শীতলা ডাইনি
শীতলা ডাইনি
১
ভোরবেলা মন্দির যাওয়ার পথে একটা অস্পষ্ট নারীকণ্ঠ শুনে, গ্রামের পুরোহিত, প্রাণবেন্দু বাবু একটু অবাক হলেন। অবাক হওয়ারই কথা! বিগত চল্লিশ বছর ধরে একই ভাবে, সূর্য ওঠার আগে স্নান সেরে মন্দিরের কাজের সূচনা করে আসছেন তিনি , কিন্তু কোনোদিনও এমনটি হয়নি। শব্দের উৎস অনুসরণ করতে করতে গ্রামের দুর্গামন্দিরে এসে এই বৃদ্ধ পুরোহিত যা দেখলেন তা, বিস্ময়, ভয় ও অস্বস্তি মেশানো এক অজানা অনুভূতির সৃষ্টি করলো তার বৃদ্ধ শরীরে । দূর্গা বাড়ির উঠোনে শুয়ে এক ষোড়শী, ঘুমের মধ্যেই অনবরত কি যেন আওড়ে চলেছে। পরনের বস্ত্ৰ অতি অনিচ্ছা সহকারে আড়াল করে রেখেছে তার ডাগর শরীরটাকে ।ছোট গ্রাম; তাই খবরটা ছড়াতে বেশি সময় লাগলো না। ঘন্টা খানেকের মধ্যে গ্রামবাসীর ভিড়ে দূর্গা মন্দির উপচে পড়লো।
প্রথম সারিতে বসে আছেন গ্রামের মোড়ল, তাঁর স্ত্রী পুত্র , গ্রামের হেডমাস্টার এবং অন্নান্য গণ্য মান্য ব্যক্তিরা। বলা বাহুল্য গ্রামের ডাক্তার হওয়ার দরুন আমার স্থানও হয়েছে প্রথম সারিতে। সেই ভিড়ের মধ্যেখানে বসে আছে একজন পনেরো সোলো বছর বয়সের মেয়ে। বঙ্গদেশের সূর্য স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে তার চামড়ার রঙে, পরনের কাপরে দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। ছেঁড়া কাপড়ের ফোকর থেকে উঁকি মারা দেহাংশ পরিষ্কার জানান দিচ্ছে আদতে সে ফর্সা। দরিদ্র হলেও তার দৈহিক গঠন বেশ ভরাট। চাতালের উপর জড়োসড়ো হয়ে বসে, মাথা নিচু করে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল কাঁধের উপর দিয়ে বয়ে কিঞ্চিৎ আড়াল করেছে তার ফোস্কা পড়া পায়ের পাতা।
"এই তোর নাম কি ?"
" শীতলা ডাইনি, আমাকে সবাই ওই নামেই ডাকে, মা "
মেয়েটির উত্তরে ভিড়ের মধ্যে একটা চাঞ্চল্লের সৃষ্টি হল। তবে সেটা ভয়ে না শ্রদ্ধায় তা ঠিক ঠাহর হল না।
গ্রামের হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, বীরেন বাবু কিন্তু পারিপার্শিক উৎসুকতাকে পাত্তা না দিয়ে বেশ জোর গলায় বললেন-
"দেখুন মোড়ল, আমি সাফ বলে দিচ্ছি এইগুলো স্রেফ ভাওতাবাজি, এরকম নাম শুধু লোককে বোকা বানানোর জন্য। খোঁজ করলেই দেখা যাবে কোনো ভিকিরি বা বেশ্যা, অন্য কোন গ্রাম থেকে খ্যাদানি খেয়ে এখানে এসে জুটেছে। "
বীরেন বাবুর সাথে পুরোপুরি একমত না হলেও একটা ব্যাপারে আমার বেশ খটকা লাগলো - ' শীতলা ডাইনি ', এ কেমন নাম! নামের দুটি শব্দ একেবারে বিপরীতমুখী। দেব দেবীর নামে নামকরণ এ দেশে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্তি না হলেও অনেক সময় ঠক, জোচ্চোরেরা এমনতর নামের সরণাপন্ন হয়, সহজেই মানুষকে বোকা বানাতে। কিন্তু ডাইনি! মেয়েটির মায়া মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে যেন কোনো মতেই খাপ খায়ানো যাচ্ছে না শব্দটাকে।
মোড়ল বৌ আবার ঝাঁজালো গলায় প্রশ্ন করলেন - " তোর এই নাম কে দিয়েছে রে ?"
"মা, সে এক বিশাল গল্প। আগে আমাকে কিছু খেতে দেবেন, খুব খিদে পেয়েছে। " বেশ করুন সুরে বললো শীতলা ডাইনি।
আড়চোখে দেখলাম বীরেন বাবুর গোফের তলাই মুচকি হাসির উদয় হয়েছে ; হাব ভাবটা এমন যেন এটাই তিনি বলতে চেয়েছিলেন। তা যাই হোক, মোড়লের আদেশে অবিলম্বেই মুড়ি বাতাসের আবির্ভাব ঘটলো। নিমেষের মধ্যে তা উদরস্থ করে শীতলা ডাইনি তার গল্প বলতে শুরু করলো।
"এখান থেকে দশ ক্রোশ দূরে আমাদের গ্রাম। বাবা ছিলেন চাষী আর মা ঘর কন্যা। অভাবের সংসার হলেও সুখে শান্তিতে কেটে যাচ্ছিল। সমস্যার শুরু হলো যখন আমি চোদ্দ বছর বয়সে পড়লাম। মাঝে মাঝেই রাতের বেলা আমার উপর কিছু একটা ভর করতো, আর আমি ঘুমের মধ্যেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলতাম। সকাল হলে আমার আর কিছু মানে থাকতো না। প্রথম প্রথম মা, বাবা খুব ভয় পেয়েছিল। আমাকে ওঝার কাছেও নিয়ে গেছিল। কিন্তু কোনো ফল হলো না। এমনই এক রাতে আমি ঘুমের মধ্যে বলেছিলাম যে দারোগাবাবুর ছেলের খুব বিপদ, তার চামড়া নাকি পুড়ে যাচ্ছে, অসহ্য যন্ত্রনা। বাবার কি মনে হল জানি না , তিনি দারোগাবাবুকে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন। কিন্তু দারোগাবাবু এক গরিব চাষীর কথাই বিশেষ পাত্তা দিলেন না। মা শীতলার অশেষ কৃপা যে সে সময় তার ছেলে-বৌ শহরে ছিলেন, কোনো এক কাজে আটকা পরে যাওয়াই তিনি তাদের আনতে যেতে পারেন নি। এক হপ্তা পরে দারোগা বাবু তার স্ত্রীর চিঠি পান যে তার ছেলের বসন্ত রোগ হয়েছে , তবে শহুরে ডাক্তার বদ্যির চিকিৎসায় সে সুস্থ হয়ে উঠছে। তিনি তাদের গ্রামে না নিয়ে গিয়ে ভালোই করেছেন। গ্রামে এলে হয়তো তার ছেলেকে বাঁচানোই যেত না। এর পর থেকেই গ্রামে ছড়িয়ে পরে যে আমার এক অদ্ভুৎ ক্ষমতা আছে , যার বলে আমি আগে থেকেই কোনো রোগ বা মহামারী ঠাহর করতে পারি। সেখান থেকেই আমার নাম হয়ে যায় শীতলা । দারোগাবাবুই নামটা দিয়েছিলেন , খুশি হয়ে পাঁচ টাকা বকশিসও দিয়েছিলেন। তারপরে দারোগাবাবুর বদলি হয়ে যাই, কিন্তু আমার নামটা থেকে গেছে।"
" সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু ডাইনি কথাটা কেন যোগ হলো, সেটা বলো "- বীরেন বাবু প্রশ্ন করলেন।
"সব মিথ্যে কথা বাবু , মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমাদের সুখের সংসার জ্বালিয়ে ছাড় খার করে দিয়েছে ওরা। সব মিথ্যে কথা, আমি ডাইনি না বাবু "- দুঃখ্যে, অপমানে গলা ধরে এলো ডাইনির।
" আহা ! আমরা কোথায় বললাম তুমি ডাইনি, তুমিই তো বললে তোমার নাম শীতলা ডাইনি।" মোড়লের মনে হয় মেয়েটাকে দেখে একটু করুনা হয়েছে; তাই কথাগুলো বেশ শান্ত ভাবে বললো সে।
কিছুক্ষন বিরতি, তারপর আবার শুরু করলো শীতলা ডাইনি।
“বড়োবাবুর ঘটনার পর থেকে অনেক মানুষ আমাদের ঘরে যাওয়া আশা করতে আরম্ভ করলো। তাদের আবদার আমাকে তাদের ভাগ্য বলে দিতে হবে। কিন্তু বাবু, আমার সেরকম কোনো শক্তি ছিল না , আমি কিছুই বলতে পারতাম না। আমি যা বলতুম সব ঘুমের মধ্যে। বাবা তার অর্থ বের করতে পারলে তবেই তা অন্যদেরকে বলা যেত। দু তিনবার আমি পাশের গ্রামের কয়েকজনের বসন্ত রোগ বাতলে দিয়েছিলাম।
চার পাশের লোক একটু মেনে চলতো আমাদের। কিন্তু বাবু , আমাদের মতো একটা গরিব পরিবারের গন্নি-মান্যি হয়ে ওঠাটা সবার সহ্য হয় নি। প্রথমে ঝামেলা করলো মহাজনের ছেলে সতু। বাবা মহাজনের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল। কথা ছিল এক বছরে শোধ করে দেবে। কিন্তু দু মাসের মাথায় সতু এসে গোল পাকালো। তার মতে বাবার এখন প্রচুর আয় হচ্ছে তাই টাকা তাড়াতাড়ি শোধ দিতে হবে। বাবা তাকে বোঝানোর শত চেষ্টা করলেও সে কিছুতেই বুঝতে চাইনা। ক্রমশ অবস্থা বেগতিক হতে থাকলো , সতু গালি গালাজ শুরু করে দিলো, সে এমনও বললো যে - "টাকা না থাকলে মেয়েকে দিয়ে দে" । অবশেষে পাড়ার লোকেরা এসে সামাল দেয়। সতু চলে যেতে যেতে বাবাকে শাসিয়ে যায় যে সে এর শেষ দেখে ছাড়বে।
এমনিতে আমি আর মা পুকুরে একসাথে নাইতে যায়। একদিন মা-র শরীর খারাপ হওয়ায় আমি একাই পুকুরে যাই। স্নান সেরে যখন পারে উঠি তখন দেখি আমার জামাকাপড় সেখানে নেই। বেলা হয়ে গিয়ে সন্ধ্যে নামছিলো, তাই আর অপেখ্যা না করে আমি ভেজা কাপড়েই ঘরের দিকে রওনা দি। লোকের নজর এড়ানোর জন্য যে পথে এসেছিলাম সে দিকে না গিয়ে বাঁশ বাগানের পথ ধরি। কিছুদূর গেছি হটাৎ কি যেন আমার উপর লাফিয়ে পড়লো। অন্ধকারেও মহাজনের ছেলে, সতু আর তার বন্ধুকে চিনতে অসুবিধে হলো না। তাদের নজর যেন রাক্ষসের মতো আমাকে গিলে খাবে। সতুর বন্ধু আমার পা দুটি ধরে রাখাই আমি অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারছিলাম না। শেষে পাশে পরে থাকা একটা পাথরের টুকরো তুলে জোরসে মারলাম সতুর মাথায়, তারপর প্রানপনে ছুটলাম বাড়ির দিকে।সেদিন বাড়ি ফিরে খুব কেঁদেছিলাম বাবু , মনে হচ্ছিলো যেন নিজেকে শেষ করে দি।"
“ পর দিন রামু কাকার থেকে বাবা খবর পায় যে সতু আগের রাতে মারা গেছে। বাবা তাকে কারন জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয় যে কারন তার জানা নেই, তবে বিকেল বেলা থেকে বুকে খুব ব্যাথা হচ্ছিলো। আমার খুব ভয় লাগলেও, মনে মনে শান্তি পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে জানোয়ারটা তার বদ কাজের জন্য সাজা পেয়েছে। কিন্তু এই শান্তি বেশিক্ষন টেকে নি। মহাজন ছিল এক অতি শক্তিশালী ও শয়তান লোক। সে রটিয়ে দিলো যে তার ছেলে মরেছে আমার অভিশাপে। আমার বাবার কাছ থাকে টাকা শোধ চাওয়াই নাকি আমি অভিশাপ দিয়েছি, তাতে
ই ছেলে মরেছে। সে আরো ভয় দেখালো যে অন্য কেও যদি আমাকে ঘাটায় তাহলে তাদেরও একই পরিণতি হবে। মহাজনের ছেলের সাথে ঝামেলা যেহেতু সবার সামনেই হয়েছে, তাই এই মিথ্যে কথা খুব তাড়াতাড়ি সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো।গ্রামের লোকেরা আমাদের গ্রাম ছাড়ার আদেশ দিল। বাবা কিন্তু নাছোড়বান্দা; সে তার বাপ-মার ভিটে কোনো ভাবেই ছাড়বে না। কিন্তু বাবু ,এর ফল হলো ভয়ংকর।"
শীতলা ডাইনি মুখ নিচু করে বসে রইলো। তার মুখ দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল এর পরের ঘটনা ব্যক্ত করা তার পক্ষ্যে অতি কষ্টকর। কিন্তু উৎসুক জনতার চোখে তা পড়লো না। তাদের পীড়াপীড়িতে সে আবার শুরু করলো।
“আমাদের ভিটেয় একটাই ঘর ছিল। ঘরের পেছনে উঠানের খানিকটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। আমি সেখানেই চাটাই পেতে শুতাম।। এক রাতে খুব গরমে আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখলাম ঘরের চালাটা দাও দাও করে জ্বলছে। আমি গলা ফাটিয়ে চেঁচালাম। সব বাড়ির করা নাড়লাম কিন্তু কেও বেরোল না। “
মেয়েটি কোলে মাথা গুঁজে ডুকরে কাঁদে উঠলো। আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কাহিনী শুনছিলাম। ঘোর ভাঙলো এক অস্বস্তিকর নীরবতায়। এই ভাবে কিছুক্ষন কাটার পর, যখন পরিবেশ একটু শান্ত হলো, মোড়ল মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন - " তা তুমি এখন কি চাও ?"
মেয়েটি যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল। নিমেষে তার চোখের জল উদাও হয়ে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
" আমাকে আপনাদের গ্রামে থাকতে দেবেন। আমি কাজ করে খাবো, আমি সব কাজ করতে পারি।"
এই আবদার শুনে ভিড়ের মধ্যে সোর্ গোল পরে গেল।এই মেয়েটিকে গ্রামে ঠাঁই দেওয়ার পক্ষ্যেও কিছু উক্তি কানে এলো। কিন্তু মোড়ল বিচক্ষণ মানুষ, বাকি সকলের সাথে আলোচনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাত্র তিনি নন।
২
মধ্যাহ্ন ভোজের পর মোড়লের উঠোনে গ্রামের মাতব্বরেরা আলোচনায় বসলো। প্রণবেন্দু বাবু স্বহৃদয় ব্যক্তি। তাঁর মতে মেয়েটি ভয় পেয়ে মিথ্যে কথা বলছে। হয়তো বা তার কিছু কথা সত্যি! তাকে গ্রামের শেষে থাকতে দিয়ে দেখা যেতে পারে। পরে যদি কোনো অসুবিধে হয় তখন না হয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
"কি বলছেন পুরুত মশাই। কোথাকার কে , এই ভাবে গ্রামে ঠাঁই দেওয়া যাই নাকি ! অরে, ও কি মতলবে মিথ্যে কথা বলছে তা আমরা জানি কি!" - বীরেন বাবু বলে উঠলেন।
প্রায় সবাই তার কথাই সম্মতি দিলেন। উপরন্তু মহিলারা তো বলেই বসলেন যে সে একটি নোংরা মেয়ে , আমাদের সহানুভূতি কুড়িয়ে এখানে শিকড় গাঁথবে আর কিছুদিন গেলেই তার নোংরা ব্যবসা শুরু করবে। এরম মেয়ে গ্রামে রাখলে গ্রামের পুরুষেরা বিপথে যাবে। আমার কিছু বলার নেই। সত্যি বলতে মেয়েটার কথা আমার এক বর্ণ বিশ্বাস না হলেও, তাকে দেখে খুব মায়া হয়েছিল। হতেই পারে তার গল্পের কিছুটা সত্যি; গ্রামের শেষে এক চিলতে জমিতে তাকে থাকতে দিলে কিই বা মহাভারত অশুদ্ধ হতো। কিন্তু এখানে উপস্থিত সকলেই আমার থেকে বয়স ও অভিজ্ঞতাই প্রবীণ, তা ছাড়া আমি বহিরাগত, কাজের স্বার্থে এখানে থাকি, তাই আমি মুখ বন্ধই রাখলাম।
অতএব সিদ্ধান্ত হলো তাকে গ্রামে থাকতে দেওয়া যাবে না। তাকে বলা হবে, আজ রাত-টুকু দূর্গা মন্দিরে কাটিয়ে কাল সকাল সকাল যেন সে গ্রাম ছেরে চলে যায়। কিন্তু এ কথা তাকে কে বলবে? বলা বাহুল্য তার গল্প কারো বিশ্বাস না হলেও, অভিশাপের ব্যাপারটা সবার মনেই দাগ কেটেছিল। অবশেষে এই দায়িত্ত পড়লো আমার উপর। উপর উপর বিরক্তি দেখালেও, মনে মনে খুশিই হলাম।
দেখতে দেখতে বেলা হয়ে গেছে। সূর্যদেব দিক্চক্রবাল রেখা ছুঁয়েছেন। দিন পড়ার সাথে সাথে গ্রামবাসীর উৎসাহেও ভাটা পড়েছে। ঘরে ফেরা পাখির কল-কাকলীতে মুখরিত, খালি দুর্গামন্দিরের উঠোনে শীতলা ডাইনি শুয়ে আছে। গলা খাকানি দিয়ে আমার উপস্থিতি জানালে সে উঠে বসলো। উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো - " কি হলো বাবু ?"
পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে বললাম - " আজ রাতটা এখানে থেকে, কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পরো। "
আমার কথার প্রত্যুত্তরে একটু হালকা হেসে সে টাকাটা তার ঝোলায় ভোরে নিলো। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
"বাবু আমি ডাইনি নই। সাবধানে থাকবেন । "...
কথাটা না শোনার ভান করে আমি ফিরে এলাম।
৩
আজ গ্রামে উৎসবের পরিবেশ। মোড়ল মশাইয়ের নতুন বাড়ির গৃহপ্রবেশ। সমস্ত গ্রাম নৃমন্তিত , তাই নিয়ে লোকের ব্যস্ততা দেখার মতো। স্যাস্থকেন্দ্রের ঘরে বসে জানালা দিয়ে তাই দেখছি। ঠিক দেখছি বলা যাই না, একটা অবশ অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে আছি মাত্র। রোগীর ভিড় খুব একটা হয় না। একমাত্র বাবার অনুরোধেই আমার এখানে আসা। বাবা যখন কিশোর বয়সে ব্যবসার মনোবাঞ্ছা নিয়ে এই গ্রাম ছাড়েন, তখন তিনি মানত করেছিলেন যদি কোনোদিন জীবনে সফল হন, তাহলে এই গ্রামের জন্য কিছু একটা করবেন। এই স্যাস্থকেন্দ্র তাঁর স্বপ্নের প্রথম ধাপ আর দ্বিতীয়টি হলো আমাকে এখানে এক বছরের জন্য পাঠানো। কোলকাতাতে থাকলে হয়তো অনেক বেশি নাম জস হতো , কিন্তু এখানে যে সন্মান পাই তা পেতাম কিনা, সেটা সন্দেহের।
এই সমস্ত সাত-পাঁচ ভাবছি, হটাৎ প্রাণবেন্দু বাবুকে দেখলাম ব্যস্ত ভাবে কোথাও একটা যাচ্ছেন।
" ও প্রাণবেন্দু বাবু, কোথায় যান? " উঠোনে এসে জিজ্ঞাসা করলাম।
" অরে বাপু, তুমি কি সব ভুলে গেলে? মোড়লের বাড়িতে নারায়ণ পুজো করতে হবে না !"
" মেয়েটাকে দেখলেন?"
" নাহ, সকালে পুকুর যাওয়ার সময় দূর্গা মন্দিরের সামনে দিয়েই গেছিলাম; কিন্তু চাতাল ফাঁকা। এদিক ওদিক খুঁজেও কাওকে দেখলুম না। তা বাপু ছাড় ওসব কথা; সন্ধ্যা বেলা তো মহাভোজ, তাড়াতাড়ি চলে এসো। "
" তা আসবো। আচ্ছা পুরুতমশাই, কাল মেয়েটি ভোরের বেলা ঘুমের মধ্যে কি আউড়াচ্ছিলো আপনি শুনেছেন?"
" ঠিক ঠাহর করি নি বাপু, তবে 'উটি, উটি' এরম একটা কিছু শুনতে লাগছিলো। আর ওই নিয়ে ভেবে কি লাভ? চলো, সন্ধ্যা বেলা দেখা হবে।" - এই বলে প্রণবেন্দু বাবু প্রস্থান করলেন।
আমি কিন্তু ভাবা বন্ধ করতে পারলাম না। কাল সারা রাত , ঘুমের মধ্যেও , শীতলা ডাইনির শেষ কথাগুলো আমার কানের সামনে কেও যেন আওড়ে গেল - " বাবু আমি ডাইনি নই।সাবধানে থাকবেন । "...
কাজে মন বসতে চাইল না। মেয়েটা কি বলতে পারে সে চিন্তাটা মনের অধিকাংশের দখল নিয়েছে। " উটি " - এইরকম শব্দ অভিধানে আছে বলে তো আমার জানা নেই। ডাক পিওনের আবির্ভাবে চিন্তায় বাঁধা পড়লো। পাঁচ মাইল দুরে সদর হাসপাতাল থেকে আমার জন্য চিঠি এসেছে।আমারি একজন সহপাঠী সেখানে কর্মরত। হপ্তা খানেক আগে দু জন রোগী পেটের গন্ডগোল নিয়ে স্যাস্থকেন্দ্রে ভর্তি ছিল। অবস্থা নিয়ন্ত্রনে চলে এলেও আমি সেই বিবরণ দিয়ে বন্ধুকে চিঠি লিখি। উদ্দেশ ছিল তার মতামত জানার। অনিচ্ছা সহকারে চিঠিটা খুললাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই - একিউট কলেরা। দুজনেই বাইরের গ্রামে কাজ করে , কোথাও একটা সংক্রমণ হয়েছে হয়তো!
ঘরের কোনে রাখা ওষুধের স্টকগুলো মেলাতে মেলাতে কখন যে দুই চোখ লেগে এসেছে বুঝতেই পারি নি। ডাইনির চিন্তা কিন্তু ঘুমের মধ্যেও আমার পিছু ছাড়লো না। একটা কুৎসিৎ স্বপ্নে ঘুমটা ভেঙে গেল আর মনে পরে গেল দুই সপ্তা আগের কিছু ঘটনা। যেই দুইজন শ্রমিক সাথ্যকেন্দ্রে ভর্তি ছিল তারা কাজ করছিলো মোড়লের নতুন বাড়িতে। সদরের কিছু কলের মিস্ত্রিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির উঠোনে নতুন টিউব ওয়েল লাগানোর কাজ। এত দিন ব্যবহার না হলেও আজ সকালেই কলটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়ে গেছে। এখন থেকে গ্রামবাসী ওই কলটিই ব্যবহার করবে পানীয় জলের জন্য। এমনকি নারায়ণ পূজার সিন্নিও হবে ওই কলের জলে। এই রকম ভাবেই যখন এক একটা করে ঘটনার স্মৃতির পর্দা সরিয়ে সামনে আসতে থাকলো , শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা শীতল অনুভূতি, শীতল থেকে শীতলতর হয়ে উঠলো। মনের কুয়াশা ভেদ করে, সব সন্দেহের বেরাটোপ ভেঙে ডাইনির "উটি " এক বীভৎস যমদূত রূপে আত্মপ্রকাশ করলো । বুঝলাম ডাইনি " উটি " বলে নি, সে বলতে চেয়েছিলো ওলাওঠা।