Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational

2  

Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational

সংকল্প পূরণ (তাতাইয়ের গল্প-১৮)

সংকল্প পূরণ (তাতাইয়ের গল্প-১৮)

7 mins
833


".... আর ৬৭, ইংরেজি।"

"কি? মামা আরেকবার বলো।"

"ইংরেজিতে ৬৭।"

"নাহ, এটা অসম্ভব। মামা তুমি ঘুরে দেখো, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে নিশ্চয়।"

"কোনো ভুল হচ্ছে না রে মা, ইংরেজিটায় কমই এসেছে।"

 ফোনটা রেখে ধপ করে খাটে বসে পড়ল তাতাই। ইংরেজিতে এতো কম!!! কি করে সম্ভব, পরীক্ষাটা তো এতো ভালো হয়েছিল!!!  


    স্কুলে যেতেই বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে দিদিমণিরা সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে তাকে, কিন্তু হাসতে পারছে না তাতাই। খুশি হতে পারছেনা সে। মা বাবার মুখটা মনে পড়ে গেলেই কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। মাধ্যমিকের পর সবাই বলেছিল সায়েন্স নিতে, তাতাই শোনেনি। তার ইচ্ছে ছিল সাহিত্য নিয়ে পড়বে, তাই সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আর্টস নিয়েছিল। মা বাবাকে বড় মুখ করে বলেছিল, "আমার ভালো রেজাল্ট করা নিয়ে তো কথা! আর্টস নিয়ে পড়েও যে ভালো রেজাল্ট করা যায় তা দেখাবো আমি।"

উচ্চমাধ্যমিকে তাতাই স্কুলের প্রথম হয়েছে, কিন্তু এই আনন্দ কোথাও যেন গিয়ে চাপা পড়ে যাচ্ছে একটা নম্বরে… ইংরাজি, যে বিষয়টা নিয়ে তাতাই ভবিষ্যতে এগোবে বলেই তার আর্টসে আসা। এখন তো কলেজে ভর্তি হতে গেলে যে বিষয় নিয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে সেই নম্বরটাই প্রাধান্য পায়, অন্য বিষয়ের নম্বরগুলো গৌণ। এক্ষেত্রে তাতাই কি সুযোগ পাবে ইংরাজি নিয়ে পড়ার???


                  ★★★★★


"তৃষা এতো চিন্তা করিস না। আমাদের স্কুলের ইংরেজির নম্বর তো ইন জেনারেল বলে লাভ নেই, সবার খারাপ এসেছে। যিনি খাতা দেখেছিলেন জানিনা তার কোনো শত্রুতা আছে কিনা আমাদের সাথে।"

   ম্যাম ফোনটা রাখার পর চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল তাতাই। স্কুলের ম্যাম যাই বলুক, কেউ তো আর দেখতে যাবে না যে গোটা স্কুলের নম্বরই খারাপ এসেছে। এখানে সবাইকে নিয়ে কাজ নয়, তাতাইয়ের নিজের নম্বরটা কম এটাই বড় কথা। 


   নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমের দিকে আসতে যেতেই কথাগুলো কানে এলো তাতাইয়ের। একজন আত্মীয় কিছুক্ষণ আগেই ওদের বাড়ি এসেছেন। তাঁরই গলা শোনা গেল,

"বেশি না হাজার কুড়ি লাগবে। এখন পাস কোর্সে ফর্ম তুলে নাও। ওখানে তো শুরুতেই ওর নাম এসে যাবে, তারপর ওই টাকাটা দিলে ইংরেজিতে ট্রান্সফার হয়ে যাবে।"

  "ডি.ডি কলেজেও ইংরেজিতে সুযোগ পাবে না?"

"আহা দেবেশ এখন কি হারে নাম্বার উঠছে তুমি জানোনা। ওই নাম্বারে তাতাই আর কোথায় সুযোগ পাবে!"

  "সে হোক জিতেন দা কিন্তু গ্রাজুয়েশনটাও আমাকে এরকম টাকা দিয়ে ভর্তি করতে হবে? জীবনের এই তো সবে শুরু, ওর তো নিজের যোগ্যতার ওপর বিশ্বাসই হারিয়ে যাবে।"

 "তুমি না বড্ড কৃপণ দেবেশ। এটা তোমার মেয়ের ভবিষ্যতের প্রশ্ন।"

"জানি আর তাই তো এভাবে পার্টিকে টাকা খাইয়ে মেয়েকে ভর্তি আমি করব না, সে আপনি আমাকে কৃপণ ভাবুন আর যাই ভাবুন।"

  "তাহলে মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে শুনি? ঘরে বসিয়ে রাখবে?"


    জিতেন জ্যেঠুর কথাটা শুনে আর ওখানে দাঁড়াতে পারল না তাতাই। ছুটে চলে এলো নিজের ঘরে। ড্রয়ার টেনে মার্কশিটটা বের করল সে। ইংরেজি বাদে বাকি সব বিষয়ে ৮০% থেকে ৯০% নাম্বার লেখা সেখানে। এর পরেও শুনতে হবে "মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে"!!! এই বাকি বিষয়গুলো, এই নম্বরগুলোর কি কোনো মূল্য নেই??? হয়তো তাতাই ইংরেজি পড়তে চেয়েছে, কিন্তু তা বলে অন্য বিষয়গুলো তার আসেনা বা সে সেগুলো নিয়ে পড়তে পারেনা তা তো নয়। এই নাম্বারে সে শহরের সবচেয়ে টপ কলেজে নির্দ্বিধায় সুযোগ পাবে যে কোনো বিষয়ে। তাও সবাই এরকম করে বলছে!!!


    রেজাল্ট বেরোনোর পরের দিন পাড়ার এক কাকিমা এসেছিলেন দেখা করতে। একটি নতুন তৈরি হওয়া কলেজের প্রথম ব্যাচ হিসেবে তিনি ৪২% রেখে ইংরেজি অনার্স পাস করেছেন। সেই কাকিমাও তাতাইকে কত কথা শুনিয়ে গেলেন,

"ইংরেজি নিয়ে পড়া কিন্তু অতো সোজা নয়। এই নম্বর নিয়ে পড়ার কথা কি করে ভাবছো জানিনা।"

  "আমি কিন্তু মাধ্যমিকে ৯৫ পেয়েছিলাম আর স্কুলের টেস্ট পরীক্ষায় ৮৭।"

"ওসব অতীতের কথা ভুলে যাও। উচ্চ মাধ্যমিকের নম্বরটাই আসল। ওখানেই ঠিকঠাক ইভ্যালুয়েশনটা হয়। আর তাছাড়া আগে কোনো কলেজে চান্স পাও কিনা দেখো। আমার এক বোন তো ৮৬ পেয়েছে, সেতো চিন্তায় অস্থির এম.কে কলেজে চান্স পায় কিনা।"

  "এম.কে কলেজেও ৮৬ তে চান্স পাবে না!!!"

"তবে আর বলছি কি, এখন তো ৯০ না পেলে কোনো কিছুর নিশ্চয়তা নেই। সেখানে তুমি তো ৭০ও পাওনি।"

   মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছিল তাতাইয়ের। প্রবাদ আছে, "হাতি গর্তে পড়লে ব্যাঙও তাকে লাথি মারে।" আজকাল কিছু লোকের কথা শুনে প্রবাদটা যে কতটা খাঁটি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তাতাই।


  দাদুর এক বন্ধুর সাথে রাস্তায় দেখা হতে তিনি বলে উঠলেন, "শুনলাম তোমার রেজাল্ট নাকি খুব খারাপ হয়েছে। কোনো কলেজে সুযোগ পাচ্ছ না?"

"কোনো কলেজে এখনও ফর্ম দেওয়াই শুরু হয়নি দাদু, তাই চান্স পাওয়ার কথা এখনই বলতে পারছিনা।"


   আজকাল মাথাটা কেমন যেন করে তাতাইয়ের। লোকের সামনে বেরোতে ইচ্ছে করেনা। তাতাই বেশ বুঝতে পারছে নিজের ভেতরেই শুকিয়ে যাচ্ছে সে। পড়াশুনোই তো এতোদিন তার ধ্যান জ্ঞান ছিল, অন্য কোনো বিষয়ে মন দেয়নি কখনও। সেই অর্থে কোনো ট্যালেন্ট নেই তার মধ্যে। এবার পড়াশুনোটাও হারিয়ে যাবে তার জীবন থেকে! কে বলছে ডি.ডি কলেজের মত একটা বি গ্রেড কলেজেও তাকে টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে, কেউ আবার বলছে সে নাকি ইংরেজি নিয়ে পড়ার যোগ্য নয়, পাস কোর্স নিয়ে পড়ার সাজেশনও এসেছে। যে যা পারছে তাই বলে যাচ্ছে। তাতাই বেশ বুঝতে পারছে সবার কথায় তার বাড়ির লোকের বিশ্বাসটাও খানিক যেন নড়ে গেছে। আজ মা তাকে ঘুরে দোষারোপ করল তখন সায়েন্স নিয়ে না পড়ার জন্য, তখন বড় মুখ করে সে কি কথা বলেছিল সেটাও মনে করিয়ে দিল মা। সত্যিই তো তাতাই হেরে গেছে,হেরে গেছে সে নিজের কাছে। আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারেনা ভয়ে, ওই হেরো মুখটা দেখতে ইচ্ছে করেনা। ফর্ম তুলতে গিয়ে দেখেছে কত লম্বা লাইন, ওদের সবার নিশ্চয় অনেক অনেক নম্বর, কেউ তাতাইয়ের মত হেরো নয়। এতদিন শুনে এসেছে, One mark cannot decide your future." কে বলেছে এটা! স্রেফ মিথ্যা। একটা নম্বরই একটা মানুষের জীবনকে ওলটপালট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। রাতের বেলা আজকাল ভীষণ কান্না পায়, অন্ধকারে রাত জেগে বসে ভাবে তার ভবিষ্যৎটাও কি এমনই, অন্ধকার!!!


                 ★★★★★★


নামটা থাকবে না জানতো, তবুও যেদিন শহরের সবচেয়ে নামি কলেজের ইংরেজির ফার্স্ট লিস্টে নামটা বেরোলো না, বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়েছিল তাতাইয়ের। তবে ঠিক তার দুই দিন আবার আশায় বুক বেঁধেছিল যখন ওর চয়েস লিস্টের সেকেন্ড কলেজের ফার্স্ট লিস্টে ওর নামটা বেরিয়েছিল। তবে নাম বেরোলেও কি! সিট সংখ্যা সীমিত কিন্তু লিস্টে নাম আছে তার প্রায় দ্বিগুণ। তাতাইয়ের নামটাও এমন কিছু শুরুর দিকে নয়। বাবা বলেছেন আশা না করাই ভালো। 


   কাউন্সেলিং শুরু হতে ঘন্টাখানেক বাকি। কলেজ ক্যাম্পাসে হাজার হাজার মানুষের ভীড়। অনেকগুলো সাবজেক্টের কাউন্সেলিং আছে, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কত মানুষ এসেছে ভর্তি হতে, ভর্তি করতে। এখন ভূগোলের কাউন্সেলিং চলছে, একটু আগে বাংলার কাউন্সেলিং শেষ হল--- হল থেকে বেরোনো মুখ গুলোর মধ্যে কারুর মুখটা ছিল হাসিতে উজ্জ্বল আর কারুরটা কাঁদো কাঁদো। ওই কান্নাভেজা মুখগুলোর মধ্যে তাতাই যেন নিজের মুখটা দেখতে পাচ্ছিল, বারবার মনে হচ্ছিল এমন হবে না তো যে ওর ঠিক আগের জনে এসে কাউন্সেলিং বন্ধ হয়ে গেল! হতেও তো পারে,বিচিত্র কিছু নয়। ওর পাশে বসেই চারটি মেয়ে আর তাদের মায়েরা গল্প করছে খোশমেজাজে। ওদের তাতাই চেনে না, অন্য স্কুলে পড়ত নিশ্চয়। ওরাও ইংরেজিতে ভর্তি হবে। কথাবার্তাতেই বুঝেছে যে ওদের rank সামনের দিকে আছে, তাই ভয় নেই ওদের। ওদের মধ্য থেকে একটা মেয়ে নিজ থেকে কথা বলতে শুরু করল তাতাইয়ের সঙ্গে, তারপর মিষ্টি হেসে বলল, "চিন্তা কোরো না, ঠিক হয়ে যাবে দেখো।" 

মেয়েটার মুখের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, তাতাই যেন মনে মনে অনেকটা ভরসা পেলো। 


   কাউন্সেলিং চলছে, রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে সবাই। একের পর এক নাম ডাকা হচ্ছে, একজন উঠে যাচ্ছে উপস্থিতি জানান দিতে। জেনারেল ক্যাটাগরির ৪৫ টা সিট। ৩৭ অবধি হিসেব রাখছিল তাতাই, তারপর আর সাহস হয়নি। চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে পরবর্তী ধাক্কাটার জন্য। অনেকগুলো নাম ডাকা হয় গেছে তারপর। চোখ বন্ধ তাতাইয়ের, আচমকা কানে বাজলো একটা নাম---- তৃষা দত্ত। চোখটা খুলে আশেপাশে তাকাল সে, ভুল শোনেনি তো! নাহ, দ্বিতীয়বার ডাকা হল নাম। উঠে গেল তাতাই। আর সঙ্গে সঙ্গে স্যার ঘোষণা করলেন, "ইংরেজি জেনারেল ক্যাটাগরির কাউন্সেলিং শেষ। এবার শুরু হবে SC ক্যাটাগরির কাউন্সেলিং।" তারপর তিনি তাতাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, "লাকি ক্যান্ডিডেট।"

ঘনঘন নিশ্বাস পড়ছে তাতাইয়ের,বাইরে বাবা অপেক্ষায় আছেন। তিনি এখনও জানেন না খবরটা। ভর্তি হয়ে গেল তাতাই। নিজের অন্যতম পছন্দের কলেজ যেখানে ভেবেছিল শুরুর দিকে নাম থাকবে সেখানে তাতাই ভর্তি হল সবার শেষে। 


   সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যের ঠান্ডা বাতাসটা যখন মুখে লাগছিল তখন অদ্ভুত এক শিহরণ হচ্ছিল শরীরে। একটা ভালো লাগা, মন্দ লাগার মিশ্র অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল মনের মধ্যে। আজ আর অন্য কারুর কাছে নয়, নিজের কাছে একটা সংকল্প নিল তাতাই--- "আজ আমি সবার শেষ ক্যান্ডিডেট হিসেবে কলেজে ঢুকছি, যেদিন আমি এই কলেজ থেকে বেরোবো সেদিন আমার নামটা থাকবে সবার প্রথমে।"


                   ★★★★★


"এবার মঞ্চে পুরস্কার নেওয়ার জন্য ডেকে নিচ্ছি আমাদের কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বিভাগে প্রথম, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় তৃষা দত্তকে।"


   মঞ্চে উঠে গেল তাতাই। প্রিন্সিপাল স্যার গলায় একটা সোনার মেডেল ঝুলিয়ে দিলেন, হাতে দিলেন বই আর পুষ্পস্তবক। প্রণাম করল তাতাই, মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন স্যার,

"Wish you a very very bright future."


  মঞ্চ থেকে নেমে পুরস্কারগুলো মায়ের হাতে দিলো তাতাই, দেখলো মায়ের চোখের কোণে জল টলটল করছে। তাতাই অস্ফুটে মাকে বলল, "আমি পেরেছি মা, আমি আমার সংকল্প পূরণ করতে পেরেছি, শেষ থেকে সবার প্রথমে উঠে এসেছি। সেদিন আমার একটা খারাপ নম্বরের জন্য যারা নানা আছিলায় তোমাদেরকে, আমাকে অপমান করেছিল তারা আজ জবাব পেয়েছে।"


মা ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, "ভুলে যা ওদের কথা। লোক তো সুযোগ পেলে কথা বলবেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো তুই নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করেছিস, নিজের সংকল্প বাস্তবায়িত করেছিস। এটাই আসল জয়।"


  মেডেলটায় হাত ছোঁয়াল তাতাই। কথায় বলে, "One mark cannot decide your future." কথাটা হয়তো সত্যিই। তবে এখনও অনেক পথ চলা বাকি…


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational