সহমর্মিতা
সহমর্মিতা


রাস্তায় ভিড় অনেক। গাড়ি সবসময় পারাপার করছে। এর মধ্যে রাস্তা পার হওয়া একটু অসুবিধা। তাও আবার যে জায়গা দিয়ে পার হওয়ার কথা নয় সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সুমিত বাবু। এখান দিয়ে পার হলে একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। না হলে সঠিক ভাবে পার হতে গেলে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে। আর তাই একটু দাঁড়াতে হলেও আপত্তি নেই তার।
এ পাশের রাস্তাটা পার হয়ে মাঝে ডিভাইডারের কাছে দাঁড়ালেন। এদিকে একটু গাড়ি চলাচল কমলে বাকি অর্ধেক রাস্তা পার হবেন। সেই উদ্দেশ্যে ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছিলেন সুমিত বাবু। কিন্তু গাড়ি চলাচল থামছে না। কোথাও সিগন্যাল খারাপ হয়ে যায়নি তো? একটু হালকা হলেও হতো। কিন্তু গাড়ি চলেই যাচ্ছে পরপর।
এভাবে চলতে থাকলে তো রাস্তা পারই হতে পারবেন না তিনি। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়? তাই তিনি ডিভাইডারের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলেন বাঁদিকে। যদি ওদিকে গিয়ে একটু ভিড় কমে। তা না হলে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হয়ে যাবেন। অফিসের ব্যাগটা কাঁধে যদি হাঁটতে লাগলেন সুমিত বাবু। জামার ভেতরে ঘামে ভিজে গেছে। তার জন্য শরীরে কেমন চ্যাটচেটে ভাব। বাড়ি গিয়ে আগে স্নান করার পরিকল্পনা করছিলেন হাঁটতে হাঁটতে।
এমন সময় তার সামনে পড়ল একটা লোক। লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায় সে একটা পাগল। ডিভাইডারের পাশেই বসে আছে পা ছড়িয়ে। মাথায় মুখে লম্বা লম্বা চুল দাঁড়ি সব উস্কোখুস্কো। গায়ে একটা নোংরা জামা আর একটা লুঙ্গি। পায়ে ছেঁড়া চটি। একটা পোটলা হাতে বসে আছে। তাতে কি আছে কে জানে। ওখানে বসে বসে মাথা চুলকাচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
পাগলটার সামনে দিয়ে গাড়ি সাঁইসাঁই করে চলে যাচ্ছে। ওর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সুমিত বাবু পাগলটার কাছাকাছি আসতেই পড়ে গেলেন ফ্যাসাদে। পাগলটা এমন ভাবে বসে ছিল ওকে টপকে যাওয়া যাচ্ছে না কেননা পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে। সুমিত বাবু পাগলটার কাছে গিয়েই ধমক দিতে শুরু করলেন।
'সর এখান থেকে। কেন যে রাস্তার মধ্যে এসে বসে থাকে এসব? যা।' সুমিত বাবু চিৎকার করে করে বললেন।
তাতে পাগলটা ঘাবড়ে গেল মনে হয়। সে তার পোটলাটা নিয়ে ওখান থেকে উঠে পড়লো। সুস্থ মস্তিষ্কের নাগরিক হলে হয়তো পাল্টা সুমিত বাবুকে জিজ্ঞাসা করত তিনি এখান দিয়ে কেন রাস্তা পার হচ্ছেন। তাহলে হয়তো লজ্জায় পড়ে যেতেন সুমিত বাবু। ভাগ্যিস সেটা হয়নি।
আরেকবার ধমকাতেই পাগলটা সোজা হেঁটে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু একজনের ডাক শুনে সুমিত বাবু সেদিকে তাকালেন। তিনি দেখলেন দৌড়ে দৌড়ে তার দিকে আসছেন তার পাশের ফ্ল্যাটের বিজয় বাবু। তাকে দেখে একটু অবাক হলেন সুমিত বাবু। এখানে তিনি কি করছেন? এই ভিড় রাস্তায় চলমান গাড়ির মধ্যে দিয়ে সুৎ করে বেরিয়ে এলেন তিনি।
'আরে বিজয় বাবু আপনি এখানে?' সুমিত বাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
'এই একটু কেনাকাটা করছিলাম।' বলেই বিজয়বাবু পাগলটাকে ডাক দিলেন,' এই হারান এদিকে আয়।'
সুমিত বাবু অবাক হলেন এই পাগলটাকে বিজয় বাবু চেনেন নাকি? না হলে নাম ধরে ডাকবেন কেন। বিজয় বাবুর কাঁধে অফিসের ব্যাগ ছিল আর হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। অন্য হাতে এক প্যাকেট পাউরুটি ছিল। পাগলটা সুবোধ বালকের মতো বিজয় বাবুর কাছে এগিয়ে এলো। বিজয় বাবু পাউরুটিটা এগিয়ে দিলেন পাগলটার দিকে। সে এক গাল হেসে সেটা নিয়ে নিল। তারপর যে দিকে যাচ্ছিল আবার ঘুরে চলে গেল।
'কি ব্যাপার বিজয়বাবু আপনি এই পাগলটাকে চেনেন নাকি?' সুমিত বাবু বললেন।
'হ্যাঁ এই আর কি। চলুন হাঁটতে হাঁটতে বলছি।' বিজয় বাবু বললেন। আর তারপর দুজনে ডিভাইডারের ধার বরাবর হাঁটতে লাগলেন।
বিজয় বাবু বলতে লাগলেন,' যে পাগলটাকে দেখলেন ওর নাম হারান। খুব শিক্ষিত ছেলে। ওর সময়ে মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল। পরে ভালো চাকরিও পেয়েছিল। বাড়ি কোন এক গ্রামে ছিল। 2000 সালের বন্যার সময় ও গ্রামেই ছিল। আসলে ছুটিতে যাওয়ার পরেই বন্যা শুরু হয়। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রচুর লোক মারা যায়। হারানের পরিবারের সবাই মারা যায়। ও কোন রকমে বেঁচে ফিরলেও এই শোক সহ্য করতে পারেনি। কিছুদিন পরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। চাকরিটাও চলে যায়। তারপর থেকে এভাবেই চলছে। যার তিনকূলে কেউ নেই তার আর সুখ দুঃখ। চলুন রাস্তাটা পার হই। গাড়ি কিছুটা কমেছে।'
দুজনের রাস্তা পার হলেন। তারপর নিজেদের ফ্ল্যাটের রাস্তার দিকে এগোতে লাগলেন।
'ভেরি স্যাড।' সুমিত বাবু দুঃখের সুরে বললেন। সুমিত বাবুর চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। সেটা লক্ষ্য করলেন বিজয় বাবু। হয়তো পাগলটার জন্য সহমর্মিতা জেগেছে তার মনে।
বিজয় বাবু মনে মনে ভাবলেন তার এই একটা মিথ্যে কথার জন্য পৃথিবীর একজন মানুষের মনেও যদি ওই ভবঘুরে পাগলটার জন্য সহমর্মিতা জাগে তবে সেই মিথ্যা কথা তিনি বারবার বলতে রাজি। তাতে সৃষ্টিকর্তা তার ওপর যত পাপই বর্ষণ করুক।