টাইটানিয়ানজ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত
টাইটানিয়ানজ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত
কথা হচ্ছিল সমুদ্রের ধারে বসে। সায়ক বললো " আর ভালো লাগেনা রে জয়। কতদিন এইভাবে চলবে? মানছি এখানে সব ই আছে তবু নিজের জায়গা ভাই নিজের জায়গা।" জয় বললো " জানি ভাই। কিন্তু পৃথিবী তে থেকে মরার চেয়ে এখানে বেঁচে থাকা অনেক ভালো।"
২১৩৬ সাল। পৃথিবী র খনিজ সম্পদ প্রায় শেষের দিকে। বিভিন্ন অল্টারনেটিভ এনার্জী সোর্স সত্বেও চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছেনা। এদিকে দুই মেরুর বরফ ৯০% গলে গ্যাছে। সমুদ্র স্তর ও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে এই বিপর্জয় গুলি ব্যাপক আকারে প্রত্যক্ষ করা যায়। এদিকে পৃথিবীর উষ্ণতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলস্তর বৃদ্ধি পাবার দরুন পৃথিবীর ল্যান্ড মাস অনেক টাই কমে গেছে। এই সব বিভিন্ন কারণে মানুষ একটা অল্টারনেট জায়গার খোজ করে, যেখানে মানুষ বসতি স্থাপন করতে পারে। মঙ্গল গ্রহে কলোনি বানাবার প্রচেষ্টা তো ব্যর্থ হয়েছে অনেক দিন আগেই। আসলে বায়ুমণ্ডল খুব ই পাতলা মঙ্গল গ্রহে। এরফলে খুব ঘন ঘন উল্কাপাত হয়। সেটা আটকানোর ডিফেন্স সিস্টেম থাকলেও ত সবসময় কাজ করেনা। মানে উল্কার গতিবেগ খুব বেশি হলে ডিফেন্স সিস্টেম কাজ করেনা। এরফলে একবার খুব বড় দুর্ঘটনা ঘটে ছিল। প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা যায়।সেও প্রায় ৫০ বছর হতে চললো। তারপর থেকে শুধু মাত্র চাঁদের মত সাইন্টিফিক রিসার্চ আর মাইনিং জন্য ই মঙ্গল কে ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৩০০ কোটি। আসলে ২০৬০ সাল নাগাদ যখন ১০০০ কোটি হয়ে গেছিলো জনসংখ্যা, তখন ই খাদ্য আর জলের জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। পারমাণবিক হাতিয়ার ব্যবহারের জন্য প্রায় ৫০ কোটি মানুষ মৃত্যু বরণ করে। তারপর রেডিয়েশন, পারমাণবিক ছাই, এবং খাদ্য সংকটের জন্য আরো প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ মারা যায়। সেই যুদ্ধে ভারত খুব গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যুগান্তকারী পারমাণবিক শিল্ড আবিষ্কারের ফলে ভারত বর্ষের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। তবু প্রায় ১০ কোটি মানুষ মারা যায়। তারপর যুদ্ধ থামার পর dome civilization system এর সাহায্যে বেঁচে থাকা মানুষ ও বাকি জীব গোষ্ঠী কে নিরাপদ রাখার ব্যাপারে ভারতবর্ষ সদর্থক ভূমিকা পালন করেছিল।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। পৃথিবীর খনিজ পদার্থ এবং আরো অন্যান্য এনার্জী রিসোর্স প্রায় শেষ। এর ফলে বসতি স্থাপন এর জন্য অন্য জায়গার দরকার হয়। আমাদের সৌর জগৎ এর মধ্যে বিভিন্ন গ্রহ এবং উপগ্রহ দেখার পর বিজ্ঞানীদের মনে হলো শনি গ্রহের উপগ্রহ টাইটান ই একমাত্র উপযুক্ত জায়গা। পৃথিবী কে বাদ দিলে একমাত্র এখানেই বেশ ঘন বায়ুমণ্ডল আছে। তবে শুক্র গ্রহের কথা আলাদা। ওখানেও বায়ুমণ্ডল আছে। তবে তা পুরোটাই ক্ষতিকারক গ্রীনহাউস গ্যাস এ পরিপূর্ণ। তাছাড়া ওই তাপমাত্রায় মানুষের জীবনধারণ অসম্ভব, যেখানে লেড ও তরলে পরিণত হয়।