সমকামী প্রেমের গল্প
সমকামী প্রেমের গল্প
রিশান আজ অনেকদিন পর লাইব্রেরিতে এসেছে,রিশানের মন খারাপ হলেই সে লাইব্রেরিতে চলে আসে।সে বইয়ের মধ্যেই যেন পৃথিবীর সকল আনন্দ খুঁজে পায়।লাইব্রেরিতে বই খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই তার চোখে পড়ল অস্কার ওয়াইল্ড-এর লেখা 'দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে' বইটি।এই বইটির সাথে তার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
সে বইটি নিয়ে চেয়ারে বসল।বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে,রিশান কভার পৃষ্ঠার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।এই বইটি দেখলেই তার মনে পড়ে তার প্রিয় বন্ধু অর্ক-এর কথা,সে রিশানের কাছে শুধু বন্ধু ছিল না,তার ভালোবাসাও ছিল।রিশানের শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল অর্কের সাথেই।
চার বছর বয়সে রিশান একটি দুর্ঘটনায় তার মা-বাবাকে হারায়,তারপর থেকে সে দাদু-দিদার কাছে মানুষ হয়।রিশানের দাদুর বাড়ির পাশেই ভাড়া থাকত অর্করা।ছোট থেকে সে বন্ধু বলতে অর্ককেই জেনেছে।তার ছোটবেলার খেলার সঙ্গীও ছিল অর্ক।স্কুল জীবন থেকে শুরু করে কলেজ জীবন পর্যন্ত অর্ক তার সঙ্গ দিয়েছে। অর্ককে দেখতে সুন্দর হওয়ার দরুন অনেক মেয়েই তাদের ভালোলাগার কথা অর্ককে জানাত। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় অর্কের একটি মেয়েকে পছন্দ হয়েছিল,সে এই সম্পর্কে রিশানকে জানালে রিশান কিছুটা অখুশি হয়।রিশানের একটা অদ্ভুত কষ্ট হয়েছিল।
কিছুদিন পর অর্ক রিশানকে জানিয়েছিল,'জানিস রিশান,আমার সাথে ঐশীর সম্পর্কটা ভেঙে গেছে ।'
রিশান মনে মনে খুব খুশি হল।বলল,'কেন?'
অর্ক বলল,'ঐশীর অন্য একজনকে পছন্দ আমাকে নয়।'
রিশান বলল,'ওহ্।'
রিশান স্কুলে পড়ার সময় জানতে পেড়েছিল সে তার লিঙ্গের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়।কিন্তু সে কখনো এই বিষয়ে কাউকে কিছু জানাতে পারেনি,এমনকি অর্ককেও নয়।সে প্রথমে ভেবেছিল অর্ককে ভালোবাসার কথা জানাবে,কিন্তু তা সে বলে উঠতে পারেনি।যতবারই বলতে গেছে তার ভয় হয়েছে,সব শোনার পর অর্ক যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়,তখন সে কি করবে,অর্ক ছাড়া তো সে একটা দিনও থাকতে পারেনা।
কলেজে পড়ার সময় অর্ক একদিন রিশানকে জিজ্ঞাসা করল,'রিশান তোর কাউকে পছন্দ হয়নি?'
রিশান কিছুটা দ্বিধা করে বলল,'ইয়ে মানে হ্যাঁ ।'
অর্ক অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,'বলিস নি তো একবারও ।মেয়েটা কে?কোন কলেজ?দেখতে কেমন?কতদিন ধরে ভালোলাগে?'
রিশান বলল,'কোন প্রশ্নের উত্তর দেবো।তুই এতগুলো প্রশ্ন করলি।'তারপর রিশান বলল ,'আমি ওকে খুব ভালোবাসি ছোটবেলা থেকে ।'
অর্ক একদৃষ্টে রিশানের দিকে তাকিয়ে থাকল ।
পরের দিন অর্ক মনে মনে ঠিক করল আজ সে লাইব্রেরিতে রিশানের ভালোবাসার মানুষের নাম জেনেই ছাড়বে । লাইব্রেরিতে দুজনেই 'দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে' বইটি সংগ্রহ করল। সে রিশানের কাছে পুনরায় জানতে চায় তার ভালোবাসার মানুষের নাম । রিশান ঠিক করেছিল সে কিছুতেই তার ভালোবাসার কথা অর্ককে জানাবে না । সে বইটি খুলে বসেছে এমনই সময় অর্ক হঠাৎই বলে বসল,'আমার দিব্বি তুই বল তুই কাকে ভালোবাসিস ?'
রিশান শেষমেষ না পেরে বলেই বসল,'আমি তোকে ভালোবাসি।'
অর্ক কিছুটা হতভম্ব হয়ে বলল,'কি?ঠিক বুঝলাম না।'
রিশান বলল,'আমি সেই স্কুলজীবন থেকে তোকে ভালোবাসি ।'
অর্ক একটু হেসে বলল,'তুই ...আমকে বন্ধু হিসাবে ভালোবাসিস তাইতো?হ্যাঁ?'
রিশান বলল,'না।একটা ছেলে যেমন একটা মেয়েকে ভালোবাসে আমিও তোকে সেভাবেই ভালোবাসি।দয়া করে তুই আমাকে ছেড়ে যাস না।
আমার খুব রাগ হয় যখন তুই অন্য কোনো মেয়ের কাছাকাছি যাস।আমি যখন বুঝেছিলাম আমি সমকামী আমি কাউকে কিছু বলিনি,আমার ভয় হয়েছিল।'
অর্ক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল,'আমি সমকামী নই,কিন্তু.....আমি তোকে ছেড়ে যাব না ।কারণ আমার মন খারাপ হলে তোকে দেখতে ইচ্ছা হয়,তোর সাথে সময় কাটাতে আমার খুব ভালো লাগে ।তুই যখন অন্য কোনো বন্ধুর সাথে বেশি কথা বলিস আমার খুব রাগ হয় ।তুই যেদিন বললি তুই একজনকে ভালোবাসিস আমার সেদিন খুব রাগ হয়েছিল । '
রিশান বলল,'আমি ভেবেছিলাম তুই আমার সাথে আর কথাই বলবি না।'রিশান কখনোই ভাবেনি অর্ক তাকে এভাবে মেনে নেবে।অর্ক রিশানের কথা শুনে হাসিতে ফেঁটে পড়ল।
কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় অর্ক আর রিশানের সম্পর্কের কথা দুই বাড়ির লোকজন জানতে পেড়েছিল।দুই বাড়ির কোন একজন সদস্যও এই বিষয়টি মেনে নেয়নি।অর্কের কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেলে তার মা-বাবা তাকে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে হায়দ্রাবাদে চলে যায়।রিশানের দাদু তাকে বলেছিল,'সমকামী প্রেম?এসব আবার কি?ওসব কিচ্ছু না।ভালো ডাক্তার দেখাবো এসব ঠিক হয়ে যাবে ।আর তাছাড়া এসব লোকে শুনলে হাসবে।পাড়ায় আর মুখ দেখানো যাবে না ।আজকালকার ছেলেপিলেরাও হয়েছে সত্যি...।'
রিশানের দিদা দূরে দাঁড়িয়ে বলল,'দেখো রিশান,আমাদের বয়স হয়েছে।আমরা আজ আছি কাল নেই,আমাদের কিছু হয়ে গেলে তোমার কি হবে বলোতো।আর তাছাড়া আমাদেরও তো একটু তোমার বউ,তোমরা সন্তান-সন্ততি দেখার ইচ্ছা হয় ।দেখবে তোমার খুব ভালো মেয়ের সাথে বিয়ে হবে।তুমি খুব সুখ...'
রিশান রেগে গিয়ে বলল,'আমি অর্ককে ভালোবাসি ,যদি বিয়ে করি তবে ওকেই করবো,নয়তো না ।'
অর্ক কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার তিন বছর পর রিশান অর্ককে ফোন করলে জানতে পারে যে,অর্কের বিয়ে হয়েছে ।অর্কের মা-বাবা অর্ককে নিয়ে এখন খুব খুশি ।কিন্তু রিশান ,অর্ক কেমন আছে জানতে চাইলে অর্ক ফোন রেখে দেয়।এরপর অর্ককে যতবারই ফোন করেছে ততবারই ফোনে পায়নি।পরে একটি বন্ধুর থেকে রিশান খবর পেয়েছিল অর্ক নিজের ফোন নাম্বার পাল্টে ফেলেছে।
আজ দশ বছর অর্কের সাথে রিশানের কোনো যোগাযোগ নেই।সে কোথায় আছে?কেমন আছে? কিছুই সে জানে না।আজ এতবছর পর এই বইটি খুঁজে পেতেই রিশানের তার কথা মনে পড়তে লাগল।
বাইরে এখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে ।সে জানালার কাঁচে জমা বৃষ্টির জলকণার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।বৃষ্টি কমতেই সে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল।দাদু দিদার মৃত্যুর পর বাড়িতে এখন সে একা থাকে।
পরের দিন সকালে অফিসে গিয়ে রিশান শোনে তাদের কোম্পানিতে একজন নতুন ম্যানেজার আসছেন আজ।কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন ম্যানেজার এসে হাজির।ম্যানেজারকে দেখে রিশান অবাক হয়ে গেলো এ যে অর্ক ।রিশান কখনো ভাবেনি অর্কের সঙ্গে তার আবারও দেখা হবে ।অর্ক রিশানের সামনে এসে বলল,'একসাথে বাড়ি ফিরব,অপেক্ষা করিস।'
রিশান ঘাড় নাড়ল।
রাতে বাড়ি ফেরার পথে রিশান অর্ককে জিজ্ঞাসা করল,'কেমন আছিস?'
অর্ক বলল,'ভালো । তুই?'
রিশান বলল,'চলছে।তোর বউ কেমন আছে?'
অর্ক বলল,'আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে । '
রিশান বলল,'কবে?'
অর্ক বলল,'বিয়ের দু'বছর পর।আমি মানাতে পারছিলাম না,অনেক চেষ্টা করেছিলাম ।বাবা আমার ডিভোর্সের পর আমাকে ত্যাগ করেছেন,মা একমাত্র আমাকে এখন মেনে নিয়েছেন । যাক্ সেসব কথা ।'
দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।
হঠাৎই অর্ক বলল,'রিশান,তুই কাউকে আর ভালোবাসিস নি ?'
রিশান বলল,'তুই ছিলিস,তুই-ই আছিস ।'
অর্ক বলল,'আমি তোকে ভালোবাসি।'
রিশান হেসে বলল,'আমিও.....।ভালো কথা,তুই কোথায় উঠেছিস?হোটেলে?'
অর্ক বলল,'না । আমি তোর বাড়িতে উঠব।'
রিশান বলল,'মানে?বাড়িটা আমার।আমার অনুমতির একটা বিষয় আছে।'
অর্ক হেসে বলল,'তাই নাকি ।তো শোনা তোর অনুমতি ।'
রিশান বলল,'উমমমম,ঠিক আছে থাকতে দিলাম।'
দুজনেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল।
______________________