মর্কট
মর্কট
প্রতি বছরের মতো এ বছরও আমাদের শহরে আয়োজিত হয়েছে এক বিশাল বই মেলা। দেশ বিদেশের প্রচুর প্রকাশকদের অংশগ্রহণ ছাড়াও এই মেলার আর একটি বৈশিষ্ট আছে। এই মেলার কেন্দ্রস্থলে প্রচুর শিল্পী, তাদের শিল্পের প্রদর্শনী করেন। বেচা কেনা ছাড়াও এটি উর্তী শিল্পীদের আত্মপ্রকাশের একটা বড়ো মাধ্যম। এবারো কোনো বেতিক্রম নেই।
পুলিশে চাকরি পাওয়ার আগে প্রত্যেক বছর ঘটা করে বই কিনতে আসতাম আর এখন আসি ডিউটি দিতে। বইয়ের প্রেম কিন্তু আমার এক ফোটাও কমে নি, অবসর সময়ের এখনো সঙ্গী সেই বই। তাই কাজের ফাঁকে সময় পেলে ঢুঁ মেরে আসি বিভিন্ন বইয়ের স্টলে। আজও গোটা দশেক বইয়ের দোকান চষে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি তখন হটাৎ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো মেলার কেন্দ্রস্থলে রাখা একটি ভাস্কর্য। একটা বেঞ্চির উপর বসে আছে প্রমান সাইজের তিনটি বাঁদর। তা আবার যে সে বাঁদর নয় গান্ধীজির তিন বিখ্যাত বাঁদর। সত্যি বলতে শিল্পীর কাজ এতটাই নিখুঁত যে বাঁদরগুলো আসল না মূর্তি প্রথমটাই সেটা বুঝতেই পারিনি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলাম। সত্যি কি নিপুণতা ! অরে এটা কি ! একটু লক্ষ্য করে দেখার পর খুঁতটা যেন বেশ প্রখর ভাবে চোখে পরলো। বেঞ্চির ডান দিকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, একজনের বসার জায়গা আছে মনে হচ্ছে না? এটা খুঁত না শিল্পীর কোনো কারিগরি সেটা নিয়ে ভাবছি, এমন সময় এক বছর তিরিশেকের মহিলা, তার বাচ্চার হাত ধরে বসে পড়লো ফাঁকা জায়গাটায়। বসে তার মোবিলিটি মুখের সামনে ধরে কথা বলতে শুরু করে দিলেন। প্রথমটা ভেবেছিলুম ভিডিও কল করছেন , কিন্তু পরে বুঝলাম ওটা লাইভ । সোসাল মিডিয়াতে এটা এখন খুব চলছে। ইশ ভাস্কর্যের অপুর্ণতাটা প্রায় ধরেই ফেলেছিলাম , যাক কি আর করার আছে ! হতাশ হয়ে উঠে পড়লাম । দু পা এগোয় নি, হটাৎ শুনি পেছনে কিসের এক গন্ডগোল লেগেছে। ফিরে এসে দেখি সেই ভদ্রমহিলা কান্না কাটি জুড়ে দিয়েছেন। তার ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সামনে এক উর্দিধারী পুলিশকে দেখে আরো অসহায় হয়ে পড়লেন মহিলা। প্রায় হাও হাও করে বেক্ত করতে লাগলেন তার ছেলে হারানোর যন্ত্রনা। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম, ততক্ষনে বড়োবাবুও এসে পড়েছেন। অবশেষে কিছুক্ষন খোঁজা খুঁজির পর তার সন্ধান পাওয়া গেলো পাশের এক বাচ্চাদের বইয়ের দোকানে। মায়ের অন্যমনষ্কতার সুযোগ নিয়ে সে এখানে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ছেলেকে ফেরত পেয়ে, আনন্দ পাওয়ার বদলে, মহিলা খড়্গহস্ত হয়ে উঠলেন দোকানের মালিকের উপর।
" আপনাদের কি কোনো কমন সেন্স নেই ? একটা বাচ্চা স্টলে ঢুকে পড়ছে , আপনারা জিজ্ঞেস করবেন না বাবা মা কোথায়?"
দোকানের ম্যানেজার যতই বোঝাতে যাই ততই মহিলা মারমূখী হয়ে ওঠেন।
"আপনাদের নামে রিপোর্ট করবো --"
অবস্থা বেগতিক দেখে বড়োবাবু হস্তক্ষেপ করলেন -
"ম্যাডাম আমরা কমপ্লেইন লিখে নিচ্ছি , যথা যত বেবস্থা নেওয়া হবে। আপনি একটু রেস্ট নিন, আপনার উপর অনেক ধকল গেছে।"
আসস্থ হয়ে মহিলা গজ গজ করতে করতে প্রস্থান করলেন।
দোকানের ভদ্রলোক ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন তাই বড়োবাবুর হাসির প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসে কাজে মনোনিবেশ করলেন।
" মাথাটা ধরে গেলো, বুঝলে সঞ্জয় !"
"হ্যাঁ স্যার। চলুন একটু চা খাওয়া যাক। "
দোকান থেকে বাড়িয়ে, সামনের একটা চায়ের স্টলে দু কাপ কফি অর্ডার দিলাম। কফি খেতে খেতে গল্প করছি, হটাৎ বড়োবাবু বাঁদরের মূর্তিগুলোর দিকে ইশারা করে বলে উঠলেন-
" সঞ্জয় দেখো, কত সুন্দর ভাস্কর্যটা, কিন্তু বেঞ্চটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে না। "
ততক্ষনে আমার মনের ক্যানভাসে এই ফাঁকা জায়গা পরিপূর্ণ হয়ে গেছে আর ভাস্কর্যের খুঁতটাও এখন আর খুঁত বলে মনে হচ্ছে না।
" না স্যার ওটা ফাঁকা নই , ওটা বসার জায়গা। "
" বসার জায়গা?" - বড়োবাবু খুব চিন্তিত ভাবে নিজের মনে মনেই আওড়াতে লাগলেন , " বসার জায়গা, কিন্তু কার ?"