উত্তোরন
উত্তোরন
জান্হবীর প্রেমটা বাড়িতে জানাজানি হওয়ার পর বাড়ি থেকে জাত-ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করা হলো।জান্হবী ওর প্রেমিককে বিয়ের কথাটা জানাতেও সে কোনরকম পাত্তা না দেওয়াতে বাড়ির দেখা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো।বর দেখে সারা বিয়ে বাড়িতে হাসির রোল উঠলো।এক বাক্যে সবাই বলছে বাঁদরের গলায় মুক্তোরমালা।জান্হবীর কানেও কথাগুলো আসছে, সে মনে মনে খুশি হচ্ছে তার বাবা মায়ের পছন্দকে লোকে আঙ্গুল দিয়ে বোঝাচ্ছে কুৎসিত। মালা বদলের সময় মনে হচ্ছিল শিম্পাঞ্জির গলায় মালা পরাচ্ছে।নিজের মনেই হাসছে আর ভাবছে বিয়ে করে এমন নাজেহাল করবে শ্বশুড়বাড়ির লোককে ওরাই তুলে দিয়ে যাবে বাড়িতে ক'দিন পর।বিয়ে করে এক ফোঁটাও চোখের জল না ফেলে শ্বশুড়বাড়ি পৌঁছালো।সেখানে গিয়ে দেখছে সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ভীর।তাও নাই কম করে পঞ্চাশ-ষাট জন হবেন।ওদের দেখে তো ওর আরো মাথা গরম।তাদের মধ্যে একজন বিবাহিত বৃদ্ধা একটা থালায় দুধ-আলতা ঢেলে জান্হবীকে তাতে পা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতে বললেন।গটগট করে ভেতরে ঢুকতেই অভিক মানে জান্হবীর বর ওকে আসুন বলে একটা সুসজ্জিত ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল এটা ওর ঘর।জান্হবী ঘরে ঢুকেই ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘর সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে পরিস্কার হয়ে এসে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটা চালিয়ে একটা ঘুম লাগিয়ে নিলো।দরজায় বেশ কবার টোকা পরতে জান্হবী ঘুম ভেঙে দেখে ঘড়িতে দুটো বাজে, মানে এগারোটা থেকে দুটো অবধি ও ঘুমাচ্ছিলো।দরজা খুলে দেখলো শিম্পাঞ্জিটা ওকে খেতে ডাকতে এসেছে।কোন কথা না বলে টেবিলে বসে খেয়ে উঠে আবার ঘরের দরজা দিলো।বৌভাতের দিনটা কোনমতে কাটলো।সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ কিছু আরো শিম্পাঞ্জির চেনা লোক,জান্হবীর বাড়ির লোকরা মিলে বৌভাত পর্ব সারলো।ঘরে জান্হবী দরজা দিতে ফুল দিয়ে সাজানো খাটটাতে একাই শুয়ে ঘুমিয়ে পরলো।সকালে উঠে দেখলো শিম্পাঞ্জি সোফাতেই শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।রান্নাঘরে গিয়ে নিজের জন্য এক কাপ চা বানিয়ে ঘরে গিয়ে খেতে খেতে টের পেলো শিম্পাঞ্জি উঠে পরেছে। কিছুক্ষন পরে জান্হবীর জন্য ব্রেক ফাস্ট এনে দিয়ে বললো আর এক কাপ চা খেলে ফ্লাস্ক থেকে নিয়ে নেবেন।আমি রান্না করে রেখে যাবো টাইম মত খেয়ে নেবেন।জান্হবী হ্যাঁ-না কিছুই উত্তর দিলো না।লোকটা নিজে খেয়ে জান্হবীর জন্য খাবার গুছিয়ে রেখে অফিসে বেরিয়ে গেলো।এইভাবে মাস খানেক চলছে।হঠাৎ জান্হবীর ফোনে ওর পুরোনো প্রেমিক সায়নের নম্বরটা ভেসে উঠতে মান-অভিমান সব ভুলে জান্হবী ওর ফোনটা তুলে নিজের জীবনের সব দুর্বিসহ ঘটনা একে একে বলতে লাগলো।সব শুনে সায়ন নিজের অবস্হার কথা জানালো।ও নিজেও খুব বিপদে পরেছিলো,তাই নিজের দেশের বাড়ি চলে গিয়েছিলো বলে সে সময় জান্হবীকে বিয়ে করতে আসতে পারেনি।তবে জান্হবীকে ছাড়া ও আজও কিছু বোঝে না।তাই নতুন করে ওকে জীবনে ফিরে পেতে চায়।কদিন পর জান্হবীকে ও বিয়েও করতে চায়।জান্হবী পুরোনো রাগ সব ভুলে এই শিম্পাঞ্জির থেকে মুক্তির পথ পেয়ে আবার সায়নের প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলো।অভিক এখন প্রায় দিনই গভীর রাত করে বাড়ি ফেরে।আবার সকালে বেরিয়ে যায়।কোথায় যায় কি করে কিছু খোঁজই জান্হবী রাখে না।রাখেনা বললে ভুল হবে রাখতে চায় না।এই ফাঁকা সময়টা সে রোজই কাটায় সায়নের সাথে।তবে সায়ন ওকে প্রায় ফোর্স করে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে।চেয়েও পারে না জান্হবী নিজেকে সায়নের হাতে সঁপে দিতে।একদিন হাতে নাতে অভিক ওদের ধরে ফেললো।থতমত জান্হবী অভিক কে বলল সায়ন ওর প্রেমিক।জাতিগত বিভেদ থাকার কারণ জান্হবীর বাড়ির লোক সায়নের সাথে বিয়ে না দিয়ে ওর মত একটা কুৎসিত শিম্পাঞ্জির হাতে তুলে দিয়েছেন।অভিক এসব কথা শুনে জান্হবীর ওপর একটুও রাগ না করে সায়নকে জিজ্ঞেস করলো "কবে বিয়ে করতে চান আপনারা জানিয়ে দেবেন আমি সেদিনই ডিভোর্স পেপারে সই করে জান্হবী দেবীকে মুক্তি দিয়ে দেবো"।
"কথাটা শুনে সায়ন বললো এর মধ্যেই ও জান্হবীকে বিয়ে করবে,সব ব্যবস্হা পাকা করে"।
দু-দিন পর জান্হবী অভিককে জানালো আজ ও চলে যাচ্ছে। সায়নের সাথে ওর আজকেই বিয়ে"।
কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে আলমারি থেকে ডিভোর্স পেপারটা বের করে দিতে জান্হবী দেখলো আগে থেকেই ওতে শিম্পাঞ্জি সই করে দিয়েছে।ও নিজেও সই করে দিয়ে পেপারটা নিজের ব্যাগে রেখে দিয়ে বিয়ের সাজে সেজে বেড়িয়ে গেলো সায়নের কাছে।সায়ন ওকে নিয়ে একটা হোটেলে ঢুকলো।জান্হবী সায়নকে প্রশ্ন করলো "কোর্টে না গিয়ে হোটেলে কেন নিয়ে এলে আমাকে"?
"আরে চল না,রেস্ট নিয়ে বিকেলে যাবো বিয়ে করতে" বলে হোটেল ঘরে ঢুকতেই কিছুক্ষন পরই জান্হবীর ওপর সায়ন ঝাঁপিয়ে পরলো।জান্হবী ছাড়িয়ে নিয়ে বার বার বলছে আগে বিয়েটা হোক তারপর সায়ন।বেগতিক দেখে জান্হবী কাঁদতে শুরু করে দিলো।সায়ন ওকে গালে একটা চড় মেরে বিছানায় ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরতে হাতের কাছে কোন রকমে মোবাইলটা পেয়ে কন্টাক্ট লিস্টের প্রথম নম্বরটা ডায়েল করে চেঁচাতে লাগলো অভিক বাঁচাও,হোটেল ক্রিস্টালে আমাকে.....কথা শেষ না হতেই সায়ন ফোনটা জান্হবীর হাত থেকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো মাটিতে।নিজেকে অনেক চেষ্টা করছে বাঁচানোর, শাড়িটা টান মেরে সায়ন খুলে ফেলতেই প্রচন্ড জোরে ওদের দরজাটাকে লাথি মেরে খুললো কেউ।সায়ন ওকে ছেড়ে দিতে তাকিয়ে দেখছে সামনে অভিক, হাতে বন্দুক।ওর সাথে আরো ক-জন পুলিশ।এই শিম্পাঞ্জি অভিকই জান্হবীর আজ পরিত্রাতা।জান্হবীকে হাত দিয়ে টেনে নিজের পেছনে নিয়ে শাড়িটা দিয়ে বললো চলে যান এখান থেকে।একে আমি দেখে নিচ্ছি।জান্হবী কোনমতে গায়ে শাড়িটা জড়িয়ে বেরোতে যাবে এমন সময় গুলির আওয়াজে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখছে অভিকের হাতে গুলিটা লেগেছে।অভিককে আরেকটা গুলি করতে যাবে তখন অভিক পাল্টা গুলি করলো সায়নের পায়ে।সায়ন পা ধরে বসে পড়তে বাকি পুলিশরা ওকে এ্যারেস্ট করলো।অভিককে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হলো।জান্হবীও সাথে গেলো।মুহূর্তের মধ্যে নার্সিংহোম ভীরে ভীর হয়ে গেলো।সেই সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও ছুটে এসেছেন জান্হবী দেখছে।হাতের গুলিটা অপারেশন করে বের করে অভিককে বেডে দেওয়া হলো। জান্হবী এতদিনে অভিকের আসল পরিচয় পেলো।সিআইডি স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসার অভিক রায়।আর সেই সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অভিকয়ের রক্তের সম্পর্কের কেউ নন।অভিকয়ের পথচারীদের জন্য বানানোর আশ্রমের আশ্রমিক এঁরা সবাই।অভিক নিজেও বড় হয়েছে ফুটপাতে,এঁদের পরিচর্যায়।খুব কষ্ট করে মানুষ করেছেন এঁরা।অভিক চাকরি পেয়ে আগে এঁদের জন্য বাড়ি বানিয়েছে।কুৎসিত মানুষটা আজ জান্হবীর কাছে হিরো।ওর আজ আর কোন খেদ নেই।ওর বাড়ির লোক যা করেছেন একদম ঠিক করেছেন।এরচেয়ে ভালো মনের মানুষ ও পেত না।দৌড়ে অভিককে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে অভিক বললো "পারবে এই শিম্পাঞ্জিটাকে নিয়ে থাকতে?আমি বিউটি এন্ড দ্য বিস্টের জায়েন্টটার মতো কিন্তু তোমার ছোঁয়ায় রাজকুমারে পরিনত হবো না সুন্দরী।ভেবে বলো,এ চেহারার মানুষটাকে ভালোবাসতে পারবে তো"?
"যদি বলি ভালোবেসে ফেলেছি" বলে অভিককে গালে একটা চুমু দিয়ে ব্যাগ থেকে ডিভোর্স পেপারটা বের করে ছিঁড়ে ফেলতেই পেছন থেকে উলুধ্বনির শব্দ শুনে দুজনেই তাকিয়ে দেখলো সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সহ জান্হবীর বাড়ির সবাই।লজ্জায় নিজের মুখটা জান্হবী অভিকয়ের বুকে গুঁজে দিলো।।
সমাপ্ত:-
*****