সুখের পায়রা
সুখের পায়রা
বনি এ বাড়ি আসার পর কনক যেনো একটু হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। বড়ো ছেলের বিয়ে দিয়েছে প্রায় বছর তিন কিন্তু বড় বউ বিউটি বিয়ের প্রথম কয়েক মাস শাশুড়ির সাথে ভালোই ব্যবহার করেছিল। কয়েক মাস পরেই তা আমূল বদলে গেল। আসলে বিউটির বাপের বাড়ি বেশ অবস্থাপন্ন । কনকের বড়ো ছেলে রজত এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজার। মাইনে পত্রর বেশ ভালোই। ছেলে চাকরি পেতে কনক যেন হাফ ছেড়ে বেঁচে ছিল। রজতের বাবা সুবল বাবু একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে কেরানীর কাজ করতেন। দুই ছেলে নিয়ে বেশ কষ্টেই সংসার চালাত কনক। তবে ওদের সংসারে পয়সার অভাব থাকলেও সুখের অভাব ছিল না। অবশ্য পুঁজি বিশেষ কিছু ছিল না কিন্তু রজত মেধাবী হওয়ায় ওর চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেতে বিশেষ দেরি হয়নি। তবে রজতের ছোট ভাই ভোলা পড়াশুনায় ততটা আগ্রহী না থাকায় ওর ঠিক ভালো কোন চাকরি হয়নি। রজত চেষ্টা করেনি তা নয় কিন্তু প্রতিটি পরীক্ষাতেই ভোলা সফল হতে পারেনি। তাও একটা প্রাইভেট ফার্মে বলে-কয়ে রজত ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
রজতের একটুও মত ছিল না ভোলার এখন বিয়ে দেওয়ার কিন্তু কনক ওকে যাহোক করে রাজি করিয়েছে। রজত তো বলেই দিল
"ভোলা কি মাইনে পায় যে ও আরেক জন মেয়ের ভার নিতে পারবে? নাকি তুমি আমার উপরে আর একজনের ভার চাপিয়ে দেবে? আমার ও তো সংসার বাড়বে না কি?"
"তোকে কিছু চিন্তা করতে হবে না বাবা ভোলা কে আমি বলে নিয়েছি ও যেভাবে হোক সংসারে টাকা দেবে, দরকার হলে নিজের হাত খরচ কম করবে, তুই আর অমত করিস ন বাবা, শানু কাল একটা পাত্রীর খবর এনেছিল আমি আর বড় বৌমা আজ দেখতে যাব"
বিউটি ওদের কথা শুনেই এসে বলে
"না মা আজ আমি যেতে পারব না তুমি বরং শানুর সাথেই আগে দেখে এসো , পরে তোমার ছেলের সাথে আমি গিয়ে দেখে আসব"
অগত্যা কনক সানুকে সঙ্গে করে গিয়ে মেয়ে দেখে এলো । সানু ওদের পাশের বাড়িতে থাকে। ওর মেয়েটিকে দেখে বেশ পছন্দ হল, খুব রূপসী নয় তবে মুখের সরলতা ওকে খুব টানলো । এই মেয়ের সাথেই ছোট ছেলের বিয়ে দেবে বলে একদম স্থির করে ফেলল। রাতে ভোলা বাড়ি ফিরতেই কনক ওকে ডেকে একান্তে বলল
"ভোলা তুই আর অমত করিস নে , আমি আজ তোর জন্য মেয়ে দেখে প্রায় পাকা করে এসেছি"
"কি বলছো মা আমার এত ইনকাম নয় যে বিয়ে করতে পারব, দাদা একদম সত্যি কথাই বলে, একজন মেয়ের ভার নিয়ে তাকে কষ্ট দিতে পারব না"
ভোলার কথায় কনক হয়তো কষ্ট পেল কিন্তু মুখে বলল
"তোর যত পাকা পাকা কথা রাখ তো, তোকে অত চিন্তা করতে হবে না , আর তোর দাদা একটা এত বড় অফিসার তুই কেন ভাবছিস এখানে তোর বউয়ের অযত্ন হবে?"
"কি যে বলো মা? দাদার টাকার উপর ভরসা করে আমি আমার সংসার চালাবো?"
এবার কনক রেগে উঠে বলে
"ঠিক আছে তাহলে তোর বিয়ে আর আমার এ জন্মে দেখা হলো না, শরীর ক্রমশ ভেঙে আসছে আর বেশিদিন আমি বাঁচবো না"
এবার ভোলা তাড়াতাড়ি মায়ের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে উঠলো
"বালাই ষাট এসব বলতে নেই তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে আমি সেটাই করব "
কনক এবার ভোলার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে ওঠে
"দেখিস ভোলা তোর বউ খুব খুব ভালো হবে , তোর অযত্ন হবে না"
রজত আর বিউটির আপত্তি সত্ত্বেও কনক ছোট ছেলে ভোলার বিয়ে দিলেন। খুবই সাধারণ ভাবে বিয়ে হল নেই কোন আড়ম্বর নেই, নেই কোনো জাঁকজমক। আসলে ভোলা চায় নি দাদার থেকে পয়সা নিয়ে বিয়েতে জাঁক-জমক করতে। শুধু মায়ের কথা চিন্তা করে ও মত দিয়েছিল বিয়েতে।
কনকের কথাই সত্য হলো। বনি খুব ভালো মেয়ে। খুব সংসারী। গরিব পরিবার থেকে আসা বনির সাথে খুব একটা মিশতে চাইতো না ধনী পরিবারের বড় বউ বিউটি।
যেহেতু স্বামী-সংসারের বেশ অনেকটাই ব্যয় ভর বহন করে তাই বিউটি কোন কাজই করত না
"আমার বর ইচ্ছে করলে দু-চারটে কাজের লোক রেখে দিতে পারে কিন্তু মায়ের বাইরের লোকের কাজ পছন্দ হয় না তাই রাখতে পারছে না"
কনক এত দিনে বিউটিকে খুব ভালো করেই চিনে গেছে তাই ওর কথার কোন উত্তর দেয় না।। তবে যখন বনিকে রেগে গিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলে তখন কনক তার প্রতিবাদ করতে ছাড়ে না।।এই নিয়ে রজত অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে বিউটি প্রতিদিনই নালিশ করে। পরের দিন সেই নিয়ে রজত খুবই ঝামেলা করে। তবে কনক সত্যি কথাটা বুঝিয়ে বললে আবার বউয়ের দোষ দেখিয়ে দিতে ছাড়ে না। এই নিয়ে মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীতে খুব ঝগড়া লেগে যায়। প্রতি বার ওদের ঝগড়ার জন্য বনিকেই দায়ী করে বিউটি। বনির কিন্তু তাতে কোন হেলদোল নেই। ও চুপটি করে ঘরের কাজ করে চলে।
সেদিন বনি সবে স্নান সেরে বেরিয়েছে, দেখলো বিউটি খুব সেজে গুজে কোথাও বেরোচ্ছে। ওর সাথে চোখাচোখি হতেই বলে উঠল
"কি রে তোরা আজ কোথাও যাবি না"?
বনি একটু অবাক হয়ে বললো
"কেন গো দিদি ভাই আজ কিছু আছে নাকি?"
"ছাড় তুই ওই সব বুঝবি না এগুলো উপর তলার ব্যাপার, আজ হাগ ডে, আমি তোর দাদার অফিসে যাচ্ছি ওখান থেকে আমরা রাতে ডিনার করে তবেই ফিরবো, এই মাসটা শুধু এনজয় করার মাস বুঝলি?"
বনি বড় বড় চোখ করে শুধু তাকিয়ে থাকে, মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। কারণ কনকের কদিন আগে পা ভেঙে ছিল তাই আজ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা আবার একটা এক্সরে করতে বলেছে,
বিউটি সব জানে কিন্তু ওর কাছে মায়ের অসুখের থেকে হাগ ডে টা অনেক আগে।
মায়ের কবে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বা কোন ওষুধ কখন খাওয়াতে হবে তা শুধু বনি জানে, ভোলা কাজের চাপে এইসব খেয়াল রাখতে পারে না। তবে ও জানে বনি ওর মায়ের এক ফোঁটাও অযত্ন হতে দেয় না। এখন ভাবে মায়ের সিদ্ধান্তটা নাকচ করে দিলে বড়ই ভুল করতো। বনির মত বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
সেদিন বেশ অনেক রাত হল রজত আর বিউটির বাড়ি ফিরতে। মায়ের শরীরটা খারাপ ছিল বলে বনি সেই রাতে মায়ের কাছেই শুয়ে ছিল। পায়ের প্রবলেম এর জন্য মা উঠে বাথরুম যেতে পারবে না তাই ও আর অন্য ঘরে যায় নি। ভোলাকে রাতের খাবার খাইয়ে ও মায়ের কাছে শুয়ে পড়ে ছিল। সকালে বিউটির বলা হাগ ডে ওর মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিউটি অত রাতে এসে টাল খেতে খেতে ওর ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে বলে উঠলো
"আজ তুমি অত লোকের মাঝে আমাকে অপমান করলে কেনো, তোমাকে বলতেই হবে"
মুখ থেকে মদের গন্ধ। সাজগোজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাগে গর গর করছে মুখ। রজত এবার চিৎকার করে বলে
"তুমি কি ভেবেছো, আমি কিছু বুঝি না, ওই লোকগুলোর সাথে কি করছিলে?"
এবার বিউটির কথাটা বেশ অনেকটাই এলিয়ে যায় তাও বলে ওঠে
"তুমি কি আমাকে হাগ ডে উইশ করতে দেবে না, বেশ করেছি যা করার করে নাও"
শেষের কথা গুলো আর স্পষ্ট হলো না । বিউটি খাটে ধপাস করে শুয়ে পড়ল।
কনক সব শুনেও চুপ করে লোকনাথ বাবার ছবি টার দিকে চেয়ে থাকে, হয়তো মনে মনে বলে "ওদের শান্তি দাও বাবা।"
কনক এত দিনের অভিজ্ঞতায় জানে বিউটি সবার কাছে সুখী হওয়ার অভিনয় করে কিন্তু অন্তর থেকে ও একটুও সুখী নয়। সুখী হওয়ার চেষ্টা করে মাত্র। সুখের পায়রা হল ওর ছোট ছেলে আর ছোট বউ। সারা বছরে যদি ভালবাসতে নাই পারো তবে বছরে একদিন ভালোবাসার দিন উদযাপন করে ফল কিছুই হয় না। বনির ভালোবাসা বা সেবার মধ্যে কোনও স্বার্থ নেই।
কনক পাশে শুয়ে থাকা বনি কে পিঠে হাত দিয়ে ডাকে
"ছোট বৌমা উঠে তোমার ঘরে যাও ভোলা তোমায় ডাকছে"
"কেন মা কিছু হয়েছে?"
প্রশ্নটা করে উঠে বসে বনি।
"কি জানি তবে আমাকে বলল তোমায় ডেকে দিতে যাও , আমি এবার ঘুমিয়ে পড়বো তোমার কোনো চিন্তা নেই কিছু হলে তোমাকে ডাকবো , যাও মা ঘুমিয়ে পড়ো"
বনি ঘুম চোখ কচলাতে কচলাতে ভোলার ঘরে গিয়ে ঢোকে। কিন্তু ভোলাকে ঘরের কোথাও দেখতে পায় না। ভাবে লোকটা গেলো কোথায়? আবার বাথরুমটা দেখে আসে কিন্তু সেখানেও নেই। কি যে হলো কিছুতেই বুঝতে পারে না বনি। কিন্তু খাটের দিকে একটু এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে ভোলা ওকে আঁকড়ে ধরে বলে ওঠে
"হ্যাপি হাগ ডে"
বনি ঘুরে ভোলার বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে বলে ওঠে।
"মা ঠিকই বলে তুমি আমার সুখের পায়রা"