উৎসব
উৎসব


লোকটির নাম উমেশ যাদব।বাড়ি বিহারে।দিল্লীতে কাজের সন্ধানে এসেছিল।
বাড়িতে চারটে পেট।মা,বউ এবং দুটো ছেলে,মেয়ে ।
বন্যায় সব ধুয়ে নিয়ে গেছে।অতীত,বর্তমান এবং ভবিষ্যত।সরকারের দয়ায় মাথা গোজার মত একটা ঠাঁই পেলেও,পেট চলে না।
উমেশ তাই একদিন সিদ্ধান্ত নিল।দিল্লী চলে যাবে।গাঁয়ের বাকি বন্ধুরা সেখানে থাকে।তাদেরকে বললে,নিশ্চয়ই একটা কিছু পেট চালানোর মতো জুটে যাবে।
এসে সবাইকে বলল।তেমন সুবিধে হল না।এখন কাজের অবস্থা ভাল না।চারিদিকে কর্মী ছাটাই চলছে।বিল্ডিং এর কাজ বন্ধ।
এভাবে দিন সাতেক যাওয়ার পর একটা সন্ধান পাওয়া যায় ।
একজন কোটিপতি ব্যাবসায়ীর বাংলোবাড়িতে মালির কাজ।একজন মালি আছে।দ্বিতীয় আর একজন রাখবেন।
মাইনে কম।উমেশ তবু রাজি হয়ে গেল। তাছাড়া আর কোন বিকল্প তার কাছে নেই ।
মাস তিনেক মন দিয়ে কাজ করল।এতটুকু কাজে ফাঁকি দেয়নি।যার ফলস্বরূপ বাংলোর দক্ষিণদিকটা এখন ফুলে,ফুলে দোল খাচ্ছে।যেখানে আজ বছর তিনেক ধরে শুধু ঘাস,পাতে ভরে ছিল।
বাংলোর মালিক মিঃ বীরেন্দ্র সিং সকালে এদিক দিয়ে ঘুরে মর্নিং ওয়াকে যান।এই রাস্তার একপাশে ভাঙাচোরা টালির ঘরে উমেশ থাকে।স্টোভে কোনরকমে ভাত,তরকারি করে একপেট খেয়ে কাজে নেমে পড়ে ।
সে প্রতিদিন উৎসুক চোখে সিংবাবুর পথের দিকে চেয়ে থাকে।
বাবু নিশ্চয়ই তাকে একদিন কাছে ডেকে তার কাজের প্রশংসা করবেন।
কিন্তু না।এমনটা আর হয় না।তার বাবুটি ঘুরেও তাকান না।
এদিকে দীপাবলি এসে গেছে।ঘরে,ঘরে উৎসব।
উমেশের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে।মুন্নি এবং মুন্না দুজনেরই জিন্স চায়।
বউটা কিছু দাবী করেনি।উমেশ তবু ভেবে রেখেছে।একটা কম দামের শাড়ি কিনে দেবে।
দীপাবলির দুদিন বাকি।উমেশ দুরু,দুরু বুকে সকালবেলায় সিংবাবুর সামনে হাজির হল।
সিংবাবু চায়ের সাথে ইংরেজি পেপার উল্টাচ্ছিলেন।
খানিকবাদে টেরা চোখে উমেশকে দেখে বলে উঠলেন,তোকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।কে তুই?কোন দরকার আছে বুঝি?
উমেশ কাঁপা গলায় বলে উঠল,আজ্ঞে বাবু আমি উমেশ।বাগানের মালি।
---ও তাই।কিছু বলছিলি নাকি?
---আজ্ঞে বাবু।দুদিন পর পরব।কিছু বোনাসের জন্য এসেছিলাম।ছেলে,মেয়ে...
উমেশের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সিংবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
মুহূর্তের মধ্যে চোখে,মুখে আক্রোশের আগুন দাউ,দাউ করে জ্বলে উঠল,ইউ রাসকেল...গেট আউট...গেট আউট।টাকা কি ঘাসের বীজ নাকি?দুদিন কাজ করা হয়নি।এসে গেছে বোনাস চাইতে!লজ্জা করে না?...সেইজন্যই ভিখীরিদেরকে আমি কাজে রাখি না।লোভটা তোদের অত্যধিক।রাস্তা থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছিল।খেতে পাচ্ছিলি না তাই।যেই ঠাঁই দিলাম,এমনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলি!একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ।এক পয়সা বোনাস দেওয়া হবে না।তাতে কাজ করার আছে করবি।না হয় কেটে পড়।এখানে কাকের অভাব হবে না।
উমেশ এরপর আর কোন কথা বলেনি।শুকনো মুখ করে সেখান থেকে ফিরে এলো।
ছেলে,মেয়ের মুখদুটো মনে পড়ছে।কী যে বলে সান্ত্বনা দেবে,সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না।
বুক ঠেলে কান্না আসছে।
আসার সময় দেখে এসেছিল,বউটার কাপড়টা দু,তিন জায়গায় ফেটে গেছে ।সেলাই করে,করে ওটাই বোধহয় আজো পরছে।
তার মায়ের আবার কোমরে ব্যথা ।তিনমাস অন্তর মালিশের জন্য কবিরাজীর কাছ থেকে তেল আনাতে হয়।তিনশো টাকা লাগে।শিশিটা এতদিনে নিশ্চয়ই ফুরিয়ে গেছে।
এতকিছু ভাবনার মাঝেও উমেশ কিন্তু কাজে কোন ফাঁকি দেয় না।সমান তালে কোদাল,গাইতি ঠিকই চালাচ্ছে ।
দীবাবলির রাতে সিংবাবুর একমাত্র ছেলে মারাত্মক দূর্ঘটনার শিকার হল।বন্ধুদের সাথে রাত করে পার্টি থেকে ফিরছিল।
কারু একটা বাজি পটকা দুর্ভাগ্যবশত তাদের গাড়ির নিচে ফেটে যায়।
পেট্রোল ইঞ্জিন।সাথে,সাথেই ব্লাস্ট।গাড়ির চারজন,চারদিকে ছিটকে পড়ে।
সিংবাবুর ছেলে ড্রাইভ করছিল।তাই রক্ষে।দুজন তো স্পট ডেড।একজনের একটা পা পুরো ঝলসে গেছে।
আর সিংবাবুর ছেলে মোক্ষম সময়ে ঝাঁপ দিয়েছিল ।
এখন অ্যাপোলো এমার্জেন্সিতে ভর্তি আছে।প্রচুর ব্লাড গেছে।ও নেগেটিভ রক্তের স্টক শেষ।তখন ডাক্তার বাধ্য হয়ে চেন্নাইএ ফোন করেন।
সারাটা রাত সিংবাবু চোখের পাতা এক করতে পারেননি।
সকাল দিকে রক্ত আসছে শুনে বাড়ি ফিরলেন।
এসেও নিশ্চিন্ত হতে পারেন না।
ফোন করতে লাগলেন,হ্যালো.আমি মিঃ সিং বলছি।ফ্লাইট চেন্নাই থেকে টেক অফ করেছে তো?আর হ্যাঁ ...এয়ারপোর্ট থেকে ড্রোন ডেলিভারি যেন দেওয়া হয়।রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক।ডাক্তার বলেছেন,হাতে ঘন্টাটেক সময় আছে।তার থেকে বেশি দেরি হলে,হার্ট কাজ করা বন্ধ করে দেবে।কুইক।
কথা শেষ হতেই পিছনে উমেশ এসে হাজির।হাতে একটা ফাটা ব্যাগ।
----বাবু...আমি...
উমেশকে এই সময় দেখে সিংবাবুর মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠল।
----ননসেন্স আবার এসেছিস?বাড়ি যাচ্ছিস যা না।তোর মতো হাজারটা কুকুর প্রতিদিন আমার বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।এত ন্যাকামী করে লেজ নাড়াতে আসিস না।
একপর উমেশ আর সেখানে এক মুহূর্তও দাড়ায়নি।
ওদিকে হন্তদন্তভাবে সিংবাবু হাসপাতালে পৌছলেন।দেড় ঘন্টার জায়গায় দুঘন্টা হয়ে গেছে।ড্রোন ডেলিভারি দেওয়া যায়নি।প্রশাসনের অনুমতি ছিল না।তাই তিরিশ মিনিট বাড়তি দেরী।
রক্ত নিয়ে ওটিতে ঢোকার মুখেই তাকে একজন ডাক্তার বাধা দিয়ে উঠলেন,প্লীজ স্যার।এখন যাবেন না।পেসেন্ট বিশ্রামে আছে।
সিংবাবুর বুকটা ধক করে উঠল,বলেন কি?আর রক্ত!
----সে তো ঘন্টা দুয়েক আগেই পাওয়া গেছে।
---পাওয়া গেছে!!
---একজন লোক এসেছিল।আপনার বাগানে নাকি মালির কাজ করে।নাম উমেশ যাদব।ওই দিয়ে গেছে।রক্তের জন্য এত খোঁজাখুঁজি করছিলেন।অথচ দাতা আপনার বাড়িতে।এসকল ব্লাডমেটদের চিনে রাখা খুব দরকার।অসময়ে দরকার পড়ে।
সিংবাবু ছুটতে লাগলেন।
গাড়ি নিয়ে যখন বাংলোই পৌছলেন।সেখান থেকে উমেশ তার সমস্ত চিন্হটুকু মুছে দিয়ে চিরদিনের জন্য বেরিয়ে গেছে।
সিংবাবু জীবনে এই প্রথম কাউকে হারানোর বেদনাই কেঁদে উঠলেন।