সুহৃদ
সুহৃদ
১•
পেঁজা তুলোর মতন ভেসে যাচ্ছে মেঘ গুলো। নীল নীলিমার পানে কী যেনো ছুঁতে চাওয়ার লক্ষ্যে ধাবিত হচ্ছে রাশি রাশি মেঘের দল। আশ্বিনের সকালে সুনীল আকাশে এমন মনোরম মেঘের ভেলা দেখে মনটা খুশিতে ভরে যায় শ্রীপর্ণার। তার ইচ্ছে করে শরতের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মেঘের দেশে ছুটে যাওয়ার। কতো শত অলীক কল্পনা এসে ভিড় করছে শ্রীপর্ণার মনে তার ইয়াত্তা নেই। আসলে প্রাক্ পুজোর সময়টা মনছুঁয়ে যায় শ্রীপর্ণার। পুজো আসছে পুজো আসছে পরিবেশ, সকলের সারা বছরের যে একটা উদ্দীপনা শারদীয়াকে ঘিরে এটা শ্রীপর্ণার কাছেও বেশ রোমাঞ্চকর। তার মনে পুজোর দামামা বাজতে শুরু হয়ে যায় যখন কাশবনের কাশফুল গুলোর অকৃত্রিম রূপ ছড়িয়ে পরে প্রকৃতির বক্ষে।
এই বছরের পুজোটা একটু স্পেশাল বটে শ্রীপর্ণার জন্য। এই বছর যে সে ছাড়পত্র পেয়েছে তার ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে একদিন সন্ধ্যেবেলায় পুজো দেখতে যাওয়ার। নাহলে এতোবছর তো বাবা, মা, ঠাম্মার সঙ্গেই পুজো পরিক্রমায় বের হতো শ্রীপর্ণারা। বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়ার সুযোগটা সহজলভ্য হয়নি তখনও। ঠাম্মা আর মা এতো হেঁটে হেঁটে ঘুরে পুজো দেখতে পারেন না তাই রয়েসয়ে অল্প কয়েকটা প্যান্ডেল দেখেই ফিরে আসতেন তারা। কিন্তু পাড়ার ক্লাবের পুজোয় চুটিয়ে মজা করতেন সকলে। কিন্তু এইবছরের ব্যাপারই আলাদা। শ্রীপর্ণা এখন ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে যথেষ্টই। তাই সেদিন সকালের জলখাবার খেতে খেতেই বাবার কাছে আবদার করলো, "বাবা এবারের পুজোতে একদিন আমি ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে বেরোবে। বাবা প্লিজ...বাবা একবার অনুমতি দাও।" বাবার কিছু বলার আগে মা যদিও একটু তির্যক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়েছিলেন কিন্তু বাবা খুব শান্তস্বরে একপলক শ্রীপর্ণার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলেছিলেন, "পুজো? বন্ধুদের সঙ্গে? তা বেশ...কিন্তু রাত আটটার মধ্যে বাড়ি ফেরা চাই মামনি।"
আনন্দে উদ্বেল হয়ে উৎসাহের সঙ্গে শ্রীপর্ণা বলেছিল, "হ্যাঁ বাবা। রাত আটটার আগেই ফিরবো আমরা..." বাবার কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে খুব খুশি তরুণী শ্রীপর্ণা। বন্ধুদের সঙ্গে তার পুজোর প্ল্যানিংয়ের শেষ নেই। কে কী কিনবে, পড়বে, সাজবে এসব নিয়েই তাদের ব্যস্ততা তুঙ্গে।
২•
সেদিন সকাল থেকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে শ্রীপর্ণা। মেঘেদের দলবেঁধে আসা যাওয়া দেখছে কেবল। মা যদিও বার'দুয়েক জিজ্ঞেস করেছেন যে পড়ালেখা ফেলে কী এত আকাশের দিকে চেয়ে দেখছে সে কিন্তু শ্রীপর্ণার সেদিকে খেয়াল কোথায়? সে তো প্রকৃতির মাধুর্যে ডুবে আছে। আচমকা তার সম্বিৎ ফেরে ঠাম্মার ডাকে। ঠাম্মা এসে তার পাশে বসেন। আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "কী করছিস দিদিভাই?" মিষ্টি হেসে শ্রীপর্ণা বলে,"মেঘেদের দেখছি গো ঠাম্মী। কি ভালো লাগে না বলো মেঘ দেখতে? নির্দ্বিধায় ছুটে যায় মেঘ গুলো আকাশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে।"
শ্রীপর্ণার কথায় ঠাম্মাও যেনো হারিয়ে গেলেন অতীতে। রাশিকৃত মেঘের দিকে তাকিয়ে বললেন, "হ্যাঁ রে দিদিভাই, ঠিক বললি। জানিস আমি যখন ছোট ছিলাম তখন স্কুল থেকে ফিরতে সকল ভাই বোনদের সঙ্গে কাশফুল কুড়াতাম... কী যে আনন্দ হতো জানিস। আমাদের পুরো পরিবার একত্রে আমরা কতো সুখী ছিলাম তারপর একে একে দিদির বিয়ে হলো, তারপর আমার। এই বাড়িতেও আগে কতো ধুমধাম করে কতো পার্বণ অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু এখন তো এসব রূপকথার গল্প। তুই একা এখানে আর তোর কাকার ছেলেটা সেই হাজার হাজার মাইল দূরে। কতদিন হয়ে গেলো দেখাই হয় না তাদের সঙ্গে..."
আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মোছেন ঠাম্মা। সেই কবে ছোটো কাকাই ভিনরাজ্যে চলে গেছেন কাকি আর ভাই সোনুকে নিয়ে। এক বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে সেখানেই চলে যান তিনি।
দুর্গাপুজাতে ছুটি পান না কাকাই তাই দুর্গোৎসবের সময় আসতেও পারেন না দেশের বাড়িতে। বছরে একবারই আসেন সেটাও ওই গরমের ছুটিতে কিছুদিনের জন্য। কিন্তু এই বছর অত্যধিক কাজের চাপে গরমের ছুটিতেও আসা সম্ভব হয়নি কাকাইদের। তাই ঠাম্মার খুব ইচ্ছে ছিলো কাকাইরা সকলে যেনো শারদীয়াতে বাড়ি আসেন এবার। কিন্তু কাকাই সব কিছু সামলে আসতে পারবেন কিনা সেটাই সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তো ওই ফোন-কল আর এখন নতুন টেকনোলজির প্রভাবে ভিডিও-কলই ভরসা। ঠাম্মার দিকে তাকিয়ে মনখারাপ হয়ে যায় শ্রীপর্ণার। কিন্তু কি'ই বা করতে পারে সে। ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরতেই ঠাম্মা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলেন, "তা মামনি এবার নাকি বন্ধুদের সঙ্গে পুজো দেখতে যাচ্ছিস... বেশ মজা করবি তাহলে তাই না? এই বুড়িটার জন্য তোর দূরে গিয়ে ঘুরেঘুরে ঠাকুর দেখা হয় না।" কপট রাগ দেখিয়ে শ্রীপর্ণা বলে "এমনি করে বললে কিন্তু কাঁদব ঠাম্মী..." নাতনির কপট রাগ ধরতে পেরে গাল টিপে দেন ঠাম্মা।
ঠাম্মা নিজের ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন তখন, হঠাৎ বাড়ির ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলো। এই সময়ে সাধারণত ছোটোকাকিই ফোন করেন। হ্যাঁ ঠিকই ছোটোকাকিরই ফোন। ঠাম্মা আর মা খুব আমোদ করে কথা বলছেন কাকির সঙ্গে। প্রসঙ্গত এসেই পড়লো শারদীয়ার কথাটা। কাকিও খুব দুঃখ করে বললেন পুজোতে হয়তো আসা হবে না। ঠাম্মা গভীর দীর্ঘনিশ্বাসটা আড়াল করেই হেসে কাকিকে আর সোনুকে আশীর্বাদ আর আদর দিলেন। শ্রীপর্ণার সঙ্গেও কথা হলো কাকির। প্রাণের প্রিয় দুর্গোৎসবে বাড়িতে না আসতে পারার দুঃখটা পরিবারের প্রিয়জনেরাই বোঝেন।
৩•
দেখতে দেখতে পুজো এসে পড়লো। আজ পঞ্চমী। চারিদিকে ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। শ্রীপর্ণা নিজেও খুব করে অপেক্ষা করে আছে উৎসবের জোয়ারে মাতোয়ারা হওয়ার জন্য। শেষ নির্ঘণ্টের প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। পঞ্চমীতেই জনপ্লাবন চতুর্দিকে। শ্রীপর্ণা তো নতুন জামাকাপড় গায়ে চাপিয়ে মহড়া দিতেই ব্যস্ত। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে অষ্টমীতে অঞ্জলী দেওয়ার সময় কোন শাড়িটা পড়বে সেটার চয়ন। তার এখন দম ফেলবারও ফুরসৎ নেই। আগামীকাল ষষ্ঠী। খুব মনে পড়ছে কাকা কাকি আর ভাইয়ের কথা। আজ সকালেও কাকির সঙ্গে মোবাইলে বেশ কিছুক্ষন কথা হয়েছে শ্রীপর্ণার।
দুর্গোৎসব শুরু। আজ ষষ্ঠী। দেবীর বোধন। আকাশে বাতাসে লেগে আছে শরতের অনাবিল রূপমাধুরীর ছোঁয়া। ভেসে ভেসে আসছে মন চঞ্চল করা পুজোর আঘ্রান। সকলেই পুজোর আনন্দে উচ্ছল। শ্রীপর্ণা তখন নিজের মোবাইলে কিছু একটা খুটুর খাটুর করছিল। হঠাৎই বাড়ির বড় গেট খুলে ঠাম্মা, জেম্মা, দিভাই বলে এক ক্ষুদে কন্ঠস্বরের মধুর চিৎকার। সহসা দৌড়ে বের হয় শ্রীপর্ণা। এ কি! এ কাকে দেখছে শ্রীপর্ণা? সোনু না! চোখে ভ্রম হচ্ছে না তো! সে কি ঠিক দেখছে? সামনে কি সত্যিই সোনু দাঁড়িয়ে আছে?
>
সোনু ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে শ্রীপর্ণাকে। ততক্ষণে কাকাই আর ছোটকাকিকেও দেখতে পাচ্ছে সে। এদিকে ঠাম্মা আর মাও হাজির। খুশি আর উত্তেজনায় কথা বলতে পারছেন না ঠাম্মা। এ কি স্বপ্ন নাকি? কাকি এসে ঠাম্মাকে প্রণাম করতেই কেঁদে ফেললেন তিনি। ওইদিকে কাকাই বলছে, "কি কেমন চমকে দিলাম তোমাদের?"
মা বলেন, "ঠাকুরপো তোমরা সত্যিই চমকে দিলে গো, ওই তো সেদিন ছোটোর সঙ্গে কথা হলো সে তখন কিছুই বুঝতে দেয় নি আমাদের। কী যে ভালো লাগছে কী বলবো...সত্যিই এবছরের সেরা উপহারটা দিলে তোমরা....।"
মা আরো কিছু বোধহয় বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আচমকা এক অপরিচিত ব্যাক্তিকে বাবার সঙ্গে বাড়িতে ঢুকতে দেখে একটু থমকে যান। কাকাই মাকে বলেন, "বৌঠান এ হলো উদয়। উদয় আর আমি এক অফিসেই কাজ করি। উদয় বয়সে আমার থেকে প্রায় সতের বছরের ছোট। কিন্তু ছোট হলে কি হবে কাজের শেষে সে একদম আমার বন্ধুর মতো..."
ততক্ষণে উদয় আর বাবাও এসে দাঁড়ালেন সেখানে। বাবা বললেন,"কি মা! আশ মিটলো তো? আমি আর ভাই দুজনে যুক্তি করেই এই প্ল্যানটা করলাম তোমাদের চমকে দেওয়ার জন্য। আর ইনি হচ্ছেন উদয়বাবু। ভাইয়ের সঙ্গে এসেছেন এখনকার পুজো উপভোগ করার জন্য...আমি কিন্তু পরিষ্কার বলে দিয়েছি যে উদয়বাবু আমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। কোনো হোটেল টোটেলে নয়।"
ঠাম্মা একবাক্যে সম্মতি জানালে সবাই একে একে ঘরে প্রবেশ করেন। সোনু ঠাম্মার কাছে আর মা কাকির সঙ্গে শ্রীপর্ণা বড় হলঘরে বসে। আর ওইদিকে ড্রয়িংরুমে কাকাই, বাবা আর উদয়বাবু। কাকির কাছ থেকেই জানতে পারা গেলো যে উদয় প্রবাসী বাঙালি। ছোটো থেকেই নাকি দুর্গাপুজা দেখার খুব সখ। কিন্তু ওর সমগ্ৰ পরিবারের বাস ভিনরাজ্যে। এখানে চেনা পরিচিত কেউই তেমন নেই। তাদের দেশের বাড়ির পাট নাকি অনেক বছর আগেই চুকেবুকে গেছে। তাই চাকরিতে যুক্ত হবার পর কাকাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলে সে আর পুজো দেখার লোভ সামলাতে পারলো না।ছোটোকাকার সঙ্গে এসেই পড়ল পুজোর রেশ গায়ে মাখতে।
৪•
ওইদিকে, আসার পর থেকেই খুব চুপচাপ হয়ে আছে উদয়। নতুন পরিবেশ, অপরিচিত লোকজনের মাঝে একটু হতপ্রভ হয়েই বসেছিল সে।
উদয়ের সঙ্গে একবার শ্রীপর্ণার চোখাচোখি হতেই উদয় একটু অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। সেদিন রাতে খাবার টেবিলেও খুব অল্প কথা বললো সে।
চারিদিকে দুর্গোৎসবের হুল্লোড়। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদয় উপভোগ করছিল পুজোর উত্তাপ। হঠাৎ শ্রীপর্ণা এসে বলে, "আপনাকে ওই ঘরে ডাকছে।" উদয় একটু থতমত খেয়ে
একবার শ্রীপর্ণার দিকে তাকিয়ে একটু শুকনো হাসি হেসে তরিঘড়ি সেখান থেকে চলে যায়। মনে মনে একটু ক্ষুন্ন হয় শ্রীপর্ণা। ভাবে "কেমন ছেলে! কোন কথাই বলে না। কেমন মুখচোরা, লাজুক। মুখে হাসি নেই, এসেছে পর থেকেই কেমন চুপচাপ আর গম্ভীর হয়ে আছে। এই ছেলে আবার উপভোগ করবে পুজো!"
এইসব ভাবতে ভাবতে সে'ও যায় বসার ঘরে। হঠাৎ কাকাই বলে ওঠেন, "এই মামনি, শোন তো...উদয়ের না খুব সখ সকালবেলার পুজা-আরতি এসব দেখার। তুই তোর কাকি, সোনু আর বৌঠান সহ উদয়কে কাল সকালে আমাদের পাড়ার ক্লাবে একটু নিয়ে যাস তো মা"। কাকাইয়ের কথার উত্তরে মা বললেন,"আহা ঠাকুরপো,সপ্তমীর সকালে এত কাজ থাকবে বাড়িতে। মামনি আর সোনুর সঙ্গেই ঘুরে আসবে না হয় উদয়..."
মায়ের কথায় সকলেই সম্মতি জানালেও শ্রীপর্ণা একটু ক্ষুন্ন হয়ে মনেমনে বলে,"এই বেরসিক ছেলে কি আদৌ বুঝবে উৎসবের মর্ম? কে জানে বাবা! "
পরদিন সকালে শ্রীপর্ণা, সোনু আর উদয় তিনজনেই ক্লাবের পুজো দেখতে যায়। সেখানে গিয়েও কেমন আড়ষ্ট আছে উদয়। একটু পরে তিনজনেই আবার ফিরে আসে। ঘরে বসে আবার আকাশ পানে মেঘ দেখছে শ্রীপর্ণা। তার মনের উঠোনে ভেসে ভেসে আসছে উদয়ের মুখটা। ভাবছে, "
এতোলাজুক স্বভাবের ছেলে উদয়! এত কম কথা বলে! বাব্বা আমি তো এত গম্ভীর হয়ে থাকতেই পারবো না।" আরো কতো কী কথা জানি ভাবছিল শ্রীপর্ণা। আচমকা সম্বিৎ ফেরে মায়ের ডাকে। মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বড় হলঘরে পৌঁছায় সে। বাড়ির সকলেই সেখানে বসে,সঙ্গে উদয়ও। বাবা শ্রীপর্ণাকে ডেকে বলেন,
"এই মামনি, কাল তো অষ্টমী। তুই তোর বন্ধুদের সঙ্গে পুজো দেখতে যাবি। উদয়কেও সঙ্গে নে না...তোদের সকলের সঙ্গে উদয়ও ঘুরে ঘুরে পুজো দেখে আসবে।" বাবার এহেন প্রস্তাবে একটু দমে যায় শ্রীপর্ণা। মনে মনে প্রমাদ গুনে। ভাবে, এই শান্তশিষ্ট ছেলেটা যে বড্ডো বেমানান শ্রীপর্ণাদের হুল্লোড়বাজ গ্রুপে।
উদয় শ্রীপর্ণার মনের দশা আঁচ করতে পেরেছিল বোধহয়। তরিঘড়ি উদয় বললো,"না না। আপনারা ব্যস্ত হবেন না। ওনাকে ওনার বন্ধুদের সঙ্গে যেতে দিন।"
কিন্তু উদয়ের কথা বাড়ির অন্যদের মতামতের নীচে চাপা পড়ে যায়। অগ্যতা কী আর করা! শ্রীপর্ণা একটু মনক্ষুণ্ণ হয়েই সম্মতিসূচক হ্যাঁ বলে। সপ্তমীর সন্ধ্যেবেলাটা পাড়ার পুজোয় আনন্দ করেই কাটান বাড়ির সবাই। মাঝেমধ্যে একটু আটকু চোখাচোখি আর কথাবার্তাও হয় উদয় আর শ্রীপর্ণার মধ্যে কিন্তু সেটা কেবলই সৌজন্যতামূলক।
আজ অষ্টমীর সকাল। বাসন্তী রঙের জামদানি পরে যখন শ্রীপর্ণা পাড়ার ক্লাবের পুজোয় অঞ্জলী দিতে ব্যস্ত উদয় তখন নিষ্পলক চেয়ে আছে শ্রীপর্ণার দিকে। নিজের বুকের বামপাশের যন্ত্রটার লাবডুব শব্দ যেনো নিজেই শুনতে পাচ্ছে সে। উদয় বারবার হারিয়ে যাচ্ছে শ্রীপর্ণার সাবলীল সৌন্দর্যে। এদিকে বাড়ির সবাই যখন পাড়ার বাকিদের সঙ্গে শারদীয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়ে ব্যস্ত তখন আচমকা প্রসাদ হাতে শ্রীপর্ণা উদয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে উদয়। এই প্রথম শ্রীপর্ণার দিকে তাকিয়ে একটু মিষ্টি করে হাসে। আনত স্বরে বলে,"খুব ভালো লাগছে আপনাকে"।
মোহময়ী দৃষ্টিতে চমকে তাকায় শ্রীপর্ণা উদয়ের দিকে। উদয় একটু অপ্রস্তুত হয়ে চলে যেতে চাইলে শ্রীপর্ণা বলে উঠে, "ধন্যবাদ। আপনি কথা বলতে পারেন তাহলে, আমি তো ভাবলাম আপনার বুঝি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে অ্যালার্জি...।" একপলক শ্রীপর্ণার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে উদয়। মাথা চুলকে বলে,"না মানে, আসলে..."
হেসে ফেলে শ্রীপর্ণাও, "বুঝেছি। আমার সঙ্গে সেরকম ভাবে পরিচয় নেই তাই কথা বলতে বাঁধছে আপনার...।"
সহসা কি উত্তর দেবে খুঁজে পায়না উদয়।
মুচকি হেসেই বলে,"হ্যাঁ... অনেকটা।"
জড়তা কাটাতে শ্রীপর্ণা বলে,"আমার বন্ধু হবেন আপনি?"
উদয় মুখ তুলে তাকায় শ্রীপর্ণার দিকে। একমুহুর্ত স্থির থেকে সে বলে,"হতে পারি তবে একটা শর্তে..."
হতবাক হয়ে শ্রীপর্ণা বলে,"কী শর্ত?"
উদয় স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে, "জোর করে বা বাধ্য হয়ে নয়, মন থেকে আমায় বন্ধু ভেবে নিয়ে যাবেন আমাকে পুজো দেখাতে?"
শ্রীপর্ণার মুখমন্ডল জুড়ে তখন সলজ্জ হাসি...