সত্যকি
সত্যকি
যদু বংশীয় এই বীর উগ্রস্বভাবের এবং নিষ্ঠুর প্রকৃতির বলে ইনি কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কে ভাই হন। হ্যাঁ ইনিও যাদব বংশের, তবে বৃষ্নী ধারায় জন্ম ওনার।
তিনি ছিলেন শিনির নাতি আর পিতা সত্যক, তাই তিনি পিতার পরিচয়ে সত্যকি নামে বড় হন।
অন্য আরেক নাম যুযুধান।
বলরাম আর তিনি ছোট বয়সে একসাথে বড় হয়েছেন। পরে তিনি পাণ্ডবদের সংস্পর্শে এলে অর্জুনের সাথে সখ্যতা বাড়ে। সখ্যতা বাড়ে শ্রীকৃষ্ণের সাথেও। গুরু দ্রোণের আশ্রমে তিনি অস্ত্র বিদ্যা শেখেন অর্জুনের সাথে। পরে তিনি অর্জুনের কাছেও শেখেন। সারাজীবন তিনি শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন বলরামের সাথেই সময় কাটিয়েছেন। এরপরে তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। মহাভারতে ওনার বর্ণনা রয়েছে এরপরে একদম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে।
যখন শ্রীকৃষ্ণ শেষবারের মত গেছেন দুর্যোধনের কাছে যুদ্ধ যাতে না হয়, যাতে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখা যায় সেই চেষ্টার জন্য। সাথে রইলেন সত্যকি।
শ্রীকৃষ্ণ চাইলেন 6 খানি গ্রাম 5 ভাইয়ের জন্য 5 টি আর একটি মাতা কুন্তীর জন্য। দ্রৌপদী র জন্য কিছু লাগবে না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে পাঁচ ভাইয়ের সাথেই...
কিন্তু দুর্যোধনের মতলব আলাদা। তিনি পরিষ্কার বলেই দিলেন "বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী"।
যুদ্ধ কতটা ভয়াবহ হবে সেটা শ্রীকৃষ্ণের জানতে বাকী ছিল না। কত মানুষ মারা যাবে। কত নারী বিধবা হবেন। সন্তানহারা হবেন কত পিতামাতা। কত শিশু হবে অনাথ। দুর্ভিক্ষ দারিদ্র আর অকল্যাণ নেমে আসবে। বহু বছর হবে জনজীবন অভিশাপগ্রস্ত।
ব্যথিত শ্রীকৃষ্ণ সেখান থেকে চলে আসার জন্য তৈরি হলে দুর্যোধন তাকে অনুরোধ করেন শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় ছাপ্পান্ন ভোগ তৈরী করিয়েছেন, তিনি যেন খেয়ে যান। শ্রীকৃষ্ণ সেই অনুরোধ অস্বীকার করেন। দুর্যোধন তখন তাকে বন্দী বানালে শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেন দূতকে বন্দী করা সবচেয়ে অনৈতিক কাজ আর এই অনৈতিক কাজ খুব শীঘ্রই দুর্যোধনের পতন ঘটাবে।
এই সময়ে সত্যকি কৌরব কূলের বধ করার জন্য অস্ত্র ধারণ করলে শ্রীকৃষ্ণ তাকে ঠান্ডা করেন।
এরপর গান্ধারী মাতার হস্তক্ষেপে শ্রীকৃষ্ণ আর সত্যকি সেখান থেকে বেরিয়ে চলে যান বিদুরের কাছে। সেখানে বিদুরের দেওয়া খুদ চালের ভাত খেয়ে তিনি তৃপ্ত হোন।পরবর্তীতে সেই ঘটনা 'বিদুরের খুদ' নামে জনপ্রিয় হয়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে যখন দুর্যোধন আর অর্জুন যান শ্রীকৃষ্ণের কাছে, তখন শ্রীকৃষ্ণ বলেন তিনি যুদ্ধ করবেন না। তখন দুর্যোধন চেয়ে নেন শ্রীকৃষ্ণের অপরাজেয় নারায়ণী সেনা আর শ্রীকৃষ্ণ যোগ দেন প্যান্ডবপক্ষে, তখন সত্যকিও যোগ দেন প্যান্ডবপক্ষে। যদিও
সত্যকির এই যুদ্ধে অংশ নেওয়া একদমই পছন্দ করেননি #বলরাম। বলরাম চেয়েছিলেন প্রদ্যুম্নর মতো তার সাথে সত্যকিও চলুক তীর্থ ভ্রমণে।
কুরুক্ষেত্রে:
সত্যকি এই যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিছু অদ্ভুত তীর বানিয়েছিলেন যার মুখগুলো ছিল সোনা দিয়ে বাঁধানো আর পেছনের পালক ছিল শকুনের।সর্বপ্রথম তিনি তার সেনানী সমেত যোগদান করেন পান্ডবপক্ষে।
যুদ্ধে সত্যকি ছিলেন প্যান্ডবপক্ষের এক অক্ষুহিনী সেনার সেনাপতি হিসেবে।
তিনি শুরুর থেকেই ছিলেন মারমূখী।
তিনি শকুনিকে পরাজিত করেন এমনভাবে, লজ্জায় আর আসেন না শকুনি তার সম্মুখে আর।
শকুনির আরেক ভাই বধ হন তার হাতে। পরাজিত করেন ভীষ্ম কে। গুরু দ্রোণের মুখোমুখি হয়ে তার যুদ্ধের শৈলী নকল করে গুরুকেই নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন বহুবার। তিনি গুরুর ধনুকের ছিলা কেটে দেন বেশ কয়েকবার।
শেষে গুরু দ্রোণ প্রয়োগ করেন দিব্যাস্ত্র। সেই দিব্যাস্ত্র কোনক্রমে নিষ্ফল করেন উপপাণ্ডব ভাইরা। রক্ষা পান সত্যকি।
এরপরে বিরক্ত হতাশ হয়ে গুরু দ্রণ অন্যদিকে যুদ্ধ করতে চলে যান।
কর্ণ কে করেন পরাজিত। কিন্তু অর্জুনের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে কর্ণকে ছেড়ে দেন।
কর্ণের ছেলে বৃষসেনকেও করেন পরাজিত।
দুঃশাসন আর দুঃশাসনের ছেলে ধুম্রসেনকেও পরাজিত করেন।
দুর্যোধনকে পরাজিত করেন তিনি।
তবে দুর্যোধন আর দুঃশাসন দুজনকেই ছেড়ে দেন তিনি ভীমের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণে রেখে।
এগুলো তো ছিল রথী মহারথীদের সাথে যুদ্ধের কথা।কৌরবভাইদের অনেক সেনাকেও করেন পরাজিত। তিনি বহু বহু পদাতিক সাধারণ সৈন্য বধ করেন যাদের রক্ষার দায়িত্ব ছিল দ্রোণ আর ভীষ্মর হাতে।
এত এত সেনার মৃত্যু দেখে দুর্যোধন খুব চটে যান সত্যকির উপরে। সাথে হতাশ ও হয়ে পড়েন গুরু আর পিতামহর উপরেও।
তিনি বধ করেন জলসন্ধকে। এই জলসন্ধ হলেন শ্রীকৃষ্ণের মামা জরাসন্ধের পুত্র। জলসন্ধর সাথে তীর ধনুকের যুদ্ধে সত্যকি তুলে নেন তার তিনটি বিশেষ বান, এই তিনটি বান একসাথে জলসন্ধের দুইটি হাত আর মাথা কেটে বধ করে জলসন্ধকে।
তার সহযোগীতার জন্য দ্রোণ পারেন নি যুধিষ্ঠির কে জীবন্ত বন্দী করতে।তার সহযোগীতায় অর্জুন পেরেছিলেন জয়দ্রথ বধ করে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে। এছাড়া তিনি #ধৃষ্টদুমন্য র প্রাণ বাঁচিয়েছেন অক্ষুহিনী বহুবার।
সোমদত্ত নামে ছিলেন এক মহাবীর। তার হাতের বর্শা কখনো বিফল যেত না। তিনি সেই বর্শা ছুঁড়ে দেন সত্যকির দিকে। সত্যকি সাথে সাথে তীর ছুঁড়ে সেই বর্শা করে দেন কয়েক টুকরো।
সোমদত্ত ছিলেন বৃদ্ধ কিন্তু তা স্বত্তেও ছিলেন মহাবীর। তার দুচোখের উপরের চামড়া ঝুলে গিয়েছিল এমন ভাবে, এতে তার দুইচোখ ঢাকা পড়ে যায়।
তিনি একটা সুতো দিয়ে কপালের চামড়া সমেত চোখের চামড়া তুলে ধরেছিলেন উপর দিকে, যাতে স্পষ্ট দেখতে পান।
সেই সুতো কেটে ফেলেন অর্জুন তীর দিয়ে, আর সত্যকি বধ করেন সোমদত্তকে।
সত্যকির ছিল দশটি সন্তান, সবাই মারা যান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। ভুরিশ্রভার হাতে।
তবে ওনার সম্পর্কে নাতি হন যুগন্ধর, যার হাত ধরে পরবর্তী বংশ বাড়ে পৃথিবীতে।
তবে ভুরিশ্রভাকেও বধ করেন উনি নিজের হাতে। এমনিতেই ভুরিশ্রভা ছিলেন তার শত্রু শুধু নয়, তাদের পারিবারিক শত্রু। সেই শত্রুতার জের ধরেই ভুরিশ্রভা বধ করেন সত্যকির দশ সন্তানকে।
এরপরে একদিন যুদ্ধক্ষেত্রে ভুরিশ্রভা অচৈতন্য করে ফেলতে সক্ষম হন সত্যকিকে। এরপরে অচৈতন্য সত্যকিকে টেনে নিয়ে যান একটু দূরে, সেখানে বধ করার জন্য অস্ত্র তুলে ধরেন ভুরিশ্রভা।
কিন্তু নিরস্ত্র কাউকে বধ করা ছিল নিয়ম বিরুদ্ধ।
শ্রীকৃষ্ণ লক্ষ করছিলেন সব। তার নির্দেশে অর্জুন তীর ছুঁড়লে কাটা যায় ভুরিশ্রভার দুই হাত।
তীব্র প্রতিবাদ করেন ভুরিশ্রভা, দুজনের যুদ্ধের মাঝে অর্জুনের এইভাবে ঢুকে পড়া অনুচিত বলে।
অর্জুন মনে করিয়ে দেন অভিমন্যু বধ করেছিলেন ভুরিশ্রভা ঠিক এইভাবেই।
অর্জুন আরও বলেন, এক অচৈতন্যকে এইভাবে মেরে ফেলাও যুদ্ধের নিয়ম নয়।
এসবের মাঝে
জ্ঞান ফিরে পেয়ে সত্যকি কেটে ফেলেন ভুরিশ্রভার মাথা তরোয়াল দিয়ে।
সোমদত্ত আর ভুরিশ্রভা ছিলেন পিতা পুত্র। দুজনেই মারা যান সত্যকির হাতে।
সমগ্র যুদ্ধ ময়দান জুড়ে তার গতিবিধি ছিল অবাধ। শুধু নিজেকে নয়, বাঁচিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন তার দ্বায়ীত্বে থাকা এক অক্ষুহিনী সেনার বেশিরভাগ সেনাকেই।
সেনাদের যত্ন আর রক্ষা করা ছিল সেনাপতির প্রধান কর্তব্য। সেই মহান কর্তব্যেও ছিলেন তিনি অসাধারণ ভাবে সফল।
ভয়ানক ছিল তার যুদ্ধ পদ্ধতি।
যুদ্ধ শেষে তিনি বেঁচে রয়েছিলেন অন্যান্য বার জন মহারথীদের সাথে।এরপরে তিনি শ্রীকৃষ্ণের সাথে দ্বারকায় চলে যান। দ্বারকা রক্ষায় তিনি ব্রতী হন।
শেষ সময়:
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ছত্রিশ বছর পরে শুরু হয় যাদব কূলের সমাপ্তির ঘটনা। মাতা গান্ধারীর অভিশাপ ফলপ্রসূ হতে শুরু করে।
যাদবদের সবাই যায় বনভোজনে, সেখানে মদ খেয়ে নিজেদের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এরপরে শুরু হয় বাক বিতণ্ডা। ক্রমশ ঝগড়ায় হয় পরিনত। ব্যক্তিগত আক্রমনে নেমে আসে।
যথারীতি জড়িয়ে পড়েন ঝগড়ায় সত্যকি আর কৃতবর্মা। কৃতবর্মাকে বলেন সত্যকি-
তিনি অশ্বত্থামার সহযোগিতা করেছেন ঘুমন্ত উপপাণ্ডবদের হত্যা করতে...
সত্যকিকে বলেন কৃতবর্মা- তিনি হাতকাটা অবস্থায় অসহায় ভুরিশ্রভাকে বধ করেন।
এইভাবে একে অন্যকে অপমান করতে করতে তুলে নেন পাশের জলা জমিতে জন্মে থাকা নল খাগড়া। সেই নল খাগড়া ততদিনে হয়ে উঠেছে তরোয়াল এর মত ধারালো, বর্শার মত ছুঁচোল আর গদার মত শক্ত। তারা একে অন্যকে আক্রমন করেন সেই নল খাগড়া নিয়ে। শ্রীকৃষ্ণ পুত্র #প্রদ্যুম্ন মধ্যস্থতা করতে গেলে কাটা পড়েন সেই নল খাগড়ায়। শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে দেখলেন সেই দৃশ্য। এরপরে মারা গেলেন সত্যকি।
সত্যকি নিজে যুদ্ধ করেছেন। সহায়তা করেছেন অর্জুন সমেত পাণ্ডবদের। দুর্যোধন দুঃশাসনদের হারিয়ে মনোবল ভেঙে দিয়ে, করেছেন ভীমের সহায়তা। ভেঙেছেন কর্ণের দম্ভ, অর্জুনের সহায়তা। ভীষ্ম পিতামহর মত ক্ষমতাবানকেও হারিয়েছেন তিনি। রক্ষা করেছেন নিজের দলে থাকা সাধারণ সেনাদের।পারিবারিক শত্রু ভুরিশ্রবা আর সোমদত্তর মত বীরদের বধ করে করেছেন নিজের পরিবারকে বিপদমুক্ত।
যুদ্ধ শেষে তিনি শ্রীকৃষ্ণের সাথে দ্বারকা নগরীর সুরক্ষা প্রদান করেছেন। তাই হয়ত শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চিন্তে সময় কাটিয়েছেন ইন্দ্রপ্রস্থে।
তিনি নিজেও ছিলেন অনন্য মহাবীর।
সবদিক থেকেই সেরা। দায়িত্ব সচেতন, কর্তব্যনিষ্ঠ, বন্ধু বৎসল এরম একজন প্রতিভা মহাভারতে কোথাও যেন রয়ে গেল নিষ্প্রভ। তবে সুখের কথা একটাই এনার মত মহাবীর নিজের যোগ্যতায় নিজের জায়গা করেই নিলেন।
যোগ্যতমরা এভাবেই জায়গা করে নেয়, কেউ আটকাতে পারে না।
সত্যকি তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
(তথ্যসূত্র : উইকিপেডিয়া ও অন্যান্য সূত্র। )