শর্ত
শর্ত
নাঃ। আমাকে আর বোঝাতে আসিস না। এর আগে বহু লোক বহু ভাবে আমাকে বুঝিয়েছে। আর বোঝাস না। আমি ওকে কিছুতেই বিয়ে করব না। ডমরুপাণির কথা শুনে থম মেরে গেল অচিরাংশু। ডমরুপাণি ওর ছোটবেলাকার বন্ধু। একই পাড়ায় থাকে। একই স্কুলে পড়াশোনা করেছে। তখনও ওরা স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। সবে গোঁফের রেখা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তখনই পাড়ার হার্দিকদাকে প্রেম করে বিয়ে করতে দেখে ডমরুপাণির কী মনে হয়েছিল কে জানে, ও একদিন কথায় কথায় ফস করে অচিরাংশুকে বলেছিল, আমি যদি বিয়ে করি তো প্রেম করেই করব। এবং ও যে সেটা শুধু কথার কথাই বলেনি, সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার দিকেই এগোচ্ছে, সেটা কয়েক দিনের মধ্যেই টের পেয়ে গিয়েছিল অচিরাংশু। এর-তার মুখে শুনেছিল, ও নাকি ওরই কোচিংয়ের দেবতুষির সঙ্গে প্রেম করছে।
— সত্যি? অচিরাংশু জিজ্ঞেস করতেই ডমরুপাণি কোনও ভনিতা না করেই সরাসরি বলেছিল, হ্যা রে, সত্যি।
কেবল অচিরাংশুই নয়, কী করে যেন অচিরাংশুর বন্ধুবান্ধব, সেই বন্ধুবান্ধবদের বন্ধুবান্ধব, এমনকী তাদের বন্ধুবান্ধবরাও জেনে গিয়েছিল ডমরুপাণির প্রেমে পড়ার কথা। এবং ও যে মাত্র দিন-কয়েকের আলাপেই চুটিয়ে প্রেম করা শুরু করে দিয়েছিল, সেটাও জানতে আর বাকি রইল না কারও।
জেনে গিয়েছিল, দেবতুষিকে প্রেম নিবেদন করার পরদিনই নাকি দেবতুষি ওকে বলে দিয়েছিল, আমার সঙ্গে মিশতে গেলে কিন্তু অত্যন্ত ভাল রেজাল্ট করতে হবে। আর পাঁচজন ছাপোষা ছাত্রের মতো হলে চলবে না। জানো তো, আমার মামাতো দাদা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। জ্যাঠতুতো দাদা জয়েন্টে তিনশো সতেরো র্যাঙ্ক করেছিল। এখন এন আর এসে প্র্যাক্টিস করছে। ফলে আমাদের ফ্যামিলিতে সহজে জায়গা করে নেওয়ার একমাত্র চাবিকাঠি হল— ভাল রেজাল্ট।
ডমরুপাণি বলেছিল, ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। দেখবে, আমি তোমার মামাতো দাদা, জ্যাঠতুতো দাদার চেয়েও ভাল রেজাল্ট করব।
সত্যিই তাই করেছিল। দেবতুষিকে ভাল না বাসলে বোধহয় এ রকম ভাবে সব কিছু ভুলে গিয়ে এতটা মনপ্রাণ সঁপে ও কিছুতেই পড়াশোনা করতে পারত না। হ্যাঁ, তার জ্যাঠতুতো দাদার থেকেও ভাল র্যাঙ্ক করেছিল ও। দুশো বারো। ফলে যে ছেলেটা এত বছর ধরে নিতান্ত সাদামাঠা ভাবে পাশ করে এসেছে, সে ওই মেয়েটির প্রেমে পড়ার পর থেকেই হঠাৎ করে পড়াশানায় এত ভাল হয়ে যাওয়ায় ডমরুপাণির বাড়ির লোকেরাও বেশ খুশিই হয়েছিলেন।
দেবতুষির মাও জানতে পেরেছিলেন ডমরুপাণির অমন রেজাল্ট করার কথা। মেয়েকে বলেছিলেন, তোর সঙ্গে কোচিংয়ে পড়ত না ছেলেটা? শুনেছিস, ও জয়েন্টে দুশো বারো র্যাঙ্ক করেছে। আমাকে তো তোদের কোচিংয়ের মহালয়ার মা বলল। ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভাল, না? দ্যাখ দ্যাখ, দেখে শেখ। এরা হচ্ছে হিরের টুকরো ছেলে। এরাই বাপ-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে, আর তুই? আমাদের মুখে একেবারে চুনকালি লেপে দিলি!
না। মামাতো দাদা জ্যাঠতুতো দাদারা ভাল রেজাল্ট করলেও দেবতুষি শুধু জয়েন্টেই নয়, এ আই ট্রিপল ই-তেও সে রকম কিছু করতে পারেনি। পজিশন ছিল একদম তলানির দিকে। পড়াশোনায় দু’জনের মধ্যে দূরত্ব যত বাড়ছিল, একজনের প্রতি অন্য জনের টানও যেন ততই বাড়ছিল। আর টান যত বাড়ছিল, ডমরুপাণি যেন তার প্রেমটাকে ততই গোপন রাখতে চাইছিল। সবার নজর থেকে আগলে রাখতে চাইছিল। তাই কোনও জনবহুল জায়গায় তো নয়ই, দূরের কোনও সিনেমা হলেও নয়, এমনকী কোনও মল-টলেও নয়, নিরিবিলি জায়গা ছাড়া দেবতুষির সঙ্গে ও দেখাই করত না। দেখা করলেও, সব সময়ই তার মনে হত, এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল। এই বুঝি কেউ জেনে ফেলল। এই বুঝি কেউ টের পেয়ে গেল। সব সময় একটা ভয় তাকে কুরে কুরে খেত। তাই ও সব সময় দেবতুষির সঙ্গে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা করত। এবং যতটা পারত, ওর সঙ্গে খুব অল্প সময় থাকত।
আসলে দেখা করার চেয়ে, এমনকী ফোনে কথা বলার চেয়েও ও এস এম এস, হোয়াটস অ্যাপ করতেই বেশি পছন্দ করত। ডমরুপাণি বলত, যত দূরে দূরে থাকব। যত কম দেখা করব, ততই প্রেম বাড়বে। আর যত প্রেম বাড়বে, ততই একজন অন্যজনকে দেখার জন্য ছটফট করব। এই ছটফটানিটাই হল— আসল প্রেম। আর সেই আসল প্রেমটাকেই আমি চেটেপুটে সাপটে-সুপটে উপভোগ করতে চাই।
প্রেম উপভোগ করতে চাইত দেখেই যে পৃথিবীর আর সব কিছু থেকে ও নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, তা কিন্তু নয়। মাত্র দু’-তিন জায়গায় অ্যাপ্লাই করেই শুধুমাত্র যোগ্যতার জোরেই ও আদায় করে নিয়েছিল ওএনজিসি-র অত্যন্ত উঁচু পদের একটি লোভনীয় চাকরি। দু’বছরের মাথায় চাকরি সূত্রেই পেয়েছিল বিশাল বাড়ি, চব্বিশ ঘণ্টা গাড়ি, গাড়ির চালক, আর্দালি, চাকরবাকর।
ডমরুপাণি যে কোনও দিন এ রকম একটা জায়গায় পৌঁছতে পারবে, তা ওর পাড়ার কেন, ওদের আত্মীয়স্বজনরাও কেউই কল্পনা করতে পারেনি। সবাই ওর মা-বাবার সামনে ধন্য ধন্য করত। আর পিছনে গিয়ে, বিশেষ করে পাড়াতুতো মাসি-পিসিরা ইনিয়ে বিনিয়ে নানা রকম নিন্দে-মন্দ করত। কই, আগে তো কোনও দিন শুনিনি ও পড়াশোনায় এত ভাল। আমরা কি জানি না? ও তো কোনও রকমে টায়েটুয়ে পাশ করত। কোনও দিনই ভাল ছাত্র ছিল না। মাধ্যমিকেও তো তেমন কিছু করতে পারেনি। অতগুলো মাস্টার ছিল বলে কোনও রকমে ফার্স্ট ডিভিশনে গিয়েছিল। দুটো না তিনটে মাত্র লেটার পেয়েছিল। সবই শোনা কথা। আমরা তো আর নিজের চোখে ওর রেজাল্ট দেখিনি। ওরা যা বলেছে, সেটাই বিশ্বাস করেছি। সত্যি-মিথ্যে জানি না। তবে এখন তো শুনছি, কোন একটা মেয়ের সঙ্গে নাকি ও মেশে। তার পাল্লায় পড়েই নাকি... যে যা-ই হোক, ভাল হলে ভাল। না হলে আমাদের কি? আমাদের তো আর পেটের ছেলে না...
দেবতুষির বাড়ির লোকেরাও কানাঘুষোয় শুনেছিলেন, তাঁদের মেয়ে নাকি ডমরুপাণির সঙ্গে মেলামেশা করছে। সেটা শুনে মেয়ের মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। যদিও পরক্ষণেই ভেবেছিলেন, বেশি মেলামেশা করলে যদি ছেলেটির আশ মিটে যায়, যদি ক’দিন পরে তাঁদের মেয়েকে পুরনো লাগতে শুরু করে, যদি শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসে, তখন? তাই মনে মনে ঠিক করেছিলেন, না বাবা, আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। ছেলেদের মন কখন কী রকম হয়ে যায়, বলা যায়? এমন ছেলে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ছেলের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। ওরা যখন ছেলের বিয়ে দেবে, দেবে। আমাদের তো অপেক্ষা করতে কোনও আপত্তি নেই। আমাদের মেয়ের এমন কী আর বয়স! তবু পাকা কথাটা বলে রাখা, এই তো...
বউয়ের কথা শুনে দেবতুষির বাবা যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। বউকে বললেন, তা হলে মেয়েকে বলো, ছেলেটিকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আসতে। কথাবার্তা বলি। তার পর নাহয় একটা ভাল দিনক্ষণ দেখে ছেলেটির বাড়ি গিয়ে ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলা যাবেখ’ন।
দেবতুষি যেন এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এক ছুট্টে নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল। না। না-এস এম এস। না-হোয়াটস অ্যাপ। ও যা সচরাচর করে না, তাই করে বসল। তিনটে তারা চিহ্ন দিয়ে ডমরুপাণির যে নম্বরটা ওর মোবাইলে সেভ করা আছে, সেটা ডায়াল করল।
ডমরুপাণি অফিসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত থাকে। একটার পর একটা মিটিং লেগেই থাকে। তাই কথা বলতে ইচ্ছে্ করলে অন্যন্য দিন সে একবার রিং করেই ছেড়ে দেয়। ডমরুপাণি যখন সময় পায়, মিস কল দেখে দেবতুষিকে ফোন করে। কিন্তু আজ তার আর তর সইছে না। আজকের দিনটা তার কাছে একটা বিশেষ দিন। আনন্দের দিন। তাই কোনও কিছু না ভেবেই সে রিং করল ওকে।
কিন্তু একবার নয়, দু’বার নয়, তিন-তিন বার ফোন করেও ও প্রান্ত থেকে কোনও সাড়া পেল না সে। টানা রিং হয়ে গেল। তখন সে এস এম এস করল— প্লিজ প্লিজ প্লিজ ফোনটা ধরো। এস এম এস করেই আবার ফোন করল। তার পর আবার। আবার। আবার। কিন্তু না। ডমরুপাণি ফোন ধরল না।
দেবতুষি চেয়েছিল, ফোনে এই খবরটা দিয়ে ওকে চমকে দিতে। কিন্তু সেটা যখন হল না, তখন ও বাধ্য হয়েই লিখল—মা তোমাকে আসতে বলেছেন। আমাদের রিলেশনটা নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
সে ভেবেছিল, অন্যান্য দিনের মতো ব্যস্ত থাকলে কিংবা অন্য কোনও কারণে তার ফোনটা ধরতে না পারলে পরে ফুরসত পেলেই ও যেমন রিং ব্যাক করে, আজ এই এস এম এসটা পেলে ও আর ফুরসতের জন্য নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবে না। সব কাজ ফেলে আগে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন করবে। করবেই। আবেগে উদ্বেল হয়ে বলবে, তাই নাকি? কী বলছ? সত্যি? আমি এক্ষুনি আসছি।
কিন্তু দু’-তিন মিনিট পর পর এই একই মেসেজ একের পর এক পাঠিয়েও যখন কোনও উত্তর এল না, তখন তার মনে হল, ও নিশ্চয়ই সেই সে দিনের মতো ওর মোবাইলটা চার্জে বসিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মোবাইলটা নেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। ভুলুক ভুলুক। বাড়ি গিয়ে যখন দেখবে আমি এত বার ফোন করেছি, এতগুলো এস এম এস করেছি, তখন ও নিজেই ফোন করবে। না। আমিও তখন ওর ফোন ধরব না। কিছুতেই ধরব না। দেখুক, যাকে ফোন করছে, সে ফোন না ধরলে কেমন লাগে। তার পর দেখি, ও আর কোনও দিন ভুল করে বাড়িতে মোবাইল ফেলে যায় কি না...
ডমরুপাণির ফোনের জন্য হা-পিত্যেশ করে অপেক্ষা করতে লাগল দেবতুষি। অপেক্ষা করতেই লাগল। কিন্তু ডমরুপাণির কাছ থেকে কোনও ফোন এল না। না-ফোন। না-এস এম এস। না। সে দিন না। তার পরদিন না। তার পরদিনও না।
‘মা তোমাকে আসতে বলেছেন। আমাদের রিলেশনটা নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।’ এস এম এস করার পর থেকেই ডমরুপাণি একদম একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেছে। তা হলে কি ওর মনের মধ্যে অন্য কিছু আছে! তা হলে কি তলে তলে ও অন্য কাউকে... অন্য কোনও মতলবে আছে... তা হলে ও এটা আগে বলেনি কেন! সে তা হলে সেই ভাবেই মিশত। কিংবা মিশতই না। এত দূর এগোনোর পর... না। ও তাকে এত সহজে ছাড়বে না। দরকার হলে ওর বন্ধুবান্ধবকে তো বটেই, এমনকী ওর অফিসে গিয়েও জানিয়ে আসবে ওর এই আচরণের কথা। পারলে খুঁজে খুঁজে বার করবে ওদের কোচিংয়ের সেই ব্যাচের অন্যান্য ছেলেমেয়েদেরও। সবাইকে বলবে। বলবে, ওর এই কীর্তির কথা। তবে সবার আগে জানাবে ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু— অচিরাংশুকে, অচিরাংশুর মোবাইল নম্বরটা তার কাছে আছে।
না। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করতে চায় না সে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল অচিরাংশুকে। বলল, তোমার সঙ্গে ভীষণ ভীষণ ভীষণ দরকার। একটু দেখা করতে চাই। কখন কোথায় দেখা করব বলো।
সব শুনে অচিরাংশু অবাক হয়ে গেল। বলল, ও তো এ রকম ছেলে নয়। আমার মনে হয়, তোমাদের দু’জনের কোথাও একটা ভুল-বোঝাবুঝি হচ্ছে। অথবা তোমার ব্যাপারে কেউ ওর কান ভাঙিয়েছে। ঠিক আছে, আমি দেখছি।
কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করে ওকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ডমরুপাণি বলল, নাঃ। আমাকে আর বোঝাতে আসিস না। এর আগে বহু লোক বহু ভাবে আমাকে বুঝিয়েছে। আর বোঝাস না। আমি ওকে কিছুতেই বিয়ে করব না। ওর কথা শুনে থম মেরে গেল অচিরাংশু। তার পর একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, কিন্তু কেন?
চোখ-মুখ কুঁচকে ডমরুপাণি বলল, কেন মানে? তুই জানিস না, সেই স্কুলে পড়ার সময়ই তো আমি তোকে বলেছিলাম, আমি যদি বিয়ে করি তো প্রেম করেই করব।
— হ্যাঁ, তা হলে পিছোচ্ছিস কেন? তুই তো ওকে প্রেমই করিস।
— এটাকে প্রেম বলে? ওর মা আমাদের রিলেশনটা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমার মাও এর মধ্যে কবে যেন একদিন বললেন, এ বার তো চাকরিবাকরি পেয়েছিস। লোকের মুখে শুনি, তুই নাকি একটা মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করিস। তা, তাকে একদিন নিয়ে আয়। আমরাও একবার দেখি। কথাবার্তা বলি।
অচিরাংশু বলল, হ্যাঁ, উনি তো ঠিকই বলেছেন। আর কত দিন এই ভাবে লুকোছাপা করবি। এ তো উত্তম কথা।
— এটা উত্তম কথা? যে প্রেমে কোনও বাধা নেই। দু’বাড়ির আপত্তি অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাওয়া নেই। সেটা প্রেম? আমার তো মনে হচ্ছে এটা দেখাশোনা করে বিয়ে। না। আমি এ বিয়ে করব না। কিছুতেই করব না।
— তা হলে কাকে বিয়ে করবি?
ডমরুপাণি যেন চোখের পলকে আপাদমস্তক বদলে গেল। আকাশের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে বলল, তেমন কাউকে, যার কাছে যাওয়ার জন্য তুমুল ঝড়জলের রাতে পোড়াকাঠ ভেবে আমি কোনও লাশ আঁকড়ে নদী পার হব... তেমন কাউকে, যার কাছে পৌঁছনোর জন্য দোতলার জানালা দিয়ে প্রেমিকার নামিয়ে দেওয়া কেশদাম ভেবে ময়াল সাপ বেয়ে উপরে উঠব... তেমন কাউকে, যার কাছে গেলে তার বাড়ির লোকেরা আমাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার জন্য উদ্যত হবে, সে রকম কাউকে।
— তুই কি পাগল হয়েছিস?
— তোর যদি মনে হয় আমি পাগল, তো পাগল। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, সেটাই প্রকৃত প্রেম, যে প্রেম মৃত্যুর দোরগোড়া ছুঁয়ে ফিরে আসে।
— তা হলে তুই ওকে বিয়ে করবি না?
— না। করব না। আর যদি করিও, তা হলে একটা শর্ত আছে।
— কী শর্ত?
— ভালবাসার জন্য মৃত্যুকে উপেক্ষা করার পরীক্ষা দিতে হবে ওকে। আমিও দেব।
— সেটা আবার কী?
— যেমন ধর, কোনও পাহাড়ের চূড়া থেকে আমরা দু’জনে হাত ধরাধরি করে একসঙ্গে ঝাঁপ দিলাম।
— অ্যাঁ!
— অথবা যেখানে এর আগে আমরা দু’জনের কেউই কখনও যাইনি, সে রকম ভয়ঙ্কর কোনও জঙ্গলের মধ্যে কেউ আমাদের দু’জনকে চোখ বেঁধে ছেড়ে দিয়ে এল...
— মানে?
— কিংবা এটাও হতে পারে, একটা স্টেশন থেকে আর একটা স্টেশন পর্যন্ত আমরা পায়ে পা মিলিয়ে রেল লাইনের পাটাতনের উপর দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে হেঁটে গেলাম...
— কেন?
— কারণ, ওই সময়ের মধ্যে যদি কোনও ট্রেন এসে আমাদের ধাক্কা মারে, তা হলে তো হয়েই গেল। আর যদি আমরা মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নির্বিঘ্নে পরের স্টেশন পর্যন্ত চলে যেতে পারি, তা হলে দু’বাড়ির বড়রা যা চাইবে, তা-ই হবে।
একটুখানি থেমে কী একটা ভেবে নিয়ে অচিরাংশু বলল, ও, এই শর্ত? ঠিক আছে। তাই হবে। এটা মন্দ নয়। তবে ছোটবেলাকার বন্ধু হিসেবে আমারও একটা শর্ত আছে।
— কী শর্ত?
— কোন স্টেশন থেকে কোন স্টেশন পর্যন্ত, কবে, কখন যাবি সেটা আমি ঠিক করব।
ডমরুপাণি বলল, ঠিক আছে। এতে আমার কোনও আপত্তি নেই।
সঙ্গে সঙ্গে ডমরুপাণির পাশ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে দেবতুষিকে ফোন করল অচিরাংশু। সব শুনে দেবতুষি বলল, একটা স্টেশন থেকে আর একটা স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে যেতে গেলে তো অনেকটা সময় লেগে যাবে। তার মধ্যে যদি ওই লাইনে কোনও ট্রেন এসে পড়ে? কানে হেডফোন থাকলে তো হর্নও শুনতে পাব না!
অচিরাংশু বলল, সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি টাইমটেবিলটা দেখে নিচ্ছি। এখনও এ রাজ্যে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে সারা দিনে সাকুল্যে দুটো কি তিনটে ট্রেন যাতায়াত করে। নাহয় সে রকম কোনও স্টেশন বেছে নেব। তার আগে অবশ্য দেখে নিতে হবে, একটা ট্রেন চলে যাওয়ার কতক্ষণ পরে আর একটা ট্রেন আসে। তা হলেই আর কোনও সমস্যা নেই।
— যদি সে রকম কোনও স্টেশন পাওয়া না যায়?
অচিরাংশু তাকে আশ্বস্ত করে বলল, তাতেও চিন্তার কিছু নেই। কারণ, কবে কখন কোন স্টেশন থেকে কোন স্টেশন পর্যন্ত যাওয়া হবে, সেটা আমিই ঠিক করব।
— সে রকম স্টেশন কি পাওয়া যাবে?
অচিরাংশু বলল, পাওয়া যাবে না মানে? আরে বাবা, এটা পশ্চিমবঙ্গ। এখানে কথায় কথায় হরতাল লেগে আছে। ধর্মঘট লেগে আছে। হামেশাই ট্রেন অবরোধ হচ্ছে। নাহয় সে রকমই একটা দিন বেছে নেব। কী? এ বার খুশি তো?
দেবতুষি মুখে কিছু না বললেও অচিরাংশু বুঝতে পারল, তার কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল দেবতুষি।