SUBHAM MONDAL

Romance Tragedy Others

2  

SUBHAM MONDAL

Romance Tragedy Others

ঠিকানা

ঠিকানা

7 mins
112


ভিড়ে ঠাসা ব্যস্ততম রাস্তায় টোটোচালক আর একটু হলেই রূপলালের দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল আর কী। তবে কিনা রূপলালেল রাগের প্রকাশ আজকাল অসহায়। টোটোচালকের দিকে কয়েক সেকেণ্ড চেয়ে রূপলাল বলেছিল "রিক্সা সমেত আমাকে ধাক্কা দিয়ে দয়া কর বাবা।"

- "আমাকে ক্ষমা করো। ভুল হয়েছে কাকা।" ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল টোটো চালক। রূপলাল রিক্সায় বসে সেদিকে চেয়ে থাকল। তার যদি একটা টোটো থাকত তবে সে কাউকে ভােয়াকা করত না। এমনকি প্যাসেনজারদের ও নয়। কালাে পিচের পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরে সে একা পাড়ি দিত। শহর ছাড়িয়ে সবুজ ক্ষেত ছাড়িয়ে সে চলে যেত। কোথায় ? তা সেও জানে না, কিন্তু যেত।


হঠাৎ রূপলালের মনে হল কে যেন তাকে কথা বলছে। সত্যি তাই একজন চল্লিশােধ্ধ ব্যক্তি, সঙ্গে একটি নারী মাথায় সিন্দুরের চাকচিক্যের অভাব।


"ই শহরের গুনাই বস্তিটো কুনদিকে একটু খুলে দেবেন।”


-"জানি না, এখান থেকে যান।" রূপলাল ঝাঁ এর সঙ্গে উত্তর দিল। ওরা চলে গেল, ওদের দিকে চেয়ে রূপলালের মনে পড়ে গেল সেও একদিন পদ্মাকে নিয়ে এই শহরে এসেছিল। সে আজ পঁচিশ বছর আগের কথা। রূপলালের বৌ ছিল চঞ্চলা। চঞ্চলা স্বভাবে ছিল ভীরু ও শান্ত; কিন্তু তার দোষ ছিল রূপলালকে সে শান্ত করতে পারে নি।


রূপলালের বাড়ি বীরভূমের দ্বারকানদীর তীরবর্তী হলধরপুর গ্রাম। সারাদিনের কাজ সেরে সে যখন ছােটো দিঘিতে নামত তখন একটি দুরন্ত শিশুর মত দিঘির জলকে আন্দোলন করে তরাঙ্গায়িত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালাত। বর্ষার আর শরতে সে নামত দ্বারকা নদীর বুকে। গতিময় অধরা স্রোতগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের রক্তের উষ্ণ অণুগুলিকে শীতল করতে চাইত সে।


প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর চঞ্চলা তার স্নান ফেরত স্বামীকে বলে উঠত - "সেই কখুন চানে গেছিলা। ইদিকে আমি রান্না করে ছেলেদের নিয়ে বসে আছি।" রূপলাল উদাসীনভাবে উত্তর দিত "তুরা খেরেত পারতিস্ ।" চঞ্চলা বলত ই কিরম কথা আমি কি তাই বুললাম। ... এতক্ষণ কেউ নদীতে চান করে ? "আমি জুবরাব না লে।" চঞ্চলা বলত “বালাই ষাট, তা হবে কেন? ".....বর্ষাকালে নদীর যা স্রোত আমার ভয় করে।” চলার এই কোমল


কথায় সদ্যস্নাত রূপলালের শাস্তঅণুণগুলি অগ্নিকণায় পরিণত হয়ে যেত। সে রেগে উত্তর দিত - "শিবদিঘিতে চান করার লােক রূপলাল লয়কে। সারাবছর জল থাকলে সে দ্বারকার জলেই স্নান ক্যোরত।" এর উপর আর কথা চলত না। খেতে ব্যেস, ভাত নিয়ে আসি।” চঞ্চলা চলে গেল সতৃষ্ণ রূপলাল বিতৃষ্ণভাবে সেদিকে চেয়ে পদ্মা কথা ভাবত। পদ্মা গােবেচারা বৃদ্ধশ্বরের স্ত্রী। রূপলালের চোখে সেদিনের পদ্মা

 ছিল দ্বারকার নদীর নারী রূপ। দ্বারকা নদী

কখনাে দুকুল উপচে গ্রামখানা ভাসিয়ে দেয়, কখনাে গতিময়তার মধ্যে আবর্ত সৃষ্টি করে, তার ঢেউগুলি কখনাে তরঙ্গায়িত হয়ে রূপলালকে স্নানে প্রলুব্ধ করত। এই ঘারকাই আবার কখনাে ক্ষীন হয়ে নিজেকে প্রভাবহীন করে ফেলত, কখনাে বা হত অন্তঃসলিলা।


একদিন ক্ষেতির কাজ করতে করতে রূপলাল পদ্মাকে বলেছিল "আজ বুদ্ধদাকে ঘ্বরকায় চান | কোরতে নিঙে যাব।” অত্যন্ত স্বাভাবিক সুরে পদ্মা বলেছিল “হ্যা, দিঙে নদীতে ডুবিড় ম্যারবাে।" “সত্যিই এতো সিনেহ আছে ?” পদ্মা বলেছিল “কী !" রূপলাল ব্যঙ্গের সুরে উত্তর দিয়েছিল,


“ব্যোলছিলাম সন্তানটুকু লেগে মাটুর সত্যিই এতখানি সিনহে আছে ?" পদ্মাকে নীরব থাকতে হয়েছিল। এরপর রূপলাল বিনা ভূমিকায় বলেছিল, “চলাে ক্যানে।" পদ্মা চাইলেও কঠিন কথা বলতে পারে নি। সে জানত পেলালের ধৈৰ্য নেই। পুকুরের মাছ ছিপ হাতে রূপলালকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করালে ভাসমান ফানার উপর একটা বড় ঢিল মেরে ঘরে ঢােকে। পদ্মা তাই কালােপাথর দিয়ে দুর্গম রাজ্য জয় করার জন্য তৈরি | রূপলালের শরীরটার দিকে চেয়েছিল। তারপর বিস্তীর্ণ ফাকা মাঠ পেরিয়ে তার দৃষ্টি চলে গিয়েছিল দিগন্ত রেখার ঐ পারে।


ওরা এসে উঠেছিল বর্ধমান শহরে। ওদের সুখী জীবনের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পদ্মা মাঝে মাঝে বলত, তুমি এই রােদে গরুমে সকাল সন্ধ্যা রিক্সা চালাচ্ছ এত কষ্ট কোরছ। আমি একটা কাজ লিই ক্যানে। রূপলাল বলত, তা হবে না কুনমতেই। আমাকে লুকিয়ে লােকের বাড়িতে কাজ কোরতে গেলে খুব খারাপ হবে, ই আমি বুলেদিলাম।”


"তাই বলে তুমি এতটা কষ্ট কোরব্যা।"


"এই গরমে পরিশ্রম কোরে আর ঘেমেই আমি সুখে আছি


পদ্মা নিজের ঘরের কাজ নিয়েই তখন থাকত। বস্তির মেয়েদের সাথে কিছুটা সময় কাটাত। ওদের | বস্তিটা ছিল শহরের প্রধান ড্রেন লাগােয়া। বর্ষার সময় ঐ বড় ড্রেন থেকে মাছ ধরে ওরা মহানন্দে খেয়েছে। কই, মাগুর, জিওল, ল্যাটা প্রভৃতি নানান মাছ। বর্ষাকালে ঐ বড় ড্রেনে রূপলাল কখনাে কখনাে স্নান করত। পদ্মা বলত - "ছি- ছি-ছিছি।" রূপলাল অস্নান বদনে উত্তর দিত - "ধােপারা বাবুদের কাপড় চোপড় ইখ্যান থথ্যকেই কেচে নিঙে যায়, সিটো মুনে কর।" প্রসন্ন চিত্তে রূপলাল আরও বলেছিল "তুমি সাথে থাকলে ই বড় ডিরেনটুই আমার কাছে দ্বারকা লদী হয়ে উঠে।" এখন ঐ ড্রেন পাকা করে দেওয়া হয়েছে। রূপলালের সেদিকে তাকাতেও ইচ্ছে করে না।


ওদের সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। শহরে টাউনসার্ভিস বাসের দৌরাত্মা শুরু হলে রূপলালের উপার্জন কমে গেল, পদ্মা চার-পাঁচ ঘরে কাজ নিল। গােবেচারা বুদ্ধদাস মারা যাবার চয় মাস পর পদ্মা খবর পেয়েছিল। পদ্মা সেদিন নীরব স্থির হয়ে গিয়েছিল। ছেলের হাতে মার খেয়ে রূপলালের বৌ মারা গেছিল। সেই খবর শুনে রূপলাল অশান্ত হয়ে উঠেছিল বহুদিন পর। রূপলালের সেদিনের অশান্ত মাদকতার সাথে পার নীরবতায় এক আশ্চর্য মিল ছিল। এখন রূপলাল বার্ধক্যের দোরগোড়ায়। টাউন সার্ভিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে টোটো। এখন রূপলাল প্রায় উপার্জনহীন। বছর চারেক আগে পর্যন্ত পদ্মার পাঁচটা কথার উত্তরে রূপলাল কুড়িটা কথা বলত; অন্তত বলার সাহস দেখাত। কখনাে পদ্মার গায়ে হাতও তুলেছে। এখন পল্মা একের পর এক বাক্যবাণে রূপলালকে বিদ্ধ করে। নারী পদ্মা অসহায় পুরুষের নীরবতা দেখে শান্ত হতে যাবে ঠিক তার আগের মুহূর্তে ক্ষণিকের উগ্রমূর্তি ধারন করে রূপলাল বলে ওঠে, "মাঝে মাঝে তাের উপার্জনে খাওয়াচ্ছিস বলে অত কথা শােনাস না। তাের জন্য আমি যা করেছি তার ঋণ জন্যে শােধ করতে পারবি না।" আজ রূপলালেল শহরে ভাষায় সেই ভালবাসা কোথায়।

আজ সারাদিন রূপলালের উপার্জন হয়নি। প্রায় সন্ধ্যের দিকে রূপলালকে জিজ্ঞাস করলাে 'রথতলা


হ্যা, যাবাে।


কত নেবে।


যাবে?


পঞ্চাশ টাকা। লােক দুটি কি বলাবলি করল। হয়ত ও রূপলালের রিক্সাতেই চাপত। সেই সময় একটা টাউন সার্ভিস বাস এল। ওরা বাসে চেপে গেল। বাসটা যৌয়া উড়িয়ে চলে গেল। রূপলাল অপেক্ষাভরা ব্যথাতুর দৃষ্টিতে সেইদিকে চেয়ে ভাবল, বাসটা ওকে চাকায় পিষে দিল না কেন? রূপলালের আজকাল মাঝে মাঝেই মরতে ইচ্ছে করে। বাসটায় না হয় ওকে দয়াটা করত। ক্ষোভে দুঃখে রূপলাল নিজের উপরপাটির দাঁতটা চিপে দিল। আঁ! ওর একটা কৃন্দক দাঁত হিলছিল। ছোটবেলায় অস্বন্তিদায়ক হিলতে থাকা দাত রূপলাল কোনমতেই তুলতে পারত না। একসময় জিহ্বার ছােটো একটা ধাক্কায় ঐ দাঁত উঠে গেল।


পদ্মা আজ কাজে যায়নি। আজকাল সে মাসে ৪-৫দিন কামাই করে ফেলে। সকালের দিকে মােতির মায়ের কণ্ঠ শুনে সে বের হয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'এত সকাল বেলা বাড়ি বাড়ি ঘুরছ কেন?' মােতির মা বলেছিল, “ও আজ বাড়িতে পুজো দিচ্ছে, শােনাে তাহলে তুমিও যেও।" সেই প্রসাদ খেয়ে পল্লা সন্ধের পর ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত্রি প্রায় দশটা। রূপলাল ফিরল। হাত মুখ ধুয়ে সে চুপ করে বলল। বেশ কিছুক্ষণ পর রূপলাল বলল, “খেতে পাওয়া যাবে না নাকি ?" পদ্মা অত্যন্ত ধীরে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল "রান্না করিনি, হােটেল থেকে খেয়ে আসতে হত ?"


বেশ কিছুদিন কেটে গেল। রূপলাল শান্ত অথচ ৰাধৰাৰ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, মােতির মা নারায়ণের প্রসাদ দেয় নি।


পদ্মা – “দিয়েছিল। কেন রাখতে হত ? ওদের ঘরে গিয়ে দ্যাখাে না। এখনাে থাকতে পারে।" রূপলালের মনে হল পন্থার এই শান্ত কষ্টের কথাগুলি তার ভৎসনার চেয়েও অনেক বেশি বেদনাদায়ক।


হাঁটতে হাঁটতে রূপলাল বর্ধমান রেলস্টেশনের উত্তরদিকের ভাঙা কেবিনের কাছে এসে পড়ল। একটা ট্রেন ঢুকছে। অন্ধকারে রূপলাল ঠিক বুঝতে পারছে না কোন লাইনে ট্রেন আসবে। কাজ্ফিত অদ্ধকারের যাতানায় পেঁচাটা রাত্রির দুইপ্রহরে আর্তনাদ করে উঠল। আধােঘুমের চোখে পদ্মা দেখল সে লােক কুটীরে ফেরেনি।


রূপলালেল অভাব শূণ্যতা সৃষ্টি করতে পারে তা 

পদ্মা আগে বােঝে নি। ঘরে পদ্মার মন বসে না, অথচ বস্তির অন্যান্য মেয়ে বউদের কাছেও পদ্মা বসতে পারে না। এক ধরনের উপেক্ষা অনুভব করে সে। হয়ত আগেও এমন উপেক্ষা পেয়েছে কিন্তু বােঝে নি। “পাপের ফল’, ‘সতীনারীর অভিশাপ", 'কর্মফল' এমন কত কথা। একদিন ছােটো নাতির কান্না থামছিল না বলে মােতির মা রেগে বলেছিল, ওসব টিবিফিবি বন্ধ কর না। পদ্মা ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। শিশুটির কান্না থেমে গিয়েছিল। পিছনে ফিরতে চাইলেও কখনাে


কখনাে পিছনে ফেরা যায় না, তখন মন না চাইলেও সামনে এগাতে হয়।


হাওড়া স্টেশনে ব্যস্ততা ও ভিড় দেখে পদ্মা ভয় পেয়ে যায়। আজ সে, বর্ধমানের থেকেও বড় শহরে পা রেখেছে অথচ তার সঙ্গে কেউ নেই। এত মানুষের ভিড়েও পদ্মা একাকীত্ব অনুভব করে। মানুষগুলির একটি করে ঠিকানা আছে। পদ্মা একজন যুবককে সসংকোচে জিজ্ঞাসা করল, “বাবু ... আমাকে একটা বাড়িতে কাজ দেখে দেবেন ?” চলুন আজ বাড়ি বাড়ি ঘুরে আপনার কাজের ব্যবস্থা করে দিই ...” লােকটি নিজের পথে যেতে যেতে বলল, "ই কোথা থেকে যে সব চলে আসে।”


হতাশ হয়ে পদ্মা এদিক সেদিক চাইতে লাগল। তার চোখে পড়ল একজন ভিকিরি বসে ভিক্ষা করছে। ক্ষীণকায় লােকটি যেন ওর চেনা, কিন্তু একী । তার পাদুটো হাঁটু থেকে নেই কেন ? লােকটাও পদ্মার দিকে চেয়েছে, তার চোখে জল। তবে আর সন্দেহ নাই। শরীর কত ক্ষীণ হয়ে গেছে ওর, চেনাই যায় না। পর চোখের জল আজ পদ্মাকে চঞ্চল করে তুলল। পদ্মা দ্রুত পায়ে ওর কাছে গেল। নিজের কাপড়টা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে পদ্মা ওকে পিঠে তুলে নিল। সাঁতারু আপত্তি করল না। সে জানে, সাঁতারু যখন সাঁতার কাটতে অক্ষম হয়ে পড়ে নদী তখন তাকে নিজের মত করে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। দেখতে দেখতে ওদের ঘিরে ভিড় জমে উঠল। পর্দার শক্ত করে বাঁধা কাপড় ওর পেটের সামনে থলির আকৃতি ধারণ করেছে। দুটাকা, পাঁচটাকা, দশটাকায় ভরে উঠে তা ভারি হয়ে উঠেছে। পিছনের বােঝাটা না নামিয়ে ও নিজের কাপড়টা আরও শক্ত করে বাঁধবে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance