তুই পাশে মম
তুই পাশে মম


বৈশাখের রাত। অনেকক্ষণ ধরেই লোডশেডইং। হ্যারিকেনের আলোয় রান্নাঘরের কাজ সেরে অলি আলোটা বড় ঘরের এক কোণে কমিয়ে রেখে ছাদে উঠে এলো। আকাশে ম্লান আলোর ক্ষয়াটে চাঁদ আর টিমটিমে তারার সভা বসেছে। কয়েক রাত আগেই পূর্ণিমা পেরিয়ে গেছে, তবু চাঁদের আলো কি মোহময়। অলি ছাদের দরজার পেছনে রাখা সতরঞ্চিটা পেতে গা এলিয়ে দিলো। ছ্যাঁকা লাগলো পিঠে। এখনো রোদের তাত ছাদের গা থেকে মুছে যায়নি। তবু উঠে বসলো না ও, বরং চিৎ হয়ে রাতের আকাশ দেখতে থাকলো। আর আকাশ দেখতে গিয়ে মনে পড়ে গেলো কলির কথা, ওর থেকে ঠিক এক বছরের ছোট বোন কিন্তু কলির বাড়ন্ত গঠনের জন্য দুজনকেই এক বয়সীই মনে হতো।
ছোটবেলাতে দুজনেই এরকম অন্ধকার রাতে ঘরের বাইরে খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতো আর তারা গুনতো আর বুঝতে চেষ্টা করতো কোনটা বেশী উজ্জ্বল কোনটা মিটমিট করছে। মা তখন রুটি গড়া শেষ করে অপেক্ষা করতো কখন ওদের বাবা ফিরবে কাজের থেকে। তারপর ওরা চারজনে খেয়ে শুতে যাবে। বাবা বিহারের মজফ্ফরপুর শহরে এক সরকারি অফিসে কাজ করতো। কাজ শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরতে রাত করতো। তারপর খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরের বাইরে উঠোনে খাটিয়ায় ঘুম। ঘরের ভেতরে ভীষণ গরম তাই সেখানে শোয়ার চিন্তা করতো না ওরা। বেশ চলে যাচ্ছিলো জীবন, স্কুল যাওয়া, বন্ধুদের সাথে খেলা, মাঝমধ্যে বাঁকুড়ায় মামাবাড়ি বেড়াতে আসা কিন্তু ভাগ্যদেবতার বোধহয় সব ওলটপালট করে দেওয়ার ইচ্ছে জাগলো।
ওদের সংসার আকাশে ধুলোর ঝড় উঠলো। এক সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই ওদের মা মারা গেলো কদিনের জ্বরে ভুগে। মা চলে যাওয়াতে সংসারের প্রতি উদাসীন বাবা আরও উদাসীন হয়ে পড়লো। কিন্তু নিজে সংসার ছাড়া হলেও মেয়েদের তো জলে ফেলে দিতে পারে না। তাই ওদের এনে তুলল সেই মামাবাড়িতেই, বাবার দিকের আত্মীয়স্বজনেরা কেউ ওদের দুই বোনের দায়িত্ব নিতে রাজি হল না। যে মামাবাড়িতে মা থাকাকালীন ওদের আদর ছিল খুব সেই বাড়িতেই মায়ের অবর্তমানে ওদের সাথে অন্যরকম ব্যবহার হতে লাগলো। আর বাবা তো ওদের অধীনে ফেলে দিয়ে নিরুদ্দেশ হল যার কারণে ওরা চুপ করে সব সয়ে থাকতে বাধ্য হল। স্কুলে যাওয়ার সাথে সাথে বাড়ির কাজেও হাত লাগাতে হতো। অলি মেনে নিলেও কলি মানতে চাইতো না। বোনকে একা পেলেই বলতো “সুযোগ আসলেই পালাবো”
“কোথায়?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করতো অলি।
“যেখানেই যাই তোর সাথে দেখা ঠিক করতে আসবো”
এসব আলোচনা মাঝ পথেই থেমে যেতো কারণ তখনও বয়েসটা কম তাই অচেনা পৃথিবীর হাতছানিতে বুক দুড়দুড় করতো।
এসবের মাঝে মামাবাড়িতে নতুন নতুন মানুষের মাঝেমধ্যেই আগমন হতো। কেউ বড়মামীর ভাই তো কেউ মেজমামীর বোনপো আবার ছোটমামীর এক মাসতুতো দাদাও শেষের দিকে আসা ধরেছিল। প্রথম প্রথম অলি অবাক হয়ে ওদের দেখে বোনকে বলতো “এতদিন আছি এর আগে কোনদিন মামীদের আত্মীয়স্বজনদের সেরকম আসতে দেখিনি। এখন একটু বেশিই আসছে না রে?”
কলি ঠিক খবর জোগাড় এনে বলেছিল “ওরা এমনি আসছে না আমাদের দেখানোর জন্য নিয়ে আসা হচ্ছে, যদি আমাদের দু বোনকে বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে নামানো যায় তাই”
দেখতে অতি সাধারণ বলে কেউ বউ করে নিয়ে যেতে রাজি না হলেও ফষ্টিনষ্টি করতে ওদের বাধতো না। অলি ভয়ে ভয়ে থাকতো কিন্তু কলি বলতো কেউ বদমায়েশি করলে তার ব্যবস্থা এমন করবো না বাছাধন টের পাবে। সেই কলিই এক রাতে বাড়ি ছাড়লো। পরেরদিন অলিকে ধরে কি জেরা মামীদের কিন্তু ও তো কিছুই জানে না। মামীরা বিশ্বাস করলো না। পরে শুনলো গোয়ালাপাড়ার রতনদার সাথে পালিয়েছে। তখন অলির মনে পড়লো কলি আভাসে ইঙ্গিতে দু একবার রতনদার কথা বলেছিল বটে। কিন্তু পালিয়ে গিয়ে কলি হারিয়েই গেলো ওর জীবন থেকে। পড়াশোনা শেষ করে গ্রামীণ স্কুলে একটা কাজ জুটিয়ে ও মামাবাড়ির আশ্রয় ছাড়লো। কাজের জায়গাতেই তারপর পলাশে
র সাথে আলাপ যা একটু একটু করে ভালোবাসার দিকে মোড় নিয়েছিল বলেই আজ ও পলাশের গৃহিণী।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। অলি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো। শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন চোখদুটো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। উঠে বসে ও বুঝতে চেষ্টা করলো সত্যিই কেউ দরজা ধাক্কালো নাকি ও ভুল শুনলো। পলাশের আসার সময় হয়ে গেছে না? না মনে হয়। তাহলে? কিন্তু না সত্যি কেউ দরজায় কড়া নাড়ছে। ও সিঁড়ী বেয়ে নেমে হ্যারিকেন নিয়ে দরজা খুলে যাকে দেখলো তাকে দেখে আনন্দে ওর বুকটা ভরে উঠলো। “ওমা কলি তুই? আয় আয় ভেতরে আয়। কতদিন পর দেখলাম তোকে যা আনন্দ হচ্ছে না” বলেই ওর হাতটা ধরলো ও। কিন্তু ধরেই অলির ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। বোনটা কত রোগা হয়ে গেছে!
কলি পায়ে পায়ে ভেতরে এলো দিদির সাথে। সোফায় বসিয়ে অলি বলল “যা গরম পড়েছে। তুই বস আমি তোর জন্য শরবৎ নিয়ে আসি” তারপর হাতপাখাটা ওর হাতে দিয়ে বলল “কারেন্ট নেই অনেকক্ষণ। তুই এটা ঘুরিয়ে হাওয়া খা আমি এখুনি শরবৎ নিয়ে আসছি তারপর তোর সব গল্প শুনবো” কলি নীরবে ঘাড় নাড়লো।
শরবৎ নিয়ে এসে অলি বোনের মুখোমুখি বসলো “কেমন আছিস বল? এতো রোগা হয়ে গেছিস কেন? অসুখ করেছিলো?”
“আছি। অসুখ করেনি”
“এবার বল তুই এতদিন পর কোথা থেকে আসছিস আর কানাঘুষোয় শুনেছিলাম তুই রতনদার সাথে বাড়ি ছেড়েছিলি, সে কোথায়?”
কলি হাসলো এবার “তোকে বলেছিলাম না যেখানেই যাই না কেন তোর সাথে দেখা করতে ঠিক আসবো তাই এলাম। রতনের প্রেমে পড়ে বাড়ি ছাড়িনি আমি কাজ খুঁজে দেবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, সেই কাজের প্রলোভনে পড়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম। কিন্তু ঐ যা হয় ডাগর মেয়ে অচেনা শহরে গিয়ে পড়লে তাই হল আমার সাথে। প্রথমে রতন ভোগ করলো তারপর যার কাছে বেচে দিলো তার হাতেই ছিন্নভিন্ন হতে থাকলাম। কিন্তু যে অন্যায়ের প্রতিবাদে মামাবাড়ি ছাড়লাম সেই অন্যায় যখন অন্যলোকও করা শুরু করলো তখন মেনে নিই কি করে? সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম কবে প্রচুর টাকার মালিক হবো। এই সাধারণ চেহারাটাকেই শানিয়ে অসাধারণ করে তুললাম। সেই আকর্ষণে অনেক পোকাও উড়ে এলো মধুর খাওয়ার লোভে। প্রতি রাতের বিনিময়ে টাকাও নিলাম প্রচুর। যখন খরচ করার থেকেও বেশী টাকা হয়ে গেলো তখন লোক ভাড়া করলাম। তারপর যে যে অন্যায় করেছে তাদের এক এক করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলাম”
এই পর্যন্ত বলা শেষ হতে অলি চমকে উঠে বোনের মুখে হাত চাপা দিলো “আরে চুপচুপ। কেউ শুনে ফেললে তোর কি গতি হবে জানিস? পুলিশ আসবে জেল হবে”
কলি হাসলো “অতো দূর আর যেতে পারলাম কই? তবে তো আবার নতুন করে জীবনটা শুরু করার সুযোগ থাকতো”
“মানে কি বলতে চাইছিস বুঝতে পারলাম না”
“প্রথমদিকে হাত বদল হতে হতে এক কয়লা মাফিয়ার হাতেও পড়েছিলাম। কিছুদিন অত্যাচার করার পর যখন ও অন্য মেয়েতে মন দিলো তখন পালানোর সুযোগ পেতেই পালিয়েছিলাম। কোন বন্দি পাখি হাতছাড়া হলে মালিকপক্ষ মানতে পারে না। ও সুযোগ খুঁজচ্ছিলো আমাকে ধরার আর আমি সুযোগ খুঁজচ্ছিলাম আমার প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার। সুযোগ পেলাম কিন্তু ওকে মারতে গিয়ে নিজের জীবন দিতে হল। আফসোস নেই যা করেছি বেশ করেছি। চলে যেতাম কিন্তু তোর কথা মনে পড়লো তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই। তোর উৎকণ্ঠাও শেষ হল আমাকে নিয়ে”
অলির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। একমাত্র বোন ছিল কলি সেও ছেড়ে চলে গেলো। কলি বলল “দুঃখ করিস না যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি চলি। পুলিশ এতক্ষণে আমার মৃতদেহ পরিচয়হীন বলে পুড়িয়ে দিয়েছে। তুই শুধু আমার নামে একটু শ্রাদ্ধ করে দিস যাতে আমায় প্রেতযোনিতে ঘুরে মরতে না হয়। তবে আমি থাকবো আজীবনকাল তোর সাথে”
“একবার গলাগলি করবি না কলি যাওয়ার আগে?”
বোনকে জড়িয়ে ধরলো ও কিন্তু ওর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে।