে দিয়েছেন এবারেও। শহর ঢাকা পড়েছে তার ডিজাইন করা বড় বড় হোর্ডিংয়ে। আগামী বুধবার চারুচন্দ্র শিল্প প্রদর্শনশালায় প্রদর্শিত হবে মৃণালিনী । দেবদত্ত তার এই মানসীকে মনের সকল মাধুরী ঢেলে সাজিয়ে তুলেছেন তিলে তিলে। দেবদত্তের হিউম্যান ফিগার এবং হিউম্যান পোট্রেট নিয়ে এই প্রথম এতো বড় মাপের কাজ। এতদিন শিল্পমহল তাকে কদর করত বিমূর্ত চিত্রকলার একজন মাগদর্শণকারি হিসেবে। আজ তার নিজেকে পরিচিত মহলে নতুন করে চেনানোর পালা।


দেবদত্ত তার নিজের স্টুডিওতে শেষ মুহূর্তের তুলির টান দিতে ব্যস্ত। উঠতি মডেল রিয়া ততক্ষনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে। দেবদত্ত রিয়াকে এগিয়ে আসতে দেখে চেকটা সই করে এগিয়ে দিলেন। রিয়া হেসে বলল - "ধন্যবাদ স্যার। কাল তো উদ্বোধন। অনেক শুভেচ্ছা রইল।" তারপর একটু থেমে বলল ," যদি কিছু মনে না করেন, ক্যানভাসগুলো কি একবার দেখতে পারি? নিছক কৌতূহল বলতে পারেন।" দেবদত্ত খুশি হয়ে বলল - " হোওয়াই নট? এই দেখো। এটা গতকাল এঁকেছিলাম । নিজেকে চিনতে পারছ? আর এটা গত রবিবার, যেদিন বৃষ্টি পড়ছিল অঝোরে আর তুমি রেলিঙে কনুই ভাজ করে দাঁড়িয়ে দেখছিলে আর ভিজছিলে। " রিয়া মুগ্ধ হয়ে বলল - " অসাধারণ বললেও কম বলা হয় স্যার। নিজেকে একেবারেই চিনতে পারছি না। এমনকি সত্যি বলতে কি, এই মৃণালিনী আমার চেয়ে ঢের বেশি সুন্দরী। অনেক বেশি লাস্যময়ী।" হাতে ধরে থাকা ব্রাশের পেছন দিকের প্রান্তটা দাঁতে কামড়ে দেবদত্ত একটু যেনো ভেবে বলল - " সত্যি বলতে কি, এই কথাটা আমারও মনে হয়েছে। আমি যদিও তোমার মুখের আদলেই মৃণালিনীকে দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুলিতে কেনো বারবার প্রতিটি ক্যানভাসে এই মুখটিই ধরা দিল, জানি না। যাই হোক, যা হয়েছে, ভালই হয়েছে, কি বলো?" রিয়া হেসে বলল - " হ্যাঁ স্যার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার প্রদর্শনী আবার খবরের শিরোনামে আসতে চলেছে। আমি আজ আসি তবে। ভালো থাকবেন।" 

পরের দিন যা ঘটলো ততটা দেবদত্ত নিজেও শিল্পী হিসেবে আশা করেননি। উদ্বোধনের পর থেকেই প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেলেন তিনি। এমনকি বেশ কয়েকটি নাম করা আন্তর্জাতিক শিল্প সংক্রান্ত বুলেটিনে বলা হল এই প্রদর্শনীর কথা।বেশ কয়েকটি পেন্টিং দুদিনের মধ্যেই বিকিয়ে গেলো রেকর্ড করা চড়া দামে। যে কোনো শিল্পীর কাছেই এত কম বয়সে এত বড় মাপের সাফল্য সত্যিই অভাবনীয়। তিনি তার অনুরাগীদের দাবি মেনে বছরে দুটি করে এই ধরনের প্রদর্শনী করবেন বলে কথা দিলেন। 

এর পরের প্রদর্শনী করলেন রবীন্দ্র তীর্থে। এবারের নাম তিলোত্তমা। কুড়িটি ক্যানভাস দিয়ে মুড়ে দিলেন গোটা চত্বর। প্রত্যাশা মতই উপচে পড়ল ভিড়। যদিও এবার আর আগেরবারের মত সমালোচকদের থেকে ততটা সুখ্যাতি আদায় করতে পারলেন না দেবদত্ত। তার কারণ তিলোত্তমার প্রতিটি দেহ বিভঙ্গে দৈব মাধুর্য, অপার্থিব সৌন্দর্য ঝরে পরলেও মৃণালিনী আর তিলোত্তমার মুখাবয়ব ছিল যেন একই রকম। যেনো একই নায়িকা দুটি ভিন্ন চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছে।

দেবদত্ত বুঝতে পেরেছিলেন নিজের ত্রুটি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করে, মডেল পরিবর্তন করেও তিনি পরবর্তী প্রদর্শনীগুলোতে এই ত্রুটি শুধরাতে পারেননি। দেবদত্তর প্রতিটি তুলির আঁচড় যেনো তার সমস্ত নির্দেশ উপেক্ষা করে বারবার তুলে ধরছিল সেই একই মুখ , যাকে তিনি মৃণালিনী রূপে এঁকেছেন। দেবদত্ত তাঁর এই সমস্যা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। পরবর্তী পাঁচটি প্রদর্শনীতে পরপর তাঁর ছবিতে নানান অভিব্যক্তির মিশেলে সেই একই মুখের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠলো বারবার। প্রথম প্রদর্শনীতে যে ছিল মৃণালিনী, সেই তিলোত্তমা, স্বপণচারিনী, শ্রী রাধিকা, সুতনুকা, শ্যামলী ও অপর্ণার বেশে ফিরে ফিরে এলো পরবর্তী প্রদর্শনীগুলোতে। ফলে যেমন ধূমকেতুর মত উঠেছিলেন সাফল্যের শিখরে তেমনই দ্রুততার সাথে হারিয়ে যেতে লাগলেন মানুষের মন থেকে।

দেবদত্ত কালকের প্রদর্শনীর পর মুষরে পড়েছিলেন বেশ। যথেষ্ট সমালোচনার স্বীকার হতে হয়েছে তাঁকে। আগামী কোনো প্রদর্শনীর জন্যই তাঁর পক্ষে এখন স্পন্সর জোগাড় করা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি নিজের স্টুডিওতে বসে ভাবছিলেন কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার নিজের চেনা গণ্ডিতে ফিরে যাবেন। বিমূর্ত চিত্র অঙ্কন নিয়ে এলাহাবাদে সামনের সপ্তাহে একটি সেমিনারে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। আপাতত সেটিরই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন একা একা বসে ।


স্টুডিওতে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন নতুন ল্যাম্পটা। এটা তাকে তার এক শিল্প অনুরাগী বিদেশ থেকে কিছুদিন আগে পাঠিয়েছেন। আলোটা বেশ হালকা সবুজ ধরনের আর চোখের পক্ষেও বেশ আরামদায়ক। সেই ভদ্রলোক নাকি নিজের হাতে এটা বানিয়েছেন। এর সেলগুলো নাকি এক ধরনের সমুদ্র শৈবাল দিয়ে তৈরি। আজই প্রথম আলোটা জ্বালিয়ে ছিলেন ঘরে। সেই আলোতে ক্যানভাস থেকে চোখ সরিয়ে হঠাৎই সোফার দিকে তাকাতে মনে হল কে যেনো একজন বসে আছে সেখানে। কোনো মহিলাই হবেন হয় তো। আবছায়া প্রতিমূর্তিটির শরীরের গঠন অন্তত তেমনটাই বলছে। মেয়েটি যেনো খুব অবাক হয়ে দেখছে তাকে। চমকে উঠলেন দেবদত্ত। "আজ তো কোনো মডেল আসার কথা নয়। এ তবে কে? খুব চেনা চেনা ঠেকছে মুখটা । কোথায় যেনো দেখেছি..." ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো - "আরে এই তো সেই মৃণালিনী মানে অপর্ণা মানে সুতনুকা মানে সব । সব কটি চরিত্রকে তো তিনি এই আধারেই রূপ দিয়েছেন"। দুহাতে মাথা চেপে ধরে দেবদত্ত চিৎকার করে উঠল - " কে আপনি?"


(২)


মরিয়ম সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। বাড়িটা নতুন। তার মধ্যে আবার এই ঘরে আলো একটু কম ঢোকে। মরিয়মের বাবা হেনরি টাইগ্রিস সিটি থেকে এই শহরে বদলি হয়েছেন সদ্য। তেমন কোনো বড় বাড়ি না পাওয়া যাওয়ায় তাড়াহুড়োতে বাধ্য হয়েই এই ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্টটা নিতে হয়েছে। এমনিতে বাড়িটা মন্দ নয়, শুধু একটু আলো বাতাস কম ঢোকে, এই যা। মরিয়ম বাধ্য হয়ে দিনের বেলাতেও ঘরে আলো জ্বালালো। এই আলোটা মরিয়মের বাবা নিয়ে এসেছেন আগেরবার। কোনো এক সেমিনারে কোনো বিজ্ঞানী দিয়েছেন সম্ভবত।

আলোটা ঘরে জ্বালাতেই মরিয়মের মনে হল চোখের সামনে যেনো মাছের আঁশের মত ফিনফিনে একটা স্বচ্ছ পর্দা ঝুলছে আর তার ঠিক পরেই ঘরের মধ্যে একটা তারই বয়সি মেয়ে ঠিক তার মতই চুল আঁচড়াচ্ছে। মেয়েটি সম্ভবত দেখতে পায়নি তাকে। মরিয়ম হাত দিয়ে ছুঁতে চাইল মেয়েটাকে। সামনে হাতও বাড়ালো। কিন্তু হাতটা হাওয়ায় কেটে বেরিয়ে এলো। বেশ বিরক্ত লাগলো মরিয়মের। আয়নায় তাকিয়ে দেখলো সেখানে এখন তার সাথে সাথে আরেকটি মেয়েরও আবছায়া অবয়ব ফুটে উঠেছে। তখনই চোখে পড়ল ঘরের অন্য কোনে একটা ছোটো টুলের ওপর বসে সামনে ক্যানভাস রেখে কি যেনো আঁকছে একটা লোক। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল লোকটা যেন তারই দিকে তাকিয়ে আছে। নাকি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে? 

দিনের পর দিন বিভিন্ন সময় আলোটা জ্বালালেই ছায়ার মত চোখের সামনে ভেসে বেড়াত এই রকম নানান দৃশ্য। কখন সেই লোকটা, কখনো লোকটার সাথে আরো অন্য কোনো মেয়ে দিনরাত ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতো। নানা কাজ কর্ম করত লোকটা। কখন ছবি আঁকতো, কখনো বই পড়ত। ঘরের মধ্যে যেনো দুটো পাশাপাশি জগৎ মিলেমিশে কিন্তু একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র ভাবে সহাবস্থান করত। মরিয়মের প্রথম প্রথম অদ্ভুত লাগলেও তার নিজের কাজে অসুবিধে না হওয়ায় আস্তে আস্তে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল ব্যপারটা। ভেবেছিল তার বাবা হেনরি বিদেশ থেকে কাজ সেরে ফিরলে তাঁকে খুলে বলবে বিষয়টা।


মরিয়মের মা নেই। বছর দুয়েক আগে তিনি মারা গেছেন। মরিয়ম নিজে বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা করে মেরিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের এই শহরটাও পৃথিবীর অন্য সব শহরের মতই জলের নিচে। তবে এই নতুন শহরটি বিজ্ঞানচর্চার দিক দিয়ে অন্য অনেক শহরের থেকে বেশি উন্নত। মরিয়মরা যে ব্লকে থাকে সেখানে অধিকাংশ মানুষই বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞান সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত। 

মরিয়ম প্রতিদিনের মতোই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে বলে তৈরি হয়ে ফ্লাইং ভেসেলে চেপে বসে। তারপর কমান্ড দেয়। কিন্তু সেটা বিপ করে কম্যান্ড অ্যাকসেপ্ট করেও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক চেষ্টাতেও কিছুতেই চললো না সেটি। মরিয়ম বুঝলো কিছু একটা সমস্যা হয়েছে ভেসেলে। অথচ কলেজে আজ তাকে যেতেই হবে। হাইড্রোইলেকট্রিসিটি নিয়ে তার পেপার জমা দেবার আজই শেষ দিন। এদিকে মরিয়মের বাবা হেনরিও দিন চারেক হল একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে আটলান্টায় গেছেন। সুতরাং কি করা যায় ভাবতে ভাবতে মরিয়ম দেখলো পাশের বাড়ির গ্যারেজে একটা লাল ভেসেল দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষনের জন্য সেটি যদি পাওয়া যায় সেই আশায় মরিয়ম খোঁজ নিতে গেল ওই বাড়িতে। 

একটু ইতস্তত করে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর সঙ্গে ওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি ধরে যোগাযোগ করার জন্য মরিয়ম রিকুয়েস্ট পাঠালো। এর আগে তার সাথে কোনদিন আলাপ হয়নি। মরিয়ম শুধু জানে সেখানে একজন বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক থাকেন। নাম - দিত্রিয়েভ মিসকিন। 

ভদ্রলোক বাড়িতেই ছিলেন। সিগন্যাল পেতেই দরজা খুলে বাইরে এলেন। তাকে দেখেই চমকে উঠল মরিয়ম।মনে মনে বলে উঠল, ' আরে, ইনি তো সেই মানুষ, যাকে আলোটা জ্বালালেই হালকা হালকা দেখা যায় ঘরে '। মরিয়মের মুখে অবাক ভাবটা লক্ষ্য করে দিত্রিয়েভই প্রশ্ন করলো - "কিছু বলবেন ম্যাডাম"? ঘোর কাটিয়ে মরিয়ম বলল -" স্যার আমরা আপনার পাশের বাড়িতে নতুন এসেছি। আসলে আমার ভেসেলটা খারাপ হয়ে গেছে হঠাৎই। আগে খেয়াল করিনি।আজ আমার কলেজে যাওয়া খুব জরুরি। যদি আপনার ভেসেলটা পাওয়া যেত.." দিত্রিয়েভ আশ্বস্ত করে বললেন - "নিশ্চয়ই। আমিও তো যাচ্ছি ঐদিকেই। আমার সঙ্গেই চলে আসুন। আর দশ মিনিটের মধ্যেই বেরোব আমি।"

সেদিন যেতে যেতে মরিয়ম জানতে পারল তাদের বাড়িটাও দিত্রিয়েভের বর্তমান বাড়িরই একটা অংশ ছিল। দিত্রিয়েভের তেমন লোকবল না থাকায় দেখাশোনার অভাবে সেটি খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তাই তিনি অংশটি বিক্রি করে দেন। দিত্রিয়েভও মরিয়মের সাথে কথা বলে বুঝেছিলেন, ছাত্রী হিসেবে তাঁর ভবিষ্যত উজ্জ্বল। গবেষণার বিষয়বস্তুতেও দুজনের অনেক জায়গায় সাদৃশ্য আছে যথেষ্ট।

এরপর থেকে দুটি বাড়ির মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। দিত্রিয়েভ এই ক্যালকুলাস শহরের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী। মাত্র আঠাশ বছরেই তার ঝুলিতে জমা হয়েছে হাজারের বেশি পেটেন্ট। দিট্রিয়েভ বয়সে অনেক ছোট হলেও হেনরি তার প্রজ্ঞাকে যথেষ্ট সম্মান করেন, সেই সাথে স্নেহও করেন ছেলের মত। হেনরি যদিও আগে থেকেই চিনতেন দিত্রিয়েভকে তবে প্রতিবেশী হিসেবে এখন আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে তাকে জানার সুযোগ হল। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘন্টা আলোচনা চলত। মাঝে মাঝে মরিয়মও এসে যোগ দিত। মরিয়ম কোনো কিছু না বুঝতে পারলে হেনরীর অবর্তমানে দিত্রিয়েভ যথেষ্ট সাহায্য করতো তাকে সেই ব্যপারে। 


দিত্রিয়েভ প্রথম থেকেই যথেষ্ট স্নেহ করতেন মরিয়মকে। ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে আলাপ পরিচয় বাড়তে থাকে।একটা সময় পর থেকে দুজনে একই সাথে কলেজে যেতে থাকে । কিছুদিনের মধ্যেই সম্পর্কটা শুধুমাত্র বিজ্ঞানের প্রফেসর আর বিদ্যানুরাগী ছাত্রীর সাদামাটা সম্পর্কের সমীকরণে আবদ্ধ থাকে না আর। ক্রমে তা দুটি হৃদয়ের জটিল রসায়নের ফর্মুলায় পর্যবসিত হয়। যদিও দুই বাড়িরই এই ব্যপারে কোনো আপত্তি ছিল না। 

মাস খানেক এভাবে এভাবে যেতে যেতে একদিন মরিয়ম দিত্রিয়েবকে নিয়ে গেল তার নিজের সেই ঘরে। বললো - "আজ তোমায় একটা মজার জিনিস দেখাতে চাই। কথাটা বাবাকে বলবো বলবো করেও বলা হয়ে ওঠেনি। জানিনা তুমি দেখতে পাবে কিনা।" বলে ঘরের সেই আলোটা জ্বালিয়ে দিল মরিয়ম। অমনি চোখের সামনে পর্দার মত আবার ভেসে উঠল একটা দৃশ্য - হুবহু দিত্রিয়েভার মত দেখতে একটা লোক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে চেয়ারে। তারপরই সে উঠে একটা ফাঁকা ক্যানভাসের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বহুক্ষণ। তারপর ক্যানভাস থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়েই যেনো ছিটকে গেলো পেছনে। এমন সময় মরিয়মের যেনো মনে হল ,সেই লোকটিও হয় তো এই প্রথম দেখতে পেয়েছে তাকে। সে যেন চিৎকার করে কোনো প্রশ্ন করছে তাকে। মরিয়মও জিজ্ঞেস করলো জোরে - আপনি কে? দিত্রিয়েভ এবার কোন কথা না বলে পেছন থেকে লাইটটা নিভিয়ে দিল হঠাৎই।

মরিয়ম খানিক অবাক হয়েই পরপর কয়েকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল দিত্রিয়েভকে - "তুমি আলোটা এখনই নিভিয়ে দিলে কেনো? আমার ঘরে তোমার মত দেখতে লোকটা কি করে সেটা আমার জানা দরকার তো। তুমি কি কিছুই দেখতে পাওনি?"

দিত্রিয়েভ উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করলো মরিয়মকে -" ডিয়ার তুমি কি জানো আমি এই মুহূর্তে কি নিয়ে গবেষণা করি?" মরিওম বলল - "বাবার কাছে শুনেছি অল্প অল্প। টাইম মেশিন সংক্রান্ত কিছু কি"? 

-"না ডিয়ার। সমান্তরাল জগৎ নিয়ে আমার গবেষণা। এই যে আলোটা দেখছো, এটা কিন্তু আমারই পেটেন্ট করা। এখনো এটা টেস্টিং এর স্তরেই আছে। গত বছর টাইগ্রিসে একটি কনফারেন্সে আমি সেটি কুড়ি জন বিজ্ঞানীকে দিয়েছিলাম।তাদের মতামত জানার জন্য। সেখানে তোমার বাবা মানে আংকেল হেনরিও উপস্থিত ছিলেন। ওনাকেও দিয়েছিলাম একটা। এটি তারই একটি। কাজ যে দিচ্ছে আলোটায়, আজকের ঘটনা তারই প্রমাণ।"

মরিয়ম তখনও দাঁড়িয়ে আছে বোকার মত। দিত্রিয়েভ হেসে মরিয়মের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললেন - "তোমাকে খুব বেশি বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই ডার্লিং। তুমি যথেষ্ট মেধাবী এবং বুদ্ধিমতী। এটুকু তো জানো নিশ্চয়ই, সময়ের অনেক স্তর আছে। আমরা যা দেখছি, শুনছি, অনুভব করছি তার বাইরেও অনেক দুনিয়া রয়েছে। সুতরাং যেটুকু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সেটুকুই ধ্রুব সত্য, এমনটা মোটেই নয়। আমাদের ঘিরে থাকা চারপাশের এই জগৎটা বলতে পারো এক ধরনের দৃষ্টি বিভ্রম । আমি বা তুমি বা আমরা সবাই নানান অবতারে নানা রূপে সময়ের এই বিভিন্ন স্তরে কাজ করে চলেছি। আমরা কেউই কিন্তু চিনি না আমাদের এই অবতারকে। আমি এখানে বৈজ্ঞানিক আবার তোমার চোখের সামনে ফুটে ওঠা কোনো জগতে হয় তো চিত্র শিল্পী। হতেই পারে তেমনটা। আমি সময়ের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা এই সমান্তরাল জগতগুলোকেই দেখতে চেয়েছি। আলোটাকে আমি এই ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছি মাত্র। তবে এই আলোটা জ্বালিও না সব সময়। যদি কোনোদিন আমাদের জগতের প্রয়োজন হয় অন্য কোনো জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করার তবেই সেই আলো তখন ব্যবহার করা হবে। অন্যথায় নয় । প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে বিনা প্রয়োজনে কোনো কাজই ঠিক নয় করা। তাতে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।"

মন দিয়ে বাধ্য ছাত্রীর মত কথাগুলো শুনছিল মরিয়ম। তারপর সেই লাইটটা খুলে অন্য একটা লাইট লাগাতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল সারা ঘর। আর কোথাও কোনো অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না।কাউকে দেখতেও পেলো না চারপাশে। মরিয়ম ছুটে গিয়ে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে ধরল দিত্রিয়েভকে ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama