Adhiraj Biswas

Horror Thriller

3.9  

Adhiraj Biswas

Horror Thriller

শেষ দেখা

শেষ দেখা

7 mins
912



নিমন্ত্রণটা অনেকদিন আগেই করে রেখেছিল সুজন, যাবো যাবো করে আমার আর যাওয়া হচ্ছিলো না সুজনদের বাড়ি। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সুজনই সবার আগে চাকরি পেয়েছিলো তাও আবার বিদেশে। সুজনের বাড়ি টাকি। সুজন প্রায় বলতো, "একদিন এসে আমাদের বাড়ি থাকবি, গোটা টাকি ঘুরিয়ে দেখাবো, নৌকা চড়াবো, বাংলাদেশ দেখাবো"। সুজনের চাকরি পাওয়ার কয়েক মাস পর আমিও চাকরি পেয়ে যাই। সুজন যখন বাড়ি আসতো তখন আমার সময় হতো না তাই ওদের বাড়ি যেতে পারছিলাম না। কিন্তু এরপর নাকি ও দুই বছরের আগে আসতে পারবে না, তাই এক শনিবার দেখে ঠিক করলাম অফিসের পর ওদের বাড়ি যাবো, সেই রাতটা ওদের বাড়ি থেকে রবিবার বিকালে বাড়ি ফিরবো। সেই মত সুজনকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম যাওয়ার তারিখ। আমি যাবো শুনে সুজন তো খুব খুশি, গর গর করে বলে গেলো ট্রেন এর সময়। ঠিক করলাম শিয়ালদহ থেকে ৭.৪৫ এর হাসনাবাদ লোকালটা ধরবো, আর সুজন বললো স্টেশন চলে আসবে আমাকে নিতে।


সময়টা ছিল বৈশাখ মাসের শেষ, কয়েকদিন থেকেই গরম টা আরো বেড়েছে। ইতিমধ্যে দুবার তিনবার ফোন করা হয়ে গেছে সুজনের, যে আমি কখন অফিস থেকে বেরোচ্ছি। অফিস থেকে বেরোনোর সময় খেয়াল করলাম আকাশটা মেঘে ছেয়ে গেছে, আর মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ এর ঝলক দেখা যাচ্ছে। অফিসের নীচের থেকেই ট্যাক্সি নিলাম শিয়ালদহ যাওয়ার জন্যে। কিছু রাস্তা যেতে না যেতেই শুরু হলো কালবৈশখীর তাণ্ডব। ট্যাক্সি ড্রাইভার বললো, "যাক অন্তত আজ রাত টা শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারবো", আমিও ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। কিছুক্ষন বাদেই ঝড়ের সাথে শুরু হলো বৃষ্টি, শিয়ালদহ স্টেশন পৌঁছে টিকিট কেটে শুনলাম ঘোষণা হচ্ছে হাসনাবাদ শাখায় ট্রেন আধ ঘণ্টা দেরিতে চলছে। ভাবলাম খবরটা জানিয়ে দেওয়া ভালো সুজনকে, ফোনটা পকেট থেকে বেড় করতেই দেখলাম সুইচ অফ হয়ে আছে। পিঠ ব্যাগ এর থেকে পাওয়ার ব্যাংক বের করে ফোনটা চার্জ করতে বসলাম। কিন্তু মনের ভিতর খচখচ করতে লাগলো, মনে হচ্ছে আমার জন্য সুজনের না ভোগান্তি হয়। যাইহোক ৭.৪৫ এর ট্রেন ছাড়লো ৮.১৫ তে। ট্রেনে ভর্তি লোক, কোনো রকমে একটা জায়গা করে নিলাম। অফিস ফেরত যাত্রীর সংখ্যাই বেশী, মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনে, আমাকে অচেনা দেখে এক বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, "ভাই কি এই লাইনে নতুন"? আমি মাথা নেড়ে "হ্যাঁ" বললাম। শুনে বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলো, "তা যাওয়া হবে কতো দূর"? আমি বললাম, "টাকি যাচ্ছি আমার বন্ধুর বাড়ি"। বৃদ্ধ বললো, "ও টাকিতে আমিও নামবো?


তা টাকির কোন জায়গাতে যাবে"? আমি বললাম, "পাড়ার নাম ঠিক জানি না, বন্ধু আসবে আমাকে নিয়ে যেতে। যতদূর মনে পড়ে বলেছিল গেস্ট হাউসের ওই দিক দিয়ে যেতে হয়"। এরপর বাকি পথটুকু ওই বৃদ্ধের সাথেই নানান বিষয়ে গল্প করতে করতে কেটে গেলো। যত বারাসাতের দিকে ট্রেন এগোতে লাগলো কামড়াতে ভিড় ও বাড়তে লাগলো। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া কামড়ার ভিতরে আসছে। বারাসাত স্টেশন পার করতেই খেয়াল করলাম বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, এরপর টাকির দিকে ট্রেন যত এগিয়েছে অন্ধকার আরো গভীর হয়েছে, এমনকি স্টেশন গুলোও অন্ধকারে ডুবে আছে। টাকি স্টেশন ও তার ব্যতিক্রম না। টাকিতে যখন নামলাম ঘড়িতে দেখি ১০.৩০ বেজে গেছে। আমার সাথে থাকা বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, "সামনের রাস্তার মোড় অবধি এগিয়ে দেবো?" আমি তাকে বললাম, "তার দরকার নেই, বন্ধু আসছে নিতে"। স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে বলেছিল সুজন, কিন্তু কাউন্টারের সামনে এসে দেখি কেউ নেই। 


চারিদিক ঘুট ঘুটে অন্ধকার, ট্রেন থেকে যে কজন লোক নেমেছিল তারা যে কে কোন দিকে চলে গেলো তার কোনো হদিস পেলাম না, এমনকি টিকিট কাউন্টার ও বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বাইরে বের করে দেখলাম ফুল চার্জ হয়ে গেছে, ফোনটা অন করে ফোন করলাম সুজনকে, ফোনটা বেজে গেলো কেউ ধরলো না। আবার ফোন করতে যাবো এরমধ্যেই সুজনই দেখলাম ফোন করলো। ফোনটা ধরে "হ্যালো" বলতেই ওপর প্রান্ত থেকে সুজন বললো, "একটু দাঁড়া, আমি আসছি নিতে" ফোনটা রেখে দিলো সুজন। দেখতে দেখতে ১১ টা বাজতে চললো। অন্ধকার স্টেশনে আমি একা, চারিদিকে ব্যাঙ এর ডাক আর ঝিঝি পোকার ডাক পরিবেশটাকে ছমছমে করে তুলছিলো, আর মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হাওয়াটা গায়ে লাগতেই একটা শিরশিরানি ভাব অনুভব করছিলাম। হঠাৎ চমকে উঠলাম একজনের গলার স্বর শুনে, "বাবু যাইবেন কদ্দুর"? দেখলাম একজন বয়স্ক লোক হাতে একটা টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে। সেই টর্চের আলোতে দেখলাম বৃদ্ধ একটু ঝুঁকে আছে সামনের দিকে পরনে লুঙ্গি আর ছেড়া গেঞ্জি। বৃদ্ধ আবার বললো, "বাবু যা ঝড় হইছে তাতে আর কিছু পাইবেন না, সামনে আমার রিক্সা আছে চলেন আপনারে নামাই দিয়া যাই"। আমি বললাম, "না না তুমি যাও, আমার বন্ধু আসছে"। বৃদ্ধ আমার কথা শুনে আস্তে আস্তে চলে গেলো রিক্সার কাছে। সেই সময় শুনতে পেলাম দূরে একটা বাইকের হর্নের শব্দ, একটু পরেই দেখলাম একটা মোটর বাইক আসছে স্টেশনের দিকে। স্টেশনের সিড়ির কাছে এসে থামলো বাইকটা। ব্যাক্তিটির মাথায় হেলমেট, গায়ে একটা রেনকোট চাপানো, দেখে বোঝা যাচ্ছে না ব্যক্তিটিকে। 


একটু পরেই শুনলাম বাইকে আসা ব্যাক্তি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, "চলে আয়, আসতে বড্ডো দেরি হয়ে গেলো"। গলার কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম সেটা সুজন। আমি ততক্ষনে স্টেশনের সিড়ি দিয়ে নেমে সুজনের বাইকের কাছে চলে গেছি। সুজন বললো, "আরে বস তাড়াতাড়ি, তোকে বাড়িতে নামিয়ে আমি আরেক জায়গায় যাবো"। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কোথায় যাবি? ভাবলাম কতদিন বাদে চুটিয়ে আড্ডা মারবো! আর এতো রাতে কি এমন কাজ? অভিসারে যাবি নাকি?" আমার সাথে সাথে সুজন ও হেসে উঠলো কথা গুলো শুনে। ততক্ষনে সুজন বাইকে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। বাইকে ওঠা থেকেই একটা বোঁটকা গন্ধ ক্রমশ নাকে আসছিল, না পেরে সুজনকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, "কিসের একটা বোঁটকা গন্ধ বেরোচ্ছে বল তো"? সুজন বললো, "আরে বলিস না বৃষ্টিতে সারা রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে আছে, তাই আসার সময় পড়ে গেছিলাম রাস্তার পাশের কাঁদায়, তাই গন্ধ বেরোচ্ছে"। কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম আমরা একটা বড়ো রাস্তায় উঠেছি। বড়ো রাস্তায় লোক জনের জটলা। কয়েকজন পুলিশকে ও দেখলাম দাঁড়িয়ে থাকতে। জটলা কাটিয়ে আমাদের বাইকটা একটা সরু গলি ধরতেই আমি সুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, "কি হয়েছে রে ওখানে"? সুজন বললো, "অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে শুনলাম, আর বলিস না দিন রাত ওই থুবোর মোড়ে অ্যাকসিডেন্ট লেগেই আছে। শুনলাম তো লরির সাথে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে আর স্পটেই মারা গেছে ছেলেটা"। বাকি পথটুকু সুজন আমাকে টাকি পৌরসভা, হসপিটাল গেট, জাতীয় পাঠাগার, টাকি কলেজ দেখাতে দেখাতে নিয়ে আসলো। যদিও অন্ধকারে দেখতেই পারিনি, সব কিছু ভূতুড়ে ভূতুড়ে বলেই মনে হলো।


কলেজের পাশের রাস্তা দিয়ে কিছুটা দূর গিয়ে একটা গলির মুখে আমাকে নামিয়ে দিলো সুজন, বললো, "ওই বা দিকের তিন নম্বর বাড়িটা আমাদের, দেখ ঐ যে আমার কাকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আমি কাজটা মিটিয়ে আসছি এক্ষুনি"। আমি আসতে আসতে এগিয়ে গেলাম সুজনের বাড়ির দিকে। দূর থেকে বোঝা না গেলেও সুজনের বাড়ির কাছে যেতেই সুজনের কাকা ছাড়াও আরও কয়েকজন লোককে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমাকে দেখে সুজনের কাকা জিজ্ঞেস করলেন, "কি চাই?" আমি বললাম, "কাকা আমি সুজনের বন্ধু অরিন্দম, সু..." আমার কথা শেষ করার আগেই কাকা বলে উঠলেন, "আসলে এমন ঘটনা ঘটে গেলো যে তোমার কথা আমাদের কারুর মনে নেই"। আমি জানতে চাইলাম, "কি হয়েছে কাকু?" সুজনের কাকু আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন আর যা বললেন তাতে আমার সারা শরীরে শিহরন খেলে গেলো। কাকু বললেন, " তুমি আসবে বলেই সকাল থেকে সুজন খুব ব্যস্ত ছিল, নিজের হাতে বাজার করেছে। সন্ধ্যার থেকে তুমুল ঝড় আর বৃষ্টি, আমরা সবাই বললাম আজ অরিন্দমকে আসতে বারণ করে দে, কিন্তু আমাদের কোনো কথা শুনলো তো নাই বরং বৃষ্টি মাথায় বেড়িয়ে গেলো তোমাকে আনতে, আর তখনই বিপদটা ঘটলো।


ওই থুবার মোড়ের মুখে সুজনের বাইকে একটা লরি এসে ধাক্কা মারে, আর সাথে সাথেই সুজন বাইক থেকে ছিটকে গিয়ে রাস্তায় পড়ে, হেলমেট থাকা সত্বেও মাথায় জোরে আঘাত লাগে, আর সব শেষ"। আমি অনুভব করলাম কাকুর শেষ কয়েকটা কথা শোনার সাথে সাথে আমার আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বোয়ে গেলো। আমার সারা মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। কাকু আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, " কিন্তু সুজন যে বলছিল তুমি আমাদের বাড়ির ঠিকানা জানো না, তাহলে কি ভাবে আসলে?" আমি তখন কোনো উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই শুধু মনে হচ্ছে আমি তবে কার সাথে আসলাম? কেউ কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? বুঝতে পারলাম চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছে, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, আর তারপরই আমার চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো।

সেই দিন রাতের কথা আমার আর কিছু মনে নেই। পরের দিন সকালে যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখি আমি সুজনের কাকুর ঘরে বিছানায় শুয়ে আছি। সারা বাড়িতে কান্নার শব্দ। আমি গতকাল রাতের কথা ভুলতেই পারছিলাম না, মোবাইলটা একবার হাতে নিয়ে দেখলাম সেই রাতে সত্যিই কি সুজন ফোন করেছিলো? কারণ সুজনের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো আমার টাকিতে নামার আধ ঘণ্টা আগে। মোবাইলের কলার লিস্টে তখনো জ্বল জ্বল করছে সুজনের নাম। মনে মনে ভাবলাম সুজন ওর কথা রেখেছে, ওই অন্ধকারেও আমাকে টাকি শহর দেখিয়েছে আর ঝড় জলের রাতে আমি যাতে কোনো বিপদে না পড়ি সেই জন্য সে তাদের বাড়ি অবধি আমাকে পৌঁছে দিয়েছে। 


সমস্ত কাজ মিটিয়ে আমি রাতের ট্রেন ধরে কলকাতায় চলে আসলাম, সুজনের কাকা আমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে গেছিলো। সেই রাতের কথা আমি কাউকেই বলিনি। সেই ঘটনার পর আর কোনোদিন আমি টাকি যাইনি, যাবার ইচ্ছা ও নেই। এমনকি সেই দিনের ঘটনার সদুত্তর এখনো আমার কাছে নেই, হয়তো সুজনের টাকি দেখানোর বাসনা এতটাই বেশি ছিল যে সে মারা গিয়েও তা পূর্ণ করে দিয়ে গেলো, কিম্বা আমাদের বন্ধুত্বটা এতটাই বেশী ছিল যে সুজন আমাকে শেষ দেখা দিয়ে গেলো। তবে সেই দিনের পর রাত করে কোনো জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কোনো বাইক চোখে পড়লেই মনে হয় ওই বোধহয় সুজন আসলো আবার দেখা করতে।

              


Rate this content
Log in