শকুনি
শকুনি
মহাভারতের সম্ভবত সবচেয়ে চর্চিত চরিত্র শ্রীকৃষ্ণের পরেই। অসম্ভব ক্রুরতা ধূর্ততা বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ হাসিল করার শ্রেষ্ঠ উপায় বোধয় এনারই জানা ছিল।
মহাভারতে যেটুকু জানা যায় দুর্যোধন নিজে ছিলেন কলির প্রতিনিধি হয়ে আর শকুনি ছিলেন দ্বাপরের প্রতিনিধি হয়ে।
মনে করা হয় শকুনি হলেন মহাভারতের প্রধান চরিত্র। তিনি না থাকলে পাপের নাশ হত না। কলিযুগের মানুষ পেত না গীতার মত আদর্শ গ্রন্থ।
শ্রীকৃষ্ণ তথা নারায়ণ আসতেন না পৃথিবীর বুকে।
মূলতঃ স্বয়ং ভগবান ছাড়া স্বয়ং দ্বাপরকে আটকানোর ক্ষমতা ছিলনা কারুর। অর্থাৎ শকুনির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দ্বাপরের চরিত্র কি ছিল কিছুটা বোঝা সম্ভব হবে.......
পরিচিতি:
***************
আসুন দেখে নেওয়া যাক ওনার পরিচয়।
বর্তমান আগফানিস্তানে অবস্থিত আজকের কান্দাহার ছিল সেদিনের গান্ধার, তিনি ছিলেন সেই গান্ধার রাজ্যের রাজকুমার।
সুবল রাজার পুত্র তিনি, সৌবল নামে পরিচিত হন বাবার নামে।
পিতার মৃত্যুর পরে তিনি রাজা হন গান্ধারের। সেই জন্য তিনি গান্ধাররাজ নামে অভিহিত হয়েছেন সারা মহাভারত জুড়েই।
বিবাহ করেছিলেন তিনি। অর্শি ওনার স্ত্রীর নাম। চার পুত্রদের নাম বিপ্রচিতি, উলুক, প্রত্যাত্রী আর বৃকাসুর।
হস্তিনাপুরের আক্রমন:
**********************
মোটামুটি সুখেই কাটছিল দিন ওনার।
তবে #হস্তিনাপুর থেকে বার বার আক্রমন তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল।
এরপরে সেই বিরোধ চরমে উঠে যখন তিনি তার ভৌমদোষ তথা মাঙ্গলিক দোষযুক্ত বোন #গান্ধারী'র বিবাহ দেন একটি গাছ মতান্তরে একটি কুকুরের সাথে। উদ্দেশ্য ছিল এরম বিবাহ দিয়ে বোনের মাঙ্গলিক দোষ কাটিয়ে দেওয়া যাতে তার পরবর্তী বিবাহ জীবন হয় সুখের।
কিন্তু মহিলার অসম্মান করা হচ্ছে গান্ধারে এই ছুতো ধরে গান্ধার আক্রমন করেন #বিচিত্রবীর্য মতান্তরে ভীষ্ম।
বন্দী করা হয় সমস্ত গান্ধার রাজপুরুষদের।
শকুনি তখন ছোট। তিনিও বন্দী তার পিতা কাকা সমেত অন্যান্য আত্মীয় আর তার শত ভাইদের সাথে।
তবে
তার এক ভাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
বন্দী গান্ধারদের জন্য প্রতিদিন দেওয়া হত মাথাপিছু একটি করে দানা। উদ্দেশ্য তাদের অনাহারে মেরে ফেলা।
এই যৎসামান্য খাবারে সবার পেট কি করে ভরবে... হস্তিনাপুরের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে সময় লাগে না রাজা সুবলের। সবার সাথে আলোচনায় বসেন তিনি।
শেষে ঠিক হয় সবার খাবার একত্রিত করে একজনকে খাওয়ানো হবে আর বেঁচে থাকা সেই মানুষটির পরবর্তী জীবনের লক্ষ্য হবে একটাই- হস্তিনাপুরের ধ্বংস।
শতভাইদের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন শকুনি আর ছিলেন চালাকও সবার চেয়ে। তাকেই এইকাজের জন্য নির্বাচন করা হয়। বাঁচিয়ে রাখা হয় তাকেই। শতভাইরা সবাই একে একে মারা যায় আর তাদের দেহের মাংস খেয়ে বাকিরা জীবন নির্বাহ করতে থাকে। ভাইদের মৃতদেহ ভক্ষনের সাথে সাথে ভাইদের ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের গুণাবলী প্রবেশ করতে থাকে শকুনির মধ্যে।
এইভাবে
সমস্ত ভাই মারা গেলে থাকেন বেঁচে পিতা সুবল।
পিতা সুবল মৃত্যুর আগে শকুনিকে আশীর্বাদ দিয়ে যান তাকে কূটনীতিক চালে কেউ হারাতে পারবে না। সাথে নির্দেশ দিয়ে যান তার নিজের শরীরের হাড় দিয়ে বানানো হয় যেন পাশা খেলার ঘুঁটি।
শেষদিনে রাজা #সুবল একটি ছুরি দিয়ে আঘাত করেন শকুনির গোড়ালিতে। প্রচন্ড যন্ত্রনায় শকুনি কুঁকড়ে যান, রাজা সুবল বলেন এরপর থেকে তুমি খুঁড়িয়ে হাঁটবে সাথে এই যন্ত্রনা তোমায় মনে করাবে বারবার তোমার কি কর্তব্য...
শকুনির পাশা:
****************
এরপরে রাজা সুবল মারা গেলে তার জঙ্ঘার মতান্তরে গোড়ালির হাড় দিয়ে শকুনি বানান একটি পাশা।
সেই পাশার ঘুঁটির ভিতরে ঢোকান থাকত একটি টিকটিকি। সেই টিকটিকি ছিল শকুনির পোষ্য, চলত সে তারই কথায়।
সেই পাশার দানের সাথে পাশাও চলত শকুনির ইচ্ছে অনুযায়ী, মোটকথা সেই পাশা খেলায় শকুনিকে কেউ পারত না হারাতে।
এরপরে যখন গান্ধারীর সাথে অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র'র বিবাহ দেবার জন্য ভীষ্ম হরণ করেন গান্ধারীকে তখন সেই কারাগার খুলে দেওয়া হয়। খুললে দেখা যায় শুধু শকুনি বেরিয়ে আসেন। তিনি বেরিয়ে এসে একমুখ হাসি নিয়ে #ভীষ্ম'র পাশের রথে উঠে যান।
না কোন প্রতিহিংসা বা রাগ দুঃখের কথা তার মুখ থেকে বেরোয় না।
সেই থেকে একরকম 'মুখে হাসি মনে প্রতিশোধ' স্পৃহা নিয়ে তিনি চলে আসেন হস্তিনাপুরে #গান্ধারী আর ভীষ্মর সাথে।
এরজন্য বরাবরের মতো ছেড়ে আসেন গান্ধার।
বিবাহ হয় বোনের এক অন্ধ রাজার সাথে, এটাও মেনে নিতে পারেন না শকুনি।
কিন্তু তিনি সমস্ত অন্যায় অবিচার সহ্য করে চুপচাপ ভাবতে থাকেন কি করে নেওয়া যায় বদলা, পরিকল্পনা করে যেতে থাকেন মনে মনে কিভাবে ধ্বংস করা যায় হস্তিনাপুরকে সমূলে।
শকুনির প্রতিশোধের পরিকল্পনা রূপায়ন:
**************************************
সময় যেতে থাকে আর জন্ম নিতে থাকে একের পর এক হস্তিনাপুরের ভবিষ্যৎ। গান্ধারী চেয়েছিলেন তার সন্তান হোক সবার বড় কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা করে দিয়ে জন্ম নেন যুধিষ্ঠির সবার আগে।
এই ঘটনা গান্ধারী আর #কুন্তী'র মধ্যে ঈর্ষার মনোভাবের সূচনা করে। বেপারটা নজর এড়ায় না শকুনির। এই ঈর্ষা উস্কে দেবার জন্য তিনি সুক্ষভাবে চেষ্টা চালাতে থাকেন।
পাণ্ডব আর কৌরবভাইদের ভালোভাবে বোঝার জন্য শকুনি সবার সাথে মিশতে থাকেন বন্ধুর মতো।
যত বড় হতে থাকে মামা শকুনি ওদের কাছাকাছি আসতে থাকেন, পাশাপাশি সবার গুনাগুন নিয়ে চুলচেরা বিচার করতে থাকেন।
খুব হাল্কা ভাবে তিনি বিষ মেশাতে থাকেন দুর্যোধনের মনে ভীমের বিরুদ্ধে। মনের বিষ শুধু নয় তিনি প্ররোচিত করেন দুর্যোধনকে, ভীমকে বিষ খাওয়ানোর জন্য।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বিষ মেশানো পায়েস খেয়ে ভীম অচৈতন্য হলে তিনি দুর্যোধনকে বলেন বিষাক্ত সাপে ভরা হ্রদের মধ্যে ভীমকে ফেলে দেবার।
কিন্তু বাসুকির নির্দেশে সর্পকুল ভীমকে কামড় দিয়ে বিষ মুক্ত করেন আর আশীর্বাদ দিয়ে ভীমের জীবন ফিরিয়ে দেন বাসুকি।
এরপরে শকুনির পরিকল্পনা অনুযায়ী পাশা খেলা হয় কৌরব আর পাণ্ডবদের মধ্যে। সেখানে শকুনির পাশা জিতিয়ে দেয় কৌরবদের।
হেরে গিয়ে যেতে হয় চৌদ্দ বছরের বনবাসে।
পাণ্ডবদের এই বনবাসকালেও বসে থাকেন না শকুনি। শকুনি আবার পরিকল্পনা দেন দুর্যোধনকে জতুগৃহ বানানোর। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বার্নাবতে অর্থাৎ আজকের উত্তরকাশিতে বানানো হয় লাক্ষা গালা ধুনো ইত্যাদি দাহ্য পদার্থের সাথে কাঠ দিয়ে এক সুদর্শন গৃহ।
সেই কাজে পুরোচন নামক একজনকে নিয়োগ করা হয়। সে এমনিতে ঘরের দেখভাল করবে তারপর একদিন সুযোগ বুঝে আগুন লাগাবে ঘরে যাতে পুড়ে মরে পাণ্ডবভাই এর দল।
কিন্তু বিদুরে'র সহায়তায় বেঁচে যান পঞ্চপান্ডব আর মাতা কুন্তী।
এরপরে পাণ্ডবদের অসুবিধা করার জন্য তিনি যোগাযোগ করেন মহাক্রোধী ঋষি দুর্বাসার সাথে। তারপর একদিন তাদের পাঠিয়ে দেন পাণ্ডবদের সাথে দেখা করতে। বহু সতীর্থ আর শিষ্যদের সাথে নিয়ে পৌঁছে যান দুর্বাসা সেখানে। পাণ্ডবদের খাওয়া তখন শেষ। অক্ষয় পাত্র ধুয়ে রেখে দিয়েছেন দ্রৌপদী। সেইযাত্রায় কোনক্রমে দ্রৌপদী মান রক্ষা করেন শ্রীকৃষ্ণের সহায়তায়। দুর্বাসার অভিশাপ থেকেও বেঁচে যান পাণ্ডবপক্ষ।
পরবর্তীকালে আবার পাশা খেলার পরিকল্পনা করা হলে আবার হারেন পাণ্ডবভাইরা। মুখ্য ভূমিকায় সেই শকুনির পাশা।
রাজত্ব সমেত ভাইদের সাথে নিজেকেও হারিয়ে যুধিষ্ঠির বাজী ধরেন দ্রৌপদী'কে।
তারপরেও হারেন দ্রৌপদী'কে।
তখন দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করেন দুঃশাসন।
ভীম সেই সভায় প্রতিজ্ঞা করেন দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত পান করবেন আর দুর্যোধনের ঊরু ভাঙবেন।
আর সহদেব প্রতিজ্ঞা করেন যাবতীয় ষড়যন্ত্রের মূল মাথা শকুনিকে তিনি করবেন বধ।
পাণ্ডবদের এই প্রতিজ্ঞাগুলোর কথা শুনে মনে মনে খুব খুশী হন শকুনি। তিনি জানতেন এই প্রতিশোধের খেলায় শেষ অবধি পুরস্কার তার জুটবে মৃত্যু এটা নিশ্চিত।
কিন্তু মৃত্যুর আগে তার প্রতিশোধ যেন হয় সম্পূর্ণ।
মোটকথা
এই পাশাখেলায় শকুনি নিশ্চিত করে নিয়েছিলেন কৌরবদের ভবিষ্যৎ। মোটামুটি এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে হস্তিনাপুরের বংশধররা সবাই।
পাণ্ডবদল বনবাস সেরে ফিরে আসার পরে শকুনির মন্ত্রনায় দুর্যোধন ফিরিয়ে দেন না ইন্দ্রপ্রস্থ।
এমনকি তার প্ররোচনায় শ্রীকৃষ্ণের দূত হিসেবে মধ্যস্থতা আলোচনাও যায় বিফলে।
কারন শকুনি ততদিনে দুর্যোধনকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি অপ্রতিরোধ্য। কোন শক্তির ক্ষমতা নেই তাকে থামানোর।
ফলাফলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়ে পড়ল অবশ্যম্ভাবী। শকুনির পরিকল্পনা হল স্বার্থক।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে:
********************
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লেও থেমে থাকেন না শকুনি। মোটেই আত্মতুষ্টিতে নিজেকে থামিয়ে রাখেন না। যুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহন করেন কারন তার এতদিনের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা এবারে পূরণ করার সময় এসে গেছে। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেই পরিকল্পনার মালায় গাঁথবেন সাফল্যের লকেট।
তাই তিনি শুধু নয়
সাথে শকুনির সেই পালিয়ে যাওয়া ভাই যোগদান করেন কৌরবপক্ষে। শকুনির ছেলে বৃকাসুরও যোগ দেন কৌরবপক্ষে।
যুদ্ধ শুরুর আগে দুর্যোধনকে পরিকল্পনা দেন নকুল সহদেবের মামা অর্থাৎ মাতা মাদ্রীর ভাই রাজা শল্যকে কৌরব পক্ষে যোগদানের জন্য যাতে করান যায় রাজী। রাজা শল্য যখন আসছিলেন যুদ্ধে যোগদানের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী দুর্যোধন তাকে মাঝরাস্তায় আবেদন করেন তার আতিথ্য গ্রহনের জন্য।
শল্যকে সেবা শুশ্রূষায় সন্তুষ্ট করেন দুর্যোধন।
পরেরদিন শল্য তার আতিথ্য গ্রহনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বিজয়ী হবার আশীর্বাদ দেন দুর্যোধনকে।
তখন শকুনি বলেন বিজয়ী দুর্যোধন তখনই হবেন যখন শল্য যোগদান করবেন কৌরবপক্ষে। তাই যদি শল্য কৌরবপক্ষ যোগ দেন তবেই শল্যর আশীর্বাদ বাস্তবতা পাবে।
শল্য তখন শকুনির কথার জালে ফেঁসে গিয়ে যোগদান করেন কৌরবপক্ষে।
কৌরবপক্ষর হয়ে তিনি যুদ্ধ করেন বীর বিক্রমে।
পাশা খেলার পাশাপাশি ছিলেন বড় যুদ্ধবিদ। মহারথী তিনি। তরোয়াল কুঠার গদা আর তীর ধনুকে পটু। নিজেকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সেভাবেই।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রথমে দুর্যোধন বলেছিলেন শকুনিকে সেনাপতির দ্বায়িত্ব নিতে। কিন্তু শকুনি বলেন মহাবীর শল্যকে সেনাপতি করতে।
শল্য এরপরে হন কৌরবপক্ষের সেনাপতি।
তবে সেনাপতি না হলেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শকুনির বীরত্ব চিরকালীন এক ছাপ রেখে যায়
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দিন অনুযায়ী পর পর বর্ণনা করলাম দিন অনুযায়ী ওনার পরাক্রমের কথা-
-যুদ্ধের প্রথম দিনেই যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন কিন্তু বধ করতে পারেন নি।
-যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে তিনি হারেন সহদেবের সাথে তরোয়াল যুদ্ধে। আর সত্যকির সাথে তীরে ধনুকের যুদ্ধে।
-যুদ্ধের চতুর্থ দিন তিনি বধ করেন মগধের একের পর এক সেনাপতিকে।
-যুদ্ধের পঞ্চম দিনে তিনি হারেন অর্জুনের সাথে তীর ধনুকে আর ধৃষ্টদুমন্য'র সাথে তরোয়াল লড়াইয়ে।
-যুদ্ধের সপ্তমদিনে তিনি হারেন ভীমের সাথে গদা যুদ্ধে আর দ্রূপদের সাথে তীর ধনুকের যুদ্ধে।
-যুদ্ধের নবমদিনে তিনি হারেন যুধিষ্ঠিরের কাছে বর্শা লড়াইয়ে।
এমনকি অভিমন্যু হারান তাকে তীর ধনুকের যুদ্ধে।
-যুদ্ধের যুদ্ধের দশমদিনে তিনি ভীষ্ম কে রক্ষা করার জন্য প্রানপন চেষ্টা করেন। তিনি ভীষ্মর কাছে পৌঁছানোর আগেই আটকে দেন শিখন্ডী'কে। কুঠারের যুদ্ধে তাকে ক্ষত বিক্ষত করে দেন। এমনকি কুঠারের আঘাত করে মুর্মুর্ষু রক্তাক্ত করে দেন শিখন্ডীর পেট কেটে দিয়ে।
আহত শিখন্ডীকে এরপরে রথে তুলে নেন অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণ। শিখন্ডীকে সামনে রেখে ভীষ্ম বধ করতে সমর্থ হন অর্জুন।
-যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে তিনি বধ করেন মগধের রাজা সহদেবকে। পাণ্ডবদের পঞ্চ সন্তানদের করেন পরাজিত। উপপাণ্ডবদের সহায়তা করার জন্য আসেন রাজা বিরাট। তিনিও পরাজিত হন শকুনির কাছে।
-যুদ্ধের তেরতম দিনে সেনাপতি দ্রোনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সাজানো হয় চক্রব্যূহ। তিনি ছিলেন চক্রব্যূহ র একদম কেন্দ্রে আরও আটজন মহারথীর সাথে।
অভিমন্যু এই ব্যূহে প্রবেশ করলে তিনি সম্মুখ যুদ্ধে না পেরে উঠে পেছন থেকে তরোয়াল দিয়ে জখম করেন অভিমন্যু'কে। শেষে সবাই মিলে গোল করে ঘিরে ধরে একরকম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারেন অভিমন্যু'কে।
-যুদ্ধের চৌদ্দতম দিনে তিনি ছিলেন কৌরবদের একমাত্র জামাতা জয়দ্রথকে রক্ষায় নিযুক্ত। অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছেন সেদিন তিনি বধ করবেন জয়দ্রথকে।
তাই সেদিন যুদ্ধ হয় নকুলের সাথে কিন্তু তিনি পরাজিত হন। পরাজিত হলেও তিনি জয়দ্রথকে বাঁচাতে হন সমর্থ।
এরপরেও
সেদিন জয়দ্রথ বধ হলে শকুনির নেতৃত্বে চলে রাত্রিকালীন যুদ্ধ। বিরাট দ্রূপদ আর সত্যকিকে সেদিন তিনি পরাজিত করেন।
-যুদ্ধের সতেরতম দিনে তার সন্তান বৃকসুর মারা যান নকুলের হাতে।
-যুদ্ধের আঠেরতম দিনেও যখন সহদেব যখন বধ করে উঠতে পারেন না শকুনিকে তখন পাণ্ডব ভাইরা সবাই মিলে আক্রমন করেন শকুনিকে। এগিয়ে আসেন কৌরবদের অবশিষ্ট ভাইরা।
কিন্তু ভীম কৌরবদের আটকিয়ে দেন।
সহদেব আর শকুনি হন মুখোমুখি। শকুনির সহায়তায় এগিয়ে আসেন পুত্র উলুক। বধ হন উলুক পিতা শকুনির চোখের সামনেই। পুত্রের মৃত্যু দেখে শকুনি তখন ক্ষিপ্ত হয়ে মারমূখী হয়ে উঠেন। সহদেবের রথ আর ধনুক তিনি নষ্ট করে দেন। সহদেব অন্য আরেকটি রথে উঠলে সেটিকেও ভেঙে দেন শকুনি।
তখন সহদেব আর শকুনি নামেন কুঠার নিয়ে লড়াইয়ে।
শেষে সহদেবের কুঠারের এক আঘাত পড়ে শকুনির মাথায় তার শিরস্ত্রান দু'টুকরো হয়ে মাথা কেটে বসে যায় সেই কুঠার।
।।।বধ হন শকুনি।।।
শেষ হয় শকুনির জীবনের সাথে তার প্রতিহিংসার জীবন। সারাজীবন ধরে তিনি ভেবেই গেলেন কি করে ধ্বংস করা যায় হস্তিনাপুরের বংশ। তারজন্য তার বোনের পুত্রদের অর্থাৎ নিজের ভাগ্নেদেরও তিনি রেয়াত করেননি। পাণ্ডবদের সাথে তিনি কখনো শত্রুতা করেন নি কিন্তু তার পরিকল্পনার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করলেন পাণ্ডবদের আজীবন।
পাণ্ডবদের মামা শল্যকে তার উপদেশেই সেনাপতি করা হয়।
ঠিক কি কারন?
পান্ডবপক্ষ তার মামার সম্মুখীন হলে দুর্বল হবেন
নাকি
শল্য দুর্বল হবেন ভাগ্নেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে
???
প্ৰশ্ন তো থেকেই যায়
কি দেখতে চেয়েছিলেন শকুনি?
হয়ত নিজের অবস্থানটা বুঝতে চেয়েছিলেন তিনি
তিনিও তো মামা, লড়াই তো তারও ভাগ্নেদের বিরুদ্ধে
যেকোন পরিস্থিতিকে তিনি পূর্ন মাত্রায় নিজের স্বপক্ষে আনতে তিনি সচেষ্ট ও সক্ষম ছিলেন।
তিনি জানতেন রাজনীতির প্রতিটি খুঁটিনাটি।
শুধু পাশার দান নয় তিনি নির্ভুল চালতে পারতেন রাজনীতির প্রতিটি চাল।
তিনি ভালোভাবেই জানতেন একজনই তার প্রধান বাধা তিনি হলেন শ্রীকৃষ্ণ। একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই পারেন কূটনৈতিক চালে তাকে হারাতে অথবা তার প্রতিটি পদক্ষেপ পন্ড করতে পারতেন একজনই।
তাই তিনি সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণকে বরাবর। শ্রীকৃষ্ণর অনুপস্থিতি তেই যাবতীয় কূট চাল তিনি চেলেছেন, পাশা খেলা থেকে শুরু করে বারনাবতে জতুগৃহ নির্মাণ অবধি...
শকুনি রক্ষা করেছেন তার জীবন দিয়ে তার ভাইদের কথা রেখে। তার বাবা কাকাদের শেষ ইচ্ছের সম্মান দিয়েছেন তার জীবনের প্রতিটি ক্ষণ দিয়ে।
গান্ধার রাজবংশ যে ভুল পাত্র নির্বাচন করেননি সে তো শকুনি প্রমান করেই দিয়েছেন।
অবশেষে ভুললে চলবে না তিনি যখন যুদ্ধ করেছেন সেটাও তিনি একজন রথীর কর্তব্য পালন করে করেছেন। যুদ্ধে তিনি সম্পূর্ণ সৎ ছিলেন। বহুবার হেরেছেন বহুজনের কাছে কিন্তু ময়দান ছেড়ে পালান নি। প্রতিটি মুহুর্তে তিনি করে গেছেন কৌরবদের সহায়তা।
ভীষ্ম ছিলেন তার প্রধান শত্রু কিন্তু যুদ্ধে তিনি ভীষ্ম রক্ষায় ছিলেন সৎ, অকপট ছিলেন তিনি জয়দ্রথ'র প্রাণ রক্ষায়।
মহারথী তিনি নিজের যুদ্ধ কৌশল দিয়ে প্রমান করে দিয়েছেন।
নিজেকে রক্ষা করেও সমর্থ হয়েছিলেন সমগ্র যুদ্ধের দিনগুলো জুড়ে। আঠের দিন হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। তিনি আঠেরদিনের দিন মারা যান অর্থাৎ যুদ্ধের শেষ দিনের গতিবিধি অব্দি তিনি ছিলেন ওয়াকিবহাল।
তিনি দেখে গেলেন কৌরবদের নাশ।
রইল বাকী শুধু দুর্যোধন তাই হয়ত তিনি নিজেকে সমর্পণ করে দিলেন নিয়তির হাতে। চাইলে তিনি শেষেরদিনে যুদ্ধে নাও যেতে পারতেন কিন্তু তিনি যোদ্ধা, তাই মৃত্যু বরন করলেন একজন বীরের মৃত্যু কুরুক্ষেত্রের পুণ্যভূমিতে।
মোটকথা তিনি যে সৎ ছিলেন তার জীবনে সেটা তিনি তার কর্মপদ্ধতির মধ্যে দিয়েই দেখিয়ে গেছেন।
তিনি গান্ধারের প্রতিটি পুরুষের কাছে ছিলেন তার দেওয়া কথায় সৎ। প্রতিশোধের ব্যাপারে ছিলেন সৎ। সেই সততার সাথেই হস্তিনাপুরের বংশকে একরকম নির্মূল করেই ছেড়েছেন তিনি।
স্বয়ং ভগবানের যুদ্ধ থামানোর অনেক প্রচেষ্টাকে তিনি করে দিয়েছেন নিষ্ফল।
তার সততার জোর এতটাই ছিল যে শ্রীকৃষ্ণের মুখের উপর দুর্যোধনকে বলাতে পেরেছিলেন
"বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী"।
এত সবের পরেও তিনি এক মহারথী হিসেবে যুদ্ধে ছিলেন সৎ।
স্বয়ম দ্বাপর ছিলেন তিনি। দ্বাপরের বৈশিষ্ট্য দুইভাগ পুন্য তো দুইভাগ পাপ। শকুনি নিজেও তো তাই। একাধারে তিনি খেলছেন 'সততার সাথে শঠতা'র পাশার ঘুঁটি।
আবার সততার সাথে করছেন যুদ্ধ যার পক্ষে
পাশাপাশি তারই বিনাশের চিন্তা মনেপ্রাণে মাথায় রেখেছেন........