তুঁহু মম/১
তুঁহু মম/১
কুমুদিনী,
খবর শুনেছ? কাল ভারতে জনতা কারফিউ। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, কাল কেউ বাড়ি থেকে বেরোবে না। বাস ট্রেন বিমান সব বন্ধ থাকবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আটকাতে এই ব্যবস্থা। কিছুক্ষণ আগে খবরটা টিভিতে দেখাল। কেন জানি না মনে হচ্ছে এই কারফিউ একদিনে শেষ হবে না। অনেক দিন ধরে চলবে। ইউরোপে যেমন চলছে। তোমাকে কি অভীকের কথা বলেছি? না বোধহয়। অভীক আমার ক্লাসমেট। একসঙ্গে মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়তাম। এখন ও বার্সেলনা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। আজ সকালে ও একটা অদ্ভুত টেক্সট করেছে। লিখেছে, সারাদিন ব্যালকনিতে বসে থাকা ছাড়া এখন আমার আর কোনও কাজ নেই। রাস্তার দিকে তাকাতে ভয় করে। যেখানে-সেখানে ডেডবডি পড়ে আছে। বিকট শব্দ করে দৌড়ে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। এসব দেখে আমার ভয় করে। আমরা এই পৃথিবীতে থাকব তো অর্জুন? ক'দিন হল আমি আমার শেষ ইচ্ছেগুলো লিখতে শুরু করেছি। এর মধ্যে মজার ব্যাপার কী বল তো? আমার শেষ ইচ্ছে নেহাত কম নয়। সব মিলিয়ে একান্নটা। হয়তো এই ইচ্ছেগুলোর জন্যেই আমি বেঁচে যাব।
অভীকের লেখাটা পড়ার পর থেকে একটা অবসাদ আমাকেও পেয়ে বসেছে। একটাই প্রশ্ন বারবার মাথার ভেতর পাক খাচ্ছে। সামান্য একটা ভাইরাসের কাছে আমরা কি হেরে যাব? অনেক চেষ্টা করেও যখন এই বিচ্ছিরি প্রশ্নটির হাত থেকে রেহাই মিলল না তখন আচমকা তোমার কথা মনে পড়ল। কলকাতায় যতবার তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, দেখেছি, তুমি খুব সহজেই মনের গুমোট কাটিয়ে দিতে পারো। যদিও এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই। তুমিও বন্দি। কাগজে পড়লাম পরশু থেকে কলম্বোয় লকডাউন শুরু হয়েছে। কেমন আছ কিছুই বুঝতে পারছি না। বোঝার জন্যই কাল তোমাকে ফোন করেছিলাম। ফোনটা এনগেজড ছিল। তাই আজ আর ফোনের কথা ভাবিনি। চিঠি...থুড়ি, মেইল করছি। কেমন আছ জানিও। কবে দেশে ফিরতে পারবে, তাও। আর সম্ভব হলে তোমার অফুরান প্রাণশক্তি থেকে এক আঁজলা আমায় ধার দিও।
অর্জুনদা
কলম্বো
শ্রীলঙ্কা
অর্জুনদা,
এইমাত্র তোমার মেইল দেখলাম। গোড়ায় ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি কেমন আছি জানার জন্য ডঃ অর্জুন দাশগুপ্ত মেইল করেছে? আরিব্বাস! মাথায় চাঁটি মেরে নিজেই নিজেকে বললাম, তুই তো বর্তে গেলি রে কুমু! নয়তো যে-মানুষটা পোড়া বঙ্গদেশের কফি শপে বসে অনায়াসে মৌর্য যুগে চলে যায় এবং জুড়িয়ে জল কফিতে চুমুক দিয়ে বলে, বাঃ বেশ করেছে কিন্তু-- তার কখনও আমার কথা মনে পড়ে!
যাক, সে কথা। কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে মনোরোগের কয়েকটি বিশেষ দিক নিয়ে পেপার পড়তে এসেছি সে তো তুমি জানো। কোভিডবাবুর দস্যিপনার কথা কলকাতাতেই শুনেছিলাম। গুরুত্ব দিইনি। মাতৃদেবীর সাবধানবাণীও ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছি। হুঁশ ফিরল সেমিনারের দিন, যখন ব্রাজিলের ডঃ অক্টাভিও গোমেজ ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বললেন, কুমুডিনি গো ব্যাক টু ইয়োর কান্ট্রি ইমিডিয়েটলি। সিচুয়েশন ইজ আউট অব কনট্রোল। কলম্বো শহরটা বেশ মনে ধরেছিল। ভেবে রেখেছিলাম সেমিনারের পর দু'দিন একটু ঘুরব। গোমেজ সাহেবের কথায় ইচ্ছেটি বাতিল করতে হল। ভাবলাম ফিরেই যাই। মাও রোজ তাগাদা দিচ্ছে। মায়ের ধারণা করোনা নামক ভাইরাসটির জন্মই হয়েছে তার মেয়েকে কেড়ে নেওয়ার জন্য। ট্র্যাভেল এজেন্টকে বলেও দিলাম ফ্লাইট বুক করার জন্য৷ কিন্তু পরের দিনই এখানকার গভর্নমেন্ট বিমান এবং জাহাজ পরিবহণ বন্ধ করে দিল। তারপর পরশু থেকে লকডাউন। তবে আছি বেশ ভালোই। ইউনিভার্সিটি আমাদের একটা গেস্ট হাউসে রেখেছে। আমি আর বাংলাদেশের জয়া আখতার। আমাদের দেখভালের দায়িত্বে আছেন সুধা আম্মা। আমরা ওর ভাষা বুঝি না আর উনি আমাদের ভাষা বোঝেন না। তবুও ওর তর্জন-গর্জন শুনতে মন্দ লাগে না। মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকলেও ঈশ্বর আমাদের মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেননি।
এবার তোমার কথা। তোমার বন্ধু ওই অভীকবাবুটিকে বেশ লাগল। যার শেষ ইচ্ছে একান্নটি তাকে মারার সাধ্য কোভিডবাবুর হবে না। এই আমাকেই দেখো না। এত যে বাঁচতে ভালোবাসি সে কি বৃথা যাবে বলতে চাও? উঁহু। কোমলি নেহী ছোড়েগি! কিন্তু তোমার এ কী হাল অর্জুনদা! লকডাউনের কথা চিন্তা করে আগেভাগেই এত হতাশ হচ্ছ কেন? লকডাউন হলে হবে। দেশের একজন তরুণ ও সম্ভাবনাময় আর্কিওলজিস্টকে সরকার তো আর জলে ফেলে রাখবে না। খাবে-দাবে ঘুমোবে। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মহাপদ্মনন্দের বউ কেমন করে চুল বাঁধত তার স্বপ্ন দেখবে।
রাগ করলে? আরে বাবা আমি তো ঠাট্টাই করছি। ঠিক আছে, সরি। আর ঠাট্টা করব না। কিন্তু তোমায় কথা দিতে হবে, হতাশ হবে না। আমার কথা যদি শোনো তা হলে বলব, তুমিও শেষ ইচ্ছেগুলো লিখতে শুরু করো। হতাশা কাটানোর জন্য এটা একটা ভালো উপায়। আমিও লিখতে চাই। তারপর মেলাতে চাই তোমার সঙ্গে। দু'একটা ইচ্ছে যদি মিলে যায় মন্দ কী!
ভালো থেকো
কুমুদিনী

