শিকার - জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত
শিকার - জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত
আজ আপনাদের আমার জীবনের একটা ঘটনা বলবো। অবশ্য ঘটনা বললেও আমার কাছে এটা একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবে সারা জীবন। অবশ্য আর কতটুকুই বা বাকি জীবনের। আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগে যখন আমার বয়স কম ছিল তখন আমি একটা কলিয়ারী কোম্পানি তে ছিলাম। তখন আমার ট্রান্সফার হয়েছিল মেঘাতুবুরু অঞ্চলে। ওখানে তখনও কলিয়াড়ি র কাজ চলতো।সারাদিন বাইরে বাইরে কাজ। আমি ছিলাম সুপারভাইজার। সমস্ত কাজ দেখে ওপর মহলে রিপোর্ট করে quarter e ফিরতে ফিরতে প্রায় ৭ টা বেজে যেত। তারপর নিজেই ইক মিক কুকারে ২ টো ভাতে ভাত ফুটিয়ে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম। এইভাবেই চলছিল। একদিন দেখি অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজার হিসাবে অরিজিৎ বলে একজন বেশ কম বয়েসি ছেলে join করেছে। কথায় কথায় আলাপ হলো। ও কলকাতার ছেলে। আমার থেকে বছর ২ ছোট। আমায় বলল "সারাদিন করেন কি? এইভাবে চললে তো মাজায় জং লেগে যাবে। চলুন রবি বার করে ছুটির দিনে শিকার করতে যাবো।" ওই অঞ্চল টা তে কলিয়ারি বেল্ট এর বাইরে তখন বেশ জঙ্গল ছিল। আমি রাজি হয়ে গেলাম। সত্যি প্রাণ টা হাফিয়ে উঠেছিল যেনো। তখন ওখানে অনেক রকম পাখি, বন মুরগি, মাঝে মাঝে হরিণ ও চোখে পড়ত। তাই আমরা রবিবার করে শিকারে যাওয়া শুরু করলাম। তবে কলিয়ারই বেল্ট এর সর্দার আমাদের বার বার বলেছিলো " বাবু, আপলোগ জওয়ান হো, সাম তক জরুর বাপাস অা জানা। উ জঙ্গল আচ্ছা নেহি হ্যায়।" কে শোনে কার কথা। আমাদের তখন বয়স কম।রক্ত গরম। অরিজিৎ ওপর মহল থেকে ধার করা winchester রাইফেল দেখিয়ে বলতো" ইয়ে দেখ রহে হো। সাথ রেহনে সে কুছ ডর নেহি"। কিন্তু সর্দার বলতো " জানোয়ার নেহি সাব জঙ্গল মে দুসরা চিজ ভি হ্যায়।" অরিজিৎ হাসতে হাসতে বলতো "হামে কই ডর নেহি"। এইরকম ই একটা রবিবার এ আমরা শিকার এ গেছি। সেদিন আমাদের ঝুলি তে ৪ টে বন মোরগ আর ২ টো পাখি। তবে অরিজিৎ এর রাইফেল দিয়ে তো আর পাখি শিকার হয়না। ওগুলো আমার গাদা বন্দুক দিয়ে হয়। শিকার শেষ হতে হতে ৫ টা বেজে গেলো। এদিকে আকাশে মেঘ করেছে। আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে চললাম querter এর দিকে। কিন্তু হটাৎ ই বড়ো বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। কি করি? কাছে অত শিকার। আমরা একটা বড়ো গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম অগত্যা। দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভিজছি। কি আর করবো? সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।হটাৎ দেখি কিছুদূর এ আলো দেখা যাচ্ছে। তারমানে ওখানে কোনো বাড়ি আছে মনে হয়। আমরা দুজনেই দৌড়ানো শুরু করলাম ওই দিকে। যদি কোনো আশ্রয় পাওয়া যায়?.....
আলোর কাছা কাছি গিয়ে দেখি একটা মাটির তৈরি বাড়ি। তার ভেতর থেকে আলো আসছে। অরিজিৎ বললো "চলো ভেতরে যাওয়া যাক। আর ভিজতে পারছিনা"। আমার কিন্তু মন টা কেমন করছিল। এত বার এই জঙ্গলে এসছি কোনো বাড়ি বা ঘর তো চোখে পড়েনি। ততক্ষনে দেখি অরিজিৎ দরজায় ঘা মেরে বলতে শুরু করেছে " কেউ আছেন? কই হ্যায়?"
হটাৎ একটা মেয়েলি গলা শোনা গেলো " আ রহি হুন"। দেখি এক মহিলা আলো নিয়ে এসছেন আর আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। লম্বা, রোগা চেহারা। তবে মুখ দেখা যাচ্ছেনা। বড়ো করে ঘোমটা দেওআ। হটাৎ একটা খুব পাতলা কন্ঠস্বর শোনা গেলো। পাতলা কিন্তু খুব তীক্ষ্ণ গলা" ম্যায় সব সমঝ রহি হুন। আপ লোগ অন্দর আইয়ে।" আমরা ঘরে গিয়ে বসলাম। একটা খাটিয়া মত পাতা আছে। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।মহিলা আমাদের জল এনে দিলেন। জল খাচ্ছি হটাৎ খুব জোরে একটা বাচ্চার তীক্ষ্ম কান্না শুনলাম। একে তো রাত হয়ে গেছে। বাইরে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। হটাৎ ওই কান্নার আওয়াজ শুনে আমি বিষম খেলাম। দেখে তো মহিলা হেসেই খুন। " ও মেরা বাচ্চা রো রাহা হে বাবুজি"। দেখি অরিজিৎ ও হাসছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেনো কাঁদছে? তখন মহিলা হটাৎ গম্ভীর ভাবে বললো " উসে ভুখ লাগা হ্যায়"। সেই গম্ভীর অথচ তীক্ষ্ম গলা শুনে আমার বুকের ভেতর টা কেমন যেনো করতে লাগলো। অরিজিৎ বলে উঠলো " সত্যি তো। সেই দুপুরে খেয়েছি আর তো পারিনা। আপ কুছ খানে কা ইন্তেজাম কর পায়েঙ্গী"। মহিলা তখন বলল আমাদের কাছে যে বন মুরগি আছে সেটা পেলে ও আমাদের মাংস ভাত করে দেবে। আমরা ভাবলাম তাই হোক। মাঝখান থেকে এদেরও ভালো মন্দ খাওয়া হবে। আমরা বড়ো বন মুরগি টা দিলাম।মহিলা চলে গেলো। আমার কিন্তু একটু অদ্ভুত লাগছিলো। মহিলা র গলা টা যেনো কেমন? আর ওর বাচ্চা টা কোথায়? দেখে তো মনে হচ্ছে একটা ই ঘর। যাইহোক প্রায় আধ ঘন্টা পরে এসে মহিলা বললো " এক মোরগা আউর দিজিয়ে না বাবুজি। ইস মে মেরে বেটে কা ভুখ নেহি মীটেগী"। আমরা তো অবাক। প্রায় ৩ কেজি ওজনের মুরগি। যাইহোক দিলাম আর একটা। মহিলা যাবার পর অরিজিৎ বললো চলো তো দেখে আসি কি ব্যাপার? আমরা ও গেলাম মহিলা যেদিকে গেছিল সেদিকে। ঘরের পর একটা লম্বা বারান্দার মত পেরিয়ে দেখি আবার জঙ্গল শুরু হয়েছে। সেখানে মহিলা একটা গাছে ঠেস দিয়ে আমাদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে। আর তার সামনে একটা ৭ ৮ বছরের বাচ্চা ছেলে মুরগীটা ধরে আছে। হটাৎ দেখি সে টেনে মুরগী র মাথা টা ছিড়ে ফেললো। আর তারপর সেটা মুখে পুরে কচ কচ করে চিবাতে শুরু করলো। ওই দেখে আমার পা কাঁপতে শুরু করেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। তাকিয়ে দেখি অরিজিৎ এরও একই অবস্থা। ওর গলা দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো " ওটা কি?" দেখি ধীরে ধীরে ওই বাচ্চা টা মুখ তুলে আমাদের দিকে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের সব রক্ত যেনো জল হয়ে গেলো। ও ও.....ওটা কি মানুষের মুখ। বড়ো বড়ো চোখ যেনো ভাঁটার মত জ্বলছে। মুখের দুই কষ দিয়ে তাজা রক্ত নেমে আসছে। মাথায় বড়ো বড়ো চুল। ও... ও ....কে? ও বলে উঠলো " বহত ভুখ লাগা হে। বহুত ভুখ"। এই দৃশ্য বোধহয় অরিজিৎ আর সহ্য করতে না পেরে দিলো ওর রাইফেল থেকে গুলি ছুড়ে ওই ছেলে টা র দিকে। অন্ধকারে দেখলাম ছেলে টা পড়ে গেলো মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে মহিলা আমাদের দিকে ফিরে সেই তীক্ষ্ম গলায় হিস হিস করে বললো " আচ্ছা নেহি কিয়া বাবুজি"। তখন ওর ঘোমটা খুলে গেছে। বিদ্যুৎ এর আলোয় দেখলাম একটা শাড়ী পরা কঙ্কাল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। চোখের জায়গায় যেনো লাল আগুনের গোলা। অরিজিৎ পাগলের মত গুলি করতে লাগলো। আমি দেখলাম সেই বাচ্চাটা উঠে বসেছে। মাথার বাঁদিক টা গুলির কারণে উরে গেছে। সেখান থেকে সবুজ ঘিলু বেরিয়ে এসছে। ওই অবস্থায় ও ও ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। পিছন ফিরে দৌড় লাগালাম। খানিক পরে ই শুনতে পেলাম অরিজিৎ এর আর্তনাদ। আর তার সাথে একটা তীক্ষ্ম গলায় খিল খিল করে অট্টহাসি। " হি ..হি ..হি ..হি।" আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরতে দেখি সর্দার সহ অনেক লোক। সকাল হয়ে গেছে। সর্দার বললো " মানা কিয়া ম্যায়নে ফির ভি আপ শুনে নেহি। অরিজিৎ বাবু কিধার হ্যায়"। আমি তখন সব বললাম। তখন ওরা সবাই মিলে খুঁজতে গেলো। ফিরে এসে বললো অরিজিৎ কে দেখতে পায়নি। শুধু ওর রাইফেল টা পেয়েছে। কিন্তু আমি তো জানি ওর কি হয়েছে। ও কাল রাতে একজনের খাবার হয়েছে। এর পর কি আমার পালা? আমি আর অপেক্ষা করিনি। কাউকে কিছু না বলে ফিরে আসি। আর পোস্ট অফিস এর মাধ্যমে আমার resignation letter পাঠিয়ে দিই কোম্পানি কে।

