তুহিনের স্বীকারোক্তি
তুহিনের স্বীকারোক্তি
বর্ণালী স্কুল থেকে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে বাড়ি ফিরছিল। সাইকেলের সামনের চাকাটার হাওয়া বেরিয়ে গেছে অথচ আগের সপ্তাহেই একবার হাওয়া দিয়ে নিয়ে এলো। মনে হচ্ছে টায়ারে লিক হয়েছে। এই গরমে দোকান আর খোলা নেই নিশ্চই নাহলে এখনি সারাতে দিয়ে যেতো। আজ স্কুলে রুম্পার সাথে কথা কাটাকাটিই হয়ে গিয়ে ওর মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে আছে। রুম্পার কি দরকার ছিল সবার সামনে ঢাক পেটানোর যে ওর সূর্য স্যারকে খুব ভালো লাগে। সবাই হইহই করে উঠলো সেই কথায়। ‘স্যারের প্রেমে পড়েছিস’ এই কথাটা বলে সবাই ওকে একেবারে পাগল করে তুলেছিল শেষে অর্ণব, ওদের ক্লাস মনিটার ধমকে ওকে চুপ করায়। অথচ সেরকম কোন ব্যাপার ওর মাথায় আসেনি। সূর্য স্যার ওদের অঙ্ক পড়াতে আসছেন এই মাস ছয়েক হল।
কার্তিক স্যার অন্য স্কুলে বদলি হয়ে যাওয়ার পরে সূর্য স্যার এসেছেন। বর্ণালী অঙ্কে বরাবরই বেশ কাঁচা একই জিনিস বারবার করেও পরীক্ষার সময় ভুল করে বসে বেমালুম। নতুন স্যার স্কুলে জয়েন করেই একটা অলিখিত নিয়ম করেছেন। বইয়ের একটা করে অধ্যায় শেষ করেই উনি ক্লাসে পরীক্ষা নেন তাতে ধরা পড়ে সবাই ঠিকমতো অঙ্ক বুঝেছে কি না। ক্লাসের এই পরীক্ষাতেই বর্ণালীর অঙ্কভীতি স্যারের কাছে ভালোভাবেই ধরা পড়েছে। তিনি অবশ্য ওকে বকাঝকার বদলে অফ পিরিয়ডে আলাদা করে অঙ্ক বোঝাচ্ছেন ক্লাসের আরও কিছু অঙ্কে কাঁচা ছাত্রছাত্রীর সাথে। খুব সহজ করে বোঝানোর ফলে বর্ণালীর এবার অঙ্ক বুঝতে সুবিধে হচ্ছে। সেটাই ও গল্প করেছিল রুম্পার কাছে কিন্তু ও বুঝলও অন্য কিছু আর ক্লাসের বাকিদেরও বোঝালো সেই উল্টোটাই। বর্ণালীর ভয় যদি এ কথা স্যারের কানে যায় তো কি ভাববেন উনি।
“এ্যাই বর্ণা... এ্যাই”
বর্ণালী পেছন ঘুরে তাকালো, ওর পেছনে তুহিন, ওরই ক্লাসে পড়ে। তুহিনের প্রশ্ন “সাইকেল খারাপ নাকি?”
ও বলল “হ্যাঁ। কি ব্যাপার রে তুই এদিকে? তোর বাড়ি তো উত্তর পাড়ায় জানতাম”
তুহিন হাসলো “হ্যাঁ ঠিকই জানিস। আমি এদিকে এসেছি রাজাদের বাড়ি যাবো বলে”
রাজা রায় বর্ণালীদের পাড়াতে থাকে ওদের ক্লাসেই পড়ে তবে বেশ কিছুদিন হল স্কুল আসছেনা। ও বলল “ও বন্ধুর খোঁজ নিতে যাচ্ছিস? কিন্তু ওরা তো বাড়িতেই নেই”
“নেই... আশ্চর্য! কাল রাতে যখন ওর সাথে ফোনে কথা হল তখন তো বলেনি যে ওরা এখানেই নেই”
“সেটা কি করে বলবে। ওরা তো আজ ভোরে গেলো ভাগলপুর, ওর দাদুর শরীর খুব খারাপ, ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। কাল মাঝ রাতে খবরটা এসেছে”
“ও”
“ও নেই তো কি হয়েছে তুই আমাদের বাড়ি চল শরবৎ জল খেয়ে তারপর নাহয় বাড়ি যাবি”
“আরে না, আজ আর যাচ্ছি না অন্য যেদিন রাজার বড়িতে যাবো সেদিন যাবো। চলি রে”
তুহিন চলে যাওয়ার পরেই বর্ণালীর চোখে পড়লো ও ঘণ্টা সাইকেল সারাইয়ের দোকান সামনে এসে পড়েছে আর যেমন ভেবেছিল সেটাই ঠিক, গরমে দোকান বন্ধ। ও সাইকেল ঠেলে চলে এলো বাড়ি। মা একটু উদ্বিগ্ন হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ওকে সাইকেল ঠেলতে দেখে বুঝলো সব কিছু তাই আর কিছু না জিজ্ঞেস করে মেয়েকে সাইকেল নিয়ে ঢুকতে দিলো।
সন্ধ্যায় পড়া নিয়ে বসে বর্ণালীর মনে পড়ে গেলো রুম্পার কথা। ভীষণ অস্বস্তি হল আবার কথাটা মনে পড়তেই। ওদিক থেকে মনকে টেনে সরিয়ে ও পড়ায় মন দিলো। পরেরদিন আবার পরীক্ষা আছে আর ও তাতে ভালো নম্বর পেতে চায়।
পরেরদিন সকালে সাইকেলটা দোকানে জমা দিয়ে ও হেঁটে স্কুল যাচ্ছে এমন সময় দেখা হয়ে গেলো অঙ্ক স্যারের সাথেই। উনিও হেঁটেই যাচ্ছেন স্কুল। বর্ণালী বেশ অবাক হল। স্যার কোনদিকে থাকেন তা এতদিন ও জানতো না তাছাড়া স্যার আসতেন বাইকে। আজ তাহলে হেঁটে কেন? তবে কি স্যারের গাড়ি খারাপ? দূর অতও ভাবার দরকার কি? ভাবতে ভাবতে ও স্যারের কাছাকাছি চলে এলো।
“সুপ্রভাত স্যার”
স্যার মাথা নাড়লেন তারপর কি মনে পড়তে বললেন “আজ তোমাদের ক্লাসে পরীক্ষা না?”
বর্ণালী উত্তর দিলো “হ্যাঁ স্যার”
“ভালো করে অনুশীলন করে এসেছো তো?”
“হ্যাঁ স্যার চেষ্টা তো করেছি”
“অঙ্ক হচ্ছে অনুশীলনের জিনিস যত করবে তত পোক্ত হবে”
ও মাথা নাড়লো। হঠাৎ বর্ণালী খেয়াল করলো ওরা স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। দলে দলে ছাত্রছাত্রী ঢুকছে স্কুলে। এর মধ্যে ওদের ক্লাসের ছেলেমেয়েও আছে। কাল রুম্পা যা করেছে তাতে সবাই একটু অন্যরকম গন্ধ পেয়েছে। এরপর যদি এখন স্যারের সাথে একই সঙ্গে স্কুলে ঢুকতে দেখে কেউ আবার কে কি বলবে কে জানে। ও আড় চোখে একবার স্যারের দিকে তাকালো। স্যার ফোনে কারো সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ও পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেলো তারপর ধীরে ধীরে স্যারের অনেক পিছনে স্কুলে এসে ঢুকলো।
চতুর্থ পিরিয়ডে সূর্য স্যার ক্লাসে এলেন। আগে ঠিক করা অঙ্ক পরীক্ষা শুরু হল। সবাই খুব মন দিয়ে অঙ্ক কষছে। খানিক পরে পরীক্ষা শেষ হল। আজ বর্ণালী খুব খুশি। ও আগের থেকে ভালো পরীক্ষা দিয়েছে। স্যার সবার খাতা জমা নিতে নিতেই বেল পড়ে গেলো। পরের ক্লাসগুলো একই ভাবে পেরিয়ে টিফিনের ঘণ্টা পড়লো। টিফিনে ওরা বাড়ি থেকে আনা খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ খেলে তারপর ঘণ্টা পড়লে আবার ক্লাসে ছোটে। শেষ ঘণ্টা পড়তে বোধহয় আর কিছু সময় বাকি এমন সময় অঙ্ক স্যার উপস্থিত হলেন পরীক্ষার খাতাগুলো নিয়ে। খাতাগুলো দিয়ে মুখে বললেন “তোমরা আজ ভালোই পরীক্ষা দিয়েছ তবে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছে বর্ণালী। ও দশে দশ পেয়েছে”
স্যার চলে যেতেই রুম্পা বলল “দেখলি স্যার তোকে ভালোবাসেন বলেই তোকে অত নম্বর দিয়েছেন। নাহলে তুই বরাবর অঙ্কে কাঁচা, তোকে কি ভাবে বেশী নম্বর দেন?”
বর্ণালী খাতা খুলে দেখলো ও সবকটাই ঠিক করেছে। রুম্পাকে তাই বলল কিন্তু রুম্পা ওর ধারণার থেকে সরতে রাজি নয়। বর্ণালী আড় সেই চেষ্টায় না গিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলো।
আজ সাইকেলটা নেবে, জমা দেওয়ার সময়ই বলে এসেছে দোকানটা যাতে একটু বেশী সময় খোলা রাখে। ও হেঁটে হেঁটে প্রায় দোকানের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকলো “বর্ণা... বর্ণা”
ও ঘুরে দেখলো তুহিন। কি ব্যাপার! প্রতিদিনই তুহিন এই রাস্তায় কেন? প্রশ্নটা এলো বর্ণালীর মনে। কাল প্রশ্ন করাতে বলেছিল ও রাজাদের বাড়ি যাবে বলে এ পথে এসেছিলো। কিন্তু ওরা তো নেই। আজ তাহলে কি বলবে? আচ্ছা ও কি সত্যি কারো বাড়ি যাওয়ার জন্য এ রাস্তায় আসছে নাকি অন্য কারণ আছে? মনে হয় কারণটা অন্যই! কি সেটা? ও কি ওকে কিছু বলতে চাইছে? কি? ও তুহিনকে বলল “কি রে কোথায় চললি?”
তুহিন ওর পাশে এসে সাইকেল থেকে নেমে পড়লো তারপর রুমালে মুখ মুছে বলল “তোর কাছেই আসছিলাম”
“আমার কাছে... কেন?”
“তোর অঙ্ক খাতাটা একটু দেখাবি?”
“হ্যাঁ কেন দেখাবো না? দ্যাখ” বলে ও ব্যাগ থেকে খাতাটা বার করে দিলো। তুহিন খাতাটা দেখলো আজকে যে পরীক্ষা হয়েছে সেই পাতাটা। কিন্তু বর্ণালীর মনে হচ্ছে ও খাতা দেখতে নয় অন্য কিছুই বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। ও বলল “তোর খাতা দেখা হয়েছে নাহলে তুই নিয়ে যা কাল স্কুলে দিয়ে দিস। আমি বেশি দেরী করলে সাইকেলটা আজ এবেলায় আর পাবো না। তাহলে আবার বিকেলে আসতে হবে”
“না হয়ে গেছে খাতা দ্যাখ। এই নে”
বর্ণালী খাতাটা নিয়ে ব্যাগে রাখছে তুহিন বলল “তোকে একটা কথা বলবো ভাবছি”
“বল না”
“তুই কি সূর্য স্যারকে ভালবাসিস?”
“এটা আবার কেমন প্রশ্ন। আমি স্যারকে শ্রদ্ধা করি। তিনি আমাকে এতো সুন্দর করে অঙ্ক বুঝিয়েছেন যে এখন আমার অঙ্ক ভীতি চলে গেছে। এখন আর অঙ্ক করতে আমার খারাপ লাগে না”
“ও তুই স্যারকে ভালোবাসিস না। আমি তো অন্যরকম শুনেছিলাম তাই...”
“কিন্তু তুই এ কথা জিজ্ঞেস করছিসই বা কেন? আমার ভালোবাসা আছে কিনা জেনে তুই কি করবি”
“আমি যে তোকে ভালোবাসি”
তুহিনের এই কথায় বর্ণালী অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আজ ও বুঝতে পারলো তুহিন ওকে কেন অতো মন দিয়ে দেখে খেয়াল করে ওর প্রতিটা গতি। হঠাৎই ওর গাল দুটো লালচে হয়ে উঠলো।