তুমি রবে নীবরে
তুমি রবে নীবরে
-''এমন বাবাইদা যদি আমার জীবনে একটা থাকত বেশ হত কিন্তু।'' তিতি বলে। আইনক্স থেকে বেরিয়ে কেএফসিতে ঢুকেছিল ওরা সবাই। তিতি, রোলী, কোয়েনা,পুপাই, আদি আর অনি। সবাই ওরা সল্টলেকে একসঙ্গে এমবিএ পড়ছে।
-''আমাদের মিস বিউটির কিন্তু একটা বাবাইদা আছে জানিস তো?'' পুপাই বলে ওঠে।
-''তুই কি করে জানলি?'' রোলী বলে।
মিস বিউটি উপমাটি ওদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী শান্ত মেয়ে ঈশিকার জন্য। ঈশিকা দেখতে যেমন সুন্দর পড়াশোনাতেও ভালো। কিন্তু ক্লাস শেষ হলেই বাড়ি চলে যায়। হেসে সবার সঙ্গে কথা বললেও কোনো গ্ৰুপেই মেশে না সেভাবে।
-'' ও আমার মাসির ননদের মেয়ে তোদের আগেও বলেছি। ওর পাশের বাড়িটাই ওর বাবাইদার বাড়ি। নামটা অবশ্য দীপ, ডাক্তারি পাশ করে এমডি পড়ছে। ভীষণ ভালো ছেলে।''
-''ঈশিকাকে দেখে তো মনে হয় না রে ! ও যে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে বোঝাই যায় না।'' কোয়েনা বলে।
-''ঐ জন্য বাড়ি যাওয়ার অত তাড়া। কোনোদিন ক্যান্টিনেও আসে না মেয়েটা।'' অনি চিকেনের লেগ পিসটা শেষ করে বলে।
আদি এতক্ষণ ছিল নির্বাক শ্রোতা। ঈশিকাকে নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকে। ও উঠে বাইরে বেরিয়ে আসে।
-''কিরে, তুই বাইরে চলে এলি যে।'' তিতিও উঠে এসেছে পেছন পেছন।
পকেট থেকে ফোনটা বার করে আদি বলে -''দরকারি ফোন করবো একটা। ভেতরে যা কিচিরমিচির চলছে।''
তিতি সরু চোখে ওকে দেখে। ঈশিকাকে নিয়ে যে আদির একটা ব্যাথা আছে ও ভালোই বোঝে। কারণ আদির প্রতি ও নিজেই ভীষণ উইক।
আদি ফোন কানে কথা বলতে বলতে আরেকটু সরে যায়। তিতির কাঁধে হাত রাখে কোয়েনা। চোখে আশ্বাসের বাণী, বলে -'' কুল তিতি, ধীরে এগো। হবে, আমি বলছি, হবে তোর।''
তিতির গা জ্বালা করে। কোয়েনার এই একুশ বছরের জীবনে বাইশটা প্রেম। কোনটাই ছমাসের বেশি টেকাতে চায় না ও। নিজেকে লাভগুরু মনে করে বিশাল ভাও খায়। ইদানিং একটা ব্যবসায়ী ছেলে আদেশ বাজাজ কে পাকরাও করেছে।
ওদিকে রোলী আর পুপাইয়ের কেমিষ্ট্রিও জমছে ধীরে ধীরে। ওদের গাইডও কোয়েনা।
তিতি একটু বিরক্তি নিয়েই এগিয়ে যায় আদির দিকে। আদি ফোনটা রাখতেই বলে -''আমায় পৌঁছে দিবি একটু?'' বৈশাখীর খাল পার করে কেষ্টপুরে ওর বাড়ি। আদি হেলমেট নেই বলে এড়িয়ে যায়।
আরো কিছুক্ষণ হয়তো আড্ডাটা জমত কিন্তু আদি হঠাৎ কাজ আছে বলে চলে যেতেই তিতিও উঠে পড়ল। কোয়েনার বাজাজ ও এসে গেছিল ওকে পিক আপ করতে। রোলী আর পুপাই ও বনবিতানের দিকে হাঁঁটা লাগায়।
******
গেট দিয়ে ঈশিকাকে ঢুকতে দেখেই এগিয়ে যায় আদি। -'' কি রে, তুই এলি না তো কাল ! কত মজা হল। ''
ঈশিকা বলে -" আমি তো কোথাও যাই না আগেই বলেছি।''
-''কেন রে? তোর দীপ দা রাগ করবে?''
আদির মুখে দীপের নাম শুনে কেমন গম্ভীর হয়ে যায় ঈশিকা। কান দুটো আরো লাল হয়ে ওঠে।
-''তুই তো তারই থাকবি, দু একটা মুহূর্ত না হয় আমদের সঙ্গে ভাগ করে নিলি।''
আদির কথা বলার ধরনে রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলে ঈশিকা। বলে -'' এই তো কাটাচ্ছি সময়।''
-''আজ সেকেণ্ড পিরিয়ডটা অফ, ক্যান্টিনে বসে টিচারস ডের মিটিং করবো সবাই। আসিস কিন্তু।'' আদি জানে ঈশিকা এসব এড়িয়ে চলে। তবুও বলে।
সেকেণ্ড পিরিয়ডে ফাঁকা লাইব্রেরীতে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল ঈশিকা। আদি এসে ওর পাশেই বসে।
-''আমাদের সঙ্গে মিশলে কি তোর বাড়িতে বকাবকি করে?''
-'' কেন বল তো?'' একটু বিরক্ত হয় ঈশিকা।
-''সব সময় একাচোরা হয়ে থাকিস ...''
-''প্লিজ, আদি!''
-''দেখ, আমার কেন জানি মনে হয় এই জীবনটা তোর জন্য নয়। তুই একটা প্রজাপতির মত উচ্ছল জীবন কাটাতে চেয়েছিলি কিন্তু....''
বইটা বন্ধ করে উঠে পড়ে ঈশিকা। মুখটা ভার।
দুদিন আদি কলেজে আসেনি। ঈশিকা কাউকে জিজ্ঞেস না করলেও এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজেছে ছেলেটাকে। আজ ঢুকেই দলটাকে বকুল গাছের নিচে দেখতে পায় ও।
-''ঈশু, এদিকে আয়।'' কোয়েনার ডাকে বকুল গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় ও।
-''তোকে পরশু ডায়মণ্ড প্লাজায় যে টাকলু ছেলেটার সঙ্গে দেখলাম ওটাই কি তোর 'বাবাই দা'? ''
কোয়েনার চোখ মটকে বাবাই দা বলার ধরন দেখে সবাই হেসে ওঠে। ঈশিকা চোখ নামিয়ে নেয়।
-''দীপদা পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, এ বছর এমডি হয়ে যাবে। আমাদের ঈশিকা একটু ফ্রি ট্রিটমেন্ট দিস তখন।'' পুপাই বলে।
-''আচ্ছা ঈশিকা ঐ টাক মাথা আধ বুড়ো টাইপ লোকটাকে তোর ভালো লাগে? মন থেকে বলবি কিন্তু। তোদের কিন্তু একদম মানায় না। বাবা না হোক কাকু ভাইঝি মনে হচ্ছিল তোদের। '' নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে কোয়েনা।
-''যাষ্ট স্টপ ইট! কার কাকে ভালো লাগবে সেটাও কি তোরা ঠিক করবি? ভালোবাসা কি এতো নিয়ম মেনে হয়?'' বেশ দৃঢ় গলায় বলে আদি।
ঈশিকা চোখ তুলে তাকায় ওর দিকে।
-''আহা, তুই ক্ষেপছিস কেন? ঈশিকার মত সুন্দরী ব্রিলিয়ান্ট মেয়ের জন্য বন্ধু হিসাবে আমাদের ভাবাটা সামাজিক দায়বদ্ধতার ভেতর পড়ে।'' রোলী বলে ওঠে।
-''ডিসগাষ্টিং....'' বলে আদি বেরিয়ে যায় ক্লাসের দিকে। ঈশিতাও ওর পিছু পিছু রওনা দেয়। তিতির চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। ও দ্রুত আদির পিছনে ছোটে -'' আদি, দাঁড়া, আমি আসছি।''
******
-''সরি ঈশু, ওদের হয়ে আমি সরি।'' বাসস্টপে ঈশিকাকে দেখে এগিয়ে আসে আদি।
-''ইটস ওকে।''
-'' তুই কিছু মনে করিসনি তো?''
আদির দিকে তাকিয়ে ঈশিকা মাথা নাড়ে। -''জানিস ঈশু কেউ যদি কাউকে ভালোবাসে তার জন্য বাইরের সৌন্দর্য দেখে না, ভেতরটা দেখে। মানুষটাকে দেখে। তুই এতো ভালো তোর দীপদা নিশ্চই খুব ভালো মনের মানুষ। বেষ্ট অফ লাক।'' হাতটা বাড়িয় দেয় আদি।
ঈশিকা অবাক হয়ে দেখছিল। কি উত্তর দেবে একথার।
-''তোর দীপদা নিশ্চই তোকে প্রচুর সময় দেয় তাই আমাদের সঙ্গে সময় কাটাতে তোর ভালো লাগে না।'' আদির গলাটা ভারি হয়ে আসে। ঈশিকা ইতস্তত করে, বাসটা আসে না।
-''তুই তো দীপদার হয়েই আছিস। তবুও যদি একটু আমাদের সঙ্গে সময় কাটাস খুব কি ক্ষতি হবে?'' আদির গলায় আকাঙ্খার ছোঁওয়া।
-''না রে, আসলে...'' বাসটা ঠিক তখুনি চলে আসে।
*****
পরীক্ষার পর সব বন্ধুরা মিলে একদিন ডায়মণ্ড হারবার যাবে ঠিক হয়েছিল। ঈশিকা উদাস, ওকে কেউ তেমন সাধেনি। শুধু বাসে ওঠার সময় আদি একবার বলেছিল -''কলেজ তো শেষ। আর দেখা হবে না। তোর মন যা চায় তাই করিস। সবাইকে খুশি রাখতে গিয়ে নিজের খুশি গুলোকে বাজি রাখিস না।''
ঈশিকার বুকের ভেতর চেপে রাখা কান্নাটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ইচ্ছা করছিল আদির সঙ্গে আরো কিছুটা সময় কাটাতে। কিন্তু উপায় নেই। চলন্ত বাসের দিকে তাকিয়ে আদি বলেছিল -'' পরশু সকাল সাতটায় শিয়ালদায় তুই আসবি, আমার মন বলছে।''
*****
ডায়মণ্ড হারবার লোকাল ছাড়তে ঠিক এক মিনিট বাকি। পিছনের এই কামরাটা আজ কিছু কলেজ পড়ুয়ার দখলে, চিৎকার করে গান গাইছে একদল। কেউ গিটার বাজাচ্ছে। রফিক মাউথঅরগ্যান বাজাচ্ছে। একমাত্র আদি প্লাটফর্মে। ওর মন বলছে সে আসবে। সবুজ আলোটা জ্বলে রয়েছে, ট্রেনটা তীব্র হুইসেল দিয়ে কেঁপে উঠতেই আদি কচিসবুজ চুরিদার আর সাদা ওড়না পরা ঈশিকাকে দেখতে পায়, ছুটে আসছে। প্রায় ওকে টেনে নিয়ে আদি ট্রেনে উঠতেই ট্রেনটা ছেড়ে দেয়। কয়েক চুল দূরে ঈশিকার তখন শ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। সবাই ওকে দেখে হাততালি দিয়ে ওঠে।
গঙ্গার পারে সারাটা দিন ছবির মত কাটে। আকাশের রঙ বদলাতেই ঘরে ফেরা পাখির ঝাঁকের মত একদল তরুণ তরুণী ট্রেনে উঠে যায়। ঈশিকা আজ ভীষণ উচ্ছল, চঞ্চল, যেন বাধ ভাঙা বন্যা।
আদি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে -''এভাবেই মনের কথা শুনে চলিস সবসময়।''
*******
বিয়ের বাজার করতে গেছিল ঈশিকা, দীপদা সেখানেও ফোনে ব্যস্ত। জাম রঙের বেনারসি নাকি হাল্কা পেয়াজি দুটোই গায়ে ফেলে দেখছে ও বারবার। কাকে জিজ্ঞেস করবে! টুং করে মেসেজ ঢোকে, ''তোর প্রিয় রঙ বোধহয় নীল।''
অবাক ঈশিকা ভাবে ওর প্রিয় রঙ ও নিজেই ভুলে গেছিল। গাঢ় নীল বেনারসিটাই দিতে
বলে।
' আকাশ নীলের জামদানিটা নিতেই পারিস। ' নম্বরটা কার ? ঈশিকা তো কাউকে নম্বর দেয়নি কখনো!
' কচি কলাপাতায় হলুদ কাঞ্জিভরণটা একবার দেখ।' ঈশিকা আসে পাশে তাকায়। আদিকে কোথাও দেখতে পায় না। কিন্তু যে ওকে মেসেজ করছে সে আসেপাশেই রয়েছে। নয়ত শাড়িগুলো দেখছে কী করে?
' রয়েছি তোর মনের ভেতর
তোর হৃদয়ে আমার এ ঘর।'
আবার দুটো লাইন ভেসে ওঠে। ঈশিকা রিং করে। নট রিচেবল বলছে। উফ।
ও লেখে- ''প্লিজ, সামনে আয়।''
-''সাত চলব সারা জীবন
ভালোবাসা থাক না গোপন।''
দীপের তাড়ায় তাড়াতাড়ি শাড়িগুলো গুছিয়ে নেয় ও।
মনটা কেমন ভার হয়ে যায়। মনের কথা... কী করে শুনবে ও মনের কথা। কী করে বোঝাবে সবাইকে ও কী চায়। অসহায়ের মত দীপের দিকে তাকায়। ড্রাইভ করছে সে আনমনে। লোকটা কেয়ারিং, খুব ভালো, কিন্তু...!
কোয়েনার ফোন আসে -''কি রে, শপিং শেষ। আর কয়দিন ?'' ঠিক তিরিশ দিন বাকি বিয়ের।
'' আদি আর পুপাই আজ ক্যাম্পাসিং এ চাকরী পেয়েছে পুনেতে জানিস। রোলী ও পেয়েছে দূর্গাপুরে।'' কোয়েনা বলে।
-''বাঃ, ভালো খবর।''
-''এবার তো বাড়িতে বল আদির কথা। এখনো সময় আছে।'' কোয়েনা বলে।
বুকের ব্যাথাটা মুচড়ে ওঠে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না ঈশিকা। ছোটবেলা থেকেই ওর বিয়ে পাকা। দীপদা ওর পাশের বাড়ি হলেও 'বাবাইদা' হয়ে ওঠেনি কখনো। দীপদার সঙ্গে বন্ধুত্বটাই তো গড়ে ওঠেনি কোনোদিন। চিরকাল ভাল ছাত্র, পড়া পাগল ছেলেটা ওকে কখনো তাকিয়েও দেখেনি বোধহয়। কিন্তু দুই বাড়ির যৌথ ইচ্ছায় বিয়েটা হচ্ছে। ফোনটা বন্ধ করে ব্যাগে রাখে ও।
******
সব বন্ধুদের ফোনেই নিমন্ত্রন করতে হয়েছিল। দীপের মা বিয়ের আগে ঈশিকাকে আর বের হতে বারণ করেছে। ঈশিকার মনে হচ্ছিল আস্তে আস্তে চারদিকের সব জানালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।ওর ইচ্ছা ওর ভাললাগার কথা কেউ ভাবছে না। বাবা মা শুধু ভালো জামাই পাচ্ছে বলেই খুশি।
সেদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টির পর আধভাঙা চাঁদ উঠেছিল। বিয়ের আর চারদিন বাকি, ঈশিকা পায়ে পায়ে ছাদে উঠে এসেছিল। কদম ফুলের মাতাল করা গন্ধে বাতাস ভারি। ওদের বাড়ির পাশের কাঠালি চাঁপা গাছ থেকে টুপটাপ কাঁঁচা সোনা রঙের কাঠালি চাঁপা খসে পড়ছে ছাদে। ভীষণ কান্না পাচ্ছিল ঈশিকার। এই বাড়ি, এই সবকিছু আর ওর থাকবে না। ছোট থেকেই দীপদার কথা বলে বলে ওকে বিভিন্ন কাজে বাধা দিয়েছে বাবা মা, ও ভাল নাচ করত। ক্লাস সেভেনে থাকতেই দীপদার মা বলেছিল নাচ ছেড়ে দিতে। পরে ছাড়লে নাকি মোটা হয়ে যাবে, এরপর ও গান গাইত। ইলেভেনে দীপদার বাবা বলেছিল গান ছেড়ে পড়াতে মন দিতে। যদি মেডিক্যাল জয়েন্টটা হয়ে যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টের উপর দিকে নাম ছিল। আবার ও বাড়ি থেকে বাধা এসেছিল। এমবিএটা পড়েছিল জোর করেই। তবে ওরা বলেছিল করপোরেটে চাকরী করতে দেবে না। স্কুল বা কলেজের টিচার হলেও চলবে। চুড়িদার আর শাড়ি ছাড়া পছন্দের পোশাকগুলো একে একে ছাড়তে হয়েছিল ওকে। আজ মনে হচ্ছে এই তেইশ বছরের জীবনে ও একটা দিনও নিজের মত করে কাটায়নি, ঐ ডায়মণ্ড হারবারের দিনটি ছাড়া।
'দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি' হঠাৎ সুর করে বেজে উঠল ওর ফোনটা, সেই নম্বর! ফোনটা ধরতেই কেটে গেল। কে হতে পারে?
পাগলের মত ডায়াল করল ঈশিকা, বন্ধ। টুং করে মেসেজ এল-' মন খারাপ?'
-'কে?'
-'গলাটা কেমন ভেজা ভেজা মনে হল!'
-'কে তুমি? সামনে এসো প্লিজ।' ঈশিকা দ্রুত টাইপ করে।
-'সামনেই তো ছিলাম।'
চোখের জল মুছে ঈশিকা লেখে -' প্লিজ... কে বলো?’'
-''চোখ বুজলেই দেখতে পাবি। একবার মনের দরজায় উঁকি দে।''
ঈশিকা জোরে শ্বাস টানে।মাতাল করা কদম ফুলের গন্ধ ভরে নেয় নিজের ভেতর। তারপর চোখ বোজে। ঝাপসা ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে আস্তে আস্তে।
রিং হচ্ছে আবার ফোনটা। ও কানে তুলে নেয়, -''আদি, প্লিজ, এভাবে কষ্ট দিস না। আমি আর পারছি না।'' কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ও। ওধারে নিশ্চুপ.... কেটে যায় ফোনটা।
দীর্ঘশ্বাসটা ঈশিকা শুনতে পায় না।
******
সানাইয়ের সুরে, জুঁই আর রজনীগন্ধার গন্ধে আলোর রোশনাইতে সেজে উঠেছে বিয়েবাড়ি। কনের সাজে ঈশিকাকে অপূর্ব লাগছে। কোয়েনা সহ ওর বান্ধবীরা খুনসুটিতেই ব্যস্ত। পুপাই ফটো তুলছে সবার।
বর আসার কোলাহলে সকলে ওকে ফেলে ছুটল গেটের দিকে।
টিং টিং করে আবার মেসেজ ঢুকল, ' অপূর্ব লাগছে তোকে, হিংসা হচ্ছে খুব। ভালো থাকিস, ভালো রাখিস।'
অবাক হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে ঈশিকা। একটু আগেই ফেসবুকে ছবি পোষ্ট করেছে পুপাই ওকে ট্যাগ করে।
মালা বদল, শুভ দৃষ্টি, কন্যদান পরপর নিয়মের ঠেলায় কেমন যেন বিরক্ত লাগছে ঈশিকার। ফোনটাও হাতে নেই। কোয়েনার কাছে। বিয়ের নিয়মগুলো পালন না করে কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না ও।যজ্ঞ শেষে সিঁদুর দান হতেই একটু ছাড়া পেল যেন। কোয়েনার থেকে ফোনটা চেয়ে ঐ নম্বরে ফোন করল। নট রিচেবেল! বর তখন শালীদের সঙ্গে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। বারবার করে ঐ নম্বরটায় ট্রাই করে ঈশিকা। কিন্তু যান্ত্রিক গলায় উত্তর ভেসে আসে।
বাসরঘরে ঢুকেও আনমনা ঈশিকা।বেশ কিছু হাসি ঠাট্টার পর একে একে অনেকেই চলে গেল। ঈশিকা আবার ঐ নম্বরটা ট্রাই করে। না, লাগছে না। ও আর থাকতে না পেরে বরের দিকে ঘুরে বলে -'' এই নম্বরটা বন্ধ কেন? এটা তোর নম্বর নয়?''
ওর হাত থেকে ফোনটা টেনে নেয় ওর সদ্য বিয়ে করা স্বামী, বলে -'' না তো।''
মৃদু গুঞ্জন, ফিসফিস, সবাই একটু অবাক। উঠে দাঁড়ায় ঈশিকা। নিচের ঘরে বাবাকে গিয়ে ডাকে, ওর পেছন পেছন এসেছে বর বেশে ওর সদ্য বিবাহিত স্বামী।
-''বাবা, দীপদা ঠিক কি বলেছিল তোমায় সেদিন?''
ব্যস্ত হয়ে ওঠেন ঈশিকার বাবা। বলেন-'' আঃ, আজ আবার এসব কথা কেন মা?''
-''প্লিজ বাবা, বলো আমায় ?''
ওদের দিকে একবার তাকিয়ে ওর বাবা বলেন -'' চারদিন আগের সেই বৃষ্টির রাতে আমি আর তোর মা গেছিলাম দীপদের বাড়ি, নিমন্ত্রন করতে। বিয়ে নিয়ে দীপের সঙ্গে কখনোই কোনো কথা হয়নি আমাদের। সেদিন হঠাৎ ও এসে বলে ও এই বিয়ে করবে না। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল সেই মুহূর্তে। তখন দীপ আমাদের আদির কথা বলে। জানায় ছেলেটা ভালো, নতুন চাকরী পেয়েছে। তোকে ভালো রাখবে। দীপের নাকি এ বিয়েতে মত ছিল না।ওর বাবা মা জোর করে দিচ্ছিল। ওর সঙ্গে তুই নাকি সুখী হবি না।জোর করে আমাদের নিয়ে যায় আদিদের বাড়ি। ও নিজে দাঁড়িয়ে সব ব্যবস্থা করে। আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না মা।তোকে জিজ্ঞেস করার কথাও মনে হয়নি।''
-''উনি তার আগের দিন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। বাবা মাকে রাজি করিয়ে গেছিলেন। আমি যে ঈশিকাকে পছন্দ করি সেটা জেনেই এসেছিলেন।'' আদি ধীরে ধীরে বলে।
সেদিন আনেক রাত করে বাবা মা বাড়ি ফিরেছিল থমথমে মুখে। ঈশিকাকে শুধু বলেছিল দীপ বিয়েতে রাজি নয়। বিয়েটা আদির সঙ্গে হবে।
ঈশিকা ভাবছিল সে স্বপ্ন দেখছে। নিশ্চই আদি কিছু করেছে। ছেলেটা সব পারে, ম্যাজিক জানে। দীপদাকে পটিয়ে ফেলল।
উত্তেজনায় এই কদিন আর কিছু ভাবতে পারেনি ঈশিকা। ওর স্বপ্নগুলো যে ভগবান এভাবে সত্যি করে দেবে কখনো ভাবেনি ও। আদিকে ধন্যবাদ দেবে নাকি ভগবানকে ভাবতে পারছিল না। পরদিন সকালেই দেখেছিল দীপদাদের বাড়িতে তালা, বাঁশ খুলে ফেলছে ডেকরেটার্স। শুনেছিল ওঁরা সবাই সপরিবারে ঘুরতে চলে গেছে।
-''আমি যেদিন শাড়ি কিনতে গেছিলাম গত মাসের ১৪ তারিখ, আদি তুই আমায় মেসেজ করিসনি? কী রঙের শাড়ি কিনবো…..''
-''ঐ দিন তো আমাদের ফাইনাল ক্যাম্পাসিং ছিল। জয়েনিং লেটার দিচ্ছিল রে, সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম।'' আদি বলে।
-"নম্বরটা ট্রু কলারে ফেলে দেখ না? আমায় দে তো ?'' পুপাই এগিয়ে আসে। আ্যপের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে ও জেনে যায় সিমটা কার। ফোনটা বাড়িয়ে দেয় ঈশিকা কে! জ্বল জ্বল করছে একটাই নাম -'দীপশিখর রায়।'
হঠাৎ টুং করে আরেকটা মেসেজ ঢোকে -'' তোরা সুখী হলেই আমি সুখী। এবার থেকে একটু নিজের কথাও ভাবিস। নিজের ইচ্ছাটাও একটু মুখ ফুটে বলিস। ভালো থাকিস।''
আদির হাতটা শক্ত করে ধরে চোখ মোছে ঈশিকা।