কিন্তু টাইটান এর সমস্যা হলো সেখানকার ঠান্ডা। মাইনাস ১০০ ডিগ্রী তো প্রায় সবসময় থাকে। কিন্তু বাকি দিক থেকে সুবিধা আছে। যেমন কোনো প্রেসার সুট পড়তে হবে না। টেম্পারেচার কন্ট্রোল করা যায় এমন সুট আর অক্সিজেন মাস্ক নিলেই হবে। আর পৃথিবীর তুলনায় মাধ্যাকর্ষণ ক্ষমতা অনেক কম বলে ওখানে মহাকাশ যান নামানো ওঠানো করাও খুব সহজ। এইসব কারণে গত শতাব্দী থেকেই মানুষ অনেক মিশন করেছে টাইটান এ। আগে পৃথিবী থেকে টাইটান যেতে ৭ বছর সময় লাগত। কিন্তু ভারত স্পেস সেন্টার বা বিএসসি র তৈরি অ্যান্টি মেটার রকেট এ করে এখন টাইটান এ যেতে মাত্র ৩ দিন সময় লাগে। প্রথমে রোবট পাঠানো হতো। তারপর মানুষ বসবাস যোগ্য ডোম হাব বানানোর পর আজ ৩ মাস হলো প্রথম প্রায় ১০০ মানুষ নিয়ে একটা মহাকাশ যান টাইটান এ এসছে।
এই সৌর জগৎ এ পৃথিবীর পরেই একমাত্র এই টাইটান উপগ্রহে নদী, লেক, সমুদ্র আছে। যদিও সেই সব জায়গাতে জলের বদলে আছে লিকুইড মিথেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তে মিথেন তরল অবস্থায় ওই সব নদী, সমুদ্র তৈরি করেছে। টাইটান এর সবচে বড়ো সমুদ্র ক্রাকান মারে র পাশেই ওদের ডোম হাব টা বানানো।এই কাজ টা আগে পাঠানো স্কাউট শিপ এর রোবট রা করেছে। ওদের এই পুরো মিশন এর দাইত্তে আছে এলা নামক একটা সুপার কম্পিউটার।
এখন যে এই ১০০ জন মানুষ এসেছে, এদের তেমন কোনো কাজ নেই কিন্তু। শুধু এই ধরনের একটা এলিয়েন উপগ্রহে দীর্ঘ সময় কাটাতে কেমন লাগবে বা তাদের ওপর সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট কেমন হবে সেটা জানার জন্যই ওদের এখানে নিয়ে আসা। তবে এই ধরনের মিশন এ সবারির একটা না একটা রোল থাকে। তেমনি ওদের দুজনার রোল হলো মিথেন সমুদ্রে যেসব স্মল রবো সাবমেরিন গুলো আছে তাদের ডাটা এনালাইসিস করে এলা ওদের কাছে পাঠায় আর ওরা সেটা পরীক্ষা করে। এমনিতে সমস্ত কাজ এলা ই করতে পারে তবু ওরা ফাইনাল ব্যাপারটা দেখে নেয়। তবে এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। টাইটান এর ওপরের সার্ফেস হার্ড আইস দিয়ে তৈরি। ভিতরে অবশ্য পাথুরে কোর আছে। আর সেটা যথেষ্ট গরম। এটার কারণ অবশ্য শনি গ্রহ। ওর মাধ্যাকর্ষণ ক্ষমতার জন্যই এটা হোয়েছে। এছাড়াও কিছু ক্রীয় ভলকানো আছে, যেখান থেকে লাভার বদলে বরফ বেরিয়ে আসে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও কোনো প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পেলে বেশ চমকপ্রদ ব্যাপার হতো। যে ডোম টা তে ওরা আছে তার প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে দুটো পারমাণবিক চুল্লি আছে। সেখানে তৈরি এনার্জী ওদের ডোম হাব এর যাবতীয় এবং অন্যান্য রোবট দের সমস্ত চাহিদা মেটায়।
এইভাবেই চলছিল, ওরা মানে সায়ক আর জয় প্রায় প্রতিদিন ই ক্রাকান মারে নামক সেই মিথেন সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসত আর পরিস্কার আকাশ থাকলে শনি গ্রহের বলয় এর সৌন্দর্য দেখত। একদিন হটাত একটা ঘটনা ঘটলো, যেহেতু এতদূরে সূর্যালোক পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ১ % প্রবেশ করে তাই ওরা প্রকান্ড দুটো আয়নার সাহায্যে সূর্যের আলো কে এই ডোম হাব এর ওপর ফেলেছিল যাতে গাছেরা photosynthesis
করতে পারে, এর ফলে দুটো কাজ হতো, ওরা খাদ্যও পেত আবার অক্সিজেন ও তৈরি হতো। কিন্তু দেখা গেলো সমস্ত গাছ হটাত কেমন নেতিয়ে পড়েছে। ওরা সব কিছু পরীক্ষা করে দেখেও কিছু বুঝতে পারলনা। অথচ আয়না দুটো ঠিক ই আছে। ওদের কাছে অক্সিজেন নিয়ে কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তারপর একদিন দেখা গেলো একটা রোবট তার লেসার অস্ত্র যা দিয়ে শক্ত বরফ কাটে সেটা দিয়ে ডোম হাব ফুটো করার চেষ্টা করছে। ভাগ্যিস ডোম হাব এর ওপর হাই এনার্জী ম্যাগনেটিক শিল্ড এক্টিভেট করা ছিলো সেটা নাহলে ভয়ঙ্কর কাণ্ড হতো। সঙ্গে সঙ্গে এলা রোবট কে শাট ডাউন করেছিল কিন্তু পারেনি। তখন অন্য রোবট এর সাহায্যে ওটাকে নষ্ট করা হয়। কিন্তু এইরকম কেনো হচ্ছে তার উত্তর এলার কাছেও ছিলনা।
আবার দিন কাটতে লাগলো। যে যার কাজ করছে। মিথেন সমুদ্রের দিক টা বাদ দিয়ে রোবট রা আশপাশের আরো 100 কিমি এরিয়া সার্ভে করে ফেললো। সবকিছু ঠিক আছে দেখে এলার নির্দেশে আর একটা ডোম হাব বানানো শুরু হোলো।
দিন 20 কেটে যাবার পর আবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। যে পরমাণু কেন্দ্র থেকে পুরো এনার্জী আসতো হটাত সেই কেন্দ্র কাজ করা বন্ধ করে দিলো। যে ইউরেনিয়াম থেকে পরমাণু এনার্জী তৈরি হয় সেটা কে ঠান্ডা রাখতে হয় যেটা টাইটান এ খুব সহজ। কিন্তু পরমাণু কেন্দ্র কাজ করা বন্ধ করলে সব দিক থেকে সমস্যা দেখা দেবে। এলা পুরো ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করে জানালো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কিছু ব্যাপার তো আছেই। অল্টারনেট ব্যবস্থা থেকে মাত্র 5 দিন চলবে। তার মধ্যে কিছু তো করতে হবে। রোবট দের কন্ট্রোল পুরোপুরি এলার হাতে। সমস্যা না থাকলে সে রোবটদের কমান্ড দেবেনা। তাই শেষ পর্যন্ত ওরা দুজন এবং সঙ্গে আরো দুজন দেখতে গেলো কোথায় সমস্যা। প্রথমে ওরা গেলো পরমাণু কেন্দ্রে। সেখানে সব ঠিক ই আছে। তারপর ওরা পাইপ পরীক্ষা করলো। সেখানেই যতো গন্ডগোল। পাইপ যেনো কিভাবে কেটে গ্যাছে? ধারালো কিছু একটা দিয়ে নিখুঁত ভাবে কাটা। টাইটেনিয়াম ধাতুর তৈরি এই পাইপ তো শক্তিশালী লেসার বিম ছাড়া কাটা সম্ভব নয়। আর এত শক্তিশালী লেসার আছে শুধুমাত্র টাইটান কে পাক খাচ্ছে স্যাটেলাইট টি সেট ১ এর ডিফেন্স সিস্টেম এ। যার কন্ট্রোল এলার কাছেও নেই । পৃথিবী থেকে ওটাকে কন্ট্রোল করা হয়। যাইহোক এলার কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে ওটাকে ঠিক করার জন্য বলা হলো। আর ওরা ডোম হাব এ পৌঁছে এলা এবং বাকি সবার সঙ্গে জরুরি মিটিং এ বসলো।
সেদিন বিকালে ওরা মানে জয় আর সায়োক আবার সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসেছে। আনমনে দুজনেই খুব চিন্তা করছে। হটাত জয় খেয়াল করলো যে নিস্তরঙ্গ মিথেন সমুদ্রে যেনো হালকা হালকা ঢেউ উঠছে। দেখতে সুন্দর লাগলেও এমন হবার কারণ কি? মনে হচ্ছে যেনো কিছু একটা এগিয়ে আসছে। ওরা চুপ করে দেখতে লাগলো, কিন্তু কোথায় কি? কিছুই নেই। বায়ুমণ্ডল এর কোনো পরিবর্তনে ঢেউ উঠছে এই ভেবে ওরা উঠলো ফিরে যাবে ভেবে। কিন্তু কোথায় ফিরবে? সামনে যাবার তো কোনো রাস্তা নেই। ওরা যে পাথর খন্ড এর ওপর বসেছিল তার পিছনে সমুদ্র আর সামনে ডোম হাব এ যাবার রাস্তা। কিন্তু এখন সামনে টা কেমন যেনো মেঘ মেঘ ব্যাপার আর পুরো শূন্য। ব্যাপার টা এতটাই আকস্মিক ওরা যেনো ভয় পেতেও ভুলে গেলো। সেই পাথর এর পিছনে সমুদ্র ছাড়া আর যেনো কোথাও কিছু নেই। ওরা মহাশূন্যের মাঝে যেনো আটকে পরে গ্যাছে। খানিক পরে স্বায়ক বললো "জয় এটা কি হচ্ছে? সব কি উবে গেল নাকি"। জয় বলল " মনে হচ্ছে আমাদের নিয়ে কেউ কিছু করতে চাইছে, কিন্তু সেটা কে আর কি করতে চাইছে সেটা বুঝতে পারছিনা"।
ওরা আবার পিছনে সমুদ্রের দিকে তাকালো, সেখানে আবার হালকা হালকা ঢেউ উঠছে।
ওরা এবার সত্যিই ভয় পেলো। এসব কি হচ্ছে? হটাত ই কান এর মধ্যে যেনো একটা তীক্ষ্ম আওয়াজ শুরু হলো, ঠিক যেমন বিপ সাউন্ড হয় তেমন। একনাগাড়ে যেনো বেজে চলেছে। ওদের কাছে অসহ্য মনে হতে লাগলো।কিন্তু আওয়াজ টা যেনো ক্রমশ বাড়ছে। আস্তে আস্তে ওরা চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো। তার কিছুক্ষন পরেই ওদের জ্ঞান হারিয়ে গেলো। কিছুক্ষন পরে জয় এর জ্ঞান ফিরলো। ধীরে ধীরে ওর মাথাটা পরিস্কার হতে লাগলো।সবকিছু মনে পড়তেই ও সায়ক কে খুঁজলো কিন্তু সায়ক কে দেখতে পেলনা। অনেক খোঁজা খুঁজি করে ও ফিরে এলো ডোম হাব। এখন কিন্তু আর সেই শূন্য ব্যাপারটা নেই। জয় সবকিছুই আবার আগের মত পেলো কেবল সায়ক কে ছাড়া।
ফিরে এসে ও সবাই কে খবর টা দিলো। সবাই শুনে তো অবাক। সবার মধ্যেই একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এলা ৪ টে স্কাউট শিপ পাঠালো যদি সায়ক কে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক খুঁজেও কিছু পাওয়া গেলো না।
এদিকে জয় কিন্তু মনমরা অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। এতদিনের পুরনো বন্ধু, সেই আজ হারিয়ে গেলো। এখনও ও প্রতিদিন মিথেন সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে। সমুদ্রের দিকে উদাস দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকে।
এই ভাবে চলতে চলতে হটাত একদিন এক কাণ্ড হোলো। একদিন জয় সমুদ্রে র ধারে বসে থাকতে থাকতে দেখল সমুদ্রের মধ্যে আবার হালকা হালকা ঢেউ উঠছে। ও এখন বুঝতে পেরেছে যে টাইটান এর মিথেন সমুদ্রে এমন মাঝে মাঝে হয়। ও যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে শনি গ্রহের বলয় দেখছিল তেমন দেখতে লাগলো। হটাত ই ওর গা এ একটা মৃদু ধাক্কা লাগলো। চমকে উঠে মুখ ফিরিয়ে দেখে সায়ক। ও তো আনন্দে বন্ধু কে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু তারপরেই চিৎকার করে উঠলো "সায়ক তোর সুট আর হেলমেট কোথায়?অক্সিজেন ছাড়া তুই কিভাবে..?" সায়ক বললো "ওইসব আমার লাগেনা। তোর ও লাগবেনা তুই আমার সাথে চল।" জয় বুঝতে পারলো যে ওটা সায়ক না, অন্য কেউ সায়ক এর মত হয়ে ওর কাছে এসেছে ওকে নিয়ে যেতে। কারণ এই বায়ুমণ্ডল এ এইভাবে মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তবে এটা কে? জয় প্রচন্ড ভয় পেলো। কিন্তু কোনো ভাবেই ওখান থেকে সরে আসতে পারলো না। আবার ওর কানে ওইরকম অসহ্য আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। ফেরার রাস্তা বলে আর কিছু ও দেখতে পাচ্ছে না। সেই আগেরবার এর মত শূন্যের মাঝে যেনো ওরা দুজন আটকা পরে গ্যাছে। ওই অবস্থা তেই ও শুনতে পেলো, সায়ক এর অস্পষ্ট ঠান্ডা আওয়াজ, " এখানে আমি খুব ভালো আছি। ওদের সাথে আমি মিশে গেছি। তোকে নিয়ে যেতে এসছি।" ওই অসহ্য অবস্থা তেই জয় বলল" কাদের সাথে? এখানে তো কোনো প্রাণী নেই।" আবার জয় সেই ঠান্ডা আওয়াজ পেলো "তুই সিলিকন বেস মিথযেনিক লাইফ সম্পর্কে কিছু শুনেছিস?" জয় কিছু উত্তর দিতে যাবে অমনি একটা তীব্র আলোর ঝলকানি হলো আর সায়ক এর দেহ যেনো ছিটকে গেলো। আবার জয় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
৫
জ্ঞান ফিরে আসতে জয় নিজেকে একটা অন্ধকার জায়গায় পেলো। কেমন যেনো আলো আঁধারি ব্যাপার। ধরমর করে উঠে বসতে গিয়ে বুঝতে পারলো যে তার হাত পা বাঁধা। অনেক চেষ্টা করেও ও নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না। তারপর ই শুনতে পেলো একটা মিষ্টি মেয়েলি গলা। " একদম উঠবেন না। চুপচাপ শুয়ে থাকুন। আর ৫ মিনিট পর সব ঠিক হয়ে যাবে।" জয় আবার শুয়ে পরলো। আরো কিছুক্ষন বাদে ধীরে ধীরে সব কিছু ওর মনে পড়তে লাগলো। সায়োক এর সেই ছিটকে পড়ার কথা মনে পরতেই আবার উঠে বসতে গেলো। তারপর বুঝতে পারলো যে এলা ওকে মেডিক্যাল কিউরবল হাব এ রেখেছে যেখানে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হবার সব মেডিক্যাল টেকনোলজি রয়েছে যা এ আই দ্বারা চালিত হয়। ও আর তাড়াহুড়ো করলোনা। কারণ কোনো লাভ নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে ও এখান থেকে বেরোতে পারবেনা। আরো কিছু সময় পর আবার সেই মিষ্টি গলা বললো " আপনি এবার উঠতে পারেন। বাইরে আপনার টীম মেম্বার রা অপেক্ষা করছে"। জয় সেই হাব এর বাইরে এসে দাঁড়ালো। সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বাইরে কি হয়েছিল সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ও কোনো কথায় কান না দিয়ে পকেট এ রাখা ছোট্ট কমিউনিকেশন মডিউল এ সরাসরি এলার কাছে জানতে চাইলো যে সায়োক কোথায়? এলা তখন জয় কে বাদ দিয়ে সবাই কে নির্দেশ দিলো সেখান থেকে চলে যেতে কারণ জয় এর একটু বিশ্রাম দরকার।
সবাই বেরিয়ে গেলে এলা বললো " জয় তুমি তোমার যে বন্ধু কে চিনতে সে আর আগের মতো নেই।"
জয় চেঁচিয়ে উঠলো" আগের মতো নেই বলতে? যা বলার সরাসরি বলো?"
এলা বললো" বেশ। তোমার শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে সায়োক আর বেঁচে নেই। তার বদলে অন্য কেউ ওর মত দেখতে তোমার কাছে গেছিলো। তোমাকেও একই ভাবে দলে টানার চেষ্টা করেছিল। সেই সময় টহলদারি বাটারফ্লাই ড্রোন এর সাহায্যে আমি ঘটনা টা দেখতে পাই ও হাই লেসার বিম দিয়ে ওকে আঘাত করি। ও ছিটকে যায়, কিন্তু তার আগে ও তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল ফলে তোমার দেহে মিথনোজেন ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পরে। তাই তোমাকে এতক্ষন মেডিক্যাল কিউরবল হাব এ রাখার প্রয়োজন হয়েছিল।"
জয় শুনতে শুনতে একটা প্রশ্ন করলো " তাহলে সায়ক এর এখন কি অবস্থা? ও যদি বেঁচে না থাকে তাহলে হেঁটে হেঁটে আমার কাছে কি করে এলো?"
এলা বলল " ও মিথনোজেন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলো জয়। আমি ওর দেহের পুরো স্ক্যান করেছি। ওর দেহের প্রতি টা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বর্তমান কিন্তু কোনো টাই কাজ করছে না। আর ডি এন এ স্ট্রাকচার পুরো ওলোট পালোট অবস্থায় আছে। দেহে কোনো রক্ত সঞ্চালন নেই। আর এই ঠান্ডায় দেহের সমস্ত তরল ফুটন্ত অবস্থায় থাকার কথা ছিল কিন্তু সেটা হয়নী, তার কারণ হলো ওই ব্যাকটেরিয়া। ওরা কোনো ভাবে সায়োক এর ব্রেইন টাকে এক্টিভ রেখে ওই কাজ গুলো ওকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। তোমার মনে আছে জয় আমাদের ডোম হাব এর সব গাছ মরে গেছিলো বা একটা রোবট লেসার বিম দিয়ে ডোম হাব ফুটো করার চেষ্টা করছিলো। এই গুলো সব ওই ব্যাক্টেরিয়ার কীর্তি।"
জয় যতো শুনছিল তত অবাক হচ্ছিলো। হটাত একটা কথা মনে হতেই জয় বলল যে " যদি ব্যাকটেরিয়া হবে তাহলে এই কাজ গুলো কি ওরা জেনে বুঝে করছে? কারণ ব্যাকটেরিয়া র তো আর বুদ্ধি নেই। ওদের দেহ তো মাত্র কয়েক টা কোষ দিয়ে তৈরি আর ওরা তো আণুবীক্ষণিক জীব।"
এলা বলল " জয় তুমি ভুলে যাচ্ছ এটা পৃথিবী না টাইটান। আমি ব্যাকটেরিয়া বললাম কারণ এদের জৈবিক ক্রিয়া কলাপ ব্যাক্টেরিয়ার মত। কিন্তু অন্য কিছু মিলবেনা। যেহেতু এখানকার গ্র্যাভিটি অনেক কম তাই ওদের চেহারা আর আণুবীক্ষণিক নয়, পৃথিবীতে ছোট মাকড়সা যেমন হয় তেমন। ফলে ওরা এককোষী র জায়গায় বহুকোষী প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। আর ওদের দেহ পদার্থ মূলত সিলিকন দিয়ে তৈরি। অনেক টা রাবার এর মত। আর ওরা নাইট্রোজেন নেয় বাতাস থেকে এবং মিথেন পরিত্যাগ এর মাধ্যমে শ্বাস কার্য চালায়। তাহলে বুঝতেই পারছো, এই ধরনের প্রাণীর কোনো তথ্য আমার ডাটাবেস এ থাকার কথা নয়। তাই বুদ্ধিমত্তা ওরা কি করে পেলো সেটা আমি বলতে পারবো না।"
জয় একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল" এত ব্যাপার তুমি জানলে কি করে?"
৬
এলা বলল " ল্যাবরেটরি তে তোমার বন্ধুর দেহ পরীক্ষা করেছি। আমাদের শরীরে যে ফ্লুইড থাকে মানে জল, রক্ত এইসব সেইগুলোর কোনো অস্তিত্ব ওর দেহে পাইনি। তারপর কেমিক্যাল এনালাইসিস করে এই ব্যাপার গুলো বুঝতে পেরেছি।"
এক মুহূর্তের জন্য জয় এর খুব খারাপ লাগলো যে তার প্রাণের বন্ধু আর বেঁচে নেই, তারপর বললো " তুমি কথাটা ঠিক ই বলেছ, আমি ও তাই ভেবেছিলাম যে টাইটান এর এই আবহাওয়ায় ও অক্সিজেন আর সুট ছাড়া আমার কাছে এলো কি করে? কিন্তু ওর শরীরে কোনো রকম পরিবর্তন দেখতে পাইনি কেনো? এই ঠান্ডায় শরীর তো শুকিয়ে বরফ হবার কথা?"
এলা বলল " সেটাই হোয়েছিলো জয়। তুমি খালি চোখে সেটা বুঝতে পারোনি। এই উপগ্রহের একটা আশ্চর্য ব্যাপার হলো, বায়ু মন্ডল এ রাসায়নিক রিএকশন এর ফলে প্লাস্টিক উৎপণ্য হয় প্রচুর পরিমাণে। আর ব্যাকটেরিয়া গুলো সেই সব প্লাস্টিক ওর শুকিয়ে যাওয়া দেহের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে ছিলো। আর সেই জৈব প্লাস্টিক এর মধ্যে লিকুইড মিথেন দিয়ে ভরে দিয়েছিলো। আর ত্বক এর ওপর ওই প্লাস্টিক এর ই একটা কোটিং ব্যবহার করেছিল। আর দেহের পেশী তন্তু গুলো কে হাড়ের প্রত্যেক জয়েন্ট এ দরির মত প্রবেশ করিয়ে অন্য মাথা টাকে টেনে নিয়ে গেছিলো মস্তিষ্কে। আর মাত্র দুটো ব্যাকটেরিয়া ওর মস্তিষ্কে ছিলো। তারাই দেহ টাকে চালনা করছিলো"।
জয় বলল " কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। কিন্তু ওরা কি চায় এলা? সেটা কি বুঝতে পেরেছো?"
এলা বলল " না সেটা এখনো বুঝতে পারিনি। তবে ওই ব্যাকটেরিয়া দুটো কে ল্যাবরেটরি তে রেখেছি, পরীক্ষা করার জন্য।"
জয় একটা দীর্ঘ নিশ্বাস জিজ্ঞেস করলো "পৃথিবীতে খবর পাঠানো হোলো?"
এলা বলল " পাঠানো র চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনো ভাবে আমাদের হাব এর কমিউনিকেশন ট্রান্সমিটার টা কাজ করছে না, দুটো রোবট কে টাওয়ার এ কাজ করার জন্য পাঠিয়েছি, ওদের রিপোর্ট পেলে আবার চেষ্টা করবো খবর পাঠানোর"।
জয় উঠে পরলো, বলল " আমি একবার ল্যাবরেটরি তে যাবো, ব্যাকটেরিয়া দুটো কে একবার নিজের চোখে দেখতে চাই"।
এলা বলল "যাও ওখানে দুটো রোবট আর বায়োলজিক নেহা আছে, ওরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে"।
রেটিনা স্ক্যান করে ভিতরে ঢুকে যা দেখলো তাতে ওর কুল কুল করে ঘাম বেরোতে শুরু করলো ওই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সুট পরে থাকা সত্বেও।
দেখলো যে রোবট দুটো অকেজো ভাবে পরে রয়েছে, ল্যাবরেটরি র বিভিন্ন কাঁচের জার গুলো ভাঙ্গা। বিভিন্ন রকমের তরল ছড়িয়ে পড়ে আছে চার দিকে, উৎকট গন্ধ। নেহা কোথায় আছে বোঝা যাচ্ছে না। আর সব চে বড়ো কথা ব্যাকটেরিয়া দুটো নেই। এবার?
সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হলো এত কিছু ঘটনা তো এলার চোখ এড়িয়ে যাবার কথা না। আর সব চে বড়ো কথা রোবট দের নেটওয়ার্ক সরাসরি এলার সাথে যুক্ত। তাহলে এত ব্যাপার এলা র চোখের সামনে ঘটলো আর ও কোনো স্টেপ নিলোনা কেনো? নেহা ই বা কোথায় গেলো?
সঙ্গে সঙ্গে জয় কমিউনিকেশন মডিউল এর সাহায্যে পুরো হাব এর সেন্ট্রাল ডিফেন্স আর এলা র সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো, কিন্তু সব বৃথা। কারণ কোনো সিগন্যাল বার দেখাচ্ছে না। হটাৎ করে জয় শ্বাস কষ্ট অনুভব করতে শুরু করলো। হাব এর মধ্যে শ্বাস কষ্ট হবার তো কথা নয়। কিন্তু হচ্ছে। অতি কষ্টে ও দেওয়ালে লাগানো ইমার্জেন্সী বাটন টা টিপে দিলো আর তার পরেই জ্ঞান হারালো।
জ্ঞান ফিরলে ও দেখলো একটা অন্ধকার জায়গায় শুয়ে আছে। প্রথমে কিছু বুঝতে পারলোনা। তারপর ধীরে ধীরে ওর সব কিছু মনে পড়তে লাগলো। হটাৎ ওর চোখে তীব্র একটা আলো পরলো। ওর মনে হোল যেনো কেউ এল ই ডি সার্চ লাইট ওর চোখের ওপর ধরেছে। তারপর আস্তে আস্তে আলো কমে এলো। ও দেখলো ওর সামনে দাড়িয়ে আছে নেহা। ও যেই কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, নেহা ওকে আঙ্গুল দেখিয়ে চুপ করতে বলল। তারপর শুরু হলো সেই তীব্র বিপ আওয়াজ। আস্তে আস্তে সেটা কমে গিয়ে ও শুনতে পেলো নেহা র কথা যেনো কত দূর থেকে আসছে। "জয়, তুমি তো আমাদের সঙ্গে এলেনা। তাই তোমাকে বাদ দিয়ে বাকি সকল কেই আমরা দলে টেনে নিয়েছি। তোমাদের দেহের মধ্যে মস্তিষ্ক ব্যাপারটা দারুন। খুব তাড়াতাড়ি পোষ মানে। সেই থেকেই আমরা তোমাদের কম্পিউটার সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। তাই তো তোমাদের এলা ও এখন আমাদের দ্বারা চালিত হচ্ছে। তোমাদের এই হাব এর মধ্যে যে আবহাওয়া, তাতে প্রথমে আমাদের বেশ কষ্ট হচ্ছিল, তাই তো নেহার সাহায্যে সেন্ট্রাল পাওয়ার ইউনিট বন্ধ করতে হয়েছিল। তার আগে অবশ্য এলা কে অকেজো করতে হলো। কিন্তু এখন সব ঠিক আছে। তোমাদের শরীরে র ভিতরে কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে, কিন্তু এখন আমরা বেশ ভালো ভাবেই তোমাদের শরীর টা চালাতে পারছি। অবশ্য তার জন্য তোমাদের প্রাণ গুলো নিতে হোয়েছে আমাদের। এই বার আমরা তোমাদের গ্রহে ফিরে যাবো। এমনিতেই তোমাদের গ্রহ থেকে ফিরে যাবার মেসেজ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সরি, তোমাকে নিয়ে যেতে পারছি না। তুমি তো আমাদের দলের কেউ নও। তবে তুমি যদি আস্তে চাও",
"না" চিৎকার করে বলে ওঠে জয়। "বেশ তবে থাকো তুমি", বলে নেহা বেরিয়ে গেলো।
জয় কাঁদতে থাকে। ও বুঝতে পারে মানুষ এদের কাছে পোষ মানা জন্তুর মত কাজ করবে। জীবন্ত পৃথিবী একটা মৃত পৃথিবী তে পরিণত হবে। সমগ্র মানব সমাজ এর অস্তিত্ব আর থাকবে না। শুধু মাত্র কিছু ভাইরাস এর জন্য। জয় উঠে দাঁড়ায়। হঠাৎ সেই শ্বাস কষ্ট শুরু হয় আবার। ও বুঝতে পারে সেন্ট্রাল পাওয়ার ইউনিট আবার বন্ধ হয়ে গেছে। অতি কষ্টে ও ইমার্জেন্সী লকার থেকে বের করে স্পেস সুইট। স্পেস সুইট পরে কিছুটা স্বস্তি পায়। তারপর পৌঁছে যায়, রোবোটিক ওয়েপন বে তে। সেখান থেকে তুলে নেয় শক্তিশালী ডাইরেক্ট এনার্জি অস্ত্র বা লেসার গান। আর আঘাত করে হাব এর দেউয়ালে। প্রায় ১ মিনিট পর হাব এর কিছু টা দেউয়াল ভেঙে পড়ে। যেহেতু সেন্ট্রাল পাওয়ার ইউনিট বন্ধ, তাই ওর স্পেস সুইট এ চার্জ দেবার ও কোনো অপশন নেই। আর মাত্র ১০ মিনিট এর মত সময় আছে ওর কাছে। তারপর অক্সিজেন শেষ হবে।ও দৌড়ানো শুরু করলো, পৃথিবী তে ফিরে যাবার রকেট টার উদ্দেশ্যে......

