শেষ সম্বল
শেষ সম্বল
পোড়ো স্কুলবাড়ির গা দিয়ে যে রাস্তাটা নতুন কলেজ বাড়ির দিকে চলে গেছে,সেখানে সন্ধ্যার পর কেউ পারতপক্ষে পা রাখে না।কেমন একটা গা ছমছমে ব্যাপার।দিনের বেলা গেলে দেখা যায়,স্কুলবাড়িটা ভেঙেচুরে একদিকে ধ্বসে গেছে,পাঁচিল বলেও কিছু আর অবশিষ্ট নেই।বড় বড় গাছের শেকড় আর ডালপালা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে বাড়িটাকে।রাস্তাটাও নির্জন।চারপাশে বড় বড় গাছপালা দিয়ে ঘেরা বলে জায়গাটা একটু ঠান্ডা,শিরশিরে।তার সঙ্গে অজানা একটা ভয়ের অনুভূতি।একা বেশীক্ষণ থাকা যায় না এদিকটায়।
সেদিন দুপুরে লাহাবাড়ির সবচেয়ে ডানপিটে দুই ছেলে বুবু আর তুতু এই পোড়োবাড়িতেই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল।ওদের কোন ভয় নেই,দুরন্ত দুপুরে খালি অ্যাডভেন্চারের নেশা।স্কুলবাড়ির কোনে কোনে দামাল পায়ে ছুটে বেড়াতে লাগল ওরা।বুবু বলল ‘দেখ তুতু,কুয়োধারে কার যেন কাপড় শুকোতে দেওয়া আছে!’তুতু বলল ‘চল তো গিয়ে দেখি।এখানে তো কখনও কেউ আসে না’।কাছে যেতেই একটা লাঠির একটু অংশ দেখা যেতে লাগল।বুবু তুতু আরও সন্তর্পনে একটু ঘুরে কুয়োতলার দিকে এগিয়ে যেতেই বুক হঠাৎ ধক্ করে উঠল।কার যেন পা দেখা যাচ্ছে কুয়োর আড়ালে।
দৌড় দৌড়।পোড়ো বাড়িটার গেটের ডানদিকে বেশ কিছুটা প্রাণপনে ছোটার পরে শিমুলতলায় হারুদার সাইকেল সারাইয়ের দোকান।বুকটা তখনও ওদের হাপরের মত উঠছিল নামছিল।হারুদাকে ব্যাপারটা বলতেই হারুদা চোখ কপালে তুলে বলল ‘করেছ কি তোমরা?ওই ভুতের বাড়িতে ঢুকেছ এই অবেলায়!সর্বনাশ।বাড়ি যাও এখুনি,নাহলে সব বলে দেব রমেনদাকে।‘রমেন’দা তুতুর বাবা,বুবুর জ্যাঠা।দুজনেই যমের মত ভয় করে এই রাশভারী ভদ্রলোকটিকে।তাই দুজনেই গুটিগুটি রওনা দেয় বাড়ির দিকে।
হারুদার মনে কোন ভয়ডর নেই।খুবই পেটানো চেহারা।বিকেলে সবেমাত্র খুলেছে দোকান।খদ্দের আসাও শুরু হয়েছে।হঠাৎ একটা ব্যাপারে হারুদার কেমন যেন খটকা লাগল।কার যেন পা দেখা যাচ্ছে বলছিল ছেলেদুটো।ফালতু কল্পনা নয়তো?কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথাগুলো কিন্তু ভুলে উড়িয়ে দেওয়া গেল না।ব্যাপারটা কি খতিয়ে দেখা দরকার।কেউ ঘাঁটি গাড়েনিতো পোড়োবাড়িটাতে?বা কোনও অঘটন!একটা পাংচার আর দুটো চাকা হাওয়া দেওয়া সারা হলে ফুটবল পাম্প দিতে কলোনির ছেলেগুলো এল।হারু ঠিক করল এদের দলে ব্যাপারটা বলে দেখা যাক।
