arijit bhattacharya

Inspirational Drama

3  

arijit bhattacharya

Inspirational Drama

উত্তরণ

উত্তরণ

4 mins
1.1K


ট্রিটমেন্ট সেন্টারের মধ্যে পড়ে থেকে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে আকাশ পাতাল ভেবে চলে আকাশ। আদৌ কি আছে তার কোনো মানসিক সমস্যা! যার জন্য তার বাড়ির লোক তাকে ভরে দিয়েছে এই চার দেওয়ালের মাঝখানে। নিয়মিত তার ওপর হয়ে চলেছে মেন্টাল টর্চার। আকাশ ভেবে চলে তার দোষ টা কোথায়! সে একজন স্নাতক,নিজে রোজগার করে,কারোর ওপর নির্ভরশীল নয়। পরিবারের লোককে ভালোবাসে আর তাদের নিয়েই চলতে চায়। কিন্তু তাও তার জন্য তার পরিবারের ভাবমূর্তি কিভাবে কলঙ্কিত হচ্ছে!


আকাশের সমস্যা হল ছেলে হয়ে জন্মালেও তার আচার আচরণ সব মেয়েদের মতো। শারীরিকভাবে সে একজন ছেলে হলেও মানসিকভাবে সে একজন মেয়ে! এই নিয়ে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে,শুনতে হয়েছে সমাজের কুৎসা,ছোটবেলায় স্কুলে পড়তে গিয়ে বা পরবর্তীকালে বড়ো হবার পর রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলার সময় শুনতে হয়েছে সহপাঠীদের নানা খারাপ টিপ্পনী। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মতো সাজতে,তাদের মতো পোষাক পরতে,তাদের মতো মেক আপ করতে,তাদের মতো লম্বা চুল রাখতে ভালো লাগে আকাশের। এই নিয়ে তার বাড়ির লোককেও শুনতে হয়েছে সমাজের কাছে কথা,বাড়ির লোকের কাছে মনে হয়েছে এ এক বিরাট সমস্যা।

আকাশের মধ্যে গুণাবলী কম নয়। সে ভরতনাট্যম আর কথাকলিতে সুপারদর্শী, এছাড়া গণিতে স্নাতক। তাও আকাশকে শুনতে হয় তার মার কাছে যে,"তোকে জন্ম দিয়ে আমি পাপ করেছি, তুই মরে যা।" বাবাও কথা শোনায়,"তোর জন্য আজ সমাজের মানুষের কাছে মুখ দেখাবার উপায় রইল না।" মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার পরেও পাড়ার লোকের কাছে তার মেয়েলিপনার জন্য কম কথা শুনতে হয় না আকাশকে। তবে এসব কথা বাড়িতে বললে বাড়ির লোক উল্টে তাকেই দোষ দেয়!


জন্ম থেকেই আকাশের মধ্যে বিরাজমান এক নারীর সত্ত্বা। ছেলেদের সবার থাকে গার্লফ্রেণ্ড। আকাশের আছে বয়ফ্রেণ্ড। বন্ধুরা কেউ 'গে', কেউ আবার 'মাগী' বলে ঠাট্টা করে।

আকাশও স্বপ্ন দেখে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি আর সেক্স চেঞ্জের মাধ্যমে একজন পূর্ণযৌবনা নারীতে পরিণত হবার।তারও অধিকার আছে এক নারীজীবন অতিবাহিত ও উপভোগ করার।


এইসব কথা তার মায়ের সাথে শেয়ার করতেই মা ভাবেন কোনো জটিল মানসিক সমস্যায় ভুগছে তার ছেলে। আকাশের যে জেন্ডার কোয়েশ্চনিং ,সেটা মায়ের চোখে পুরোপুরি অস্বাভাবিক। তাই মা তাকে ভরে দেন ট্রিটমেন্ট সেন্টারের চার দেওয়ালের মধ্যে। চলতে থাকে টর্চার!


---------------------------------------------------


চারদিকে শুধু যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা। সবাই সন্দেহের চোখে দেখছে। জীবনে অনেক ছেলের সাথেই প্রেম হয়েছে,কিন্তু সবাই তাকে প্রতারণা করেছে। মাঝে মাঝে নিজেকে একটা 'অবজেক্ট' বলে মনে হয় আকাশের। চারদিকে যেন চক্রব্যূহের ফাঁদ পাতা রয়েছে!

কলেজে পড়ার সময়ই তার জীবনে আসে আদিত্য। আদিত্য জেনেছিল আকাশের ছেলেদের প্রতি সেক্সুয়াল ফিলিং এর কথা। ধীরে আদিত্যও আকাশকে একজন ভালো বন্ধু হিসাবে দেখতে থাকে, তার সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলিকে, ভালো লাগাকে মর্যাদা দিতে শুরু করে। হয়তো মনের কোথাতে আদিত্যকেও স্থান দিয়েছিল আকাশ। ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে এক সম্পর্ক- মনের চরম ভালোলাগার থেকে উৎসারিত এক আবেগমথিত প্রেমের সম্পর্ক। ক্রমশ সময়ের সাথে সাথে শারীরিক ও মানসিক চাহিদার আগুনে দুজনে ধীরে ধীরে কাছে আসতে থাকে। বাইরের লোকজন সন্দেহভরা নজরে দেখলেও,কলেজের বন্ধুবান্ধবেরা দুজনকে নিয়ে নানা রকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি ও টিপ্পনী কাটলেও সেইসব জিনিসকে পাত্তা দেয়নি আকাশ। আদিত্যও চরম নিস্পৃহ ছিল সব রকম কুৎসা ও রটনার প্রতি। আকাশ ও আদিত্যর সম্পর্ক কোনো বয়ফ্রেণ্ড-গার্লফ্রেণ্ডের থেকে কম রঙিন ছিল না! যখন প্রেমের চরম মুহূর্ত চলছিল দুজনের জীবনে,তখন আকাশের মনে আদিত্যের প্রতি আবেগ কোনো লয়াল গার্লফ্রেণ্ডের থেকে কম ছিল না। হাতে হাত ধরে একসাথে পার্কে ঘুরতে যাওয়া, একসাথে প্রিন্সেপঘাটে গঙ্গার ধারে সূর্যাস্তের মায়াবী রক্তিমায় ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কাটানো,হাতে হাত ধরে গঙ্গার ধারে মিলেনিয়াম পার্কে বসে থাকা-কম রঙ ছিল না তাদের জীবনে। আদিত্যের কাছেই প্রথম ব্যক্ত করে আকাশ তার শারীরিক ফ্যান্টাসির কথা, তার সম্পূর্ণ একজন উদ্ভিন্নযৌবনা সুস্তনী নারীতে পরিণত হবার স্বপ্নের কথা, তার জীবনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারিণী হবার স্বপ্নের কথা। সে চেয়েছিল তার ভালোবাসা আদিত্যের হাত ধরে জীবনে বড়ো হতে,সমাজে সম্মান,ভালোবাসা আর গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে ,কিন্তু সে কি তা পেরেছিল!

ক্রমশ শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল আদিত্যের সাথে। আদিত্যের দৃপ্ত পৌরুষ আর পেশীবহুল চেহারা কামনার আগুন জ্বালিয়ে দেয় তার শরীরে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় আদিত্যের সাথে তার। লম্বা চুল,মেয়েদের পোষাক আর মেক আপে তাকে কোনো উদ্ভিন্নযৌবনা নারীর চেয়ে আলাদা বলে মনে হত না!


কিন্তু একসময় কাঁচের আয়নার মতো ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে তার স্বপ্নের শিসমহল। আদিত্যের জীবনে তনিমা আসতেই আদিত্য ছেড়ে চলে যায় তাকে। আদিত্য বলে যে আকাশের সাথে তার সম্পর্ক স্রেফ 'টাইম পাস' ছাড়া আর কিছু ছিল না। সম্পর্কছেদের আকস্মিকতায় পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় আকাশের সামনে! আদিত্য সাফ জানায়,সে কোনো 'হিজরাকে' সঙ্গ দিতে পারবে না,বন্ধুও হতে পারবে না। তার জীবনে একমাত্র সুন্দরী তনিমা ছাড়া আর কেউ নেই,আর হবেও না কেউ। নিজেকে প্রতারিত-প্রবঞ্চিত বলে অনুভব হয় আকাশের। সব প্রমিস এক নিমেষে ভুলে গেল আদি! এ কি কম মানসিক নির্যাতন!মনে ক্রোধমিশ্রিত ক্ষোভ জন্ম নেয়।


পারবে কি সে এইরকম প্রতারিত প্রবঞ্চিত অন্ধকারময় জীবনে আলোর দিশা লাভ করতে! ঘটবে কি তার জীবনে উত্তরণ! ট্রিটমেন্ট সেন্টারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে আকাশ।


আজ সারা পাড়ায় হইহুল্লোড়। আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়ে পাড়ায় ফিরছেন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী রূপা,এছাড়াও তাঁর আরেক পরিচয় তিনি অনেক এন জি ও র সাথেও জড়িত আছেন,যারা সমকামী ও রূপান্তরকামীর জন্য কাজ করে।

হ্যাঁ,সেদিনের আকাশই আজকের রূপা। ট্রিটমেন্ট সেন্টার থেকে বেরোতে কম ঝামেলা হয়নি। কিন্তু ব্যাপারটা আকাশের গানের স্যার অরিন্দমবাবু কর্তৃক প্রেসের জানাজানি হয়ে গেলে মিডিয়ার চাপের কাছে ট্রিটমেন্ট সেন্টার নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। এর মধ্যেই সমাজকর্মী নারায়ণ কাকু ( নারায়ণ চক্রবর্তী ) ও পায়েল দি (পায়েল সেন)এর নজরে আকাশের ট্যালেন্ট পড়তেই এক স্বপ্নের উত্তরণ শুরু হয় তার জীবনে। আসে নাচের জন্য জাতীয় সম্মান । এর মধ্যেই লিঙ্গ পরিবর্তন করে এক নতুন জীবন শুরু করেছে আকাশ। আজ তারই নাম রূপা!


মাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই মায়ের আনন্দাশ্রু বইতে শুরু করে। আজ তিনি বুঝতে পারেন ,ছেলেই হোক বা মেয়েই হোক বা তৃতীয় লিঙ্গ,হীরে হীরেই হয়-তার ঔজ্জ্বল্যই তার প্রমাণ। সেটা লিঙ্গের ওপর নির্ভর করে না। ফুলের সুগন্ধ থাকলে সেটা ছড়িয়ে পড়বেই,ফুলকে যতোই লুকিয়ে রাখা হোক না কেন!


সমাপ্ত


কলমে অরিজিৎ



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational