সময়ের পথে
সময়ের পথে


টাইম মেশিনটা প্রায় শেষ করে এনেছি, কাল চেপে বসেছিলাম ভবিষ্যতের সফর করবো বলে। কিন্তু 3000 সালের একটা টাইম আর ডেট সেট করে বসতেই মেশিনটা অসম্ভব কাঁপতে শুরু করল। প্রায় দশ মিনিট টাইম ট্র্যাভেল করে যখন আমার মেশিন থামল, চারপাশটা কেমন ধুসর রঙ ছড়াচ্ছে। ছেড়া ছেড়া কুয়াশা আর কালচে জল ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। কম্পিউটার বাইরের আবহাওয়া ও বায়ুর চাপ পরিমাপ করে বলছে বাইরে বার হলেই অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে আমার ক্ষতি হতে পারে। জিপিএস সেট করে জাপান আমেরিকা লন্ডন ভারত অস্ট্রেলিয়ার বেশ কিছু বড় শহর ঘুরে নিলাম মেশিনের পেটে বসেই। কিন্তু কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব চোখে পড়েনি। নিশ্চই কিছু প্রবলেম রয়েছে মেশিনে। একটাও হাইরাইজ বা শহরের রাস্তাঘাট কেনো চোখে পড়ল না কে জানে !! বোধহয় কোনো টাইম লুপে পড়ে গেছিলাম। ফেরার ডেট আর টাইম সেট করতেই আরেক বিপত্তি, 2020 লিখলেও মেশিন নিচ্ছে না। এখনো মেশিনটা কাঁপছে। ঘড়ি বলছে ছাব্বিশ ঘন্টা আমি রয়েছি মেশিনের ভেতর। ভেতরটা তিন ফুট বাই তিন ফুট, উচ্চতা পাঁচ ফুটের একটু কম। অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে এবার। আমার তৈরি স্পেশস্যুটের মত দেখতে বিশেষ পোশাকটা পরে আমি তৈরি। এই পোশাক আমায় অক্সিজেন সরবরাহ করে সব সময়। ডেট আর টাইমের জায়গাটা কয়েকবার জোরে টিপতেই আবার থরথরিয়ে কেঁপে উঠল মেশিনটা। সময় ঘড়িটা গোল গোল ঘুরেই চলেছে। তবে কি আমি আর কখনো নিজের সময়ে ফিরতে পারবো না !! কিন্তু দু বার যখন ট্রায়েল দিয়েছি এমন তো হয়নি কখনো !!
এমারজেন্সি বটনটা টিপতেই ধীরে ধীরে মেশিনের গতি কমল। ঘড়িটাও স্থীর হয়েছে। কিন্তু মনিটার দেখাচ্ছে এক পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা জায়গায় পৌঁছে গেছি। টাইম সন্ধ্যা বেলা, ডেটের জায়গায় কয়েকটা চিহ্ন ফুটে রয়েছে। তারমানে এই ডেটটাই ঠিক করতে হবে।
তা কোন যুগে পৌঁছে গেছি সেটা বোঝার চেষ্টায় মনিটারটাকে এডযাষ্ট করে আশেপাশে দেখতে শুরু করলাম। মেশিনটার চার্জ কমছে। সৌরশক্তিকে এনার্জিতে পরিনত করে এ মেশিন চলে। দিনের আলো না ফুটলে চার্জ হবে না এ মেশিন। আপাতত আমি বরং জায়গাটা ঘুরে দেখতে পারি। প্রথমেই মেশিনের বাইরে যে চারটে ক্যামেরা বসানো আছে সেগুলোকে চালু করে দেখে নিলাম, কয়েকটা টিলা পাহাড় ঝোপঝার চোখে পড়ছে। মনিটারে লেখা ফুটল প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে আসেপাশেই। কিছুক্ষণ ওয়েট করে নেমেই পড়লাম। দেখা যাক কোথায় এসেছি। মনে তো হচ্ছে চেনা পৃথিবীতেই পৌঁছে গেছি। পায়ে হেঁটে আসপাশটা একটু ঘুরে দেখলাম। গাছপালা গুলো একটু অন্যরকম, বড় বড় গাছ গুলো চেনা মনে হলেও এই লতা গুল্ম আর ঝোপগুলো বড্ড অচেনা। টিলার ওপাশে একটু বালিয়ারি মত রয়েছে। বাতাস বেশ শীতল। তবে কি সমুদ্র রয়েছে কাছে!! পাশের টিলাটা পার হতেই একটা ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ল। আরে ওটা কি ? আগুন মনে হচ্ছে তো !! আমায় অবাক করে একটা পাথরের আড়াল থেকে যে বেরিয়ে এলো তাকে দেখে প্রথমে বন মানুষ ভাবলেও একটু লক্ষ্য করেই বুজতে পারি ওটা আদিম মানুষ। ওর হাতে একটা মশাল। গায়ে পশুর চামড়ার পোশাক। ওধারের ঝোপ থেকে আরো দু জন বেরিয়ে এসেছে। একজনের হাতে লাঠি, অন্য জনের হাতে পাথরের অস্ত্র। মুখ দিয়ে হুব হুব করে কি এক অদ্ভুত আওয়াজ করছে জীব গুলো। আমি দু হাত তুলে স্থীর হয়ে দাঁড়ালাম। ওরা আমায় ভয় পাচ্ছে। ভুল করে আক্রমন না করে বসে। একটা নির্দিষ্ট দুরত্বে এসে ওরা থমকে দাঁড়ালো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তারপর মনে পড়ল।পকেটে বেশ কয়েকটা চকলেট বার রয়েছে। ওদের বার করে দিলাম। মাটিতে বার গুলো রেখে একটু পিছিয়ে এলাম। ওরা বেশ লম্বা, তবে ঝুঁঁকে হাটছে। আমার হাইট প্রায় সাত ফুট। এই স্যুট আর হেলমেটে আরো একফুট বেড়ে গিয়ে আমায় বেশ লম্বা লাগছে, ওরা ভয় পাচ্ছে বোধহয়।
হেলমেটটা খুলে একটা চকলেট বার নিজে খেতে খেতে ওদের ইশারা করলাম। একজন ভয়ে ভয়ে একটা তুলে নিল। ও ভেঙে খেতেই বাকিরা এগিয়ে এলো।
কিন্তু এরা কারা ? এটা কোন যুগ।
আমার হাত ঘড়ির মনিটারে ফুটে উঠল আমার প্রশ্নর উত্তর।
"১.৮ মিলিয়ন বছর আগে মানুষের যে পূর্বপুরুষেরা পৃথিবীতে ছিল তাদেরকে হোমো ইরেক্টাস বলেই মনে করা হয়। এরা ছিল বেশ লম্বা আর কম বুদ্ধিসম্পন্ন। তাদের কাছ থেকে পরবর্তীতে দুটো ধাপ সামনে এগিয়ে যায়। সেগুলো হলো- নিয়ান্ডারথাল এবং আধুনিক মানুষ। নিয়ান্ডারথালদের উদ্ভব হয়েছে ৬,০০,০০০ বছর আগে। আর আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয় ২,০০,০০০ বছর আগে। হোমো ইরেক্টাসদের তুলনায় নিয়ান্ডারথাল ছিল ক্ষীণকায়। এদের মস্তিষ্ক ছিল তুলনামূলকভাবে বড় এবং তারা হোমো ইরেক্টাসদের চাইতে বেশি বুদ্ধি ধারণ করতো। এরাই তারা। মনে করা হয়, হোমো সেপিয়েন্সদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।"
চকলেট বার শেষ করে ওরা জুলজুল করে আমায় দেখছে। আবার এগিয়ে আসছে। আমার হাত ঘড়ির লাল আলোটা দপদপ করছে। এটা একটা বিপদ সঙ্কেত। ওরা তো মাংসাশি। বেঁচে থাকার জন্য সর্বভূক। আর খাদ্য সংগ্ৰহ ওদের এক মাত্র কাজ। পিঠের ব্যাগে দুটো ক্রিম বিস্কুটের প্যাকেট ছিল। ছুড়ে দিলাম। ততক্ষণে আরো দুটো অবয়ব বেরিয়ে এসেছে। লম্বায় এরা আট ফুট হবে। আগের তিনজন তবে বাচ্চা। এদের চোখ মুখ বেশ হিংস্র। হাতে আগুন।
দ্রুত আমার টাইম মেশিনের দিকে ছুটলাম। ওরাও ছুটছে। পায়ের আওয়াজ আর হুপ হুপ শব্দ ভেসে আসছে পেছন থেকে। মেশিনের দরজা বন্ধ করেই টাইম আর ডেটের নবটা নিউট্রাল করে মেশিন চালু করলাম। ওরা এসে পড়েছে প্রায়। ভীষণ জোরে কেঁপে উঠল আমার টাইম মেশিন। ভগবান কে স্মরণ করে টাইম আর ডেট সেট করলাম। জিপিএসে আমার বাড়ি সেট করে চোখ বুজে ঠাকুরকে ডাকছি। হঠাৎ ল্যাণ্ডিংয়ের বেল বাজল। মনিটারে হাওড়া ব্রিজ ভিক্টোরিয়া দেখা যাচ্ছছ। কিন্তু গঙ্গার পারের বহুতল গুলোকে কে যেন ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে। একটা বাগান দেওয়া মাটির বাড়ির সামনে থামল আমার যন্ত্রটি। এ আমার চেনা পৃথিবী তবে পাড়াটা অচেনা। সামনের বড় বাড়িটায় কিছু উৎসব চলছে। স্পেসস্যুট পরে এখানে নামলে লোকে আমায় অন্য গ্ৰহর প্রাণী ভাববে। সে সব খুলে নর্মাল পোশাকে নামলাম। অনুষ্ঠান বাড়িটা একবার ঘুরে আসাই যায়, সুন্দর পোলাও মাংসর গন্ধ ছাড়ছে।
ঢুকতেই আমায় আপ্যায়ন করে খেতে বসিয়ে দিলেন এক কর্মকর্তা। কত খাবার, তিন রকমের মাছ , পাঠার মাংস, শেষ পাতে রসমালাইটা যাষ্ট অসাধারণ ছিল।
খেতে খেতেই শুনলায চৌধুরী বাড়িতে ছোট ছেলে পরেশের পুত্র প্রাণেশ চৌধুরীর অন্নপ্রাশনের খাওয়া চলছে। আমিও চৌধুরী, তৃষিত চৌধুরী। আমার দাদুর নাম ছিল প্রাণেশ চৌধুরী। আহিরি টোলায় বিশাল বাড়ি ছিল দাদুর। শরিকি ঝামেলায় সব শেষ। আমি খুব ছোটবেলায় দাদুকে দেখেছিলাম।
বাচ্চাটাকে একঝলক দেখেই বাকিটা বুঝতে পারলাম। এখানেই এখন আমার ফ্ল্যাট, আমি প্রায় একশো বছর পেছনে এসে গেছি। মেশিনটায় গিয়ে বসলাম আবার। এবার ঠিক করে এডযাস্ট করতেই হবে।