যা শোনা তাই কাজ।প্রবল অত্যুৎসাহী ছেলেদের দল হৈ হৈ করে এগিয়ে চলল পোড়োবাড়িটার দিকে।সামনে অসীমসাহসী হারু।পিছনে দল বেঁধে ছেলেছোকরার দল।যদিও তারা একটু ভয় পেয়েছে,একটু দ্বিধায়,বোঝাই যাচ্ছে;বিশেষতঃ নির্জন স্কুল বাড়িটাতে ঢোকার পর হঠাৎযখন একটা অজানা পাখি টি টি করে ডেকে উঠল কোথা থেকে।বুকটা ছমছম করছে হারুরও।কখনও এমন অ্যাডভেন্চারের নেশায় ঢোকেনি এই পোড়োবাড়িটাতে।কাজটা কি ঠিক হচ্ছে,একটু দোনামনা তারও।একটু দূরেই এই সাইকেল সারাইয়ের দোকানটা অবশ্য অনেক পুরোনো,বাবার আমলের।শুনেছে সেই সময় চালু ছিল স্কুলটা।কিন্তু ছোটবেলা থেকেই এমন ভগ্ন দশাতেই দেখেছে স্কুল বাড়িটাকে।কেউ কেউ বলে আগে নাকি এটা সাহেবদের বাগানবাড়ি ছিল।তখন নাকি বিশাল রমরমা ছিল এখানে।দলে দলে সাহেব মেম আসত উইকএন্ডে ফুর্তি করতে।সরকারি স্কুলটা তার পরে হওয়া।চলেছিলও অনেকদিন।কিন্তু ঐ যা হয়।সাহেবী আমলের বাড়ি,রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছিল।একদিন ঝড়বৃষ্টিতে ধসে গেল একটা দিক।তারপর থেকে শুধু বট-অশ্বথ্থের শেকড় আর ডালপালাই গজিয়েছে,ঢাকা পড়ে গেছে গোটা বাড়িটাই।তবু আজও খেয়াল করলে খিশানের আদল,কড়ি বরগা,দেওয়ালের থাম আর ছাদের কিছু ভগ্নপ্রায় নকশা চোখে পড়ে।
কুয়োর দিকেই হেঁটে চলছিল সবাই।একটু এগোতেই দেখা গেল একটা পুঁটলি আর লাঠি।তারপরে দেখা গেল একটা বুড়ি ময়লা শতচ্ছিন্ন কাপড় পরে শুয়ে আছে সেই পুঁটলিটাকে জড়িয়ে।মলীন চেহারা,পাকা চুল অবিন্যস্ত।চেহারাটা শুকিয়ে কাঠ।এবারে দল বড় হওয়ায় কেউ আর পালালো না ঠিক,তবে সবারই মুখ শুকিয়ে,চাপা স্বরে ফিসফাস।কে এই বুড়িটা?বেঁচে আছে না মরে?পোড়ো বাড়ি বলে সবাই ভয় পায়,এলো কিকরে বুড়িটা এখানে!কেনইবা এলো!কিই বা আছে পুঁটলিতে?খবরটা চাউর হতে সময় লাগল না।থানা,পুলিশ,লোকজন,ভীড়ভাট্টা।
সন্ধ্যা হবার আগেই পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গেল বডি।সঙ্গে লাঠি,গামছা,পুঁটলি।বুড়িটা নাকি মরেছে বেশ কদিন।এমনই চামড়াসর্বস্ব শরীর,মরে তেমন গন্ধটুকুও বেরোয়নি।আহারে,কতদিন বুঝি খেতে পায়নি বেচারা।কিন্তু বুড়িটা কে?কোনদিন এ তল্লাটে দেখেনি তো কেউ।
দোকানটা আর খুলল না হারু।তারও মনটা কেমন ছমছম করছে।সন্ধ্যা হয়ে এল।নিজের সাইকেলটার হ্যান্ডেলে হাত রাখতেই বুকটা ধক্ করে উঠল হারুর।শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল একটা ঠান্ডা স্রোত।সাইকেলের ক্যারিয়ারে একটা লাল পুঁটলি বাঁধা।ঠিক ওই রকমই।