সময়
সময়
শ্যামলীর কদিন ধরেই মাথার পেছনে একটা মারাত্মক ব্যাথা হচ্ছে।পেইন কিলার খেয়ে এতদিন কমে যেত।এই কদিন আর পেইন কিলারেও কাজ হচ্ছে না।বুঝতে পারছে না কেন এমন হচ্ছে।প্রাইভেট ফার্মের নো ওয়ার্ক নো পে।ডিউটি একদিন না গেলে দশহাজার মাইনে থেকে টাকা কেটে নেবে।এমনি এই টাকায় পাঁচটা পেট চালাতে হিমশিম খেয়ে যেতে হয় শ্যামলীকে।বৃদ্ধ মা-বাবা-দিদি সহ দিদির বাচ্চা আর ও নিজে।দিদির বিয়ের একবছরের মাথায় বর ছেড়ে দিয়ে অন্য মহিলার সাথে সংসার পাতে।দিদিকে ভালোবাসত না,দিদির শরীরটাকে ভালোবাসত।তার ফসল দিদির পাঁচবছরের মেয়েটা।জন্ম থেকে মেয়েটা বড্ড কমজুড়ি।মেয়েটা পেটে থাকতে ভালো করে কিছু পথ্যই খাওয়াতে পারেনি শ্যামলী তার দিদিকে।উদয় অস্ত সবার খেয়াল রাখতে গিয়ে কবে নিজের বিয়ের বয়স পার করে ফেলেছে বুঝতেও পারেনি শ্যামলী।সময় তার গতিতে চলে গেছে।ধরে রাখতে পারেনি নিজের মনের মানুষকেও।মনের মানুষের সাথে ব্যবধান ধীরে ধীরে এত বেড়ে গেলো এপার ওপারের মাঝে উঠে গেল দেওয়াল।এতগুলো পেটকে অভুক্ত রেখে সে কিছুতেই স্বার্থপর হতে পারে নি।সময় একদিন করে পার হয়েছে, ঘুরেছে দিন-মাস-বছর।ঝুলপির চুলেও বয়সের পাক ধরেছে।কলপ করাও যার সাধ্যের বাইরে।ছুটে চলেছে জ্বর গায়ে দিনের পর দিন।মাথা ধরা রোগটার সাথে এখন জ্বরের প্রকোপে অফিসের কাজে মন বসাতে পারে না শ্যামলী।পরিবারের মুখগুলো ভেসে উঠলে আবার চাকরী চলে যাওয়ার ভয়ে মন বসিয়ে কাজ করতে থাকে।
এভাবে সাতদিন অতিক্রম হয়ে গেলো।না!জ্বর কমলো না।মাথার ব্যাথাটার সাথে এখন চোখে অন্ধকার দেখছে মাঝে মাঝেই।ডাক্তার দেখাবে, কিছুতেই সংসার খরচ থেকে ম্যানেজ করতে পারছে না শ্যামলী।পাহাড় প্রমান ফাইল জমে গেছে।দু একটা দেখার পরই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো।চোখের সামনে সব অন্ধকার।জ্ঞাণ ফিরতে নিজেকে হসপিটালের বেডে পেলো শ্যামলী।সামনে নার্স দাঁড়িয়ে, স্যালাইনের বোতল ঝুলছে।জ্ঞাণ আসতেই শ্যামলী বেড থেকে উঠে বসতে গেলে নার্স মেয়েটা "কি করছেন উঠবেন না" বলে ওকে আবার শুইয়ে দিতে শ্যামলী নার্সকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে ওর,উত্তরে নার্স মেয়েটি "স্যার এসে বলবেন" বলে ওকে একটা ইনজেকশন দিয়ে পাশের রোগীকে ইনজেকশন দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।শ্যামলীর বাড়ির জন্য মন ছটফট করছে।বাড়িতে কি করে যোগাযোগ করবে বুঝতে পারছে না।সময় অনেকটা চলে গেছে।ঘড়ির কাঁটায় নটা বাজে,এতক্ষনে ও বাড়ি চলে যায়।আজ ওর বাবার জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে হবে।কাশতে কাশতে প্রাণ বেরিয়ে যায় ওষুধটা না পেলে। এসব ভাবছে, এমন সময় দেখছে ডাক্তার বাবু রাউন্ডে এসেছেন।ওর কাছে আগে এলেন,হাতে একটা বোর্ড নিয়ে।বোর্ড দেখে শ্যামলীকে বললেন "আপনার বাড়ির লোক কোথায়"?
"তারা কেউ নেই,আপনি আমাকে বলুন যা বলার,কি হয়েছে আমার"?
ডাক্তার শ্যামলীর দিকে একবার তাকিয়ে বললেন "আপনার এ রোগের ট্রিটমেন্ট করতে হলে অপারেশন করাতে হবে।সে অপারেশন কোন ভালো প্রাইভেট নার্সিংহোম থেকে করাতে হবে।এখানে এই রোগের ট্রিটমেন্টের তেমন কোন যন্ত্রপাতি নেই।এটা একটা দাতব্য চিকিৎসালয়।এখানে এসব কঠিন রোগের চিকিৎসা হয় না।আর আপনার যা কন্ডিশন আজ কালের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।নাতো সময় খুব কম।বাঁচার আশাও খুব কম।বড় জোর তিনমাস"।
"কি হয়েছে আমার"?
"ব্রেন টিউমার"।
"এর অপারেশনে খরচ কেমন"?
"ধরে নিন কয়েক লাখ,সেটা কোথায় করাবেন তার ওপর নির্ভর,তবে অপারেশনটা না হলে আপনার বাঁচার চান্স কম,খুব বেশী হলে তিনমাস"।
"আমাকে রিলিজ করে দিন আজই"।
"আজ তো সময় নেই, কাল দশটার পর রিলিজ করে দেওয়া হবে আপনাকে" বলে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন।পরেরদিন দশটার পর শ্যামলীকে ছেড়ে দেওয়া হলো।বাড়ির দিকে রওনা হল সে,ভাবছে বাড়ির লোক এতক্ষনে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন।ওদের তো শহরের পথ চেনাও নেই।যে অফিস চিনে ওর খোঁজ নেবেন তারা।বাড়ি যেতেই সবাই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।কোথায় ছিলো সারারাত?কাউকে সত্যিটা বলতে পারছে না সে।শ্যামলীর মা মেয়ের চুপ থাকার মানে অন্য বের করে বললেন "শ্যামু সংসারের চাপে নোংরা পথে নামলি না তো"?
"শ্যামলী মায়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো বেশ কিছুক্ষন।তারপর নিজের মনে হেসে মনের মধ্যে বলতে লাগলো সঠিক বয়সে বাবু ধরলে আজ হয়ত সে অপারেশনটা করতে পারতো।মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে বাবার প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে ওষুধের দোকানে চলে গেলো।পরদিন অফিস গিয়ে সব পেন্ডিং কাজ গুলো শেষ করতে লাগলো।সময় যে তার হাতে আর সত্যি নেই।ঘড়ির কাঁটা তার কক্ষপথে ঘুরে বেরাচ্ছে অবিরত,একটা করে ঘন্টা চোখের পলকে চলে যাচ্ছে ঠিক তেমনি ওর হাত থেকেও ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে সময়।কানে বাজছে স্কুল জীবনে শোনা লাইন "সময় চলিয়া যায়,
নদীর স্রোতের প্রায়,
যে জন না বুঝে,তারে ধিক্ শত ধিক্।
বলিছে সোনার ঘড়ি,টিক টিক টিক"।
শরীর জানান দিচ্ছে আর মাত্র দুমাস।দিদির জন্য একটা চাকরীর ব্যবস্হা করে দিলো শ্যামলী।না খেয়ে যাতে না মরে পরিবারটা।ভাবছে মরার আগে ও যদি কিছু টাকা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স করে যেতে পারত!ভাবতে ভাবতে খবরের কাগজের পাতায় চোখটা যেতেই নজরে এলো একটা বিজ্ঞাপন,কিডনি ডোনার চাই,দাতাকে চাহিদামত টাকা দেওয়া হবে।সময় নষ্ট না করে চলে গেলো যোগাযোগ করতে।টেস্ট করে দেখা গেলো মিলে গেল সব।বিনিময়ে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে রেখে ভর্তি হয়ে নিজের জীবনের বিনিময়ে একটা বাচ্চা মেয়ের জীবন ফিরিয়ে দিলো।সুসময় বাচ্চা মেয়েটার হাতে বশ হয়ে ওকে প্রান ফিরিয়ে দিলো।অপরদিকে শ্যামলীর দুঃসময়ই জীবন কেড়ে নিয়ে চিরবিদায় জানালো।।
সমাপ্ত:-
*****