"তোমার সঙ্গ মহামারীতে"
"তোমার সঙ্গ মহামারীতে"
দেড় বছর আগের কথা আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম ,
খবরে শুনলাম লকডাউনের কথা |
কারণটা ছিল এক অজানা ভাইরাস ভারতে প্রবেশ করেছে ,
নামটা হলো করোনা |
সেই ভাইরাসের প্রকোপ চলে আসে কলকাতা শহরে |
যেখানে আমি থাকি নিজের পরিবারের সাথে ,
সবে সংসার পেতেছি মনের মানুষের সাথে |
প্রথমে ভাবলাম যে ঠিক হয়ে যাবে সব কিছু
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই চারিদিকে মহামারীর প্রকোপে ,
অভাব এবং মৃত্যু মিছিল শুরু হয়ে গেলো |
মানুষ সংক্রমিত হয়ে উঠলো এই ভাইরাসের দ্বারা এবং বহু মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারাও যেতে লাগলো ,
কিছুদিনের মধ্যে কর্ম সংস্থান গুলো বন্ধ হয়ে গেলো |
উপার্জনের যতটুকু উপায় ছিলো সেটাও আর থাকলো না |
নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম ,
তার উপর সংক্রমন এতটাই বেড়ে গেল যে সম্পূর্ণ লকডাউন ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না সেটাই হলো |
এদিকে আমার নতুন একটা চাকরি সেটাও প্রাইভেট ,
সেটাও এই লকডাউনের জন্যে বন্ধ হয়ে গেলো |
ঘরবন্দী হয়ে পরলাম আমি ও আমার স্ত্রী |
থাকি কলকাতা শহরে এক ভাড়ার বাড়িতে ,
দিন রাত শুধু একটাই চিন্তা মাথায় ,
বাড়ি ভাড়াটা দেবো কোথা থেকে,তার সাথে ইলেকট্রিক বিল এবং জলের টাকা এই ভাবতে ভাবতেই দিন কাটতে লাগলো আমাদের |
বাড়ীওয়ালা ছিল এমন যে শুধু টাকাকেই বেশি ভালবাসতেন নিজের প্রানের চেয়েও বেশি |
মাসের পয়লা তারিখে ঘর ভাড়া না পেলে কিংবা ভাড়াটে যদি সেটা দিতে একটু দেরি করে তাহলে তার আর রক্ষা নেই |
যাই হোক আমি থাকতাম ওনার বাড়ির ছাদের ঘরটি ভাড়া নিয়ে ,আরও দু'ঘর থাকতো নিচের তলায় |
প্রথম যখন আমি ঘরটা ভাড়া নিয়েছিলাম ,তখন আমার চাকরি ছিল এমনকি আমার স্ত্রীও চাকরি করতো একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে |
তখন আমাদের ভালো মাইনে ছিল এবং নতুন বিবাহিত সংসারটা আমাদের সুখ সাচ্ছন্দে ভরে উঠলো |
সেই সময় বাড়ি ভাড়াটাও আমরা সময় মতো দিতাম ,আবার কখনো সময়ের আগেও অনেক সময়ে দিয়ে দিতাম |
কিন্তু এমনটা হবে সেটা কে জানতো ?
এই ভাবে জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে সেটাই বা কে জানতো ???
এই সবে বিয়েটা করেছি ,
নতুন সংসারটা ঠিক ভাবে পেতে পারলাম না তার উপর এই মহামারী,এবং লকডাউন |
একদিকে এই ভয়ঙ্কর মহামারী মানুষ মারতে শুরু করলো মারণ রোগ দিয়ে ,
অপর দিকে লকডাউন মারতে শুরু করলো মানুষকে অভাব অনটন দিয়ে |
হওয়াটা স্বাভাবিক ,
প্রথম লকডাউনের কিছুটা সময় খুব একটা অসুবিধা হয়নি কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ যত বেশি বাড়তে লাগল যেন জীবন এর ভালো সময়গুলো সব দূরে সরে যেতে লাগলো ,
আত্মসম্মান হানি এবং অভাবের কালো মেঘটা যেন ঘিরে ফেললো আমার গোটা সংসারটাকে |
লকডাউনের প্রথম দিকে আমার কাছে কিছু টাকা ছিলো সেই দিয়ে এবং আমার স্ত্রী তার এক মাসের মাইনে পেয়েছিল সেই দিয়ে লকডাউনের অনেকটা সময় আমরা কাটিয়েছি |
কিন্তু সেটা আর কতদিন ,
লকডাউনের এক মাস যেতে না যেতেই আমরা অভাবের সম্মুখীন হলাম |
ঘরে সমস্ত রেশন শেষ কি খাওয়াবো ওহকে
কিছুই বুঝতে পারলাম না |
কি করে বলি ওহকে যে ঘরের সমস্ত রেশন শেষ |
আমি সেটা আর ওহকে বলে উঠতে পারলাম না |
একদিন সকালে কি হলো ,
ওহ আমায় বলল আমায় একটু চা খাওয়াবে আমি বললাম ,
নিশ্চই কিন্তু সত্যি বলতে আমি নিজেও জানতাম না যে চাপাতা টুকুও ঘরে শেষ হয়ে গেছে |
আমি চা করতে গিয়ে লজ্জায় পরে যাই,
ওর চোখ এড়িয়ে কোনো মতে আমি আমার মানি ব্যাগটা খুলে দেখি একটা খুচরো পয়সা অবধি সেখানে নেই |
আমি রান্নাঘরেই চুপ করে কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলাম ,
ওর সামনে যাওয়ার মতো ক্ষমতা রইলো না আমার |
হঠাৎ দেখি ওহ কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে |
আমি ওর দিকে তাকাতেই একটু হেসে বললো ,
চাপাতা শেষ ?
থাক আমার চা চাই না
তুমি পাশে আছো ,
আমার কাছে এটাই অনেক |
অভাব যতই আসুক না কেন ,
তোমার থেকে আমাকে কেউ আলাদা করতে পারবে না |
অনেকটা অসহায় লাগছিল সেদিন নিজেকে |
যে এমন দিন এসে গেছে সামান্য ওর পেট চালানোর ক্ষমতাটুকু আমার আজ নেই |
কত চেষ্টা করেছি একটা কাজের যাতে ,
সংসারের হালটা শক্ত করে ধরতে পারি |
দুবেলা দু মুঠো ওহকে খেতে দিতে পারি ,
কিন্তু শত চেষ্টা করেও কিছু হচ্ছিল না |
তার সাথে দিনের পর দিন এভাবে অনাহারে আমার স্ত্রী অসুস্থ এবং দুর্বল হয়ে পড়লো |
ডাক্তার দেখানোর টাকাটুকু আমার কাছে ছিল না ,
কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না |
একদিকে অসুস্থ স্ত্রীকে বিছানায় পরে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে পারছিলাম না ,
অপর দিকে রোজ সকালে লকডাউন চলাকালীন বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় ,
বাড়িওয়ালা দরজায় এসে নানান ভাবে অপমান করে যেত |
সেটাও সহ্য করাটা অসম্ভব হয়ে উঠছিল |
এমন সময় আমি শুধু ভগবানকে ডাকতে লাগলাম যে সাহায্য করো |
এই সময় চলাকালীন হঠাৎ আমার এক সহকর্মী এবং তার সাথে আমার বড় দাদা বলাটা ভুল হবে না ,
আমায় ফোন করলেন খোঁজ নেওয়ার জন্যে পাশেই থাকতেন উনি আমাদের |
আমি দাদাকে আমাদের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললাম ,
সেই দিনটার কথা আমার আজও মনে আছে ,
দাদা বলেছিলেন তোমরা চিন্তা করোনা
আমি সব সময় তোমাদের পাশে আছি |
আজ যতটাই কষ্ট তোমরা পাচ্ছ এর পরের সময়টা ,
তোমাদের ততটাই ভালো কাটবে
ঈশ্বর আছেন উনি সবার ভালো করবেন |
উনি আমাকে ছোট ভাই হিসাবে স্নেহ করেন
ঠিক তেমনি আমার স্ত্রীকেও ছোট বোনের মতো স্নেহ করেন |
ওনার সাথে হয়তো আমার কাজের সূত্রে সম্পর্ক ,
কিন্তু ওনার ব্যবহারে তাড়াতাড়ি সেই সম্পর্কটা পারিবারিক হয়ে উঠলো ,
ওনার বাড়িতেও আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি নানান অনুষ্ঠানে ,
কিন্তু বিয়ের আগে অবশ্য |
এই মহামারী এবং অভাবে দাদা সত্যি
যেন ঈশ্বরের দূত হয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন |
যখন সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলো ,
তখন যেন একটা দরজা খুলে গেল দাদার আসার কারণে |
উনি আমায় একদিন ফোন করলেন সকালে
জিগেস করলেন বাড়ি আছো ?
উত্তরে বললাম হ্যা আছি ,
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি আমার বাড়ির কাছে এসে ,
আমাকে এক মাসের রেশনটা দিয়ে যান |
বললেন শেষ হলে বলো আমি আবার দিয়ে যাবো |
আর এও বলে গেলেন যখন যেরকম পারবো ,
আমি নিশ্চই করবো তোমাদের জন্যে |
তোমাদের খাবারের কোনো অসুবিধা আমি হতে দেবো না |
যখন আমি খেতে পাচ্ছি ,
তাহলে তোমাদেরকে ক্ষুদার্ত কি করে রাখি |
আর তোমরা তো হলে আমার নিজের লোক |
সত্যি বলতে সেই দিন থেকে ,
আমি দাদার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম |
হয়তো আমি হাজার চেষ্টা করলেও তার এই ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না |
ঈশ্বরের কাছে শুধু এইটুকু চাইলাম আমার দাদা কে সব সময় ভালো রেখো ,এবং তার পরিবারকেও |
তার পরে কয়েক মাস কেটে গেছে লকডাউন উঠে গেলো ,
আমি বেশ কয়েক জায়গায় কাজের চেষ্টা করলাম ,
এক জায়গায় চাকরির কথা বলে চাকরি ঠিক করে আসলাম |
শুধু মনে এই বিশ্বাস টুকু ছিলো যে অসম্ভব কেও সম্ভব করা যায় চেষ্টা করলে |
তাই হয়তো চাকরিটাও পেয়ে গেলাম |
ম্যানেজার এর পোস্ট ছিল দায়িত্বও ছিলো অনেক |
একদিন কি হলো আমার কাছে কিছু টাকা কম পড়লো ,
বাড়িতে কিছু নিয়ে যাওয়ার ছিল সেই কারণে |
দাদার বাড়ির কাছেই ছিলো আমার কাজের জায়গাটা ,
প্রায়ই দাদা আসতেন দেখা করে যেতেন |
সেদিনও উনি এসেছিলেন ,
আমায় চিন্তিত দেখে
আমায় জিগেস করলেন কি হয়েছে ?
উত্তরে আমি কারণটা বলতে উনি বললেন এইটুকু ব্যাপার ,
এই নাও এটা রাখো দেখলাম দুশো টাকা |
আমি ফেরত দিতে দাদা বললেন ,
আরে ঠিক আছে তুমি এখন রাখো পরে ফেরত দিয়ে দেবে আমি হিসাব রাখছি
বলে একটু হাসলেন |
পরে বললেন বাড়িতে বাচ্চার জন্যে
দুধ কেনার ছিলো |
যাই হোক আমার ভাই এর জন্যে ,
একটা দিন আমি আমার বাচ্চার দুধটা নয় বাকিতেই নিয়ে নেবো ,
আর দোকানদার চেনে আমায় তেমন অসুবিধা কিছু হবে না |
বলে উনি চলে গেলেন ,
হাসতে হাসতে ||
এই হলেন আমার দাদা "সাহাজাদা হোসেন" ||
ভেবেছিলাম মহামারী এবং অভাবের পরিণতি মৃত্যু হবে | কিন্তু তোমার মতো একজন ঈশ্বরের দূত এর আগমনে ,
হয়তো নতুন জীবন ফিরে পেলাম আমরা |
তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকলাম |
ঈশ্বরের কাছে তোমার এবং তোমার পরিবারের ভালো চাইলাম ||
