SHUBHAMOY MONDAL

Drama Action Classics

4  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Action Classics

শাস্তি

শাস্তি

17 mins
448





এই কাহিনী মূলত যাঁকে ঘিরে তিনি - দূর্গাপ্রসাদ দত্ত, বনেদী দত্ত বংশের এক উত্তর পুরুষ। আগে এই প্রতাপনগরে তাঁদের পরিবারের প্রতাপ ছিল ভয়ানক। তাঁদের চৌদ্দ পুরুষ প্রবল দাপটের সঙ্গে জমিদারী করেছেন একসময় এখানে। কথায় বলে না - অমুকের দাপটে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়! সেইরকম প্রভাব প্রতিপত্তিই নাকি ছিল এখানে তাঁদের। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সাবেক যত জমিদার পরিবার আছে, তার মধ্যে তাঁদের নাম তো অবশ্যই আগে আসবে।


তখন কলকাতা সবে নগর রূপ ধরছে। এখন যে সব এলাকা প্রাসাদ কংক্রীটে ঢাকা, একসময় সেখানে ছিল ঘন অরণ্য, বন-বাদারে ঘুরে বেড়াত হরিণ, শেয়াল, বাঘও। ছিল বড় বড় ভেরী, দিঘী, জলাশয় বা পুকুরও - কিছু প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট আর কিছু খনন করে বানানো। পানীয় জল রূপে কূপ বা পুকুরের জল তখন খাওয়া হতো।

যাই হোক, সেই তাঁদেরই বংশের দূর্গাপ্রসাদের তিন পুরুষ আগের একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে এই কাহিনীর সূত্রপাত। ঐ এলাকারই ব্রাহ্মণ (বামুন) পরিবারের একটা ছেলে চুপি চুপি তাঁদের পুকুর থেকে মাছ চুরি করতে গিয়ে, ধরা পড়েছিল তাঁর ঠাকুরদা বিজয় প্রতাপ দত্তের লোকজনের হাতে। তাকে ধরে এনে, তাঁর কাছারী বাড়ির দালানের থামে বেঁধে রেখেছিলেন তিনি। ভালোমতই তাকে উত্তম মধ্যমও দিয়েছিলেন নাকি তাঁর ঠাকুরদা। ছেলেটা আবার তখন সদ্য যজ্ঞোপবীত (পৈতে) ধারণ করেছে, তাই শারীরিক ভাবে বেশ দুর্বল ছিল সে।


খবর পেয়ে তার মা তাই দৌড়ে এসে তাঁর হাতে ধরলো, পায়ে পড়লো তার ছেলেকে ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু বিজয় প্রতাপ কর্ণপাত করেন নি, যতক্ষণ না তার ছেলের চুরি করা মানে ঐ লুকিয়ে ধরা সমস্ত মাছের দাম, জরিমানা সহ তাঁকে কড়ায় গণ্ডায় মিটিয়ে না দেওয়া হলো। আইনত তিনি ভুল কিছু করেন নি - তাঁর পুকুরে তিনি মাছচাষ করেছিলেন, আর ছেলেটা সেই মাছ লুকিয়ে চুরিই করেছিলো।


কিন্তু সদ্য যজ্ঞোপবীত ধারণের অনুষ্ঠানের বিরাট ঝক্কি সামলানোর পর, শারীরিকভাবে এতই দুর্বল ছিল সে যে, তাঁর ঐ ক'টা চড় থাপ্পড় খেয়েই তখন রীতিমত নেতিয়ে পড়েছিল। দালানের থামে বাঁধা অবস্থায় খুব করুণভাবেই ধুঁকছিল সে তখন! সেদিন আবার একাদশীর নিরম্বু উপবাস চলছিল - তাদের মা ছেলে দুজনেরই।

তাই ছেলের কষ্ট আর সহ্য হয়নি মায়ের। ক্রোধের বশেই সেই বামনি তখন অভিশাপ দিয়ে বসলেন - আপনি এক মায়ের আবেদন উপেক্ষা করে, তার রুগ্ন ছেলেকে এত কষ্ট দিলেন তো? আমি যদি সতী বামুন ঘরের বৌ হই, তো আপনারাও তিনপুরুষ ধরে আপনাদের বংশের ছেলের জন্য, অন্য কারোর মায়ের সামনে বাধ্য হবেন মাথা নত করতে। এই আপনাদের শাস্তি।


এখন, সেটা চোরের মায়ের বড় গলা শোনালেও, ঘটনা ছিল এটাই - ঐ মহিলা খুব নিষ্ঠাবতী সতী নারী রূপে এলাকায় প্রশংসিত ছিলেন। জমিদার বিজয় প্রতাপ দত্ত, মানে দূর্গাপ্রসাদের ঠাকুরদা, যাঁকে ঐ অভিশাপ দিলেন ঐ বামনি, তিনিও তার কথা জানতেন। কিন্তু, এখানে যেহেতু তাঁর নিজের দিক থেকে কোন অন্যায় তিনি করেন নি বলে বিশ্বাস ছিলো তাঁর, তাই ঐ বামনি তাঁকে শাপ-শাপান্তর করলেও তাকে ছেড়েই দেন তিনি।


বামনির আবার সেদিন একদাশীর নিরম্বু উপবাস চলছিলো। তাই ঠিক ভুল যাই হোক, ঐ অভিশাপ যখন বের হয়েছে তার মত সতী বামনির মুখ দিয়ে, তা' ফলবেই - এমন মতামত ব্যক্ত করলেন বেশ কয়েকজন জমিদারের ঘনিষ্ট দিগ্গজ ব্যক্তিও। তাই জমিদার বিজয় প্রতাপ তাঁদের থেকে ঐ সব কথা শুনে, বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন নিজের বংশের ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।


পালকি পাঠিয়ে কালীঘাট থেকে নিজেদের গুরুদেবকে তাই আনালেন তাঁর বাড়িতে। তাঁকে খুলে বললেন সব ঘটনা। তিনি সব শুনে চোখ বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ - ধ্যান যোগে ভাবলেন। তারপর বললেন - এ' মা মহামায়ার লীলা বিজয়। তোমার বংশরক্ষার জন্য তিনিই বামনির মুখ দিয়ে ঐ অভিশাপ দেওয়া করিয়েছেন, যা' বিফলে যাবে না।


কিন্তু মায়ের উদ্দেশ্যটা মহৎ। তোমার বংশে এখন পরবর্তী তিনপ্রজন্মে পুরুষ সন্তান অবশ্যই জন্মাবে এবং রাজত্ব করবে - নাহলে ঐ অভিশাপ খাটবে না। সামনেই আছে মন্বান্তরের যোগ, দেশের অধিকাংশ জায়গা জনশূন্য হয়ে পড়বে। মানুষ মারা যাবে অগুণতি। তার পরেই দেশে রাজ্যশাসনেও পরিবর্তন হবে। (হলোও তাই - চল্লিশের দশকের মহামারী, তার পরেই দেশের স্বাধীনতা লাভ! অবশ্য তখন বিজয় প্রতাপ জীবিত ছিলেন না।)

মা মহামায়া সেই বিপদের দিনে তোমার এবং তোমার বংশধরদের সহায় হবেন। তাঁর আশীর্বাদে তোমার বংশধররা ঐ বিপদের সময় রক্ষা পাবেন, সগৌরবে রাজত্বও করবেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই উত্তরাধিকারী রূপে পুরুষ সন্তানও থাকবে। অভিশাপের আড়ালে আশীর্বাদ করে গেছেন মা মহামায়া তোমায়। তুমি ভেঙে পড়ো না, চিন্তা করো না। মায়ের আর কি লীলা আছে জানি না, তবে যা হবে তোমার মঙ্গলই হবে।


প্রথম পুরুষ


এখানে জেনে রাখা দরকার, সেই বিজয় প্রতাপ দত্ত ও তাঁর পূর্বপুরুষরা সকলেই ছিলেন শৈব, মানে পৌরুষের পূজারী। তাঁর গৃহে লক্ষ্মীপূজারও চল ছিল না তখন! তাঁরা সিদ্ধিদাতা গণেশের পূজা করতেন ধনলাভের জন্য! পরে অবশ্য স্ত্রীর বারংবার অনুরোধে, তাঁকে গৃহেই লক্ষ্মীপূজা করার অনুমতি দেন বিজয় প্রতাপ। তাঁর জন্য এই বাড়িতেই একটা ঠাকুর ঘরও বানিয়ে দেন। কিন্তু তা' সত্ত্বেও, নিজে কখনও সেই ঠাকুর ঘরে পাও রাখেন নি তিনি।

পরে তাঁকে আবার স্ত্রীকে অনুমতি দিতে হয়েছিলো - একমাত্র পুত্রের পড়াশুনায় উন্নতি কামনায় গৃহে সরস্বতী পূজার জন্যও। সেই একই ভূমিকা ছিল তাঁর এখানেও - স্ত্রীকে পূজার অনুমতিও দিলেন, পূজার ব্যবস্থাও করিয়ে দিলেন সব, কিন্তু নিজে কখনও ফিরেও তাকান নি তিনি, গৃহিণীর সেই ঠাকুর ঘর পানে। তাঁর বাড়িতেই শিবমন্দির ছিল, তার বিশাল চাতালে বসেই, গৃহকর্তারূপে বাড়ির যাবতীয় আভ্যন্তরীণ কাজকর্ম চালাতেন তিনি।

যাই হোক, আমাদের এই কাহিনী যাঁকে ঘিরে সেই দূর্গাপ্রসাদের জন্ম নিয়ে একটি কাহিনী শোনা যায়। তাঁর বাবা মহেন্দ্র প্রতাপ দত্ত ছিলেন ঐ জমিদার বিজয় প্রতাপ দত্তের একমাত্র পুত্র এবং একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। পূর্বপুরুষদের মত তিনিও ছিলেন একদার। কিন্তু বিবাহিত জীবনে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা ছিলেন নিঃসন্তান। তাই, শেষপর্যন্ত তাঁদের সেই কুলগুরুর বিচার ও পরামর্শ অনুযায়ী, বিজয় প্রতাপ বংশরক্ষার্থে তাঁর বাড়িতেই একটা বিরাট ঠাকুরদালান বানিয়ে, তাঁদের বংশে প্রথম দূর্গাপুজার প্রচলন করলেন।


সেই পূজান্তে নাকি পুরোহিত হিসাবে তাঁদের কুলগুরু, যজমানের মঙ্গলকামনার্থে দেবীর কাছে একটি পুত্র সন্তানের প্রার্থনা করেন। মা মহামায়ার সেই পূজায় স্ত্রী পুত্র পুত্রবধূ সহ জমিদার বিজয় প্রতাপ স্বয়ং সেই মণ্ডপে দাঁড়িয়ে করজোরে নতমস্তকে মাকে পুষ্পাঞ্জলিও দেন। শোনা যায় যে, সেই মা দূর্গার আশীর্বাদেই নাকি পরের বছর তাঁর জন্ম হয়, তাই ঠাকুরদা তাঁর নাম রেখেছিলেন দূর্গাপ্রসাদ। তিনিই বংশের প্রথম ব্যক্তি যাঁর নামে প্রতাপের জায়গায় প্রসাদ রাখা হয়েছিলো!


তাঁর ঠাকুরদা অর্থাৎ বিজয় প্রতাপ দত্ত, জীবনে সেই প্রথমবার কোন মায়ের কাছে বংশের ছেলের কারণে মাথা নত করেছিলেন - সেও মা মহামায়ার সামনে। ঐ বামনির অভিশাপ অনুযায়ী, এই কাজকে তার অভিশাপের সেই শাস্তিরূপে স্বীকার করতে তাই বোধ হয় তাঁর বিশেষ বাধে নি। এর কয়েক বছর পরই তাঁর দেহান্ত হয় এবং তাঁর জীবদ্দশায়, সেই বামনির অভিশাপকে স্মরণে রাখলে, ঐ একবারই তিনি মাথানত করেছিলেন কারোর মায়ের কাছে। অবশ্য একটা ভালো লাগা তাঁর মনেও ছিলো - মা মহামায়া কি কারও একার মা, তিনি কি তাঁরও মা নন?


দ্বিতীয় পুরুষ


বিজয় প্রতাপ নিজে এত তেজস্বী এবং ভয়ঙ্কর প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়েও, সেই বামনির অনুপযুক্ত কারণে দেওয়া ঐ অভিশাপের কোন বিরোধিতা করেন নি, সে তো আগেই বলেছি। কিন্তু তাঁর পুত্র মহেন্দ্র প্রতাপ নিজে শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তি হলেও, ঐ অভিশাপ এবং শাস্তির কথা সদা-স্মরণে রেখে, কোনো নারীর সামনে কোনো অবস্থাতেই মাথা নত করার ব্যাপারে ছিলেন - ভীষন রকম বিরোধী এবং একরোখা!


যাই হোক, তো ঐ দূর্গাপ্রসাদের একমাত্র ছেলে রাহুল, শৈশবে একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই মুহুর্তে নাতিকে নিয়ে বাড়িতে তখন একাই ছিলেন মহেন্দ্র প্রতাপ। স্ত্রীকে নিয়ে কোনো এক অনুষ্ঠান বাড়িতে গিয়েছিলেন দূর্গাপ্রসাদ সেইদিন। সম্ভবত কোনো কিছুর কামড়ে বা অন্য যে কোন কারণেই হোক, বিষক্রিয়া শুরু হয়েছিলো শিশু রাহুলের শরীরে। জমিদারের ডাকে বৈদ্য যিনি এসেছিলেন, তিনি তাকে দেখে পরামর্শ দেন - তখনই তাকে দুধ খাওয়াতে, ফোটানো দুধ নয় কাঁচা দুধ! তবেই নাকি তাঁর ওষুধে কাজ দেবে।


বিকেলবেলা সেই মুহুর্তে সকলের বাড়ির গরুই গেছে মাঠে বিচরণে, দুধ পাওয়া গেল না। গরুর পাল ফিরতে দেরী আছে। এখন মাঠে গিয়েও যদি দোহন করে গরুর দুধ আনানোও হয়, তাতেও কিছুটা সময় তো লাগবেই। কিন্তু বৈদ্য ওদিকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন যত দ্রুত সম্ভব দুধের ব্যবস্থা করতে। নতুবা রাহুলের প্রাণ সংশয় হতেই পারে।

নিরুপায় মহেন্দ্র প্রতাপের সামনে তখন একটাই পথ খোলা ছিলো - তাঁর বাড়িতেই তখন উপস্থিত পরিচারিকাটিকে অনুরোধ করা, রাহুলকে তারই স্তন্যপান করাতে। কারণ সে কয়েকমাস আগেই সন্তান প্রসব করেছিলো, তিনি জানতেন। সে তার নিজের বাচ্চাকে তখন মাতৃদুগ্ধই পান করাতো, তা'ও তিনি জানতেন। কিন্তু, তাঁর সেই অহংকার, মিথ্যা আত্মমর্যাদা আর সেই বামনির অভিশাপ সম্পর্কে আগাম সতর্কতার জন্য, তিনি কিছুতেই তাকে গিয়ে সে'কথা বলতে পারছিলেন না!


বিষয়টি জানতে পেরে তাই সেই বৈদ্য নিজে ঐ পরিচারিকাটিকে গিয়ে বললেন, রাহুলের সেই অসুস্থ হয়ে পড়া এবং তাকে বাঁচানোর জন্য তখনই তাকে স্তন্যপান করানোর কথা। তাঁর সব কথা শুনে পরিচারিকাটি তাঁকে যা বললো, তা'তে বৈদ্য মহাশয়ের আর বিশেষ কিছু বলার কোনো জায়গা রইলো না।


পরিচারিকাটি সব শুনে তাঁকে উত্তর দিলো - দেখুন আমার নিজের বাচ্চা সবে ছয় মাসের। সে এখনও শুধু আমার এই বুকের দুধই খায়। এখন রাহুলবাবাকে বাঁচাবার জন্য, তাকে আমার বুকের দুধ খাওয়াতে গিয়ে যদি ঐ বিষের প্রভাব পড়ে আমার শরীরে, আমার বাচ্চার দায়িত্ব কে নেবে তখন? আমার এত সামর্থ্য নেই যে আপনাকে দক্ষিণা দিয়ে নিজের বা আমার বাচ্ছার চিকিৎসা করাতে পারবো, তাহলে? ঐ বিষের কারণে তো আমার দুধের শিশুটা মারা যাবে!


অবশেষে, তখন বৈদ্যের পরামর্শে আর রাহুলের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে দেখে, মহেন্দ্র প্রতাপ তাঁর গৃহপরিচারিকা সেই মায়ের সামনে অবনত শির হতে বাধ্য হলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরই সেই অনুরোধে, নিজের বুকের দুধ খাইয়ে সেই মুহুর্তে রাহুলের প্রাণ বাঁচান ঐ পরিচারিকা। তার পরেও দীর্ঘদিন ধরে রাহুল নিয়মিত ওষুধ সেবন ও পথ্য মেনে চলার পরই সুস্থ হতে পেরেছিলো।


মহেন্দ্র প্রতাপ অবশ্য অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। ঐ পরিচারিকার সেই পরম উপকারের সম্মান দিয়েছিলেন তিনি। নিজের জমিদারীর ভিতরেই একটা বাস্তুজমিতে একটা ছোট বাড়ি তৈরী করিয়েছিলেন। পরে, কোনো রকম ঢাক ঢোল না পিটিয়ে সেটাই তাকে দান করেছিলেন মহেন্দ্র প্রতাপ! তিনি ঐ পরিচারিকাকে বাড়িতে ডেকে তার হাতে দলিলের কাগজপত্র তুলে দিয়ে, বিনা আড়ম্বরেই সেই দানের কাজ সেরেছিলেন।


তৃতীয় পুরুষ


দূর্গাপ্রসাদ দত্ত খুব ভালো মতই জানেন তাঁর নিজের বংশের ইতিহাস আর ঐ অভিশাপের কথাও। তাই নিজে নারী বিদ্বেষী বা বিরোধী না হলেও তাদের সংস্রব তিনি এড়িয়েই চলেন। রাহুলের বিয়ের সময়েই শেষ কোন মহিলার সঙ্গে কথোপকথনে গিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া বাইরের কোন মহিলার সম্মুখীন হনই না তিনি কখনও।

অবশ্য, সেই সব দিক থেকে কোনও অসুবিধা না থাকলেও, বাড়িতে অশান্তির কিছু কমতি ছিল না তাঁরও। এবং এসবের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে আর কেউ না স্বয়ং রাহুল, তাঁর পুত্র। সে নিজে সরকারী উচ্চপদে চাকুরীরত, তাঁর বৌমা রমাও যথেষ্ট সুন্দরী, শিক্ষিতা এবং গৃহকর্মে নিপুণা।

তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে, তাদের বিয়েও দিয়েছিলেন তাদেরই নিজেদের পছন্দে, তবুও কি নিয়ে যে তাদের অশান্তি জানা নেই তাঁর। এখনও তাদের কোনও সন্তান সন্ততি হয় নি, বিয়ের প্রায় দশ বারো বছর পরেও! এটাও তাঁর মনে একটা মৃদু অশান্তির কারণ।

এমন সময় একদিন ঘটলো এক মারাত্মক দুর্ঘটনা। অফিস থেকে ফেরার পথে রাহুল মারা গেলো গাড়ির ধাক্কায়। বাড়িতে ক্রন্দন রোল, রমা হতভম্ব হয়ে গেছে যেন ঐ ঘটনার আকস্মিকতায়। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সব মিটলো যেদিন, সেই দিনের ঘটনা - দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর, শোকস্তব্ধ সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে তখন বসে ছিলো বাড়িতে।

এমন সময় সাদা থান পরিহিতা একজন যুবতী এসে ঢুকলো বাড়িতে, সঙ্গে দশ বারো বছরের, একটি সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা কিশোর! সবার সামনেই ছেলেটিকে দাঁড় করিয়ে রেখে মহিলাটি সটান ঢুকে গেলো গিয়ে রাহুলের শোবার ঘরে।

আর বেরিয়ে এলো একহাতে একটা ফাইল, আর অন্যহাতে চুলের মুঠি ধরে রমাকে টানতে টানতে! সবাই তাদের দেখে চমকে ওঠায়, সেই মহিলাটি বললো - ভয় পাবেন না, আপনাদের কূলবধূকে না, একজন দাগী আসামীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। আমি অর্পিতা দত্ত, সিনিয়র ইন্সপেক্টর, ক্রাইম ব্রাঞ্চ।


রাহুলের খুনের তদন্তটা আমিই করছি। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন - খুন। কোনো দুর্ঘটনা নয়, তাকে খুন করা হয়েছে। যে গাড়ি ধাক্কা মেরেছিলো রাহুলকে, তার চালক আর কেউ নয়, আপনাদের এই বৌমারই প্রেমিক, সমীর। ধরা পড়ার পর সব সত্যি উগলে দিয়েছে সে। এখন তো আমাদের কব্জাতেই আছে সে। এবার এই এনার ভালো করে আঁশ ছাড়ানোর পালা।


- মঞ্জুদি, বলে তিনি জোরে ডাক দিতেই, দু'জন মহিলা পুলিশকর্মী এসে দু'হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে রমাকে তুললো তাদের জিপে। মাথা হেঁট করে তাদের সঙ্গে চলে গেলো রমা। অর্পিতা তাঁদের অফিসে চলে যেতে বলতেই, গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো তারা। অর্পিতার নিজের জন্য অন্য একটা গাড়ি রয়ে গেলো সেখানে।

অর্পিতা এবার সেই ছেলেটিকে নিয়ে দূর্গাপ্রসাদের সামনে এসে বললো - বাবা, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনার আসল কূলবধূ উনি নন যাকে তুলে নিয়ে গেলো পুলিশ। আপনার ছেলের আসল বিধবা আমি, আর এই আপনার পৌত্র কুণাল। সরকারের চোখে, কারোর স্ত্রী হিসাবে কোনো মহিলার পরিচয়ের জন্য, সামাজিক বিয়ের কোন মূল্য নেই। সেখানে রেজিস্ট্রী ম্যারেজ সার্টিফিকেটই সব, আর আপনার ছেলেও সেটা জানতো।


এত কিছু ঘটে যাবার পর, এখন আপনাদের কাছে আর কোনো কিছুই গোপন করার কোন অর্থ হয় না। কারণ, আপনাদের বংশের যে সম্মান রক্ষার জন্য এত প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলো রাহুল, সেই সম্মান যথেষ্টই লুন্ঠিত হয়েছে আপনার ঐ বৌমা রমার কারণে, আর যে এতদিন ধরে সেই ইজ্জত রক্ষার দায় মাথায় নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিলো সেও যখন নেই, তো আর লুকিয়ে কি লাভ?


তার ওপর আবার তদন্তের কারণে যখন আসতেই হলো এখানে, ভাবলাম নিজের পরিচয়টা আপনাদের জানিয়ে দিয়েই যাই। আর আমাদের ছেলেও তার নিজের চোখে অন্তত দেখুক একবার, তার বাবা তাকে যেমন মিথ্যা কথা বলতে শেখায় নি, নিজেও তাকে কখনও কোনও মিথ্যা কথা বলেনি - তারা সাবেকী জমিদার বংশেরই লোক।

আপনার ছেলের ঘরের লকার থেকে, আপনাদের সামনেই এইমাত্র যে বের করে আনলাম এই ফাইলটা, এখানেই রাখা আছে - আমাদের ম্যারেজ রেজিস্ট্রী সার্টিফিকেট, কুণালের বার্থ সার্টিফিকেট, লাইফ ইনসিওরেন্সের দলিল আর আমাদের তিনজনের পাসপোর্টও। আর আমাদের বিয়ের এবং পরে কুণালকে নিয়ে তোলা অসংখ্য ছবির গোটা তিনেক অ্যালবামও আছে, দেখুন। দেখলে নিজেরাই সব বুঝতে পারবেন।


দূর্গাপ্রসাদ ও তাঁর স্ত্রী বিহ্বল চোখে তাদের পানে চেয়ে ফাইলটা নিলেন হাত পেতে। দূর্গাপ্রসাদ সেই কাগজপত্রগুলোয় চোখ বোলাতে লাগলেন, আর ছেলের ছবির অ্যালবাম খুলে বসলেন তার মা!

বড় অদ্ভুত এক পরিস্থিতি আজ তাঁদের সামনে - একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর, তার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়াদির সব কাজ শেষ হলো আজ। এত দিন যাকে বৌমা বলে জানতেন, সেই দেখা গেলো তাঁদের ছেলের খুনী। আর সামনে এখন দাঁড়িয়ে তাঁদের যে আসল পুত্রবধূ এবং বংশধর পৌত্র, তাদের আগে দেখেনই নি তাঁরা কোনোদিন!


দূর্গাপ্রসাদ কাগজপত্রগুলো দেখে, অর্পিতার হাতে ফেরত দিতে দিতে বললেন - আমাদের কাউকেই কিছু জানাও নি এতদিন তোমরা, বুঝতে পারলাম না কেন? আমাদের কাছে সব গোপন করার তোমাদের কারণ কি ছিল মা? আর এখন বললেই বা কেন, তাও স্পষ্ট হল না ঠিক। সে কি কেবল ছেলের উত্তরাধিকার চাইবে বলে?

অর্পিতা মৃদু হেসে বলে - আমাকে আপনি কোনো দিক থেকেই তো চেনেন না। তাই আমার আসল পরিচয়টাই আগে দিই। আপনার বাবা, স্বর্গীয় মহেন্দ্র প্রতাপ দত্তের আবেদনে সাড়া দিয়ে, তাঁর নাতি, মানে আপনার ছেলে রাহুলের জীবন রক্ষা করেছিলেন আমার


মা - শৈশবে বিষক্রিয়ার কারণে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো যেদিন, তখন তাকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে।

মা জানতেন, এর ফলে রাহুলের শরীরে ঢুকেছে যে বিষ তার প্রভাব তাঁর শরীরেও পড়বে। তাঁর নিজের কোলেও ছিলো তখন এক ছয় মাসের শিশু, আমার ভাই। তবু রাহুলকে বাঁচিয়েছিলেন মা, কারণ তাঁর সামনে অবনত হয়ে তার প্রাণ রক্ষার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন স্বয়ং আপনার বাবা।


কিন্তু আপনি বোধ হয় আজও জানেনই না, ঐ বিষক্রিয়ার কারণেই প্রথমে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা। আর তাঁর বুকের দুধ খাওয়ার অপরাধে, পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় আমার সেই দুগ্ধপোষ্য শিশু ভাই। মাও বাঁচেন নি আর বেশি দিন, কয়েকটা বছর ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচার চেষ্টা করে, তিনিও ব্যর্থ হয়ে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আমি তখন ক্লাস ফোরের ছাত্রী, যখন মাতৃহীনা হলাম।


আপনি খবর নিয়েছিলেন কখনও - আপনার একমাত্র পুত্রকে বাঁচাতে গিয়ে, আর এক মা আর তার সেই শিশু সন্তান মারা যাবার পর, তার পরিবারের কি হাল হয়েছিলো? বেঁচে রইলো কি করে তার অন্য সন্তানটি? না, কোনও খবর নেন নি আপনি কখনও। আর আজ সেই আপনিই কিনা উত্তরাধিকারের লোভ দেখাচ্ছেন আমায়?

আমার মা আপনাদের গৃহপরিচারিকা ছিল, একটু স্থূল বুদ্ধিসম্পন্ন আমার বাবা কাজ করতো বাইরে - একা, সদ্য কৈশোরে পা রাখা তাদের একমাত্র মেয়েকে বাঁচাবার জন্য, তার দেখভাল করার জন্য কি করেছেন আপনারা, যে আপনার বংশের উত্তরাধিকার আমি বা আমার সন্তান কখনও নিতে যাবো? তাকে কি কখনও কোনও দান করা যায় - যার কাছে আপনারা আগে থেকেই ঋণী হয়ে আছেন?


আপনারা শাপগ্রস্ত, তাই হয়তো ভীরু। কিন্তু রাহুল আপনাদের মত ছিলো না কখনও। সে নিজের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে আশৈশব সচেতন ছিল। সেই শুধু আমার মায়ের অসুস্থতার সময় নিয়মিত তাঁর কাছে গিয়ে বসতো। তাঁর বুকের দুধ তো খেয়েছিলো সে, তাই ঋণটা বোধ হয় স্বীকার করতো।


মা চলে যাবার দিন, সে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কথা দিয়েছিলো, আমার হাত সে সারাজীবন ধরে রাখবে। তার কথার খেলাপ করেনি সে। আমার পড়াশুনা তখন নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে যেতো, কিন্তু হয়নি তার জন্যই। আমার বই খাতার অভাব পূরণ করে দিতো সে - তার নিজের টিফিনের পয়সা থেকে। টিউটরের কাছে শিখে আসা পড়াটা আমাকে পড়িয়ে দিতো সে রোজ।


আমি বাড়িতে টিফিন বানিয়ে ওকে খাওয়াতাম, ও সেই বেঁচে যাওয়া টাকায় আমায় বই খাতা পেন কিনে দিতো। সেই ছোট থেকেই তাকে আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে এসেছি, আর সে আমায়। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর, আমি পুলিশের এস আই পোস্টে চাকরিটা পাই। স্কুলের স্টেট লেভেল প্রতিযোগিতায়, খেলা ধূলায় আমার পারদর্শিতা দেখে, আগেই মুগ্ধ হয়েছিলেন পুলিশকর্তারা। তাই আমার খুব একটা অসুবিধা হয়নি ঐ চাকরীর জন্য সিলেক্ট হতে।


রাহুল আমায় তার পরেও পড়াশুনা বন্ধ করতে দেয় নি। ওর ভরসা আর সহায়তাতেই বিএ পাস করেছিলাম আমি। ডব্লুবিসিএস দেবার স্বপ্ন আমি কখনও দেখিনি, কিন্তু তার ওটা লক্ষ্য ছিল। আর সেটা সে পেয়েও দেখিয়েছিলো। মাধ্যমিক পাস করার আগেই বাবাও চলে গেলো। আমি তখন সম্পূর্ণ একা, শুধু রাহলকে পাশে পেয়েই নিশ্চিন্তে বেঁচেছিলাম।


রাহুল আপনার বাবাকে বলেছিলো আমার কথা, আমায় বিয়ে করার ইচ্ছাও, কিন্তু জানিনা কেন তিনি মানতে রাজী হন নি। বাবা হয়েও নিজের ছেলের জীবনে কোনোদিনই বিশেষ কিছু ভূমিকা ছিলো না আপনার - সে হয়তো আপনার বাবার জন্যই। কিন্তু রাহুলের জীবনে তার বাবার ভূমিকার জায়গাটায় শুধু শূন্যস্থান রাখতে পারলেন? আপনি তখনও প্রকৃত দায়িত্ব নিতে অপারগ ছিলেন, আর আপনার বাবা গত হবার পরেও তা' শেখেন নি।

নতুবা, জানা নেই শোনা নেই, হঠাৎ একটা মেয়ে এসে আপনাকে জানালো আপনার ছেলেকে ভালোবেসে সে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে, তাকে না পেলে, নাকি আত্মহত্যা করবে সে, আর আপনিও তাকে পুত্রবধূ করবেন বলে ঢাক পিটিয়ে দিলেন? একবার নিজের ছেলেকে অন্তত জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচাই করে নিতে পারতেন ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে? তা' করলেন না, সেই মেয়েও তার মনগড়া প্রেম কাহিনী শুনিয়ে গেলো আপনাকে, আর আপনিও তার কথায় নেচে নিজের ছেলেকে সারপ্রাইজ দিতে গেলেন - কি না তার বিয়ে দিয়ে!


ঠাকুরদা রাজী হননি বলে, রাহুল আমাকে নিয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রী অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে রেখেই, তার কমপাল্সরী ইন্ডাকশন ট্রেনিংএ গিয়েছিলো। ঠিক ছিলো - ফিরে এসে আপনাকে সব জানিয়ে, হয় আমাদের বিয়েটা সামাজিকভাবে দিতে বলবে, না হয় বাড়ি ছেড়ে আমাদের কোয়ার্টারেই চলে যাবো আমরা।

এর মধ্যে আপনার পিতৃবিয়োগ হলো। আপনি ছেলের বিয়ের কথা মাথায় রেখে তড়িঘড়ি তাঁর বাৎসরিক ক্রিয়াকর্মও করে ফেললেন। আত্মীয় স্বজনকে কার্ড পাঠিয়ে নিমন্ত্রণও করে দিলেন, এমনকি বিয়ের লগ্ন পর্যন্ত স্থির করে নিলেন!


আচ্ছা আপনি কখনও এতটা উদ্যোগ নিয়ে হবু পুত্রবধূর পরিচয়টাও জানার চেষ্টা করেছিলেন? তার আত্মীয় স্বজন কারা, তাদের আসল কাজ কারবার কি, তারা কি করে, কোথায় থাকে এসব পরিষ্কার করে জানতে চেয়েছিলেন কখনও? যত দূর মনে হয় - তখন কেন, বোধ হয় আজও আপনি জানেন না তাদের নাড়ি নক্ষত্রও। বলতে পারেন, কোন মোহে পড়েছিলেন - এমন হঠকারী, এমন অপরিণত মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেবার সময়?


আপনার বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারের লোভটা তার ছিলো, আমার না। আর সেটা রাহুলেরও মোটেই অজানা ছিল না। চাকরি করার কারণে, আমি তো কলেজ যেতেই পারতাম না প্রায়, আর সে তখন দিনরাত হাত ধুয়ে পড়ে থাকতো রাহুলের পিছনে - বারংবার প্রত্যাখ্যানের পরেও।


কলেজে তার কাছে পাত্তা না পেয়ে, সে রাহুলকে পাবার জন্য অন্য পথ খুঁজছিলো। আর যখন জানতে পারলো চাকরি পেয়ে ট্রেনিংএ গেছে রাহুল, আপনার কাছে এসে নিজেকে তার প্রেমিকার পরিচয় দিয়ে, তাকে বিয়ে করতে চাইলো।


কলেজে তার রাহুলের পিছুপিছু ঘোরার কথা সবাই জানতো, তাই সেখানে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে, সবাই তো ওর প্রেম করার কথাই বলবে। আপনি হয়তো সেটাই করেছিলেন আর সম্ভবত এই জায়গাতেই আপনি ধোঁকা খেয়ে গিয়েছিলেন। রাহুলকে নিজে একবার জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো আপনার।


বোধ হয় আপনার বাবা যে রাহুলের পছন্দের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে রাজী হননি - এই খবরটা ছিলো আপনার কাছে। আর রমার কথা বিশ্বাস করে, ভাবলেন হয়তো ওই সেই মেয়ে যাকে রাহুল বিয়ে করতে চাইছে। হতে পারে, হয়তো তার জন্যই আপনি এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন! কারণটা যাই হোক না কেন, সিদ্ধান্তটা আপনার ভুল ছিলো।


ট্রেনিং এর সময় রাহুল উইকলী অফ ডে গুলোতে চলে আসতো আমার কাছে। আমরা লীগ্যালী তখন স্বামী স্ত্রী হওয়ায়, একসাথে থাকতে কোনও বাধাও ছিল না আমাদের। আপনার এই নাতি কুণালকে সেইসময়ই কনসীভ করেছিলাম আমি। ট্রেনিং শেষে ফিরে এসে সব থেকে বড় বিপদে পড়তে হলো রাহুলকে!

আপনার হঠকারী সিদ্ধান্তে, উৎসবমুখর আত্মীয় স্বজন ভর্তি বাড়িতে বংশের মান রাখতে, বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো তাকে। আমাকে আপনাদের বাড়িতে তখন চাইলেও নিয়ে আসার উপায় ছিলো না। কারণ প্রেগন্যান্সীতে ক্রিটিক্যাল কণ্ডিশনের কারণে, আমি তখন সম্পূর্ণরূপে বেড রেস্টে। নিরুপায় রাহুল সেদিন যা করতে বাধ্য হলো - তার জন্য না তো কখনও আপনাকে ক্ষমা করতে পেরেছে সে, না রমাকে।


রমার সাথে সহবাস তো দূর, একবিছানাতেও কখনও শোয়নি রাহুল। আপনাদের বংশধর দরকার ছিল কিন্তু রমার পক্ষে সেটা দেওয়া তাই কখনই সম্ভব ছিল না। তাই সে ইদানীং খুব জোরাজুরি করছিলো রাহুলকে। কিন্তু সে রাজী না হওয়ায়, তার এক্স-লাভার সমীরের সাহায্য নিয়ে স্যারোগেসীর কথা বলে তাকে ভয়ও দেখিয়েছিল। কিন্তু সে জানতো, তা' করলে সেই বিপদে পড়বে - ডি এন এ টেস্টে সব ধরা পড়ে যাবে! রাহুল তাকে সোজাসুজি অনুমতি দিচ্ছে না দেখে, তাকে ভয় দেখিয়ে রাজী করানোর পথ বেছে নেয় সে। তাই ঐ সমীরকে দিয়েই সে অ্যাক্সিডেন্ট করায় রাহুলের। কিন্তু ঐ দুর্ঘটনায় যে মারা যাবে রাহুল, এটা হয়তো ভাবতে পারে নি রমা।


রাহুল এই সন্দেহটা কিছুদিন ধরেই করছিলো। তাই এফআইআর করিয়েও রেখেছিলো থানায়, আর ঘরে সিক্রেট ক্যামেরাও বসিয়েছিলো। তাই সব প্রমাণ আমাদের কাছেই আছে। আপনার ঐ পুত্রবধূ রেহাই পাবে না - ফাঁসী থেকে যদি সে ভাগ্য জোরে কোনোভাবে বেঁচেও যায়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড তো তাকে পাইয়েই ছাড়বো আমি, কথা দিয়ে গেলাম।


এবার, আপনার উত্তরাধিকারের প্রশ্নের জবাবটা দিই। আমি নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণা। চাকরী করি, নিজের পৈতৃক বাড়ি আছে। তাছাড়াও কোয়ার্টারও পেয়ে যাবো চাইলেই এখন। আমার ছেলের ভবিষ্যতের জন্যও তার বাবা মা যা ব্যবস্থা করে রেখেছে, কখনও অন্য কোন লোকের কাছে গিয়ে নিজের পিতৃপরিচয় দেখিয়ে, অধিকার চেয়ে হাত পাততে হবে না তাকে।


সুতরাং, এই রইলো আপনার ছেলের ঘরের ঐ লকারের চাবি। ওখানেই রাখা আছে সমস্ত কাগজ পত্র, খুললেই দেখতে পাবেন - ওর সার্ভিস বুকের কপি, ওর সমস্ত সার্ভিস রেকর্ড সব ফাইলে রাখা আছে। ওর পি এফ এবং পেনশনের টাকার জন্য, আপনারা চাইলে এখন ওর অফিসে গিয়ে ডিম্যাণ্ড করুন।


তার যাবতীয় যা কিছু রক্ষিত ছিলো আমার কাছে, সব ওখানেই রাখা আছে - যার চাবি দিয়ে গেলাম আপনাদের। আর হ্যাঁ, তার স্ত্রী হবার দাবীটাও আজ এখানেই ছেড়ে যাচ্ছি। আমরা দুই মা ছেলে আমাদের মত করে আরামেই বাঁচতে পারবো - কারও কোনো সহানুভূতি, সাহায্য বা কোনো দানের আমরা বিন্দুমাত্র মুখাপেক্ষী নই।

আসি বাবা, চলো কুণাল। - বলে ছেলের হাতটা ধরে অর্পিতা ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত হতেই, দূর্গাপ্রসাদ এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। বললেন - আমি এই বংশের অভিশপ্ত পুরুষদের শেষ জন, মানে তৃতীয় পুরুষ। ভেবেছিলাম বুঝি, বামনির শাস্তিটা বোধ হয় আমাকে আর পেতে হবেনা, অভিশাপটা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে গিয়েছি আমি।


কিন্তু না, নিজেরই পুত্রবধূ অথচ তাকেই আজ অপরিচিতা, অন্যের মায়ের রূপে সামনে পেয়ে নত হচ্ছি, আমার ভুলের জন্য তোমার থেকেই ক্ষমা চাইছি মা। নিজের বোকামির জন্য আজ সবথেকে বড় ক্ষতি তো আমারই হয়ে গেছে। জানি না রাহুল আমায় ক্ষমা করতে পারতো কিনা। কিন্তু... আমার এই বাড়িতে গৃহলক্ষ্মী করে তোমায় আগেই আনা উচিত ছিল আমার।


দেরী হয়তো হলো, কিন্তু তবু আজ এই গৃহে তোমার আসা তো হলো! এ গৃহ তোমারই মা, তুমি তোমার গৃহে - সগর্বে, নিজের পরিচয়ে, নিজের অধিকারে, সসম্মানে ফিরে এসো মা। আমি স্বয়ং তোমায় বরণ করে পুত্রবধূরূপে আমাদের ঘরে তুলবো। এসো দাদুভাই - বলে দূর্গাপ্রসাদ কোলে তুলে নিলেন কুণালকে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama