Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Drama Horror Thriller

3  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Drama Horror Thriller

ট্রেন যাত্রা( পর্ব - আট)

ট্রেন যাত্রা( পর্ব - আট)

6 mins
194


প্রত্যয়বাবুর ঘরের সামনে এসে দেখি ঘর খোলা,আমি ঢুকে সোজা উনার চেয়ারের পাশে গিয়ে বসলাম, উনি তখন আরাম কেদারায় বসে রয়েছেন দৃষ্টি বাইরে, কোলে একটা বইয়ের মতো কি রাখা।

আমি কোনো ভনিতা না করে সোজাসুজি বললাম, অবশ্য আমার সেসময় ভনিতা করার মন মানসিকতা কিছুই নেই। "সব উত্তর মিলে গিয়েছে। "

হঠাৎ করে কথাটা শুনে কথার উৎস খুঁজতে তাকাতেই আমাকে নীচে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললেন "ওখানে বসে রয়েছ কেন মা?"

আমি কোনো কথা না বলে উনার হাতে মালাটা দিতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন "কেন খুলেছ মালাটা?"

" না না খুলিনি, এই দেখুন গলায় রয়েছে। এটা তো আমার এই কবজের মধ্যে ছিল। "

বলে বাম হাতে রাখা দ্বিখণ্ডিত কবজের অংশটি দেখালাম।

তিনি অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে হাতে নিলেন কবজের টুকরোগুলো। তারপর নাড়িয়ে টারিয়ে দেখে বললেন "এটা আবার কোথা থেকে পেলে।"

আমি উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেলাম।

" আমার এই কবজ মায়ের দেওয়া, যে মায়ের আঁচল তলে আমি বড় হয়েছি। মা আমাকে এই কবজ দিয়ে বলেছিলেন কখনো কাছ ছাড়া না করতে। আর তারসাথে এটাও বলেছিলেন কখনো যেন না হারাই, যত্ন করে রাখি যেন এটা। একবার খুলে রেখেছিলাম দেখে মা বকেছিলেন। যে মা তার মিনুকে কখনোই বকতেন না।"

প্রত্যয়বাবু বললেন "তারমানে তোমার কাছে তোমার দাদার লকেটসহ মালা খানি এসেছিল ট্রেন যাত্রার সময়, অদ্ভুত হলেও এটা সত্যি দেখছি।"

" আপনার শুনেই অদ্ভুত মনে হচ্ছে আর আমি এই অদ্ভুতের অংশীদার। আমার মনের অবস্থা কি চলছে আন্দাজ করেন। আমি ছোট বেলায় কোনো জানতে বা বুঝতে পারিনি যে আমি আমার পরিবারের মেয়ে নই। কোনো দিনও আলাদা চোখে দেখেনি কেউ৷ হঠাৎ বছর খানেক আগে মায়ের মৃত্যুর সময় জানলাম আমাকে আর ভাইকে নাকি কোথায় খুঁজে পেয়েছেন তিনি। কিন্তু কোথায় কিভাবে জানিনা। মা বলে যাননি বা বলার সময় পাননি। এরপর হঠাৎ স্বপ্ন দেখলাম ট্রেন যাত্রার সময়, কাকতালীয় ভাবে মালাটা পেলাম।কতটা অদ্ভুত একটা স্বপ্ন ছিল আপনাকে বলে বোঝানো আমার পক্ষে কেন কারোর পক্ষেই হয়তো সম্ভব না। " আমি হঠাৎ পেছন ঘুরে বললাম "আচ্ছা আমার জন্মদাতা মা-বাবার মৃত্যু ঘটেছিল কি রে জানতে পারি?"

প্রত্যয়বাবু একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন "আর কি বলব সেই অভিশপ্ত ঘটনার কথা। তুমি হয়তো শুনেই থাকবে গাইসালের ট্রেন দূর্ঘটনার কথা। ওই মর্মান্তিক দূর্ঘটনার.. "

আমি শুনে চিৎকার করে উঠে, দুহাতে মুখ ঢাকলাম।

প্রতীম এতোক্ষণ চুপ করে ছিল, এবারে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো " কি হলো মান্তু? কষ্ট পেলে?"

আমি কেমন ঠকঠক করে কাঁপছিলাম, সেদিন স্বপ্নে দেখা সব বিভৎস দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

আমি তেমনি করে দাঁড়িয়ে রয়েছি দেখে সে আমার কাঁধে হাত রাখতেই বুঝতে পারলো আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। আমার হাত ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে জোর করে জল এগিয়ে দিলো।আমি জলটা খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হতেই ধীরে ধীরে বললাম সবটা। এমন কি আর কি কি দেখেছি এতোদিন পর্যন্ত সবটা বললেম। আমার মুখে সবটা শুনে প্রতীম বললো "এই কারণে মন্দিরের সামনে তুমি আমার সাথে সেই ব্যবহারটি করেছ?"

" আমার ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত, তখন আমার .. "

" থাক মান্তু তোকে এতো কিছু বলতে হবে না।"

হঠাৎ প্রত্যয়বাবু আমাকে ডেকে বললেন "এদিকে আয় তো মা, দেখ পুরোনো অ্যালবাম আমাদের বাড়ির। এটাই দেখছিলাম।"

সত্যি বলতে আমার এখনো কিছুই মনে পড়েনি। খালি হিসেব মিলেছে মাত্র।

আমি এগিয়ে এসে বসে পড়লাম। অ্যালবামের পাতা উল্টে উল্টে তিনি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন আত্মীয়দের সাথে। এমন সময় প্রতীম বললো "তোর হয়তো এখন মনে নেই, তোর পিসি ঠাম্মা আমার বাবার কাকিমা হয়ে ছিলেন, দুই পরিবারের ইচ্ছেতেই বিয়েটা হয়। উনাদের বাবারা বন্ধুত্বকে আত্মীয়তায় রূপান্তরিত করেছিলেন সম্পর্কগুলোকে আরও দৃঢ়তা করার জন্য। "

আমি প্রত্যয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেম " তাই?"

উনি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালেন।

" তারমানে তুই আমাদের পরিচিত নয়, আত্মীয়াও।"

আমি কিছু উত্তর দিলাম না।

অ্যালবামের একটা পাতা উল্টোতেই একটা ছবিতে আমার চোখ আঁটকে গেল, আমি আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম "আমি উনাকে চিনি, আমি দেখেছি।"

প্রত্যয় আর প্রতীম একসাথে বললেন "কি করে সম্ভব? "

" আরে ইনি তো আমার সামনে বারবার আসতেন, ইনার হাত ধরেই তো এখানে এসেছিলাম, তবে সেটা হয়তো স্বপ্নে, নইলে এতোটা পথ আসা কি সম্ভব? যদি স্বপ্নও হয় সবকিছু বড়ই জীবন্ত ছিল, আমার মনে হতো সবটা বাস্তব। অবশ্য তখন আমি জানতাম না জায়গাটা ঠিক কোথায়, যে আসামে রয়েছে তা জানলাম আপনাদের সাথে এসে।"

প্রতীম প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো "এটা কি করে সম্ভব? উনি.."

উনার কথা শেষ করার আগেই বললাম "কেন? আপনার কি মনে হয় মিথ্যা বলছি?"

" তা নয় মান্তু, তুমি জানো উনি কে?"

আমি মাথা দুলিয়ে না বলাতে, প্রতীম বলল " মনিকা কাকিমা,মানে তোমার জন্মদায়িনী মা।"

আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। উনি আমার মা? উনি তো জীবিত নেই। তাহলে?

আমার আবার সবকিছু গুলিয়ে গেল। আমি অবোধ্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম।

প্রত্যয়বাবু মাথায় হাত দিয়ে বললেন " কি রে কি ভাবছিস মা?"

" স্যার উনি আমার মা?তবে কি উনি আমাকে ভয় দেখাতেন কেন?"

উত্তরটা প্রত্যয়বাবু নয়,প্রতীম দিলো " মান্তু মনিকা কাকিমা হয়তো তোকে ভয় দেখান নি, হয়তো তোকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। হয়তো কিছু বলার আছে তোকে। "

প্রত্যয়বাবু বললেন "তাই হবে হয়তো। নইলে.... "

কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম " যদি তাই হয় তবে এতোদিন যোগাযোগ করেননি কেন? "

" হয়তো পারেন নি, ভুত প্রেত এসবের বিষয় আমার ধারণা অতি সীমিত। তবুও আমার মনে হয় তোর সাথে যোগাযোগ করার সূত্র পায়নি। "

আমি হু করে চুপ করে গেলাম। একটা কথা মনে পড়াতে বললাম " আমারও এসবে বিশ্বাস ছিলো না, তবে আপনার কথার একটা যোগসূত্র পাচ্ছি। হতে পারে আপনার আন্দাজটা ঠিক হতে পারে। "

প্রতীম এতোক্ষণ চুপ করে কথা শুনছিল, সে এ যুগের ছেলে এসবে বিশ্বাস করাটা সোজা না। কিন্তু অবিশ্বাস করতেও মন চাইছেনা প্রতীমের।

" হঠাৎ এমন কথা বলছিস কেন মান্তু?"

আমি প্রতীম আর প্রত্যয়বাবুর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললাম " আমি শেষ যেদিন ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছিলাম, যেদিন বিভৎস স্বপ্নের সাথে সাথে গলায় থাকা মালাটা পাই, সেদিন ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন মাস্টারের ঘরে গিয়েছিলাম, উনার কাছে থেকে অনেক কষ্টে জানতে পারি সেই ট্রেনের কামরাগুলো গাইসাল ট্রেন দূর্ঘটনায় ব্যবহৃত কামরা। সবে সারাই করে জেনারেল কামরার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। মাঝেও চেষ্টা করা হয়েছিল কি কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এবারে নতুন একজন অফিসার এসে কামরাগুলোর অবস্থা ভালো দেখে নাকি ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর এখন বলছেন আমার জন্মদাতা মা-বাবা নাকি ওই দূর্ঘটনায়..."

" শুধু দাদা বৌদি না, তোমার দাদা আর ঠাকুমা, ঠাকুরদাও চলে গিয়েছিলেন, আমাদের কলকাতার বাড়িতে আমার ছোট বোন মানে প্রতীমের ছোট পিসির বিয়েতে গিয়েছিল তারা। ফিরতি পথে.." বলে মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠেন।

প্রতীম এগিয়ে এসে প্রত্যয়বাবুর কাঁধে হাত দিয়ে বললো "আমি তখন অনেকটাই ছোট তবে এতোটুকু মনে আছে বাবা-কাকাইরা ছুটে আসলেন গাইসালে। খোঁজ করা হলো। কিন্তু না পাওয়া গেল তোর খোঁজ, না পাওয়া গেল কাকুদের কারো খোঁজ। অনেক ছোটাছুটির পরে এতোটুকু জানা গেছিল তোরা যে কামরায় ছিলি সেখানে কেউ বেঁচে ছিল না। কিন্তু কারো দেহ পাওয়া গেল না। সব তাবড় তাবড় নেতাদের সাথে যোগাযোগ করা হলো,বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করা হলো, কিন্তু কিছুই লাভ হলোনা। আমরা ভাবতেই পারিনি তোকে দেখবো। তোর বড় পিসি আর দেশে আসেনি সেই ঘটনার পরে, তোর ছোট পিসির আমার মেজকার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল, সেও আর কোনো দিনও এদিকে আসলোনা। এই দূর্ঘটনার বছর খানেক পরে বিয়ে করে তারা দিল্লিতে চলে গেল, ওখানকার কোম্পানির দায়িত্ব নিয়ে। তোর কাকা বলেই দিলো আর সে চা-বাগানে ফিরবেন না। বাবার কাছে তার অংশটা বিক্রি করে দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেল উড়িষ্যায়, পুরীধামে বড় হোটেলের ব্যবসা খুলে বসলেন। এখন দীঘা, থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় হোটেল খুলেছে ব্রাঞ্চ হিসেবেই।আমরা গেলে ওখানেই উঠি।তবে আমার এতোকিছু মনে ছিল না,সবটাই বড় হয়ে শোনা।"

আমি চুপ করে সব শুনছিলাম, কি মনে হতে বললাম "আচ্ছা উনাদের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ কে করেছিলো? "

কথাটা শুনে প্রত্যয়বাবু আমার দিকে তাকালেন। আমিও হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন করে বসলাম জানিনা।

তিনি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন "দেখো মা সেভাবে শ্রাদ্ধশান্তি করা হয়নি..."

আমি বিস্ময়ের সুর " করা হয়নি!!"

" না, কি করে করা হবে? আমরা যে কারো দেহাংশ পায়নি। হিন্দু শাস্ত্রমতে ১২ বছরের আগে করা যায়না।"

কেন জানিনা আমার মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। চোখের কোল নিজের অজান্তেই ভিজে গিয়েছিল। আমি বললাম " তারমানে ১২ বছর পরে করা হয়েছিল? "

প্রত্যয়বাবু ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে বললেন "আমরা করিনি মানে আমরা তো ঠিক করতে পারি না, তবে তোমার কাকা-পিসিরা করে থাকলে আমরা জানিনা।"

আমি আর কিছু বললাম না ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। আমার মনটা কষ্টে ভারাক্রান্ত হয়ে গেল আমার অজ্ঞানে হারিয়ে ফেলা আপন জনেদের জন্য।

বিঃদ্রঃ - কেমন লাগছে গল্পটা জানালে ভালো লাগতো। আর যদি ভুল ভ্রান্তি ধরিয়ে দিতেন তবে শুধরে নিতে পারতাম নিজেকে...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama