Sutanu Sinha

Drama

3  

Sutanu Sinha

Drama

সর্বজ্ঞানী

সর্বজ্ঞানী

8 mins
3.5K


সমস্ত ইস্কুলেই কতিপয় ছেলে থাকে যারা বিশেষ একটি দলের সাথেই সারাক্ষন ঘোরাকে পছন্দ করে । আমাদের স্কুল এ ও এরকম একটি দল ছিল । যারা সবসময় একসাথে ঘুরতো । এক ই কথা বলতো । আর এই সব দলে সাধারণত এক জন নেতা থাকতো । যার স্বভাব , কথাবার্তা অন্যদের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা হতো , একটা সর্বজ্ঞানী ভাব নিয়ে ঘুরতো সে । এরকম এক সর্বজ্ঞানী আমাদের স্কুল এ ও ছিল । নাম বলাই , ভালো নাম ছিল বলরাম মল্লিক । আজ কের গল্পটা এই সর্বজ্ঞানী বলাই কে নিয়ে ।

বলাই ভালো ছেলে না খারাপ , সেটা বলা খুব মুশকিল ছিল । আমাদের চোখে ছেলেটাকে খুব একটা ভালো মনে হতো না । সে যেমন তার এই কতিপয় চেলাদের নিয়ে দুষ্ট ছেলেদের সাইকেল এর বেল চুরি করতো , তেমনি রাগী মাস্টারমশাই দের জব্দ করার জন্য বিটকেল সব বুদ্ধি বের করতো । মাস্টারমশাই রা রেগে গিয়ে তার চেলাদের শাস্তি দিলে ও বলাই কোনোদিন শাস্তি পেত না । কি ভাবে বেঁচে যেত তা বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব ও ছিল না । এরকম দল কে কেন জানিনা মাস্টারমশাই রা ও একটু সমঝে চলতো । আমরা ও কিছু ভালো ছেলের দল , যারা একটু ভয় পেয়ে হোক বা মাস্টারমশাই দের কুনজর এ না পরার জন্য হোক , খুব একটা কথা বলতাম না তাদের সাথে ।

বেশি কিছু বলতে গেলে তার কথার উপর প্যাঁক খেয়ে যেতে হত আমাদের । ছোকরার আর যাই হোক সাধারণ জ্ঞান প্রচুর । তাই কিছু একটা বলে অতি সহজেই হার মানিয়ে দিতো আমাদের । যেমন সেদিন ক্লাস এ ঢুকছি , হঠাৎ শুনতে পেলাম বলাই দের দল টা কিছু একটা নিয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে । আর সেখানে সবজান্তা বলাই যে মধ্যমনি আলাদা করে বলে দেবার দরকার নেই । কি মনে হলো একটু মন দিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম ওরা ক্রিকেট নিয়ে বিশেষত হেলিকাপ্টার শট নিয়ে আলোচনা করছে । ক্রিকেট এর পোকা হওয়ায় আলোচনা টা মন দিয়ে শুনতে লাগলাম । বলাই কোন ম্যাচ খেলতে গিয়ে প্রথম হেলিকাপ্টার শট মেরেছিলো আর কিভাবে মেরেছিলো তার ই বিবরণ দিচ্ছিলো । শুনতে বেশ ভালোই লাগছিলো , বলাই আদৌ এরকম কোনো ম্যাচ খেলেছিল কিনা , বা খেললেও এরকম কোনো শট মেরেছিলো কিনা , সেটা তর্কসাপেক্ষ। কিন্ত শট টা কে নিয়ে সে যেরকম পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিছিলো তা তারিফ যোগ্য । ক্রিকেট নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে এতটা বলা বোধহয় সম্ভব নয় ।হঠাৎ ই বলাই এর একটা কথা সম্পূর্ণ ভুল মনে হলো । ও বলতে চাইছে যে টাইম এ ও এই শট টা মেরেছিলো তখন মহেন্দ্র সিং ধোনি নাকি খেলা শুরু করেনি । তাই এই হেলিকাপ্টার শট এর আসল হোতা হচ্ছে সে । নেহাৎ পড়াশোনা ছাড়তে পারবে না বলেই সে ক্রিকেট টা নিয়ে সিরিয়াস হতে পারছে না । কথাটা ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না । কারণ ধোনি ইন্ডিয়া টীম এ খেলা শুরু করে সম্ববত ২০০৫ এ । ২০০৫ এর আগে যদি বলাই এই শর্ট মেরে থাকে , তাহলে তখন তার বয়স ছিল কমপক্ষে ১২ বছর । কায়দা করে জিজ্ঞেস করলাম, বলাই তুমি তাহলে কবে এই শর্ট টি মেরেছিলে ? ধোনি তো ২০০৫ এই এই শর্ট টা মেরেছিলো , তুমি কি তার ও আগে.... কথা শেষ করতে দিলো না বলাই , বলে উঠলো অবশ্যই তার আগে, তখন আমার বয়স হবে এই ১২ বছর মতো , না হলে আর কেন বলবো এই শর্ট তখন ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এ কেউ মারেনি । আমি তাদের কথাবার্তায় যোগ দেয়াই দারুন খুশি হয়ে বলে উঠলো বলাই । আসতে আসতে বললাম কিন্ত যতদূর জানি ২০০২ এ সচিন তেন্ডুলকর প্রথম এই শর্ট টি মেরেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এ । আর মেকআপ দেবার কোনো জায়গা ছিল না বলাই এর , কারণ আগেই সে বলে ফেলেছে সে যখন শর্ট টি মারে তখন তার বয়স ১২বছর । কিন্ত চেলাদের কাছে হারবার পাত্র নয় বলাই, তাই বেশ ঝাঁজিয়ে বলে উঠলো , তুই সব জানিস নাকি , সচিন মেরেছিলো বললেই হলো , পরশু কাগজ এ সৌরভ গাঙ্গুলী ইন্টারভিউ টা পড়ে নিস্, সব বুঝে যাবি । এটা নিশ্চয় বলবি না সৌরভ এর থেকে তোর ক্রিকেট জ্ঞান বেশি ? চুপ মেরে গেলাম আমি , পরশু না কবে কার কাগজ এ সৌরভ এর একটা ইন্টারভিউ দেখছিলাম বটে , কিন্ত অত গভীরভাবে পড়িনি ।বলাই এমনিতে এসব ব্যাপার ভালোই খবর রাখে । তাই প্রসঙ্গ আমার ফেভারিট ক্রিকেটার সচিন কে নিয়ে হলেও ঢোক গিলে চুপ করে গেলাম । আর বলাই যেমন রাজা ছিল ওর চেলাদের কাছে তাই রয়ে গেলো ।

এরকম কিছু ছোট খাটো অপমান আমাদের সহ্য করতেই হতো । একবার সুবীর ও ফিজিক্যাল সাইন্স সম্বন্ধে একটা তর্কে বলাই কে খুব চেপে ধরেছিলো , ও একই ভাবে অমুক , তমুক বলেছে বলে অপমান করেছিল , বেচারা সুবীর তো কেঁদে ফেলার জোগাড় ।এহেন সর্বজ্ঞানী বলাই , তার দলের বাইরে কাউকে ই বিশেষ পাত্তা দিতে অভ্যস্ত ছিল না । তবে বলাই যতই সর্বজ্ঞানী হোক কিছু ভালো গুন ও ছিল তার মধ্যে । যেমন পড়াশোনায় সে ভালোই ছিল , যে কোনো পরীক্ষায় বলাই মোটামুটি প্রথম ৫ এর মধ্যে থাকতোই । বন্ধু দের বিপদ এ সব সময় আগে দৌড়ে যেত । কিন্ত তার বলা এই সব গুল গল্প আর চেলা দের সব কিছুতে ঘাড় নাড়া,খুব ই অসহ্য লাগতো । আমরা সবসময়ই একটা চুপি চুপি চেষ্টা চালিয়ে যেতাম বলাই কে ফাঁসানোর । কিন্ত প্রতিবার ই ব্যর্থ হতাম । কিন্ত বলাই যে নিজেই নিজেকে এ ভাবে ফাঁসিয়ে ফেলবে আর আমরা যে এতো সহজে বলাই এর এই সর্বজ্ঞানী ভাবনা থেকে মুক্তি পাবো স্বপ্নে ও তা ভাবিনি ।

সেদিন ছিল ভূগোল পরীক্ষা , আমি এমনিতেই ভূগোল এ বেশ কাঁচা । এড়িয়ে ই চলি এই বিষয়টিকে । তাই প্রতিবার এর ই মতো বেশ ভয় নিয়ে ই স্কুল এ হাজির হলাম । স্কুল এ গিয়ে শুনলাম আজ পরীক্ষা হবেনা । স্কুল এ ইন্সপেক্টর এসেছে । তাই কিছু ক্লাস ও না হতে পারে । সাধারণত গ্রাম এর দিকের স্কুলে ইন্সপেক্টর আসা মানে আমাদের ছাত্রদের খুব ই মজা । সারাদিন ক্লাস সেরকম ভালো করে হয় না । মাস্টারমশাই রা সবাই ভীষণ ব্যস্ত থাকে ইন্সপেক্টর কে নিয়ে ।আর সারাবছর আমাদের কে বকলে ও ইন্সপেক্টর এর সামনে আমাদের কে খুব ভালো ছেলে বলে । ইন্সপেক্টর মাঝে মাঝে ক্লাস এ এসে কিছু প্রশ্ন করে । তার সঠিক উত্তর না দিলে ও ইন্সপেক্টর নিজেই বলে দেয় ,বা মাস্টার মশাই রা বলে দেন । তাই ইন্সপেক্টর আসার কথা শুনে সবার ই মন টা বেশ আনন্দে ভোরে উঠলো । প্রথম ২ টো ক্লাস হয়ে যাবার পর হঠাৎ ই ৩ ক্লাস এ কোনো মাস্টারমশাই এলো না । শুধু ক্লাস টিচার এসে বলে গেলো যে কোনো সময় ইন্সপেক্টর আসতে পারে, ভালো ভাবে থাকতে । ২ টো ক্লাস এভাবে কাটানোর পর নিতাই দা এসে বলে গেলো টিফিন করে নিতে , ইন্সপেক্টর চলে গেছে । সবাই খুশি মনে টিফিন করতে চলে গেলাম । টিফিন করে সবে ক্লাস এ ঢুকবো , দেখি আমাদের সর্বজ্ঞানী বলাই , বেশ বড় করে গল্প করতে বসেছে । বেশ জোরেই গল্প করছিলো সে , তাই না চাইলেও কি বলছে আমরা সবাই শুনতে পাচ্ছিলাম । বিষয় ছিল যথারীতি ইন্সপেক্টর কে নিয়ে ।বলাই এর কথা মতো , শুধু মাত্র তার জন্য ইন্সপেক্টর আজ কের তাদের ক্লাস এ আসেনি । এটা অবশ্য সত্যি কথা , অনেকক্ষন বলাই কে কেউই ক্লাস এ দেখেনি । বলাই নাকি টিচার রুম এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন ই ইন্সপেক্টর তাকে দেখে চিনতে পারে আর ডেকে নেই । তারপর তাকে ২ টো বীজগণিত এর অঙ্ক করতে দেয় ।বলাই নাকি এতো স্মার্টলি সেটা করে দেয় ইন্সপেক্টর সাহেব ভীষণ খুশি হয়ে যাই । এর পর তাকে একটা ইংরিজি তে কবিতা বলতে বলে, গর্বের সাথে সেটা ও শুনিয়ে দেয় বলাই । বেশ আর পাই কে , সেই সময় নাকি আমাদের হেডমাস্টারমশাই ও ঢুকছিলেন , ইন্সপেক্টর সাহেব নাকি হেড মাস্টারমশাই কে ডেকে বলাই কে আবার অনুরোধ করে কবিতাটি বলার । বলাই আবার বলে । সব শুনে নাকি ইন্সপেক্টর সাহেব এতো খুশি হয় ,যে বলে তোমাদের ক্লাস এর ইন্সপেকশন আর দরকার এ নেই । যে ক্লাস এ বলাই এর মতো ছেলে আছে তার ইন্সপেকশন করা নাকি বোকা বোকা হয়ে যাবে । এসব কথা এক দম এ বলে চলেছিল বলাই , এমন সময় পিছন থেকে একটা রোগা , ধুতি পাঞ্জাবি পরা লোক হঠাৎ বলে উঠলো , কে বলেছে এসব কথা ? বলাই তার দিকে দৃঢ়তার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো , আজ কের যে ইন্সপেক্টর সাহেব এসেছিলো উনি বললেন । তাতে ভদ্রলোক বললেন , তা উনি কি অঙ্ক করতে দিয়েছিলো তোমাকে ? সে একটি বীজগণিত এর অঙ্ক । তা তুমি কি ইন্সপেক্টর কে আগে থেকেই চিনতে ? বলাই বলে উঠলো , অবশ্যই , আমার এক কাকার বাড়ির পাশেই থাকেন তিনি । সব শুনে ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে চলে গেলো ভদ্রলোক । যাই হোক এটা প্রতিবার এ যখন ইন্সপেক্টর চলে যাই , আমাদের কাছে খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছিলো, যে বলাই ইন্সপেক্টর কে নিয়ে তার কিছু অসাধারণ ক্ষমতা আমাদের কে শুনাবে । এ বার ও তার অন্যথা হলো না । সব শুনে সহ্য করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকে না ।

পরের ক্লাস সবে শুরু হয়েছে ,হঠাৎ এ হেডমাস্টারমশাই প্রবেশ করলেন আমাদের ক্লাস এ । তিনি এসে জানালেন ইন্সপেক্টর সাহেব যাবার আগে একবার আমাদের ক্লাস এ আসতে চাই । আমাদের বসার ব্যবস্থা কিছু রদবদল করানো হলো , সামনের বেঞ্চে আমাদের কিছু ভালো ছেলেদের নিয়ে এলো, যথারীতি আমাদের সাথে বলাই ও চলে এলো সামনের সারিতে । আমরা সবাই ই চাইছিলাম বলাই এর কাছে থাকতে যাতে আমাদের বেশি প্রশ্ন না করে । এর পর হেডমাস্টার মশাই ঢুকলেন ইন্সপেক্টর কে নিয়ে ।তখন ই ছিল সবার অবাক হবার পালা । কারণ যে লোক টি হেডমাস্টারমশাই এর সাথে ঢুকলেন , তিনি আর কেউ নন , সেই ধুতি পাঞ্জাবি পড়া লোক, যার সামনেই বলাই ইন্সপেক্টর কে নিয়ে প্রচুর গল্প দিচ্ছিলো । আমরা , এমন কি বলাই এর চেলা চামুন্ডা রা ও চুপিচুপি হাসতে থাকলাম । হেডমাস্টারমশাই কেন জানিনা আজ কের এ বলাই কেই প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলেন , বললেন স্যার , এই ছেলেটি এই ক্লাস এর এক জন জিনিয়াস ছেলে । ইন্সপেক্টর সাহেব হেসে বললেন হ্যা, ওর সাথে আগেই দেখা হয়েছে আমার । তা কিছু বীজগণিত এর অঙ্ক দেব নাকি বলাইচাঁদ ? বলাই এর তখন চোখ মুখ পুরো লাল হয়ে গেছে । আমতা আমতা করতে লাগলো সে । ইন্সপেক্টর সব দেখে হেসে উঠলেন , আর কোনো এক অজ্ঞাত কারণ বশত তিনি বলাই কে আর কিছু বললেন না । অন্য ছেলেদের কিছু সাধারণ প্রশ্ন করেই চলে গেলেন তিনি । ইন্সপেক্টর চলে যাবার পর আমরা যখন সবাই মিলে বলাই এর দিকে চাইলাম , তার চোখ মুখ পুরো লাল হয়ে গেছে । যাহোক করে নিজের কান্না চেপে , এক দৌড়ে ক্লাস থেকে পালিয়ে গেলো সে । টানা ৩ দিন শরীর খারাপ এর নাম করে সে স্কুল এ এলো না । এর পর যখন স্কুল এ এলো পুরোপুরি চুপচাপ হয়ে গেলো বলাই । তার সব চেলা চামুন্ডা রাও তার বুজরুকি বুঝতে পেরে তার থেকে দূরত্ব রাখতে শুরু করলো । আর আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । এর পর থেকে আর কোনোদিন বলাই এর সর্বজ্ঞানী গল্প আমাদের কে আর সহ্য করতে হয়নি ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama