Debasmita Ray Das

Drama

5.0  

Debasmita Ray Das

Drama

শিউলিবর্ষণ

শিউলিবর্ষণ

5 mins
1.6K


  পরপর ছটা ক্লাস সেরে বাড়ি ফিরে খুব ক্লান্ত লাগছিল শিউলির.... অলসভরা চোখে ফোনটার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। দশটা মিসড্ কল!! নম্বরটা সে চেনেনা। কে হতে পারে রে বাবা.... একটু বিরক্তই হয় শিউলি। ভাবতে না ভাবতেই আবার বেজে উঠল ফোনটা আর সে হ্যালো বলার আগেই....

'আমায় তুমি চিনবেনা শিউলি। তুমি তো রোজ তোমার বান্ধবীদের সাথে খুব গল্প করতে করতে বের হও.... তোমাদের কলেজের ঠিক পাশেই যে একটা চায়ের দোকান.... আর তার সামনে দাঁড়িয়েই যে একটা ছেলে তোমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সেটা কি তুমি কখনো খেয়াল করেছো শিউলি....??

অবাক শিউলি আপ্রাণ মনে করার চেষ্টা করেও পারেনা এইরকম কারুর কথা। অপরদিকে সে খুব ক্ষেপে ওঠে....

  'এইসব ফালতু কথা বলতে আপনি ফোন করেছেন.... আপনার কি আর খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই....??

বলতে বলতেই সে শুনতে পায় ফোন রেখে দেওয়ার আওয়াজ।

   

 যা বকা দিয়েছে আর মনে হয় বিরক্ত করবেনা.... খুশিমনে ভাবে শিউলি....

    শহরের একটি নামকরা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে বাংলা নিয়ে পড়ে শিউলি। খুব সুন্দর না হলেও বেশ চটক আছে চেহারায়। পড়াশুনায় খুব ভাল আর তাই বন্ধুমহলে একটা আলাদা খাতির আছে তার। তার ক্লাসের কারুর এতো সাহস হবে বলে তো মনে হয়না।

   পরেরদিন কলেজ যাওয়ার সময়ে খুব ভাল করে দোকানটা খেয়াল করে শিউলি। নাহ্, ওইরকম কাউকে তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা.... নিশ্চিন্ত মনে কলেজ ঢুকলো শিউলি। দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা বিভাগের প্রথম হওয়া মেয়েটিকে এমনিতেই অনেকে মনে মনে পছন্দ করে সেটা জানে শিউলি.... তাই আর এই নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামালোনা।।

    বিকেলে ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে ফোনটাকে বন্ধ করে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিল সে। মায়ের ডাকে উঠে দেখে রাত প্রায় নটা বেজে গেছে। ফোনটা অন করতেই গতকালের ওই একি নম্বর থেকে আটটা মিসড্ কল এলার্ট দেখালো। সাথে সাথেই ফোন বেজে উঠল....

'আজকেও অপেক্ষা করলাম তোমার জন্য। একবারও তাকালেওনা তুমি.... কেন বলোতো এতো নির্দয় তুমি....??

রাগে গা হাত পা রিরি করে উঠল শিউলির.. ইচ্ছা করছিল ঠাস্ করে এক চড় মারে ছেলেটার গালে। প্রচন্ড চেঁচিয়ে বলে ওঠে....

  'শোনো তুমি যেই হওনা কেন এইসব বাঁদরামি বন্ধ কর.. নাহলে কিন্তু বড়দের জানাতে বাধ্য হব।

'আচ্ছা বাবা আর তোমায় হাঁ করে তাকিয়ে দেখবোনা.. হল?? কিন্তু একদিন আমার সাথে দেখা তো কর.. তোমায় যে খুব দেখতে ইচ্ছা করে।

  রাগের চোটে এবার ফোনটা শিউলিই রেখে দেয়। মেজাজটা বিগড়েছে ভালই। অথচ সামনের মাসেই পরীক্ষা.. ভেবেছিল আজ অনেক রাত অবদি পড়বে। কিন্তু নাহ্ আর মন বসাতে পারলোনা।


   পরের দিনটা ছিল রবিবার। একটু দেরী করেই ঘুম থেকে উঠল সে। উঠতেই মা বললেন....

'তোর নামে কি এসেছে একটা। ওই টেবলে রেখেছি।

অবাক শিউলি তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখে একটা খাম, ভিতরে সাদা কাগজের চিঠি। ছোট্ট দুই লাইন....

তোমার মধুর কন্ঠে মুগ্ধ তোমার এই ভক্ত। আজ কি একবার বিকেলে দেখা পেতে পারি....??

দাঁত কিড়মিড় করে মনে মনে শিউলি। তারপর কি ভেবে নিজেই ওই নম্বরে রিং করে.... অপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ ভেসে আসে....

'কি সৌভাগ্য আমার.. তুমি নিজে আমার খবর নিচ্ছ....

   মনে মনে দুটো গাল পেড়ে শিউলি বলে.... 

'আজ বিকেলে কলেজের কিছু দূরেই যেই মাঠটা আছে.. সকলে আড্ডা দেয় ওখানে চলে এসো। শুরুতেই ডানদিকে যেই বটগাছটা আছে তার তলায় আমি অপেক্ষা করব।

   মনে মনে ঠিক করে নেয় শিউলি, আর না অনেক সহ্য করেছে। সব বন্ধুদের বলে এর একটা বিহিত করতে হবে। রবিবার কলেজ তো ছুটি.. তাই পরপর কয়েকটা ফোন করে সকলকে আসতে বলে দেয় শিউলি 

     তুঁতে রঙের একটা চুড়িদার পড়ে বিকেলে বেরিয়ে পড়ে শিউলি। কলেজের গেটের সামনে পৌঁছে দেখে সকলে উপস্থিত। চট করে পুরো ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে দিল। ঠিক হল ওরা সব আড়ালে আড়ালে থাকবে আর একবার তাকে দেখতে পেলেই সকলে বেরিয়ে আসবে। তারপর হবে ধোলাই।

   প্ল্যানমতোন বটগাছটার কাছে পৌঁছায় শিউলি। বিকেল পাঁচটার সময় আসার কথা ছিল। পাঁচটা পাঁচ বাজে। কেউ আসেনি। ইশারায় আড়ালে থাকা বন্ধুদের সাথে কথা চলতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল.... প্রায় সাড়ে পাঁচটা তাও কারুর দেখা নেই। অস্থির হয়ে ওঠে শিউলি। বন্ধুরাও এদিক ওদিক করতে থাকে। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে ওঠে....

  'কি হল তুমি আসবেনা????

'তুমি তো তোমার কথা রাখোনি শিউলি। তুমি একা আসবে বলেছিলে.... এতোজনকে সাথে নিয়ে এলে কেন?? আমি আসবোনা....

চমকে উঠে আশেপাশে তাকায় শিউলি। কাউকে দেখতে পায়না.. বন্ধুদের ইশারায় ডাকে....

'চল আজ আর কিছু করার নেই!! সে আসবেনা, দেখে ফেলেছে আমাদের সকলকে।

   কি আর করা বাড়ি ফিরে এলো সকলে। সামনের হপ্তা থেকেই পরীক্ষা শুরু। এখন এইসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই হবে ভাবে শিউলি। এমনিতেই এইসবের জন্য বেশ কিছুদিন নষ্ট হয়েছে।।


   পরের দিন থেকে শুধু সে নয়, সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে.. আর মাত্র ছটা দিন। আশ্চর্যের ব্যাপার ফোন আসাও এরপর থেকে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। খুব নিশ্চিন্ত হয় শিউলি।

    পরীক্ষার দিন এসে গেল দেখতে দেখতে। চারটে পেপার দুদিন গ্যাপে গ্যাপে। এই নিয়ে আর কারুর সাথেই কোনো কথা হয়না তার.. সময়ই মেলেনা।

   পরীক্ষা মোটামুটি বেশ ভালোই হল শিউলির। কিন্তু তার মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করতে লাগলো। যতোটা ভাল তার হয় অতোটা যেন ঠিক হলনা। খালি মনে হতে লাগলো ওই ছেলেটাই যতো নষ্টের গোড়া!!!!

   ক্রমে ক্রমে রেজাল্ট বেরোনোর দিন এসে উপস্থিত হল। বন্ধুদের সাথে কলেজ এলো শিউলি। সকলে বলতে বলতে এলো যে তার পরীক্ষা যেইরকমই হোক না কেন, তাকে টেক্কা দেওয়ার মতোন এখানে কেউ নেই। প্রথম সে হবেই। রেজাল্ট বোর্ডের দিকে তাকিয়ে কিন্তু তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল.... দ্বিতীয় স্থানে শিউলির নাম। আর প্রথম নাম প্রণবেশ রাহা....

    ক্লাসের সবথেকে ক্যাবলা ছেলেটা যে উঠে দাঁড়িয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দূরস্ত, ভাল করে কথাও বলতে পারেনা বলে দাম্ভিক শিউলি একদিন তাকে খুব প্রহসন করেছিল। শুধু সেই নয় তার বন্ধুরাও ওকে নিয়ে খুব মজা করতো।

  হাঁ করে বন্ধুদের দিকে তাকায় শিউলি....

'এটা কি করে হল বলতো????

তারাও সব চুপ। কেউ কিছু বুঝতেই পারছেনা। হঠাৎ বেজে ওঠে শিউলির ফোন। প্রায় এক হপ্তা পরে আবার সেই নম্বর....

'কেমন আছো তুমি শিউলি?? ভাল তো?? কলেজ এসেছো তো রেজাল্ট জানতে.. রেজাল্ট দেখে আজ আমার খুশি আর তোমার অবাক হওয়ার পালা। আমি গ্রাম থেকে এসেছি। তোমাদের মতোন গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা বলে একদিন যে অপমান করেছিলে সকলের সামনে.... তখন থেকেই ঠিক করি এর জবাব দেব একদিন আমি!!!! দেখিয়ে দেব সকলকে যে সকলের মধ্যেই প্রতিভা লুকিয়ে থাকে, শুধু তা বিকাশের জায়গা পায়না। তুমি সুন্দরী কলেজের ফার্স্ট গার্ল.... তাই তোমার নম্বর পেতে বিশেষ একটা অসুবিধা হয়নি। এর পরেরটুকু তুমি জানো।।

  কি বলবে ভেবে পায়না শিউলি।

প্রণবেশ আবার বলে....

'পারলে সবকিছু ভুলে যেও.. আর সকলকে তার মূল্য দিও।

   বাইরের আকাশে তখন একটু একটু মেঘ জমেছে। সেইদিকে তাকিয়ে শিউলির চোখে নেমে আসে বৃষ্টির ধারা.... নিজের ভুল বুঝতে পারে সে।।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama