Manik Goswami

Romance Tragedy

4.5  

Manik Goswami

Romance Tragedy

সেই তো শেষ

সেই তো শেষ

59 mins
659


বৃষ্টি পড়ছিলো অঝোর ধারায় | দৌড়োতে দৌড়োতে, মাথার ওপর একহাত দিয়ে বইখাতার ব্যাগটাকে তুলে অন্যহাতে মনীশের হাতটা ধরে একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো প্রতীক্ষা |

 - ‘উঃ বাব্বা | যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, একেবারে ভিজিয়ে ছাড়লো' | হাতের রুমালটা দিয়ে মাথা আর মুখ মুছতে মুছতে বলে উঠলো প্রতীক্ষা |

 'তবু মন্দের ভালো, এই গাছটা ছিল | তাই একটু আশ্রয় পাওয়া গেলো | জোরালো বৃষ্টিটা আর সরাসরি গায়ে লাগছে না | দু এক ফোঁটা গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে গায়ে লাগছে ঠিকই, তবুও অনেকটাই বাঁচোয়া' - মনীশের গলায় একটু স্বস্তির ছোঁয়া |

 - 'আজকের দিনটা ভালোই কাটলো, কি বলো মনীশ' বলে মনীশের উত্তরের অপেক্ষায় রইলো প্রতীক্ষা | মনীশ বলতে শুরু করলো -'অবশ্যই, কেমন সুন্দর ফুটফুটে রোদ দিয়ে দিনটা শুরু হয়েছিল, বিকেল হতেই বৃষ্টি' |

-' বেশ কিছুদিন পর আমরা আজকে একটু ঘুরে বেড়াতে চেয়েছিলাম, বাঁধ সাধলো বৃষ্টিটা'| প্রতীক্ষার গলায় একটু আক্ষেপের সুর লেগেছে বুঝতে পেরেই মনীশ বলে উঠলো, -'যাই বলো, আজ কিন্তু আমরা অনেক ঘুরেছি | প্রায় সারাদিনটাই কেটে গেলো ঘুরতে ঘুরতে | এখন ঘরে ফেরার সময় বৃষ্টির মধ্যে পড়লাম | এবার ঘরে ফিরে কি জবাব দেবে সেটাই তৈরী করে রাখো নিজের মনের মধ্যে | না হলে বিপদে পড়তে হতে পারে |

 -'সে কথাটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছো | বৃষ্টি যদি এইভাবেই চলতে থাকে, তাহলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে ঘরে ফিরতে | প্রশ্নের বোঝাটাও তো বাড়তে থাকবে | সেই কখন কলেজ যাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়েছি | তোমার সঙ্গে দেখা না হলে তো এতক্ষনে বাড়ি পৌঁছেই যেতাম | অবশ্য, দেখা না হলে কথাটা বলছি কেন | যে ভাবে তুমি আমাকে অনুসরণ করে একই বাসে এসে উঠলে, তাতে একটু হলেও আমি অবাক হয়ে গেছিলাম' | প্রতীক্ষা বলেই চলেছে | ' আমাদের দেখা করার কথা ছিল ঠিকই, কিন্তু তুমি যে এভাবে চলে আসবে সেটা আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি' |

 'আমি যখন কথা দিয়েছিলাম যে আমি আসবো - আমি অবশ্যই আসবো | কিন্তু মাঠে ময়দানে দেখা করার চেয়ে আমি বাসটাকেই বেছে নিয়েছিলাম এই কারণে যে, আমার মনে হয়েছিল এর মধ্যে একটা নতুনত্ব আছে | তোমাকে একটু চমক দেয়ার জন্য যে আমি এই পন্থা নিয়ে ছিলাম সেটা বলাই বাহুল্য | তাছাড়া তোমার কাছাকাছি বেশ কিছুক্ষন থাকতে পারবো, সেটাও মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিলো বই কি'| মনীশের অকপট স্বীকারোক্তি |

 'আচ্ছা, বেশিক্ষন থাকতে পারবো, নাকি বেশিক্ষন আমার ছোঁয়া পাবার আশায় একেবারে আমার গাঁ ঘেসে দাঁড়িয়েছিলে' | প্রতীক্ষার কটুক্তি |

 'তা হয়তো হবে' - মনীশ মেনেই নিলো কথাটিকে |

 'হয়তো বোলো না, সেটাই হয়েছে, সেটাই তোমার ইচ্ছা ছিল' | প্রতীক্ষার গলায় একটু জোরেই শোনালো কথাটা | এইভাবে বলাটা ঠিক হয়নি ভেবেই হয়তো আবার বলে উঠলো - 'অবশ্য ভালোই হয়েছে | তুমি সাথে থাকায় আমার নিজের মধ্যেও কেমন একটা সাহস, একটা ভালোলাগা ভালোলাগা ভাবও কাজ করছিলো |

প্রতীক্ষার মুখে এই খুশি খুশি ভাব মাখানো কথাটা মনীশেরও ভালো লাগলো | বললো, 'আসলে যত বেশিক্ষন তোমার সাথে থাকতে পারি, সেই ইচ্ছেটা মনের মধ্যে নিয়েই, বলতে পারো একটু আশা নিয়েই এসেছিলাম | তোমার সম্মতিতে মনের ভেতরটা কেমন যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল | তাই তো বাস থেকে নেমেই তোমার হাতটা ধরে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিলাম | অনেক্ষন হেঁটেছি, কি বলো | অনেক কথা তো হলো দুজনের | এটাই কি কম পাওয়া নাকি' |

'সে তো হবেই, আমার বাড়ির হাঁড়ির খবরটা নেওয়ার তো তোমার খুবই দরকার ছিল | বাবা কেমন মানুষ, অযথা রাগারাগি করেন কিনা | আর মা, - মা তার মেয়েকে কি চোখে দেখে - এইসব কথা জেনে তোমার কি হবে | তবুও তুমি এইসব কথাই জিজ্ঞাসা করেছো তোমার অনিসন্ধিৎসু মনকে শান্ত করার জন্য | আমিও কি পারতাম না তোমাকে এই ধরণের কথা জিজ্ঞাসা করতে | কিন্তু করিনি, কেন জানো ? আমার অতশত জেনে কি হবে | তোমাকে, শুধু তোমাকে জানতে পারলেই তো হবে, তাই' | একটানা কথাগুলো বলে প্রতীক্ষা চেয়ে রইলো মনীশের মুখের দিকে | যেন কোনো কথা এবার সে মনীশের মুখ থেকে শুনতে চায় | হয়তো কোনো রসিকতা ভরা জবাব আশা করেছিল, কিন্তু যখন বুঝতে পারলো মনীশ প্রত্যুত্তরে কিছু বলবে না তখন নিজেই আবার বলতে শুরু করলো -' আমার অত আগ্রহ নেই যে তোমার বাড়ির লোকেরা সকলে কে কেমন জানতে যাবো | আমি চাই আমরা দুজন দুজনকে যেন ভালোভাবে জানতে পারি | তুমি যদি আমার মনের ভেতরটা জানতে চাও বা আমি যদি তোমার মনের ভেতরটা জানতে চাই তবে আমাদের আরো বেশি বেশি করে কথা বলতে হবে | একসাথে আরো বেশি সময় কাটাতে হবে | আরো কাছে আসতে হবে , আরো নিবিড়ে আসতে হবে' |

'ও তাই, একে অন্যকে জানতে গেলে আরো নিবিড় হতে হবে' - মনীশ যেন কথাবলার একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলো | বললো, 'এস তাহলে, আরো কাছে এস, এস আরো নিবিড় হই' |

কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও সজোরে একটা বজ্রপাত হলো | কড় কড় কড়াৎ | শব্দের ধাক্কায় ভয় পেয়ে প্রতীক্ষা জড়িয়ে ধরলো মনীশকে | সারা শরীর বেয়ে একটা শিহরণ জেগে গেলো মনীশের | ভালোবাসার হাতটাকে প্রতীক্ষার মাথার ওপর আসতে আসতে বোলাতে বোলাতে বললো, 'অত ভয় পাওয়ার কি আছে | আমি তো আছিই তোমার সাথে' | মনটা কিন্তু বলে উঠলো, থাকো না এই ভাবে জড়িয়ে ধরে | জন্ম জন্মান্তর ধরে আমাকে তুমি এইভাবেই জড়িয়ে ধরে থাকো | তোমার মিষ্টি ছোঁয়ায় যদি এইরকম শিহরণ জাগে আমার মধ্যে, আমি যদি রোমাঞ্চিত হই, তাহলে এ ছোঁয়া আমি সর্বদা পেতে চাই | প্রতীক্ষায় ভাবতে থাকলো, দাও না এভাবে আমার মাথার ওপর তোমার ভরসার হাত বুলিয়ে | তোমার হাতের স্নিগ্ধ পরশ থাক না আমার মাথার ওপর সারা জীবন ধরে | তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে আমি আশ্বস্ত হতে চাই | রাখবে তো সারা জীবন তোমার ছোঁয়া দিয়ে আমাকে ভরিয়ে | ভগবান নিশ্চয়ই চাইছেন যে আমরা দুজন আরো কাছে আসি | তাই হয়তো এই ভয়াল বজ্রপাত | আমার ভয় কি আমার মনের আশংকাকেই ব্যক্ত করে তুলেছে | পাছে মনীশ হারিয়ে না যায় আমার জীবন থেকে তাই কি ভগবান বললেন যে জড়িয়ে থাক, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখ মনীশকে তোর জীবনের সঙ্গে' | প্রতীক্ষা ভেবেই চলেছে | 'যদি আমি মনীশকে এইভাবেই সারাজীবন জড়িয়ে ধরে থাকতে পারি, তবে আমি যেমন একটা নির্ভরতা খুঁজে পাবো তেমনই আমি আমার মনের মানুষটিকেও দুহাতে আগলে রাখতে পারবো’ |

 মনীশের মনেও নানা ধরণের আশা নিরাশার ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে | 'এইভাবেই আমাকে ধরে রেখো | আমি যেন পথভ্রষ্ট না হই | প্রতীক্ষাকে আমি যেন আমার সারা জীবনের সঙ্গী হিসেবে পেতে পারি | সমাজের বিধিনিষেধের উর্ধে উঠে আমি যেন প্রতীক্ষাকে ভরসার বার্তা দিয়ে আশ্বস্ত রাখতে পারি | এই ভয় পাওয়া থেকেই শুরু হোক না আমাদের ভয় ভাঙানোর অধ্যায় | সমাজের ভয়, লোকলজ্জার ভয়, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানসিক ভাবে হীনমন্যতার ভয়, কটু সমালোচনার ভয়, প্রতিবেশীর কুমন্তব্যের ভয়, বাঁকা চোখের তির্যক দৃষ্টির ভয়, গর্হিত কাজ করে ফেলা আসামির শাস্তি পাবার ভয় | আর নয় | আজ এসেছে সময় | ভয়কে করতেই হবে জয় | কথায় বলে না, যে ভয় পেয়েছে সে আসলে মরেই গেছে | ভয় পেলে তো মরতেই হবে | জীবন যুদ্ধ থেকে সরে আসতেই হবে | কিন্তু এ সময়কাল তো ভয় পাবার নয় - ভয়কে জয় করার সময় | আমাকে ধরে থাকো এইভাবে - দু বাহু বাড়ায়ে | ধরে থাকো আমায় জড়ায়ে | আমি থাকবো তোমার ভরসার আশ্বাস নিয়ে তোমারই সংগে দাঁড়ায়ে’ |

কতক্ষন এই ভয়ের আবেশটা ছিল জানেনা দুজনেই | হঠাৎ প্রতীক্ষার মনে হলো, 'এই বৃষ্টিটা একটু ধরেছে মনে হয়, এবার তো বাড়ি ফিরতে হবে' |

 'ধরেছে কি গো, একেবারে বন্ধই তো হয়ে গেছে | চারিদিক অন্ধকার হয়ে আছে, সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ |এবার তো সত্যিই ঘরে ফেরা দরকার | চলো এগোই' বলে মনীশ এগিয়ে যেতেই প্রতীক্ষাও পিছু ধরলো |

 'বাড়ি গিয়ে কি বলবে, যদি জিজ্ঞেস করে এতো দেরি হলো কেন' - প্রতীক্ষার প্রশ্ন মনীশকে |

সহজ ভাবেই মনীশ জবাব দিলো, 'কেন ? বলবো প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছিল - সে তো অনেক সময়ের ব্যাপার - তার ওপর বৃষ্টি নেমে গেলো, তাই দেরি হয়ে গেলো '|

 'হ্যাঁ, তোমরা তো বিজ্ঞানের ছাত্র, তাই তোমাদের কাছে বিভিন্নভাবে ঘরের লোককে বুঝিয়ে দেওয়া খুব সহজ ব্যাপার' - প্রতীক্ষা বলে উঠলো | 'কিন্তু আমাদের মতো কলা বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদের ঘরের লোককে কলা দেখিয়ে ভুল বোঝানো তো সম্ভব নয়, তাই হয়তো তারা সন্দেহই করতে থাকবে আমাকে' |

'দেখো প্রতীক্ষা, তোমার কথার মধ্যে কলা বিভাগে পড়ার জন্য একটা কেমন যেন আক্ষেপের সুর বেজে উঠেছে | এটা কিন্তু ঠিক নয় | আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হতে পারি, কিন্তু কোনো বিভাগই আমার কাছে তুচ্ছ নয় | আমি মনে করি যদি এই সমস্ত বিভাগগুলো, কলা বলো বা বাণিজ্য বলো না থাকতো তাহলে কিন্তু একটা দেশ পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারতো না | দেশকে ঠিকপথে চালনা করার জন্য সব বিভাগেরই জ্ঞানী লোকের প্রয়োজন | হতে পারে আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনেক সাধারণ লোক শুধুমাত্র গায়ের এবং মুখের জোর দেখিয়ে ঢুকে পড়েছে | কিন্তু তা দিয়ে তো দেশ চলবে না | দেশ চালানোর জন্য সব বিভাগেরই উন্নত মস্তিষ্কের লোকের প্রয়োজন | তাই কোনো বিভাগকেই ছোট মনে করে দুঃখ পাবার কোনো কারণ নেই | কোনো সন্দেহই নেই, একটা দেশ আগে এগোতে পারে বিজ্ঞানের উন্নতির মাধ্যমে | চতুর্দিকে দেখতে পাবে বিজ্ঞান সাধনার ফল | এই বিদ্যুৎ বলো, রাস্তায় যে গাড়িগুলো দৌড়োচ্ছে, বড় বড় ব্রিজ যে তৈরি হচ্ছে বা বিশাল বিশাল অট্টালিকা গুলো যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবই তো বিজ্ঞানের দেন | এসব তো আছেই - শত সহস্র অবদান আছে বিজ্ঞানের | ঘরের অন্দর মহল থেকে শুরু করে, সিনেমা - সংস্কৃতি সবেতেই | কিন্তু সমস্ত উন্নয়নের জন্য দরকার ম্যানেজমেন্ট অফ ফিনান্স | অর্থনৈতিক কাঠামোকে সুদৃঢ় না করতে পারলে কোনো দেশ কোনোদিন উন্নতিই করতে পারবে না - আর এখানেই আছে কলা বা বাণিজ্য বিভাগের অবদান | অর্থনীতিটা তারাই ভালো বুজতে পারবে, বোঝাতে পারবে, দেশকে অগ্রগতির পথ দেখতে পারবে | যারা এ বিষয়টা ভালো জানে, তারা তার সময়োপযোগী এপ্লিকেশনটাও করতে পারবে | তুমিও জানো যে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে সেই দেশের ব্যাঙ্কিং সিস্টেমটাও সুন্দর করতে হবে | আর তার ভিত তৈরি করবে কারা- এই যে তোমার মতো কলা বা বাণিজ্য বিভাগ থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরাই | এরাই তো শক্ত করে গড়ে তুলবে দেশের ভবিষ্যৎকে | তাই এতটা হীনমন্য ভাব দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই | নিজের সাবজেক্টকে ভালোবাসতে হবে আর বুদ্ধির প্রয়োগবলে সেই ভালোলাগাটাকে বাস্তবায়িত করতে হবে | সেটাই তো হবে আসল শিক্ষা | পুঁথিগত বিদ্যায় তো পারের কড়ি জোগাড় করা যায় মুখস্থ করেই, কিন্তু বিষয়টাকে ভালোভাবে জানতে গেলে তোমাকে তো তোমার বিশ্লেষণ শক্তিকে কাজে লাগাতেই হবে | আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয়তা তো তোমাকেই উপলব্ধি করতে হবে | না, তোমাকে আমি দোষ দিই না | দোষটা সম্পূর্ণরূপেই আমাদের মানসিকতার | আমাদের বাবা-মায়েরা সন্তান হলেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন যে তাদের সন্তান বড় হয়ে হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার হবে | তাই সন্তানের শৈশবটাকে গুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়ে তাদের মনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার বীজ বপন করে দেয় | পিছিয়ে পড়া চলবে না কোনো মতেই| শৈশব শেষ হয়ে গেলো, সুন্দরভাবে বিকশিত হবার স্বাধীনতারও পরিসমাপ্তি ঘটে গেলো | আদা-জল খেয়ে লেগে যাও, তোমার লক্ষ্য হবে একটাই - ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার | অথচ কিশোর মন কি চায়, কোন পথে গেলে সে নিজেকে মেলে ধরতে পারবে, কোন বিষয়টা তার ভালো লাগে, শিক্ষকতা করতে ভালো লাগে নাকি টেকনিকাল কাজকর্ম করতে ভালো লাগে, এসব চিন্তাধারাকে মনে ঠাঁই দিতে চান না বাবা-মায়েরা | ফলে কি হয় ভালো না লাগা বিষয় গুলোকে একরকম আঁকড়ে ধরে চলতে গিয়ে পদস্খলন হয়ে যায় | বেশির ভাগ বাচ্চারাই শেষপর্য্যন্ত বিভ্রান্ত এবং দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পরে | মানসিকভাবে হার মেনে নেয় সে | অথচ এটা যদি করা যেত, যখন একটা বয়সের পর বাচ্চারা বুঝতে শেখে যে কোন বিষয়টা তার ভালো লাগে, কোন বিভাগে গেলে সে নিজেকে মেলে ধরতে পারবে - যদি সে তার মনমতো বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে তবে, সে তো নিজের উন্নতির সাথে সাথে দেশের উন্নতির ব্যাপারেও নিজেকে উজাড় করে দিতে পারবে | আমার মনে হয় এই বোধটাই আজ হারিয়ে গেছে মানুষের | কি হলো, ওভাবে অবাক চোখে চেয়ে আছো কেন আমার দিকে - আমি তোমার চিন্তাধারাকে ভুল পথে চালিত করে দিলাম নাকি তোমাকে তোমার সাবজেক্টকে যাতে সত্যিই ভালোবেসে আপন করে নিতে পারলে তোমার যে উপকারটা হবে তার পথ বাতলে দিলাম | এমন করে একভাবে চেয়ে থেকো না | আরে ধুর, ওসব কিছু নয়, আমি তোমার জ্ঞানের ভান্ডারটিকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য একটু উপদেশই না হয় দিয়ে দিলাম | যাক, এবার স্বাভাবিক হয়ে যাও'|

 'সেটা তো তুমি ঠিকই বলেছো' - প্রতীক্ষা এবার মুখ খুললো - 'কিন্তু ঘরে বেশি চাপাচাপি করলে আমি হয়তো শেষ পর্যন্ত সত্যিটাই বলে ফেলবো'|

 'আরে, পাগল নাকি | এখনই বলে ফেললে তো আমাদের স্বাধীনতাই নষ্ট হয়ে যাবে | তখন কড়া শাসনে থাকতে হবে | ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা কলেজ আর ক্লাস শেষ হলে সোজা বাড়ি | অন্য কোনোরকম কিছু করতে গেলেই সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে যাবে | আর তাছাড়া সত্যি কথাটা বলতে হবে কেন তোমায় | কারণ দেখানো কি আর শক্ত ব্যাপার | বলে দেবে আজ ক্লাসে বিতর্কের আয়োজন করা হয়েছিল | ইতিহাস বলো, ভূগোল বলো, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বলো - যে কোনো একটা বিষয়ের ওপর বিতর্ক রাখা হয়েছিল | স্বপক্ষে, বিপক্ষে এমন সব যুক্তি রাখা হচ্ছিলো যে ঘড়ির কাঁটার দিকে কারো নজর দেবারও সময় হয়নি | যখন হলো তখন তো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেই গেছে' | একসাথে এতগুলো কথা বলে মনীশ হেসেই ফেললো | জিজ্ঞেস করলো, 'কি, মনঃপুত হয়েছে তো | যাও, খোলা মনে বাড়ি চলে যাও, আর কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে বানিয়ে বানিয়ে যা পারো বলে দিও | হোঁচট খেলেই কিন্তু গন্ডগোল - সবাই অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়বে'|

 'হ্যাঁ, তোমার আর কি |আমার বানিয়ে বলার দক্ষতা তো নেই, তাই ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনাটাই বেশি | দেখি কিভাবে ম্যানেজ করা যায়' - একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে প্রতীক্ষার |

 'এই, তোমার ঘরের অনেকটাই কাছে এসে গেছি | আর একসাথে চলাটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না | পরিচিত কেউ দেখে ফেললে তুমিই পড়ে যাবে অসুবিধার মধ্যে | আমাদের দেশ তো, এখানে এখনও মেয়েদের দিকে আঙ্গুল তোলাটা অনেক সহজ ব্যাপার | খোঁটামারা কথা মনের অনেক গভীরে গিয়ে ধাক্কা দেয় | আমাদের কথা আলাদা | কেউ কিছু বলার চেষ্টা করলে তাকে গলার জোরে দাবিয়ে দিতে আমার বেশি কষ্ট হবে না | কিন্তু তোমাদের ক্ষেত্রে আলাদা | সবকিছুই গায়ে মেখে নিয়ে লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে যাবে, আর আঘাতের ধাক্কাটা যদি একটু বেশি হয়ে যায় তবে বলা যায় না চোখ থেকে দুচার ফোঁটা অশ্রুকণাও বেরিয়ে আসতে পারে' - হাসতে হাসতে বলে উঠলো মনীশ |

'আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছো | কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার কপালে যে কি ঘটতে চলেছে সেই নিয়ে রসিকতা করতে গিয়ে তোমার চোখে মুখে আমার প্রতি সহানুভূতির তো কোনো চিহ্নই দেখতে পাচ্ছি না'| প্রতীক্ষার কথায় কেমন যেন অভিমান ফুটে উঠলো | 'আরে, না না, আমি তোমাকে উপহাস করার মানসিকতা নিয়ে কিছু বলিনি | যাক গে, কিছু মনে করো না | তুমি চলে যাও এখন থেকে একাই | আমি একটু অন্য পথে ঘুরে বাড়ি যাবো | এর পর কবে দেখা হচ্ছে বলে যাও | আর কোথায় দেখা করতে হবে জানিয়ে দাও'|

মনীশের প্রশ্নের উত্তরে প্রতীক্ষা বাড়ির দিকে এগোতে এগোতেই বললো, ' আচ্ছা, আমি জানিয়ে দেব | সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে | তবে চিন্তা করো না | দায়িত্বটা আমিই নিলাম'| প্রতীক্ষা হাত নেড়ে এগিয়ে চললো বাড়ির দিকে | কিছুক্ষন সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো মনীশ | পরে পেছন ফিরে হাঁটতে থাকলো নিজের ঘরের দিকে |


                                        (২)

'তোমাদের কলেজ ক্যাম্পাসটা সত্যিই সুন্দর' | প্রতীক্ষার চোখেমুখে কেমন একটা ভালোলাগা ভালোলাগা ভাব ফুটে উঠলো | 'কতটা জায়গা জুড়ে, অনেকগুলো বিল্ডিং যেমন আছে, খেলার মাঠও আছে দেখতে পাচ্ছি'|

 'তা বলতে পারো', মনীশ বলে উঠলো | 'আমি যেদিন প্রথম এই কলেজে পা রাখি, সেদিন থেকেই কলেজের ওপরে আমার ভালোলাগা ভাবটা তৈরী হয়ে গেছিলো, যেমন তোমার এখন লাগছে | ভালোলাগার আবেশে আবিষ্ট ছিলাম বেশ কিছুদিন | সত্যিই আমাদের কলেজে ক্যাম্পাসটা খুবই সুন্দর | বেশ অনেকটা জায়গা জুড়েই এই কলেজটা | এখানে যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয় তেমনই বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য - সব আলাদা আলাদা পড়ানোর ব্যবস্থা আছে | সন্ধ্যের পরেও ক্লাস নেবার ব্যবস্থা আছে এখানে | যারা সারাদিন অফিসের কাজ বা অন্য কোনো কাজের জন্য দিনের বেলায় পড়াশোনা করতে পারে না, এবং তারা যদি পড়াশোনা করতে আগ্রহী হয়, তাদের জন্যই সান্ধ্যকালীন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে | এর ফলে শিক্ষাগত যোগ্যতার মান তারা যেমন বাড়াতে পারে তেমনই অফিসের কাজেও পদোন্নতির সম্ভাবনাও অনেকাংশে বেড়ে যায় | তবে, তুমি কি শুধু বিল্ডিং আর খেলার মাঠই দেখতে পেলে, কত গাছ আছে দেখেছো | আর গাছের নিচে বসে নিশ্চিন্তে প্রেম করার মতো আবহাওয়াও তৈরী হয়েছে | লক্ষ্য কারো, প্রায় প্রত্যেক গাছের নিচেই দুজন করে বসে আছে, আর কেমন বইপত্রও খুলে রেখেছে দেখেছো | আসলে পড়াশোনার মাধ্যমেই যে প্রেমটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা ওরাই বুঝিয়ে দিচ্ছে | আমাদেরও কিন্তু, ভালোলাগা বলো বা ভালোবাসা বলো তৈরী হয়েছে ওই কলেজ যাবার পথেই - বইখাতা অবশ্য খোলা হয়নি, কিন্তু সাথে তো ছিলই | চলো দুজনে ওদিকটায় গিয়ে বসি | ওদিকে একটা পুকুর আছে | তার একটা বাঁধানো ঘাটও আছে | তোমার ভালো লাগবে নিশ্চয়ই' |

দুজনে পুকুর পাড়ের বাঁধানো ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলো |

 'অপূর্ব, কি মনোরম জায়গা'| প্রতীক্ষার ভালোই লেগেছে বলে মনে হলো | মনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললো,'অফ পিরিয়ডে এখানে এসে বসলে মন তো ভালো হয়ে যাবেই, সময়টাও সুন্দর পার হয়ে যাবে | আচ্ছা, এই পুকুরটা করেছে কিসের জন্য |

মনীশ তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতেই বলতে শুরু করলো,'এই পুকুরটাতে একটা আংলিং ক্লাব চলে | ছুটির দিনগুলোতে ক্লাবের সদস্যরা সকাল থেকে এসেই ফাতনায় টোপ দিয়ে তীর্থের কাকের মতো সারাদিন বসে থাকে, মাছেরাও টোপ গেলে | কোনো কোনো সদস্যের কপাল ভালো, টোপ ঠিকমতোই মাছে খায় | এতক্ষন হেঁটে আসার সময় গাছের নিচে যে মানব যুগলকে দেখলে, তারাও অনেকদিন এই বাঁধানো ঘটে টোপ ফেলে বসে ছিল | যখনই কেউ টোপ গিলেছে , তার ভাগ্যও খুলে গেছে | প্রেম যখন গভীরভাবে একবার গেঁথে বসে, তখনই তারা বইপত্তর হাতে নিয়ে গাছতলায় বসে পড়ে | ঘর বাধার স্বপ্নের শুরু কিন্তু এই বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি বেয়েই - তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়'|

'কি যে বলোনা, রসিকতার একটা সীমা আছে'- প্রতীক্ষার গলায় একটু বিরক্তির আভাস |

'তুমি বিশ্বাস করছো না তো | এই যে আমরা দুজন আজ এখানে এসে বসলাম, কিছুদিন পরে দেখবে আমরা গাছতলাতেই গিয়ে বসেছি'| মনীশের কথায় সেই রসিকতার ছোঁয়াই দেখা দিলো |

'বালাই ষাট, গাছতলায় গিয়ে বসতে হবে কেন | এই জায়গাটা আমার খুব ভালো লেগেছে | আমার খুব পছন্দ হয়েছে | আমরা এই কলেজে দেখা করলে আমি কিন্তু এই জায়গাটাকেই বেছে নেবো | এখানে দুজনে গল্প করতে করতে যেমন হারিয়ে যাওয়া যায়, তেমনি পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে থেকে, জলের স্বচ্ছতার বিচার করতে করতে, স্বচ্ছ জলের ভেতর দিয়ে মাছেদের ক্লান্তিবিহীন আনাগোনা দেখতে দেখতেই সময় কোথা দিয়ে যে কেটে যায় তা ধারণায় আনা যায় না | আমি এখানেই বসবো'- বলেই প্রতীক্ষা বাঁধানো ঘাটের যে উঁচু লম্বা বেদি করে বসার জায়গাটা করা আছে সেখানে বসে পড়েই মনীশের হাত ধরে টেনে বললো, 'বসে পড়ো | এই ভালোলাগার আবেশে আমাকে কিছুক্ষন বসতে দাও | গল্প করেই কিছু সময় কাটিয়ে দিই, বসো' | |

'আমাদের পথ চলা শুরু কবে থেকে সেটা মনে করতে পারো কি? প্রশ্নটা মনীশের দিকে ছুঁড়ে দিলেও প্রতীক্ষা নিজের মতো করেই বলতে শুরু করলো, 'পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের চাইতে তোমাকে একটু আলাদাই মনে হতো | অন্যান্যদের মতো তোমাকে দেখিনি কোনোদিনই কোনো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কারো সাথে কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে | পাড়ার রকে আড্ডা মারতেও যেমন দেখিনি, তেমনি দেখিনি কোনোদিন কাউকে গালাগালি করতে বা কোনো ব্যাপারে উৎশৃঙ্খলতা করতে | নিজের মতো করেই থাকতে ভালোবাসতে বোধহয় | কেমন যেন একটা আলাদা রকমের গাম্ভীর্য্য আছে তোমার মধ্যে | মনে হতো এটা তোমার কোনো অহংকার নয় বা ভালো কলেজে পড়ার জন্য কিংবা ভালো রেজাল্ট করার জন্য কোনো দম্ভও নয়, তোমার এই নিজস্বতা কে আমার কেমন ভাবে হঠাৎ ভালো লাগতে লাগলো | সবার সঙ্গেই মিশেছ, সবার সঙ্গেই সুন্দর কথাবার্তা বলছো আবার আচার ব্যবহারেও সুন্দর নম্রতা, ভদ্রতা; অথচ সবার থেকেই আলাদা | আমার কাছে এটা চারিত্রিক দৃঢ়তার একটা দিক, পরিষ্কার অথচ দৃঢ় মানসিকতার পরিচয় বলেই মনে হতো | তাই যখনই তোমাকে আমি দেখতে পেতাম, সুন্দর একটা মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তোমার দিকে দেখতাম আর ভাবতাম, এরকম চারিত্রিক দৃঢ়তার একটা মানুষকে যদি আমি আমার সারা জীবনের চলার পথে পাশে পাই তবে আমি নিজেকে অনেক গর্বিত মনে করবো আর আনন্দিত থাকবো | ধীরে ধীরে এই ভালোলাগাটাই কখন যেন ভালোবাসায় পরিবর্তিত হয়ে উঠলো | আর এখন, এই যে তুমি আমার পাশে বসে রয়েছো, আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আমার জীবনের এই পরিবর্তনের পালা শুনছো, তাতেই আমি তৃপ্ত - এটাই আমার সব পাওয়া | আমি কিন্তু তখন থেকে একতরফা বলে যাচ্ছি - তুমি শুনে যাচ্ছ, এবার তুমি কি কিছু বলবে, আমি শুনতে থাকবো'|

 ' না, না, বলে যাও, বলতে থাকো | ভালোই তো লাগছে শুনতে | নিজের সম্বন্ধে এতো ভালো ভালো কথা শুনতে কার না ভালো লাগে বলো | তাই আমারও ভালো লাগছে | তোমার চোখে যে আমি কেমন ছিলাম সেটা শুনতে শুনতে আমি আবার নিজেকে নতুন করে চিনতে পারছি, বুঝতে পারছি | এই নতুন করে নিজেকে জানতে পারাটা একটা ভীষণ রকম গর্বের ভাব এনে দিচ্ছে মনের মাঝে, আর তাই আমি তোমার দিকে চেয়েই আছি, আর বোঝার চেষ্টা করছি যে আমাকে নিয়েও কেউ তাহলে চিন্তা করে, আমাকে কেউ তো অন্ততঃ সম্ভ্রমের চোখে দেখে | আসলে প্রশংসাসূচক এই বাক্যগুলোকে খুব মন দিয়ে শুনছিলাম - আর নিজেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছিলাম | আসলে আমার মতটা একেবারেই অন্যরকম | আমি নিজেকে বিশ্লেষণ করেছি একদম অন্যভাবে | একটা স্বার্থবাদী লোক, যে অন্যের দিকে দেখতে চায় না, নিজেকে নিয়েই থাকে| কারো সাথে সাধারণভাবে কথাও বলতে পারে না, যার মধ্যে সর্বদা একটা হেসিটেশন আছে, নিঃস্বার্থভাবে কারো সাথে মিশতে পারে না, নিজের দাপট দেখাতে পারে না, সর্বদা নিজেকে নিয়েই মেতে থাকতে ভালোবাসে, নিজের গাম্ভীর্য্যতা দেখাতে গিয়ে অন্যদের দূরে সরিয়ে রাখে, সম্পূর্ণভাবেই একটা ইন্ট্রোভার্ট ছেলে | তাই তোমার কথাগুলো শুনে একটু বিস্মিতই হচ্ছিলাম - ভাবছিলাম, একই লোককে দূরকমভাবে দেখলে শুধু বৈপরীত্যই চোখে পড়ে | মনে হয় দুটো দৃষ্টিভঙ্গিই ঠিক | যে যেরকম ভাবে দেখে বা বিচার করে’|

মনীশের নিজেকে বিশ্লেষণ করা শেষ হবার আগেই প্রতীক্ষা বলে উঠলো, 'তুমি তো তোমাকে নিজের মতো করেই সাজালে, এবার বলো তো আমার দিকে তুমি কিভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়লে' |

 'আকৃষ্ট, ঠিক হলো না কথাটা'| মনীশ বললো, 'বরং আবিষ্ট বলতে পারো যার উৎপত্তি ভালোলাগার আবেশ থেকে | হ্যাঁ, আবেশই বলা যায় | মাঝে মধ্যেই তোমাকে যখন দেখতে পেতাম বা তোমার দিকে চোখ পড়তো, তখন মনে হতো এই মেয়েটা আমাকে কেমন যেন অন্য চোখে দেখছে | চোখের ভাষা বোধহয় পড়তে শিখে গেছিলাম | তাই মনে হতো এ হয়তো আমাকে নিয়ে ভাবে, আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখে | একটা অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে | নিজের মনেই এইসব সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতেই কখন কিভাবে যে তোমার দিকে ইনক্ল্যাইন্ড হয়ে পড়লাম, নিজেই জানিনা | প্রথম দিকে একটু ভয় ভয় করতো ঠিকই, সমাজের ভয়, লোকলজ্জার ভয়, লোকের মুখে কটু কথা বা উপহাস শোনার ভয় | শুধু সমাজ বা প্রতিবেশীদের সমালোচনার ভয় নয়, বাড়ির লোকেদের সন্দেহ করার ভয়, অতিরিক্ত বেহিসেবি শাসন শুরু হয়ে যাবার ভয়, গর্হিত অপরাধের আসামী হিসেবে সনাক্ত হয়ে যাবার ভয়, সর্বোপরি ঘরের লোকেদের বিশ্বাস এবং স্বপ্ন ভেঙে যাবার ভয় | পরে নিজেকে ধীরে ধীরে বোঝাতে পেরেছিলাম যে এবার একটু সাহসী হতেই হবে, মনের থেকে ভয়ের চিন্তাধারাগুলো সরিয়ে ফেলতেই হবে, নয়তো আমরা একে অন্যকে জানবার সুযোগটুকুও পাবো না' |

'হ্যাঁ, সাহসটা তো দেখলাম| একেবারে সোজাসুজি আমার সাথে সাথেই বাসে উঠে পড়লে, আর আমার ঠিক পাশটাতে এসেই দাঁড়ালে | সাহসী হয়ে উঠেছে ছেলে'- প্রতীক্ষার মুখে হাসি ফুটে উঠলো |

মনীশ সাফাই দেবার মতো বলে উঠলো,'এই সাহসটা দেখতে না পারলে আমরা দুজনে যে আজ পাশাপাশি বসে গল্প করছি, সেটা কি কোনো দিনও হতে পারতো | এ সমাজে কিছু নিজের মনে করে ধরে রাখতে গেলে সাহস তো একটু দেখাতেই হবে | তাই আমিও আমার ভেতরে ভয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাহসটাকে বাইরে আনার সামান্য প্রচেষ্টা করেছি মাত্র' |

 'আজকে তোমার সাথে কথা বলতে এতো ভালো লাগছে কেন বলতো'| প্রতীক্ষা প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় মনীশের দিকে কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে থাকে 'আসলে কি জানতো, আজ তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার কোনো তাড়া নেই | বাড়ির লোকেরা আজ মাসির বাড়ি না কোথায় যেন যাবে বলছিলো | ফিরতে সন্ধ্যে হয়েই যাবে | তাই আমার আজ দেরিতে ঘরে ফিরলেও চলবে | কারণ সেই সন্ধ্যের পরই তো ঘরে ঢুকতে পারবো - তাই কলেজ থেকে ফিরে আমি তন্দ্রাদের বাড়িতেই থাকবো | অন্ততঃ, ঘরের লোক তো আমাকে সেরকমই নির্দেশ দিয়েছে’ |

'তাহলে তো ভালোই হলো | আরো কিছুক্ষন গল্প করা যাবে'| মনীশের কথায় একটু নিশ্চিন্ততার সুর | বলতে থাকলো, 'এই প্রতীক্ষা, তোমার বান্ধবীরা কি আমাদের এই মেলামেশা করার ব্যাপারটা জানতে পেরে গেছে | আমার বন্ধুরা কিন্তু কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছে এরই মধ্যে | আমার চোখে মুখে নাকি প্রেমে পড়ার একটা ভাব তৈরি হয়েছে | ওরা আমার চোখ মুখের ভাব দেখেই ধারণা করে নিয়েছে যে আমি নাকি এখন অন্য জগতে বিচরণ করছি | ক্লাসে বসেও আমি নাকি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি | ভালোবাসার সমুদ্রে আমি নাকি ঝাঁপ দিয়েই ফেলেছি | সেদিন তো খুব পেছনে লেগেছিলো | কি হয়েছে, ঘটনাটা কি - জানার জন্য সবাই উদগ্রীব | অবশেষে নিজেকে আর নিজের মধ্যে আটকে রাখতে না পেরে তোমার কথা ওদের বলেই দিয়েছি | বলা মাত্রই সবাই মিলে এমন একটা চিৎকার করে উঠলো যেন আমি যুদ্ধ জয় করেই ফেলেছি - চিৎকার টা যুদ্ধ জেতার জয়ধ্বনি | তাদের দাবি তাদের সাথে তোমার আলাপ করিয়ে দিতে হবে | অবশ্য আমি জানি যে আমাকে আলাপ করিয়ে দিতে হবে না, ওরা নিজেরা এসেই আলাপ করে নেবে | এখন মন দিয়ে সবাই ক্লাস করছে | আসলে পরীক্ষাটাও তো সামনে, দিন এগিয়ে আসছে | তাই আমাদের ব্যাপারে এখন অত ইন্টারেস্ট দেখাতে পারছে না | তাছাড়া, সামনের সপ্তাহে প্রথম দুদিনে আমাদের আবার ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ | বিভিন্ন কোম্পানি গুলো আসবে আমাদের ইন্টারভিউ নিতে, এই ক্যাম্পাসেই | চাকুরী পাবার এই একটা বড় সুযোগ | কোনো কোম্পানি যদি অফার দেয় তবে পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর পরেই সেখানে জয়েন করতে হবে | অবশ্য শুধু ভালো ইন্টারভিউ হলো আর চাকুরীর অফারটা মেনে নিলাম তা কিন্তু নয় | প্যাকেজ টাও দেখতে হবে | অফারটা লোভনীয় হলে, আর কোম্পানির বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সুনাম থাকলে তবেই জয়েন করার প্রশ্নটা আসবে | আমাকেও এখন পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে | ইন্টারভিউয়ের জন্যও প্রস্তুতি নিতে হবে |তাই এরপরে আমাদের দেখা হওয়ার জন্য সামনের সপ্তাহের শেষের দিকটাই বেছে নিতে হবে, আর তার পরেই তো শুরু হবে ফাইনাল পরীক্ষা | সেসব নিয়ে খুব বেশি একটা চিন্তা করাটা আমার আবার ঠিক লাগে না| চেষ্টা তো নিশ্চয়ই খুব করবো যাতে দুটোই ভালোভাবে উত্তীর্ণ হতে পারি | ভালো চাকুরী একটা পেতেই হবে | আরে দেখো, নিজের কথা বলতে গিয়ে কেমন একটা গম্ভীর, থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি করে দিলাম | পরিবেশটা হালকা করা যাক | যে কথাটা বলছিলাম |তোমার বান্ধবীদের কি জানিয়ে দিয়েছো আমাদের এই মেলামেশার ব্যাপারটা'|

'অবশ্যই, তুমি তোমার বন্ধুদের জানাতে পারো আর আমি আমার বান্ধবীদের জানাবো না, সেটা হয় নাকি | জানিয়েছি | ওরা সবাই তোমার সাথে দেখা করার জন্য, কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়েই আছে | আজই আসতে চেয়েছিলো, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আজকে ওদের আসাটা বন্ধ করতে পেরেছি, কিন্তু আর আটকানো যাবে না | এবার সম্মতি দিয়ে দিতেই হবে | তাছাড়া সম্মতি দেবার আগে তোমার ইচ্ছেটাও তো জানতে হবে, তাই আজকে ওদের মানা করেই দিয়েছি | আসলে, তোমার সম্বন্ধে ওদের আমি এমন বলেছি যে ওরা আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছে না | আলাপ করবেই'|

'মানে, কি এমন বলেছো আমাকে নিয়ে যে তোমার বান্ধবীরা এই আজব জন্তুটির সাথে দেখা না করে থাকতেই পারছে না'| মনীশ একটু অবাক হয়েই বলতে থাকলো,'কি এমন বলেছো প্রতীক্ষা যে ওরা আমাকে জানার জন্য আর সময় নষ্ট করতে রাজি নয়'|

 'ওরকম বোলো না মনীশ, নিজেকে অত ছোট মনে করার মতো কিছু হয় নি | যা বলেছি তাতে তোমার ওপর ওদের ধারণাটা অনেক উচ্চতায় উঠে গেছে | সম্মানের আসনে বসিয়ে দিয়েছে তোমাকে | আরে ধ্যাৎ, কি সব বলছি, আসলে তোমার সম্বন্ধে শোনার পর থেকেই ওরা ঠিক করেছে তোমার ক্লাস নেবে' |

 'আমার ক্লাস নেবে' - মনীশ এবার হেসেই ফেললো| বললো,'ঠিক আছে, দেখা যাবে কে কার ক্লাস নেয় | আর হ্যাঁ, তোমার তো আজকের ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, আর তোমার কথামতো তুমি তো এখন তন্দ্রাদের বাড়িতেই আছো | তাহলে এখানে কি করছো| যাও, তন্দ্রাদের বাড়িতেই যাও' | ' ঠিক তাই, এখানে আমি তোমার সঙ্গে আছি ঠিকই, কিন্তু আমি তো কলেজেই এসেছি | কত পড়াশোনা করলাম বলোতো’| প্রতীক্ষার মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো | 'ঠিক আছে, ধরেই নেওয়া যাক আমার ক্লাস শেষ হয়ে গেছে আর আমি এখন তন্দ্রাদের বাড়িতেই আছি | এবার বাড়ি ফিরতে হবে' |

 মনীশ বলে উঠলো, 'তোমার ক্লাস শেষ হয়ে গেছে মানে, তোমার ক্লাসই নেওয়া হলো না আর তুমি বলছো ক্লাস শেষ হয়ে গেছে'|

মনীশের কথা শেষ হবার আগেই প্রতীক্ষা প্রতিবাদ করে উঠলো,'ক্লাস ? আবার ক্লাস নেবে মানে ? কি বলতে চাইছো তুমি'|

 'কেন, এই যে কলেজে যাবার নাম করে বাইরে এসে আমার সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছ, তো ক্লাসের পড়াশোনাটা কেমন হলো সেটার একটা পরীক্ষা নিতে হবে না | বলে যাও আজকের পড়াশোনাটা কতদূর এগোলো আর তুমি তার থেকে কতটা কি বুঝতে পারলে, বলতে থাকো'|

মনীশের কথা শেষ হতেই প্রতীক্ষার চোখে মুখে একটা অবাক হয়ে যাবার ভাব ফুটে উঠলো | বললো, 'ক্লাস নেবে ? পরীক্ষা নেবে ? ইস, কত বড় মাস্টারমশাই এলেন যে নিজের ক্লাস ফাঁকি দিয়েও আমার পরীক্ষা নেবে | যাও, নিজের ক্লাসের দিকে মন দাও | সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা, সেদিকে মন দাও গিয়ে | আমাকে নিয়ে অত চিন্তা না করলেও চলবে'|

 'সেই ভালো, চলো ওঠা যাক | অনেক সময় পার হয়ে গেছে | সামনেই পরীক্ষা | সেটা তো অন্ততঃ ভালো করে দিতেই হবে | ঠিক আছে, যদি একটা দুটো ক্লাসও এখন করে নিতে পারি সেটা আখেরে হয়তো আমাদেরই ভালো হবে'| কথাটা বলেই মনীশ প্রতীক্ষার অভিব্যক্তিকে পরীক্ষা করতে লাগলো |

 'ঠিক আছে, আমি এখন যাই'- উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রতীক্ষা বলতে থাকলো, 'আমাকেও বন্ধুদের কাছ থেকে ক্লাস নোটগুলো নিতে হবে | যাও, ভালোমানুষের মতো গিয়ে ক্লাসে বসে যাও | পরে দেখা হবে'| প্রতীক্ষা দু পা এগোতেই মনীশ বলে উঠলো, 'ঠিক আছে, এখন যাই | তবে এরপরে কবে কোথায় দেখা হবে একটু জানিয়ে দিও | কোনো মাঠে বসবে, নাকি সিনেমা হলে বা কোনো রেস্টুরেন্টে'|

 'আমার তো বাবা এই পুকুর পাড়ই সবচেয়ে ভালো লেগেছে | তবুও, ঠিক আছে, পরে ঠিক করে নেওয়া যাবে | জানিয়ে দেব' | প্রতীক্ষা হাত নেড়ে এগিয়ে চললো | মনীশও চললো ক্লাসের দিকে |


                                      (৩)


'না, না | আমি এতটা খেতেই পারবো না | কি দরকার ছিল কলেজ ক্যান্টিনে খাওয়ার ব্যবস্থা করার | আর তাছাড়া আমরা সবাই তো বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া করেই বেড়িয়েছি | এখন এতো কিছু খাওয়াই যাবে না' -- প্রতীক্ষার কথা শেষ হতেই মনীশ বলে উঠলো, 'দেখো প্রতীক্ষা, তোমার বন্ধুরা এসেছে আমাদের কলেজে, আমাদের সঙ্গে দেখা করবে, গল্পগুজব করবে বলে | আমরা একটু অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবো না | তাই এই সামান্য ব্যবস্থা আমাদের বন্ধুদের তরফ থেকে' |

 'না, না; আমি বাড়ি থেকে খেয়েই বেড়িয়েছি | এখন এতটা আমি কোনোমতেই খেতে পারবো না' | প্রতীক্ষা সত্যিই খেতে পারবে না বুঝতে পেরে মনীশ বলে উঠলো,' তুমি যদি সত্যিই খেতে না পারো, তোমার যদি এই খাবারটাই বেশি বলে মনে হচ্ছে তাহলে এস আমরা দুজনেই এই প্লেটটা ভাগ করে খেয়ে নিচ্ছি' |

 ‘তুমি শেয়ার করবে | তাহলে তো খুব ভালোই হলো | এই প্লেটের খাবারটা আমরা দুজনেই খেয়ে নেবো' -প্রতীক্ষার মুখে একটু নিশ্চিন্ত হওয়ার আভাস দেখা গেলো | তন্দ্রা হঠাৎ বলে উঠলো,'বাব্বা, এখন থেকেই, এতো ভালোবাসা | একসাথে খাওয়ার অফার | সত্যি মনীশদা, তোমার তুলনা হয় না | প্রতীক্ষার কাছে তোমার সম্বন্ধে আমরা অনেক শুনেছি | শুধু শুনেই তোমার ওপর আমাদের শ্রদ্ধা বলো, ভালোলাগা বলো, ধারণা বলো সব বাড়তে বাড়তে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে গেছিলো যে এই মহান মানুষটিকে চাক্ষুস দেখার বাসনাটা আর সামলাতে পারছিলাম না | তাই তো আজ দল বেঁধে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চলে এসেছি' |

 'তন্দ্রা, আমাকে এমন উচ্চতায় তুলে রেখো না যে হঠাৎ পদস্খলনে হাত পা ভেঙে আবার একটা কেলেঙ্কারি না হয়ে যায়' | মনীশ বলতে থাকলো, 'আমাকে উচ্চাসনে বসানোর কোন দরকার নেই | অত মহান ব্যক্তি আমি নই | আমার সম্বন্ধে প্রতীক্ষা তোমাদের যদি কিছু বলেও থাকে, তাহলে বলবো ও অতিরঞ্জিত করেছে | ও নিজেও জানে আমি সেরকম কিছু নই | আমি এখনও ওকে ফুটপাথ ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাই | এখনও সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাইনি | ভিক্টরিয়ায় নিয়ে যাবার স্বপ্নটাকে এখনও বাস্তব রূপ দিতে পারিনি | আমি এমন কিছু মহানুভবতার কাজ এখনো করে উঠতে পারিনি যে তোমরা আমাকে মহান ভেবে বসবে' |

তন্দ্রা বললো,' দেখো মনীশদা, তুমি যে এখনও না হওয়া কথাগুলো বলে গেলে, সেগুলো কোনো না কোনোদিন বাস্তব রূপ পাবেই | আমরা কিন্তু তোমার মনের মহানুভবতার কথা বলেছি | বাহ্যিক কোনো ঘটনা বা না পাওয়ার জন্য হওয়া বেদনা, কোনো কিছুই মানুষ মনীশদাকে আমাদের চোখে ছোট করতে পারবে না | আমরা প্রতীক্ষার কাছে শুনে শুনেই আমাদের মনের গভীরে তোমার সম্বন্ধে যে ধারণাটা বদ্ধমূল করে রেখেছি, তার থেকে আমরা কোনোমতেই সরে আসতে পারবো না - তোমার হাজারো ভুল বোঝানোর প্রচেষ্টা থাকা সত্বেও | যাক গে, আমরা অনেক বড় বড়ো কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করলাম | হঠাৎ করে এই ধরণের কথা শুনলে তত্ব কথার মতোই লাগে | তার চেয়ে এস আমরা একটু রসিকতা, গল্পগুজব বা খোলামেলা আলোচনাই করি' |

 'ঠিক বলেছো | বাতাসটা কেমন যেন ভারী ভারী হয়ে উঠেছিল | একটু হালকা মেজাজেই গল্প গুজব করা যাক' - মনীশ সম্মতি দিলো | 'কিন্তু তার আগে সবাই খাওয়ার পর্বটা সেরে নাও | খাবার সামনে রেখে কিছু অবাস্তব কথা বলার বা শোনার জন্য খাবারটা ঠান্ডা করার কোনো মানে হয় না | তাছাড়া খাবার সামনে রেখে আমি বেশিক্ষন অপেক্ষাও করতে পারবো না | কিন্তু তাই বলে অতিথিদের বসিয়ে রেখে আমিই আগে খেতে শুরু করে দেব, সেটাও তো হতে পারে না | চলো, তাহলে আমরা একসাথেই খাওয়া শুরু করি' |

 'না, মোগলাইটা সত্যিই ভালো বানিয়েছে' --রথীন, মনীশের ক্লাসমেট, বলে উঠলো |

'সত্যি, এতো ভালো বানিয়েছে যে বাড়ি থেকে খেয়ে বেড়িয়েছি, সেটাই ভুলে গেছি'--তন্দ্রা জবাব দিলো | - 'মনীশদা, তোমরাও খেয়ে নাও নাহলে আবার সবকিছুই ঠান্ডা হয়ে যাবে' |

 প্রতীক্ষা জিজ্ঞাসা করে উঠলো,'এই, সবকিছুই ঠান্ডা হয়ে যাবে - মানেটা কি ? তোরা আসলে কি বলতে চাইছিস ?

 'না অন্য কিছু নয়, খাবারটা ঠান্ডা হওয়ার সাথে সাথে আমাদের মনের অভিব্যক্তি বা আবেগ যদি ঠান্ডা হয়ে যায় - এই আর কি'- শ্রুতি হঠাৎ বলে উঠলো |

প্রতীক্ষা আবার স্থির থাকতে না পেরে বলেই ফেললো,'আমাদের মনের আবেগ কেন ? তোদের মনেও কি কোনো আবেগ তৈরি হচ্ছে নাকি ? আর "আমাদের" বলে কি বোঝাতে চাইছিস | এর মধ্যে আমাকে জড়াবি না | আমার মনে যে আবেগটা আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে সেটা ঠান্ডা হবার নয় - হবেও না '|

'বাব্বা, তাই নাকি | এতো ভালোবাসা | তা ভালো, এরকম ভালোলাগার আবেশে ডুবে থাকতে পারলে মনটা অবশ্য খুব প্রফুল্ল থাকে, তুই চির প্রফুল্ল থাক প্রতিক্ষা, আমরা সেটাই কামনা করি' - শ্রুতি বলতে থাকলো - 'প্রতীক্ষা, তোর দৃষ্টি শক্তির গভীরতাকে আমি শ্রদ্ধা করি | সাহস করে এগিয়ে চল, সার্থকতা অবশ্যই তোর প্রাপ্য | আমরা আছি তোর সাথে, তোকে উৎসাহ দেবার জন্য | আচ্ছা মনীশদা তুমিই বলো, ঠিক কিভাবে তুমি প্রতীক্ষার প্রেমে পড়লে | অবশ্য প্রতীক্ষার কাছ থেকে আমরা সবই জেনে নিয়েছি, তবু তুমিও কিছু বলো | তোমার কাছ থেকে শুনতে আমাদের ভীষণ ইচ্ছে করছে'|

'দেখো শ্রুতি, একই প্রশ্নের দুরকম উত্তর তো হতে পারে না | তোমরা প্রতীক্ষার কাছ থেকে আগেই যে উত্তরটা পেয়ে গেছো, সেটা আবার নতুন করে তো শোনার দরকার নেই - একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে' - মনীশ উত্তর দিলো |

 'সে তো ঠিক মনীশদা, একই প্রশ্নের একই উত্তর বারে বারে শোনার তো কোনো মানে হয় না - আমিও মানি সেটা' শ্রুতি বলতে থাকলো 'কিন্তু মনীশদা, একই প্রশ্নের একই উত্তর বিভিন্ন জন্যে বিভিন্ন ভাবে লিখতে পারে - উত্তরের মান বিচার করেই তার মূল্যায়ন করা হয় | আমরাও না হয় তোমার উত্তরটা শোনার পরেই তার মূল্যায়ন করে দেখবো, প্রথম প্রেমের ব্যাপারটা কার দিক থেকে কিরকম ভাবে অগ্রসর হয়েছে | বলেই ফেলো মনীশদা, আর অপেক্ষা করতে পারছি না | শোনার জন্য ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছি আমরা | আর এই খাতা পেন নিয়ে বসে গেলাম উত্তরের মূল্যায়ন করতে' |

'দেখো শ্রুতি, তোমার এই জানতে চাইবার আগ্রহের একটা উত্তরই আমার কাছে আছে, আর সেটা হলো.... "কিছুতেই পাইনা ভেবে, কে প্রথম চেয়ে দেখেছি"- মনীশ পরিচিত গানের লাইন দিয়েই বোঝাতে চাইলো দুজনের উত্তরই এক |

'বুঝতে পেরেছি, তোমাদের দুজনের বোঝাপড়াটা এতো সুন্দর, এতো নিবিড় যে আমরা আমাদের জানার ইচ্ছেটুকুকে মনের মধ্যেই জোর করে আটকে রাখবো - কারণ উত্তরটা তো আর পাবো না'| শ্রুতির কথায় একটু হতাশার ছোঁয়াই ধরা পড়লো |

 'মন খারাপ করো না শ্রুতি, উত্তর তোমরা জেনে গেছো | জানিনা, তোমার নিজের কোনো ভালোলাগার মানুষ আছে কি না - অবশ্য থাকায় উচিত |এখনকার মেয়েরা একটু বয়েস হলেই বয়ফ্রেন্ড ছাড়া রাস্তায় একা চলতেই পারে না | আমি অবশ্য শহরের মেয়েদের কথাই বলতে চেয়েছি | গ্রামে খুঁজলে এখনও অনেক এমন পাওয়া যাবে যারা প্রেম ব্যাপারটাকেই গর্হিত অপরাধ বলেই মনে করে | সমাজের চোখে তারাই অপরাধীর পর্যায়ে পড়ে যারা তাদের নিজেদের ইচ্ছেতেই বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজে নেয় | তোমার যদি বয়ফ্রেন্ড থেকে থাকে, তাই প্রথম প্রেমের আদান প্রদানের মুহূর্তটাও তোমার ভুলে যাবার কথা নয় | এ বিষয়ে তোমার অভিজ্ঞতা থাকারই কথা' |

 'তুমি কি বললে কথাটা মনীশদা, এখনকার মেয়েরা বয়ফ্রেন্ড ছাড়া একা রাস্তায় চলতেই পারে না | তুমি কি আজকালকার মেয়েদের এমনই মনে করো যে তাদের এখনও পুরোনো মানসিকতাই রয়ে গেছে, একা পথ চলতেই পারে না | কেন, এখন যে মেয়েদের অগ্রগতির যুগ, সেটা কি তুমি ভুলে গেছো মনীশদা | মেয়েরা আর ঘরের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখার মানসিকতা নিয়ে এখন বেড়ে ওঠে না | কিছু একটা করতেই হবে, নিজেকে দাঁড়াতে হবে, দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে - এই ধরণের ইচ্ছেগুলোকে মনের মধ্যে পোষণ করেই এখনকার মেয়েরা এগিয়ে চলেছে | দেখছো না, কত মেয়েই তো বিভিন্ন বিভাগে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে গেছে | সে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার থেকে শুরু করে যুদ্ধ ক্ষেত্রেও যে মেয়েরা এগিয়ে গেছে তোমাকে তো সেটা মেনে নিতেই হবে মনীশদা '- শ্রুতি একটু প্রতিবাদী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বলে মনে হলো |

 'আরে না না, ছি ছি | আমি কোনোমতেই মেয়েদের ছোট করে দেখানোর মতো কিছু বলার চেষ্টাটাই করছি না | আমি মেয়েদের ছোট করে দেখি না | তারা সব বিভাগেই পুরুষদের সমকক্ষ, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েও গেছে বলা যায়' | মনীশ ব্যাপারটাকে একটু হালকা করার চেষ্টা করেই আবার রসিকতা করে বলেই ফেললো,'অবশ্য প্রত্যেক সাফল্যের পেছনে পুরুষদের অবদান নিশ্চয়ই থাকে | সেটা উৎসাহ দেওয়া থেকে শুরু করে সহযোগিতা করা পর্য্যন্ত | মনে জোর বাড়িয়ে দেবার জন্য, মেয়েদের এনকারেজ করার জন্য পুরুষেরা সব সময়েই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েই রেখেছে' |

'এই, আমরা কিন্তু একজোট হয়ে দিনটাকে পালন করার মূল উদ্দেশ্য থেকে অন্য দিকে সরে যাচ্ছি' | প্রতীক্ষা আলোচনাটাকে অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলো | বললো, 'এই ধরণের কথা কাটাকাটি করতে থাকলে, সেটা চলতেই থাকবে, আর আবহাওয়াটাও ভারী হয়ে উঠবে | পথ হারিয়ে অন্য দিকেই চলতে থাকবো | ফলে আমরা আমাদের এই সুন্দর দিনটাকে আর উপভোগ করতেই পারবো না' |

 'হ্যাঁ, ঠিক তাই' | রথীন বলে উঠলো |'বরং আমরা সকলের কাছ থেকেই তোমাদের প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতির সম্বন্ধে জেনে নিই | এক একজন করে বলতে থাকো, আমরা উপলব্ধি করতে থাকি' |

 'মানেটা কি ? আমরা বলে যাবো, আর বাবুরা শুনবেন'- তন্দ্রা বলতে থাকলো | 'কেন শুধু আমরাই বলতে যাবো কেন ? সকলের জীবনেই আশা করি এই ধরণের অভিজ্ঞতা কোনো না কোনোদিন হয়েইছে | আমরা সবার কাছ থেকেই শুনতে চাই' |

 'তাহলে আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করছি' - দীপন বলতে শুরু করলো | 'আমার কপাল তো আর মনীশের মতো এতো চওড়া নয় | তাই প্রতীক্ষার মতো একজন সুন্দরী আমার জীবনে আসেনি | অবশ্য তার জন্য আমি নিজেকেই দোষ দিই | প্রথম থেকে গুছিয়ে শুরু করে উঠতে পারিনি | তাই,প্রথম অভিজ্ঞতার পর থেকেই এইসব প্রেম ট্রেম এর ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি | পৃথা, পৃথা এসেছিলো আমার মনের গভীরে | ভালো লেগেছিলো | তবে পৃথার আমাকে ভালো লেগেছিলো কিনা জানিনা | দুচারবার চোখ তুলে চেয়েছিলাম এই আর কি | তাতেই মনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল পৃথা | অনেক স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছিলাম নিজের মনের মধ্যেই | রাতের স্বপ্নে পৃথা, দিবাস্বপ্নে পৃথা | ভালোবাসার ইচ্ছেটাকে মনের মধ্যে প্রশ্রয় দিয়ে বেলুনের মতো এতটা ফুলিয়ে দিয়েছিলাম যে, ভ্যালেনটাইন ডে তে একগুচ্ছ গোলাপ হাতে নিয়ে সোজা পৃথার ঘরের দরোজায় গিয়ে নক করি | পৃথাই বেরিয়ে এসেছিলো |হাতের গোলাপগুচ্ছকে পৃথার দিকে একটু এগিয়ে দিয়ে সবে বলেছি, 'পৃথা, আমি তোমায় ভালোবাসি পৃ....কথা শেষ হয়নি, তার আগেই গালের ওপর সজোরে একটা চড় এসে পড়লো | আমি একদিকে কাত হয়ে গেলাম | সোজা হতেই দেখি, সামনে পৃথা নেই, যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি পৃথার বাবা | তার সবল হাতের থাবাটা পড়েছিল আমার গালে | অনেক কথাই তিনি আমায় শুনিয়ে ছিলেন | কিন্তু সব কথা শোনার মতো সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার ছিল না | সেই যে দৌড়ে বাড়ি চলে এসেছিলাম, আর ওমুখো হইনি | ভালোবাসা চুলোয় যাক | নিজের মান-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারলে ওরকম ভালোবাসা-টালোবাসা অনেক পাওয়া যাবে |

 'এটা তুমি কি করলে দীপনদা' - শ্রুতির প্রশ্ন, 'এরকম কাঁচা কাজ কেউ করে | এতো তরিঘড়ি এসব করতে গেলে কেন | কিছুদিন ধরে ধীরে ধীরে এগোতে হতো | একেবারে খেলিয়ে খেলিয়ে পৃথার মনের মধ্যে তুমি জায়গা করে নিতে প্রথমে | তারপরে যখন বুঝতে পারতে যে পৃথাও তোমার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তখন না হয় গোলাপ ফুল টুল নিয়ে চেষ্টা করতে পারতে ওর মনের গভীরে যাবার | বড্ডো কাঁচা কাজ করে ফেলেছো তুমি | যাই হোক, প্রথম বারে পাশ করতে পারোনি তো কি হয়েছে, পিছিয়ে এসো না, চেষ্টা করে যাও | সাফল্য একদিন নিশ্চয়ই আসবে |

'আমাকে নিয়ে রসিকতা করতে চাইছো বলে মনে হচ্ছে | করো করো, কতজনই তো করেছে | তুমিই বা বাদ যাও কেন | ফেল যখন করেছি, তখন অপবাদ তো মাথায় নিতেই হবে | তবে এই আমি বলে দিলাম - একদিন জয়, হবে নিশ্চয় | দেখো আমাদের জীবনটাই এরকম | প্রতি পদক্ষেপেই পরীক্ষা দিতে হয় | পরীক্ষায় কেউ পাস করে তো কেউ ফেল | আমার মনে হয় এই পরীক্ষায় অকৃতকার্যের সংখ্যাটাই বেশি | যারা লেগে থাকতে পারে, আর গভীর মনোযোগী হয়, সমস্ত কিছু নিজের মনে করে মানিয়ে নিতে পারে তারাই জেতে, তারাই কৃতকার্য হয় | একনাগাড়ে কথা বলে দীপন একটু থামলো |

 ' আর কে কে বলবে, বলার জন্য এগিয়ে এসো | শোনাও তোমাদের প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতার কাহিনী ' শ্রুতি বলতে থাকলো | ' রথীন দা, তুমি বলো | এবার তোমার বলার পালা' |

‘না, না, আমার হবে কেন | এবার তো তোমারই বলার পালা' বলো শ্রুতি, বলতে থাকো | আর শোনাও অভিজ্ঞতার কথা |

 'আমার কোনো কাহিনী নেই'- শ্রুতি বলতে শুরু করলো | 'একজন তার প্রেমিক মনটাকে নিয়ে একটু এগিয়ে ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা বাড়িতে জানাজানি হবার পর আমার প্রায় তিন মাস ঘরে বন্দি দশাতেই কেটেছে | তারপর একদিন শুনলাম একটা বাস একসিডেন্টে ছেলেটা মারা গেছে | খবরটা পেয়ে আমার বাড়ির সকলে আস্বস্ত হয়ে আমাকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করে দিলো, তবে শর্তসাপেক্ষে | আমি যেন আর কোনোদিন এ পথে পা না বাড়াই | আবার যদি কারো সাথে ভাব ভালোবাসার কাহিনী তাদের কানে যায়, তবে আমাকে আর আস্ত রাখবে না | চরম কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করবে | ব্যস, আমার প্রেম কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে গেলো সেখানেই, আর স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে যাতে আর জাগতে না পারে, তাই সে ইচ্ছেটাকেই বরাবরের জন্য রুদ্ধ করে দেওয়া হলো'| শ্রুতি মাথাটা নামিয়ে নিয়ে নিজের পায়ের দিকেই দেখতে থাকলো |

রথীন বলে উঠলো, 'আরে শ্রুতি, এসব নিয়ে মন খারাপ করার কিছুই নেই, দুঃখ পাবারও কিছু নেই | আমাদের এক এক জনের জীবনটাই এক এক রকম | সাফল্য পায় কজন | অনেকেই উড়ু উড়ু ভাব নিয়ে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে | অল্প বয়সের মন তো | দুম করে এই মনটাকে যেমন কাওকে দিয়ে দেওয়া যায়, তেমনই নিজের থেকে হোক বা পরিস্থিতির চাপে পরেই হোক, সরে আসতে বা পিছিয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না | আসলে বন্ধনটা এই বয়সে খুব একটা দৃঢ় হয়না | অপলকা | একটু ধাক্কাতেই সেই বাঁধনটা ছিঁড়ে গিয়ে দুজনে দুদিকে ছিটকে পড়ে | তাই তোমাকে বলছি দুঃখ কোরো না | এগিয়ে চলো সামনের দিকে | পড়াশোনায় ভালো ফল করে বাবা-মা, এমনকি পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করো | একটা ভালো চাকুরী জোগাড় করো |দেখবে, জীবনের ধারাটাই পাল্টে গেছে' - রথীন একটানা কথাগুলো বলে একটু থেমেই আবার বলতে শুরু করলো,'চলো, তাহলে এবার ওঠা যাক | আসলে শ্রুতির কাহিনী শোনার পর বাতাসটা এমন ভারী হয়ে গেছে যে আর কারো অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনার মানসিকতা বোধ হয় আর কারও নেই | আর হ্যাঁ, এই সামনের শুক্রবারই তো আমাদের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ আছে | তারপর বুধবার থেকেই তো ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে | সেটার জন্যও তো এবার নিজেদের তৈরী করতে হবে | হাতে সময় খুব কম | তাছাড়া যে কোম্পানিগুলো ইন্টারভিউ নিতে আসছে তাদের সম্বন্ধেও তো একটু ধারণা রাখার প্রয়োজন আছে | ভাবছি কোম্পানিগুলোর কাজকর্ম সম্বন্ধে অনলাইন কিছু নলেজ জোগাড় করে নিই | কাজে লাগতে পারে | তোদের কি মনে হয় মনীশ | আমি কি ঠিক বলছি ? আমি অবশ্য নিজের মতটাই দিলাম' |

'একদম ঠিক' | মনীশ বলতে শুরু করলো | 'কোম্পানিগুলো কারা কি ধরণের কাজ করে, সেগুলো যেমন জানতে হবে, তেমনই তাদের রেপুটেশন কিরকম, জয়েন করলে কি ধরণের ফেসিলিটি দিতে পারবে, সে সব তো মোটামুটি জেনে রাখতে হবে | তার সাথে আবার ফাইনাল পরীক্ষার প্রিপারেশন | সুতরাং আজকের মতো আমাদের অধিবেশন এখানেই শেষ করতে হবে | পরে কোনো একদিন আবার একসাথে মিলিত হবার আশা বুকে বেঁধে রেখে এবার আমরা উঠে পড়তে পারি' |

 'হ্যাঁ, ঠিক আছে | তোমরা তোমাদের কাজগুলো মন দিয়ে করো | আর, আমরাও এবার আসি | ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ আর ফাইনাল পরীক্ষার জন্য আমাদের সবার তরফ থেকে তোমাদের সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলাম | ভালো ফল করে দেখাতেই হবে | তোমাদের পরীক্ষা-টোরীক্ষা সব হয়ে যাক, তারপর একটা ভালো দিন দেখে আমরা সবাই মিলে আসর বসাবো আর চুটিয়ে আড্ডা মারবো'- এই কথাগুলো বলে প্রতীক্ষা তার বন্ধুদের দিকে তাকাতেই তারাও সমস্বরে বলে উঠলো, 'অবশ্যই আমরা আবার আড্ডা বসাবো, কিন্ত তার আগে তোমাদের ভালো করে পরীক্ষা আর ইন্টাভিউ গুলো দিতে হবে, যাতে কোম্পানিগুলো তোমাদের মোটা অংকের অফার দিতে পারে | ভালো চাকুরী আদায় করে নিতেই হবে |আর অবশ্যই ফাইনাল পরীক্ষা শারীরিক ভাবে সুস্থ থেকে সবাই যেন খুব ভালোভাবে দিতে পারো, ভালো ফলাফল করতে পারো, সেই আশা রইলো আমাদের সবার তরফ থেকে | শুভেচ্ছা রইলো | এই চল সব | এখন গেলে আমরা বোধহয় শেষ দুটো ক্লাস ও করতে পারবো |

 চল যাওয়া যাক | ঠিক আছে, বাই | আবার দেখা হবে | খবর দিয়ে দিও আমরা কবে আবার একটু মজা করতে পারবো' | 'অবশ্যই', মনীশ বললো, 'আমি নিজেই তোমাদের জানিয়ে দেব | ভালো থেকো | এখন চলি আমরা' বলে মনীশ আবার জিজ্ঞাসা করলো, 'তোমাদের কি আমরা একটু এগিয়ে দেব'?

'না, না | তার দরকার নেই | আমরা ঠিক চলে যাবো | তোমরা নিজেদের কাজে যাও, বাই’ |


                                    (৪)


'কতদিন পর আবার দেখা হলো মনীশ'- কথাটা বলেই প্রতীক্ষা একঝলক মনীশকে দেখে নিয়েই আবার বলতে শুরু করলো, 'বাব্বা, একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম | কিছুই ভালো লাগছিলো না | কলেজের ক্লাসেও মন বসাতে পারছিলাম না | সারাক্ষন একই চিন্তা, কবে আবার দেখা হবে | কবে আবার আমরা দুজন দুটো কথা বলতে পারবো মনের মতো | আজ চিন্তার শেষ | এই যে তোমার সঙ্গে দেখা হলো, কথা বলতে শুরু করলাম, এতেই আমি অনেক হালকা বোধ করছি | যাক গে, তোমার কথা বলো | পরীক্ষা কেমন হলো | আর ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট কি কিছু জানতে পারলে ? বলো বলো | আমার আর তর সইছে না, জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে'|

 'পরীক্ষা মোটামুটি ভালোই হয়েছে | একটা বিষয়ে একটু গন্ডগোল করে ফেলেছি | তবে তেমন কিছু নয় | খারাপ লাগছে এই কারণেই যে মার্কসটা একটু কম হয়ে যেতে পারে এই বিষয়টাতে | ফলে ওভারঅল পার্সেন্টেজটাও একটু কম হয়ে যেতে পারে | যদি খুব বেশি কমে যায় তাহলে যে কোম্পানিগুলো আমায় সিলেক্ট করেছে তারা যে সত্তর পার্সেন্ট নম্বর পেতেই হবে, এই যে শর্তটা দিয়েছে, সেটার নীচে নেমে গেলে তো আমি একটা কোম্পানিতেও জয়েন করতে পারবো না | আমাকে তিনটে কোম্পানি অফার দিয়েছে, কিন্তু সবাই বলেছে ফাইনাল পরীক্ষায় সত্তর পার্সেন্ট নম্বর আনতেই হবে, তবেই এই অফারটা প্রযোজ্য হবে | ওই বিষয়টা একটু খারাপ হয়ে যাওয়ায় চিন্তা তো একটা থেকেই গেলো'|

 প্রতীক্ষা হঠাৎ জিজ্ঞেস করেই বসলো,'এই, এই মনীশ, একটু বলো না, কোথাকার কোম্পানি আর কিরকম প্যাকেজ দেবে' | 'ভালো প্যাকেজের অফারই আছে, আসলে আমার ইন্টারভিউতে ওরা এতটাই স্যাটিস্ফায়েড হয়েছে যে বেশ ভালো অংকের প্যাকেজই দেবে বলেছে'| মনীশের কথা শুনে প্রতীক্ষা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করলো,' ও, তুমি তাহলে প্যাকেজের অঙ্কটা বলবে না | ঠিক আছে, না বলবে বোলো না | তবে এটুকু তো বলবে, কোথাকার কোম্পানি, মার্কেটে রিনাউনড কি না' |

 'আরে, এতে মন খারাপ করার কি আছে | এমাউন্ট টা বলছি না,তবে চলনসই | আসলে ছেলেদের মাইনে আর মেয়েদের বয়স এই দুটোই কেউ জানতে পারে না | আর জানতে চাওয়াটাও উচিত নয় | এটা আন্দাজ করে নেওয়াই ভালো | আর কোম্পানিগুলো ? হ্যাঁ, মার্কেটে নামডাক যথেষ্টই আছে | দুটো কোম্পানি বলতে পারো সাউথ থেকে, একটা বেঙ্গালুরু বেসড, আর একটা পুনেতে | তিন নম্বর কোম্পানিটা হরিয়ানার গুরগাওঁ তে | তবে প্রত্যেকটাই ভালো কোম্পানি | সমস্যা একটাই, যদি সত্তর পার্সেন্টের বেশি নম্বর পেয়ে যাই, তবে অসুবিধায় পড়ে যাবো যে, তাহলে কোন কোম্পানিতে জয়েন করবো |

'না, না | তুমি বেঙ্গালুরুতেই জয়েন কোরো | আমার মনে হয় পুনে বা গুরগাওঁ এর থেকে বেঙ্গালুরু তোমার ভালো লাগবে | আর ওখানে পলিটিকাল ডিসটার্বান্স ও বোধহয় কম | আর শহরটাও সুন্দর | আবহাওয়াটাও মোটামুটি মডারেট' | প্রতীক্ষা নিজের মতামত টা জানিয়েই দিলো |

 মনীশ জানালো, 'হ্যাঁ, আমার বাড়ির থেকেও বেঙ্গালুরুর কথাই বলছে | তুমিও তাই বললে | তবে পলিটিকাল ডিসটারবানসের যে কথাটা তুমি বললে, সেটা পুনে বা গুরগাওঁতেও নেই | তবে হ্যাঁ, গরমটা দুই জায়গাতেই বেঙ্গালুরুর তুলনায় বেশিই হবে | আবার দেখো, পুনের আশেপাশে কিন্তু অনেক ভালো ভালো ঘোরার জায়গা আছে | আমি আরো দুদিন সময় নেবো | নেট ঘেঁটে কোম্পানিগুলোর সম্বন্ধে আরও নলেজ জোগাড় করবো | তারপর সমস্ত দিক বিবেচনা করেই মনস্থির করবো কোথায় জয়েন করলে ভালো হবে | এখন এই মুহূর্তে এ বিষয়ে আর চিন্তা করছি না' |

 'এই, তুমি যেখানেই জয়েন করো, কলকাতা থেকে তো দূরে চলে যাবে | তাহলে, আমাদের তো আর দেখাই হবে না | সেই নমাসে ছমাসে দুদিনের ছুটি নিয়ে তুমি কলকাতায় ফিরলে তখন দেখা হলেও হতে পারে | অবশ্য, তোমার বাড়ির লোকেরা যদি তোমাকে বাইরে বেরোনোর অনুমতি দেয় তবেই হয়তো দেখা হতে পারে' |

-'না, না | কলকাতায় আসলে তো নিশ্চয়ই দেখা হবে | কিন্তু যখন আসতে পারবো না, তখন কি আমাদের কথা বলাও বন্ধ থাকবে নাকি | মোবাইল তো আছে, তাতেই কথা হবে' | কথাটা বলে মনীশ প্রতীক্ষার দিকে তাকাতেই প্রতীক্ষা বলে উঠলো, 'কিন্তু ঘরে যতক্ষণ থাকবো তখন ফোন করলে তো অসুবিধায় পড়ে যাবো | বাড়ির লোকেরা জানতে পেরে গেলে আমাকে তো মোবাইলটাই আর ধরতে দেবে না | সব সময় চোখে চোখে রাখবে | তার চেয়ে এক কাজ করো | চিঠির মাধ্যমেও তো আমরা যোগাযোগ রাখতে পারি | চিঠি দেবে, তবে বাড়ির ঠিকানায় নয় | বাড়ির ঠিকানায় দিলে সে চিঠি আমার হাতেই আর আসবে না | তোমাকে তন্দ্রা অথবা শ্রুতির বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেব, তুমি সেখানেই চিঠি পাঠাবে' |

'তুমি কিন্তু এবার আমাকে সত্যিই হাসালে'| মনীশ বলতে থাকলো, 'এই স্মার্ট ফোনের যুগে তুমি এখনও চিঠি নিয়ে পড়ে আছো | ঠিক আছে, চিঠি লিখে আমি কবুতরের পায়ে বেঁধে পাঠিয়ে দেব | এই প্রাচীন পন্থাটাই আমার মনে হয় সবথেকে ভালো হবে' |

'ঠাট্টা করছো' | প্রতীক্ষা একটু অভিমান ভরা মুখ নিয়ে বলতে শুরু করলো, ' ‘আমি তো আমার দিক দিয়ে কি কি ধরণের অসুবিধা হতে পারে শুধুমাত্র সেটাই বলেছি | চিঠি পাঠালে তো আর আমার বাড়িতে পাঠাতে বলছি না, ফলে অসুবিধাটা আর থাকবে না | আর, মোবাইল এ কথা বলতে গেলে তো কলেজে ক্লাস চলাকালীনই করতে হবে | কিন্তু তোমার তো অফিস থাকবে, আমারও ক্লাস থাকবে; কি করে যে কথা হবে? না, আমি আর কিছু চিন্তা করতে পারছি না | হয়তো আমাদের আর কোনো কথাই হবে না, যোগাযোগটাও আস্তে আস্তে নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যাবে | আমার আর কিছু ভালো লাগছে না | তোমার সঙ্গে দেখা না হলে, কথা বলতে না পারলে, আমি তো আর বাঁচতেই পারবো না' |

 'আচ্ছা বাব্বা, ঠিক আছে' | মনীশ প্রতীক্ষাকে একটু সান্ত্বনা দেবার জন্য বলতে থাকলো, 'এতো বেশি চিন্তা করে এখনই মন খারাপ করার কিছু নেই | আগে পাশ করতে দাও | তারপরে চাকুরীটা পাওয়ার জন্য যে মিনিমাম নম্বরটা পেতেই হবে, সেটার গন্ডি পার হতে দাও | চাকুরীটা পেলে কোন অফিসে জয়েন করবো সেটাও ঠিক করতে দাও | তারপর তো কলকাতা ছেড়ে যাওয়া | এখনো অনেক দিনের ব্যাপার | অনেক যদি, অনেক কিন্তুর ব্যাপারটাও তো আছে | শুধু শুধু পরে আমাদের কি হবে, আমরা যোগাযোগ রাখতে পারবো কি না, সে সব যদি এখনই চিন্তা করে মন ভারী করে ফেলি, তবে আমাদের এখন, বর্তমানে পরীক্ষা-ইন্টারভিউ সব হয়ে যাবার পর যে সময়টা হাতে পেয়েছি, সেটার সঠিক মূল্যায়নই করতে পারবো না | অনেক দাম, অনেক মূল্য আছে এই সময়টার | চলো, এই হাতে পাওয়া সুন্দর সময়টাকে আমরা দুজনে যতটা সম্ভব সুন্দরভাবে উপভোগ করি' |

 'ঠিক বলেছো,' প্রতীক্ষা বললো, 'পরে কি হতে পারে সেই চিন্তা করে আমরা আমাদের জীবনের এই মূল্যবান সময়টাকে তো আর নষ্ট হতে দিতে পারি না | চলো, কোথাও যাওয়া যাক | সিনেমায় যাবে নাকি | তাহলে চলো, মেট্রোতে একটা ভালো ইংলিশ মুভি এসেছে - যাবে তো চলো' |

 'মুভি দেখবে ? মনীশের কথার ভাব দেখে মনে হলো ওর ইচ্ছে নেই | বললো, ইংলিশ মুভি বলে নয়, কোনো ধরণের মুভি দেখাটা আমি মন থেকে ঠিক মেনে নিতে পারি না | তুমি পছন্দ করলে হয়তো আমি যাবো না এমন নয়, যাবো, কিন্তু মুভির গল্প থেকে হয়তো নিজেকে সরিয়েই রাখবো; হয়তো দুঘন্টা সুন্দর একটা ঘুমই দিয়ে দেব |আসলে, আমি জানিনা কেন, মুভি দেখাটা আমার সময়ের অপচয় বলেই মনে হয় | এ আমার এক অদ্ভুত বিচারধারা | সবার সাথে মেলে না | তোমার মতের সাথেও মিলবে না | তবু, তুমি যখন বলছো, তোমার যখন ইচ্ছে হয়েছে, চলো তোমার সঙ্গে বসে মুভিই দেখে আসি' |

‘না, না, আমি বলেছি বলেই যে তোমাকে মুভি দেখতে যেতেই হবে এমন নয়' - প্রতীক্ষা বলতে শুরু করলো | 'তোমার ভালো লাগা বা না লাগা, সেটা তো তোমার ব্যাপার | আমি সেখানে জোর করতে যাবো কেন ? তোমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা কোথাও যেতে চাই না | আর তাছাড়া, আমিও চিন্তা করে দেখলাম, মুভি দেখতে গেলে তো আমরা মুভির গল্পের মধ্যেই ঢুকে যাবো | নিজেরা আর গল্প করতে পারবো না | তার চেয়ে ভালো, মুভি নয়, অন্য কোথাও গিয়ে একটু নিশ্চিন্তে বসা যাক, শুধু গল্প, গল্প করেই সময় কেটে যাক | কি বলো'|

 'চলো তাহলে, কোথায় যাবে বলো' - মনীশ ব্যাপারটা পুরোপুরি প্রতীক্ষার ওপরই ছেড়ে দিলো | বললো, 'কোনো মাঠে গিয়ে বসবে না কি কোনো রেস্টুরেন্টে, |

 'হ্যাঁ, মাঠে গিয়ে বসতে পারি' - প্রতীক্ষা বলতে শুরু করলো, | 'কিন্তু কি জানো, মাঠে গিয়ে বসলেই বাচ্চা থেকে বুড়ো, যতজন মাঠে আসবে, সবাই একটা বিরাট কৌতূহলী চোখ আর সজাগ কান নিয়েই আমাদের পাশ ঘেসে বসার বা হেটে পার হবার চেষ্টা করবে | মানুষের কৌতূহল তখন এত বেড়ে যায় যে আজব দুটো জন্তু দেখার মতোই দেখতে থাকবে | এগিয়ে গেলেও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেবে আর নিজের মনেই কল্পনার জাল বুনতে থাকবে | বলবে, কি দিনকাল পড়লো রে বাবা, একা এখন আর কেউ চলতেই পারে না বলে মনে হচ্ছে | পাখনা মেলতেই সঙ্গী জোগাড় করে নিতেই হবে | বাড়ির লোকজনও সব কি রকম ধরণের | ছেলেমেয়েদের বাইরে বেরোনোর ব্যাপারে একটু শক্ত হতেই হয় | না হলেই সব গোল্লায় যায়' |

 'বাঃ, তুমি কি সুন্দর চিন্তা করে নিতে পারো যে লোকে তোমাকে নিয়ে কি ভাবতে পারে' | মনীশ বলতে থাকলো, 'আরে বাবা, কারো কাছে এখন আর এত সময় নেই যে তুমি কি করছো, কি কথা বলছো সে দিকে মন দেবে | যুগ অনেক এগিয়ে গেছে | অন্যকে নিয়ে চিন্তা করার মানসিকতাও লোকে বদলে নিয়েছে | যে যা করছে করুক, আমার কি ? এই রকম একটা চিন্তাধারাই মানুষের মনে কাজ করে | কেউ কারো ব্যাপারে আর নাক গলাতে চায় না | মানুষ এখন নিজের ব্যাপারেই খুশি থাকার চেষ্টা করে | অন্যান্য বাহ্যিক বিষয় বস্তুগুলোকে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে | যাক যে, তাহলে তুমি মাঠে গিয়ে বসবে না বলছো | অবশ্য এখন মাঠে গিয়ে বসলে তোমার অস্বস্তিটা থেকেই যাবে | একবার নিজের মনটাকে যখন এই ধরণের চিন্তাধারায় তৈরি করেই নিয়েছো, তখন মাঠে গিয়ে বসলেও তুমি কোনোমতেই আর সাচ্ছন্দ অনুভব করতেই পারবে না | তার চেয়ে বরং চলো, কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়েই বসি | অবশ্য সেখানেও তোমাকে বেশিক্ষন বসতে দেবে না | কিন্তু তবুও, যতক্ষণ তুমি বসে থাকবে, প্রাণ ভরে মনের কথা বলতে পারবে | অন্যান্যরা হয়তো আড়চোখে তোমাকে একটু দেখার চেষ্টা করবে | তবে ওই পর্যন্তই | একবার দেখে নিয়েই নিজেরা নিজেদের মধ্যেই আলোচনায় মেতে উঠবে | চলো তাহলে, কাছাকাছি একটা মোটামুটি ভালো রেস্টুরেন্ট আছে - সেখানেই যাই' |

               *          *          *            *          *

'কি খাবে বলো' - মনীশ জিজ্ঞাসা করলো | 'চা, কফি তো খাবই, তবে তার আগে কিছু একটা খেতে হবে | একটু ক্ষিধেও পেয়েছে | আসলে রেস্টুরেন্টে ঢুকলে খাওয়ার ইচ্ছেটাও কেমন যেন বেড়েও যায় | বলো, তাড়াতাড়ি বলো | মনের ক্ষিধেটা কিন্তু বাড়তেই আছে' |

 'মনের ক্ষিধে মানে' -প্রতীক্ষা চোখমুখ ভরা এক অবাক চাহনিতে মনীশকে জিজ্ঞেস করেই বসলো | 'কি বোঝাতে চাইছো তুমি' ?

 'কি আর বোঝাবো | এই যে তুমি এখানে আসার আগেই বললে কিছুক্ষন আমার সাথে বসে তুমি তোমার মনের কত কথা আমাকে শোনাতে চাও - তাই তো বললাম, যত দেরি হবে ততই সে সব কথা শোনার জন্য মনের উদগ্রীব ভাবটা বেড়েই চলবে | মানে ক্ষিধেও বেড়ে যাচ্ছে | এক কাজ করি, দুটো ফিশফ্রাই এর অর্ডার দিয়ে দিই | তৈরী করতেও তো একটু সময় লাগবে | তারপর না হয় দুকাপ কফির অর্ডারটাও দিয়ে দেব | ততক্ষনে অনেক সময় পেয়ে যাবো তোমার কাছ থেকে কিছু শোনার | তুমি বলতে থাকো, আমি শুনতে থাকবো বিভোর হয়ে' |

 মনীশের মুখের দিকে একটু চেয়ে দেখেই প্রতিক্ষা বলতে শুরু করলো,'তা কেন' | শুধু আমিই বলবো, আর তুমি শুনবে | না গো, সেটি হবে না | তোমাকেও বলতে হবে আমাকে শোনানোর জন্য | আমার মনে কিন্তু একটা কথাই এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে | তুমি বাইরে চলে যাবে আর আমি রইবো এখানে | দিনগুলো কাটবে কি করে আমার | এতো কঠিন শাস্তি কি তুমি আমায় দিতে পারবে বলো | আমাকে তো তোমার পথ চেয়ে বসে থাকতে হবে, কবে তুমি আসবে | কবে আবার আমরা দুটো মনের কথা বলবো' |

 'কি করা যাবে বলো, এরই নাম চাকুরী' | মনীশ বলতে শুরু করলো -'চাকুরী করতে বাইরে তো যেতেই হবে | তাও তো আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি না | দেশের মধ্যেই অন্য কোনো রাজ্যে, যেখানে মোটামুটি হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ছেলেমেয়েরা চাকুরী পেতে পারে | ঘরের পাশেই তো কেউ আর চাকুরী নিয়ে বসে নেই যে বললাম আর চাকুরী দিতে রাজি হয়ে গেলো | সেটা সম্ভবও নয় | হ্যাঁ, এমন হয়তো হতে পারে যে কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা হয় গেলে পরে চাকুরী পরিবর্তন করে অথবা ট্রান্সফার নিয়ে এ রাজ্যে এসে গেলাম | সেটা হলেও হতে পারে | অবশ্য আমার মনে হয় সেটা হবার সম্ভাবনা খুবই কম | তবুও, আশা তো করা যায়' |

 'তাহলে আমার কি হবে ? আমি কি করবো' ? প্রতীক্ষা চোখেমুখে বিরাট জিজ্ঞাসার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললো |

'কি হবে মানে ? কি আবার হবে |আমি তো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি না | তাছাড়া আমি তো মাঝেমাঝেই আসবো | বাড়ি আসার নাম করে তোমাকে দেখতে আসবো | তোমার সাথে ঘুরে বেড়াতে আর অনেক অনেক কথা শুনে আনন্দ উপলব্ধি করার জন্য তো আসতেই হবে' | মনীশ সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে প্রতীক্ষাকে |

' আর যখন আস্তে পারবে না বা এমনও তো হতে পারে যে আসার জন্য ছুটিছাটার ব্যবস্থা করে উঠতেই পারলে না বা আসার ইচ্ছেটাও ধীরে ধীরে কমে গেলো, তখন কি হবে - আমি সে কথাটাই জিজ্ঞেস করছি' | একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে মনীশের মুখের দিকেই চেয়ে রইলো প্রতীক্ষা |

 'এক এক করে তোমার কথায় আসছি | হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো | কাজের চাপ যদি কোনো সময় বেশি থাকে, তখন হয়তো ঘন ঘন আসতে পারবো না | অনেক সময় এমনও হতে পারে যে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ ছুটি দিতে রাজি হলেন না, সে ক্ষেত্রেও নিয়ম মাফিক আসাতে ব্যাঘাত ঘটবে | সে ক্ষেত্রে আসাটা হয়তো অনেক দিন দেরি হলেও হতে পারে | তবে হ্যাঁ, শেষে যে কথাটা বললে, আসার ইচ্ছেটা কমে গেলে - এখানে আমাকে একটা প্রতিবাদ করতেই হচ্ছে | ইচ্ছেটা কমে যাবে কেন ? আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ, আমার ভালোবাসা পড়ে থাকবে এখানে আর আমার তার সাথে দেখা করার ইচ্ছেটাই কমে যাবে ? আমি রইবো দূর দেশে সেটা ঠিক | কিন্তু পথের এই দূরত্ব আমাদের মনের দূরত্বকে বাড়িয়ে তুলবে কেন ? অবশ্য তুমি এটা বলতেই পারো যে চোখের সামনে থাকার টান বা বন্ধনটাই আলাদা | আর চোখের বাইরে থাকা মানেই ধীরে ধীরে দূরে সরে যাওয়া | কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ওই একই ব্যাপারটা ঘটতে যাবে কেন ? কেন আমাদের মনের দূরত্ব বেড়ে যাবে ? তাহলে তো এটাই প্রমান পাবে যে, আমাদের ভালোবাসা, একের প্রতি অপরের আন্তরিক টান, সবই ঠুনকো | স্থিতিশীল নয় | মনের বাঁধনটা অপল্কা | কিন্তু সেটা তো সত্যি নয় | এ বাঁধনে আছে অন্তরের টান | দূরত্ব বেড়ে গেলে সে বাঁধন তো আরো দৃঢ়তর হবার কথা | ছিন্ন হয়ে যাবার কথা তো নয় | যদি তাই হয়, ছিন্নই হয়ে যায়, তবে নিশ্চয়ই আমাদের ভালোবাসার মধ্যে কোনো খাদ রয়ে গেছে | সহজেই ভেঙে যাবার ইন্ধন আগে থেকেই অন্তরের গভীরে গোপনে রাখা আছে | সুযোগ পেলেই সে তার নিজের রূপ দেখিয়ে দেবে | দুজনকেই শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে | না না, সে হতে পারে না | আমরা সেটা হতে দেব না | যদি বেশ কিছুদিন আমাদের দেখা না হয়, আমরা ধরেই নেবো যে সেটা নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধার কারণেই হয়ে উঠছে না | কেউ যেন কাওকে ভুল না বুঝি | এখন, এই মুহূর্তে হয়তো দেখা হচ্ছে না, তবে ভগবান নিশ্চয়ই কোনো সুন্দর ব্যবস্থা করে দেবেন যাতে আমরা আবার কাছাকাছি আসার সুযোগ করে উঠতে পারি | যাই হোক, এই নিয়ে চিন্তা করে আর এখন মন খারাপ করো না | হাসিখুশি থাকো, ভালো থাকবে | অবশ্য এখন স্মার্ট ফোনের দৌলতে আমরা তো ভিডিও কলেও কথা বলতে পারি | কিন্তু তুমি তো আবার সেটাও চাও না | তোমার আবার চিঠির ওপরেই ভরসা বেশি | ঠিক আছে, চিঠিতেও যোগাযোগ রাখা যাবে | সুতরাং, একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে মনের ওপর আর বোঝা বাড়িও না | একটু হাসো, একটু আনন্দ করো' |

মনীশের কথা শেষ হতেই প্রতীক্ষা বলে উঠলো,'এই তোমাদের ফাইনাল পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময় হয়ে গেলো না | কবে বেরোচ্ছে' ?

 'সামনের সপ্তাহের প্রথম দিকেই, সোম বা মঙ্গলবার', মনীশ জানিয়ে দিলো | 'আর হ্যাঁ, তারপরেই তো পাড়ি দেবে বেঙ্গালুরুতে | সুতরাং হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিনই সময় | তার পরেই তো বুকে পাথর বেঁধে দিন পার করতে হবে'| প্রতীক্ষার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো |

 'আরে, অত চিন্তা করছো কেন ? সত্তর পার্সেন্টের কম নম্বর হলেই তো আর নো চাকুরী | অন্য রাস্তা দেখতে আবার পথে পথে ঘুরতে হবে | যদি আমাকে তোমার কাছেই এখানে বেঁধে রাখতে চাও তাহলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করো, হে ভগবান, কিছুতেই ওকে সত্তর পার্সেন্টের বেশি নম্বর পেতে দিও না | সত্তরের নিচেই রাখো আর ওকে এখানে আটকেই রাখো' |

 'আরে তা কেন | আমি কি তাই বলেছি নাকি | তুমি ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করবে, ভালো চাকুরী করবে, জীবনে উন্নতি করবে, প্রতিষ্ঠিত হবে, আমি ভগবানের কাছে এগুলি চাইবো নাকি তোমার যাতে উন্নতি না হয়, অমঙ্গল হয় সেই প্রার্থনা করবো | এই কি তুমি আমাকে জানতে পেরেছো এতদিনে ? আমি কি কখনও তোমার যাতে অমঙ্গল হয় সেই চিন্তা মাথায় আনতে পারি ? কখনোই নয় |তুমি আমাকে এত ছোট করে দেখ না, আমি সহ্য করতে পারবো না'|

প্রতীক্ষার চোখমুখ ছলছল করে উঠেছে দেখেই প্রতীক্ষার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মনীশ বলে উঠলো,'আরে বাবা, এতে মন খারাপ করার কিছুই নেই | এতো কথার কথা বললাম | এটা কি আমার মনের কথা নাকি | তোমার সঙ্গে একটু রসিকতা করতে চাইছিলাম | তুমি এত সিরিয়াসলি নেবে সেটা বুঝতে পারিনি | আমার সত্যিই খুব ভুল হয়ে গেছে | কিছু মনে করো না প্লিজ | এগুলো তো সত্যি সত্যিই আমাদের মনের কথা নয় | আমরা দুজনে দুজনকে খুব ভালো ভাবে জানি | আমরা একজন আর একজনের ক্ষতি বা অমঙ্গলের কথা চিন্তাতেই আনতে পারবো না | মন খারাপ করো না | চলে যেতে হবে বলে আমারই কি ভালো লাগছে | শুধু মনের ভার, বোঝাটা একটু হালকা করার জন্যই তো মাঝে মাঝে আমি হালকা কথা বলে ফেলি | উল্টোপাল্টা বলে যদি নিজেকে সহজ বা স্বাভাবিক রাখতে পারি | চলো, এখন তাহলে ওঠা যাক | কফি কখন শেষ হয়ে গিয়েছে | এতক্ষন যে ওরা আমাদের এখানে বসতে দিয়েছে এটাই ওদের বদান্যতা | চলো উঠি'|


     *          *          *          *          *          *


'তোমাদের তো রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে | কেমন হলো’| প্রতীক্ষা জিজ্ঞাসা করলো |

 'আর কেমন | আমাদের মধ্যেকার দূরত্বটা এবার সত্যি সত্যিই বেড়ে গেলো | আর তো মাঝে মাঝেই এই ভাবে দেখা সাক্ষাৎ করা হয়ে উঠবে না | নমাসে-ছমাসে হয়তো এক আধবার | আমি ভাবছি তোমাকে ছেড়ে এতো দূরে গিয়ে আমি থাকবো কেমন করে | সারাক্ষণই তো আমার মনের মাঝে তুমি | কিন্তু এই রাস্তার দূরত্ব আমাদের মনের দূরত্বকে বাড়িয়ে দেবে না তো'|

মনীশের কথা শেষ হবার আগেই প্রতীক্ষা জিজ্ঞেস করলো,'কেন. আমাদের মনের দূরত্ব বেড়ে যাবে কেন | মনের দিক দিয়ে আমরা যতটা কাছাকাছি আছি ততটা থাকবো | আর তুমি ভাবছোটা কি | তুমি বেঙ্গালুরু চলে গেলে আমি আমার মনটাকে শান্ত রাখতে পারবো ? মানসিক যন্ত্রনায় আমার বুকটা ফেটে যাবে না ? কিন্তু তুমি তো এখনও বললে না যে কত পার্সেন্ট নিয়ে পাশ করেছো | তোমার কথায় তো বুঝতে পারছি যে সত্তর পার্সেন্টের বেশিই পেয়েছো | আর তাতেই তো মনে মনে এতো ভেঙে পড়েছো | এই আমি প্রথম এমন একজনকে দেখলাম যে ভালোভাবে পাশ করেও মনে একরাশ দুঃখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে | এখন তো মনে হচ্ছে তুমিই হয়তো ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলে যেন সত্তর পার্সেন্ট না হয় - আর তুমি তোমার মনের প্রার্থনাটা আমার ওপরই চাপিয়ে দিয়েছিলে | এমন ভাবে বলেছিলে যেন আমারই ইচ্ছে ছিল তুমি কম নম্বর পাও | দেখো, তুমি বড় হবে, ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করবে, ভালো চাকুরী করবে, জীবনে অনেক অনেক উন্নতি করবে, প্রতিষ্ঠিত হবে - আমার মনের চাহিদা তো এই রকমই হওয়া উচিত কিনা বলো | তোমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখলে আমারও তো আনন্দ হবে | আমিও সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে বলতে পারবো আমি যাকে মন দিয়ে বসেছি, সে যে আমার গর্ব, আমার অহংকার | তোমার সাফল্যে আমার নিজেকে সম্পূর্ণ সফল বলেই তো মনে হচ্ছে | মন খারাপ কোরো না | যোগাযোগ তো থাকবেই, সে মোবাইলেই হোক বা চিঠিপত্রের মাধ্যমেই হোক | আমাদের ভালোবাসা তো এতো ঠুনকো নয় যে দুদিন দেখা না হওয়ার কষ্টের বোঝা সেই ভালোবাসাকে সন্দেহ করতে শুরু করবে | সেরকম হলে তো আমরা নিজেদের কাছেই হীনমন্য হয়ে যাবো | এতো নীচ আমরা হতে পারবো না | যাই হোক, তোমার সাফল্যে আমার মনপ্রাণ ভরে গিয়েছে | আমি সত্যিই খুব আনন্দিত, খুব খুশি | চলো তোমার এই কৃতিত্বকে আমরা সেলিব্রেট করি | কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি | আজ কিন্তু পয়সা খরচ করার দায়িত্বটা সম্পূর্ণই আমার | তুমি না করতে পারবে না'|

 'না না, তাই হয় নাকি ? তুমি খরচ করবে আর আমি তোমার পয়সায় খেয়ে আসবো | হয় না, সেটা একদমই হতে পারে না | খরচটা আমিই করবো' -মনীশ বলে উঠলো |

প্রতীক্ষা মনীশের প্রতিবাদের ধরণকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনেই বললো, 'আমি যখন বলেছি আজকের খরচ আমার, তখন আমিই খরচ করবো, তুমি না বলতে পারবে না | অবশ্য তোমার যদি মনে হয় এর ফলে তুমি আমার কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছ, তবে অন্য কোনোদিন তুমি খাওয়ানোর দায়িত্বটা নিও | আজ কিন্তু সমস্ত দায়িত্ব আমার | তুমি শুধু লক্ষ্মী ছেলের মতো আমার সঙ্গে যাবে, বসবে, গল্প করবে | বাকি দায়িত্ব আমার'|


                                    (৫)


প্রতীক্ষার আর প্রতিক্ষা সইছে না | প্রায় দুমাস হয়ে গেলো মনীশ বেঙ্গালুরু চলে গেছে, এখন পর্যন্ত একটা খবরও জানালো না | ওখানে গিয়েই কি আমাকে ভুলে গেলো ? মনটা একটু ভারী হয়ে উঠলেও প্রতীক্ষা নিজের মনেই বলে উঠলো, এরকম অবিবেচক তো মনীশ নয় | চিঠি পাঠাবে বলেছিলো, সেইমতো তন্দ্রার বাড়ির ঠিকানাটাও তো দিয়ে দিয়েছিলাম | সেখানেও কোনো চিঠি আসেনি এখনো নিশ্চয়ই | চিঠি পেলে তন্দ্রা তো নিশ্চয়ই জানাতো | মনীশদের বাড়িতে গিয়েই জিজ্ঞেস করবো না কি একবার, কোনো খবর পাঠিয়েছে কি না | আবার ওদের বাড়িতে গেলেও তো আমাকে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে | কি যে করি, কিছুই মাথায় আসছে না | তন্দ্রাকে একটা ফোন করি ? না থাক, আর একটু পরে তো কলেজেই ওর সাথে দেখা হবে | তখনই না হয় একবার জিজ্ঞেস করে নেবো | নানা ধরণের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিছুই ভালো লাগছে না | তবু কলেজ তো যেতেই হবে | কোনো খবর না এসে থাকলে এখন তো অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই | মোবাইলে খবর পাঠাতে মানা করে দিয়েছি, তাই হয়তো বাবুর গোঁসা হয়েছে |

কলেজের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তন্দ্রা প্রায় চিৎকার করেই প্রতীক্ষা কে ডেকে উঠলো, 'এই প্রতীক্ষা, তোর একটা চিঠি এসেছে | মনীশদা পাঠিয়েছে | কালকে বিকেলের ডাকে এসেছে | আমি কিন্তু বাবা, তোর চিঠি খুলেও দেখিনি | বাড়ির লোকেও খোলেনি | তবে ঐরখমই মানে একটু খোলা খোলা, ছিঁড়ে যাওয়া অবস্থাতেই এসেছে | আমার বাড়ির লোকেরা অবশ্য জিজ্ঞেস করছিলো যে তোর চিঠি আমাদের ঠিকানায় কেন এসেছে | আমি সমস্ত কিছু বুঝিয়ে বলার পর তারা শুধু একটু মুচকি হেসে বলেছিলো, আজকালকার ছেলেমেয়েদের কান্ড কারখানা দেখো | বাড়িতে জেনে যেতে পারে বলে এই গোপন ব্যবস্থা | এই নে তোর চিঠি | বাব্বা, চিঠির অপেক্ষায় থেকে আমাদের এই সুন্দরী বন্ধুটা একেবারে শুকিয়ে যেতে বসেছে | এবার তো মন খুলে একটু হেসে ওঠ, কথা বল | মনীশদা বেঙ্গালুরু চলে যাওয়ার পর থেকে তো তোর মুখের হাসিটা আমরা আর দেখতেই পাইনি | যা,যা; একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে বসে চিঠিটা পড় | অবশ্য আমাদেরও চিঠিতে লেখা বিষয় বস্তু নিয়ে একটু আগ্রহ থেকেই যাচ্ছে | তাই, প্রথমে তুই পড়ে নে | তারপর আমাদের আগ্রহটা মিটিয়ে দিবি মনীশদা কি লিখেছে জানিয়ে দিয়ে |

প্রতীক্ষা কলেজ ক্যান্টিনের একেবারে শেষ বেঞ্চে বসে ধীরে ধীরে চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো | 'সুচরিতাসু প্রতীক্ষা, লেখার প্রথমেই বলে রাখি, চিঠি লেখাটা আমার ঠিক আসে না | সেজন্য অনেক ভুলত্রুটি নিশ্চয়ই পাবে, কিন্তু সেগুলো ধরতে যেও না, অযথা সময় নষ্ট হবে | অনেকদিন হয়ে গেলো তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি, তাই প্রথমেই মার্জনা ভিক্ষা করে নিলাম | এর ফলে আমিও আমাকে অনেকটা হাল্কা অনুভব করতে পারলাম | তুমিও নিশ্চয়ই আর আমার ওপর রাগ করে থাকবে না | তাই চিঠি দিতে দেরি হওয়ার কারণগুলো এক এক করে জানিয়ে দিই | এখানে এসে অফিসে জয়েন করার পর থেকেই বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই ছিলাম | প্রথমত, থাকার জন্য ভালো কোনো জায়গা পেয়েছিলাম না | একটা গেস্ট হাউসে আরো দুজনের সাথে একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম মাত্র | খাওয়া দাওয়া বাইরেই সারতে হতো, কোনো হোটেল, রেস্টুরেন্ট বা রাস্তার পাশের কোনো অস্থায়ী ভোজনালয়ে | জয়েন করার পরপরই আমাদের তিন মাসের ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করলো কোম্পানি | সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত | প্রচন্ড খাটুনি গেছে এই তিন মাস | শরীর এতো ক্লান্ত হযে পড়তো যে গেস্ট হাউসে ফিরে কোনোরকমে রাতের খাবারটা খেয়ে নিয়েই শুয়ে পড়তাম | পরের দিন আবার সকাল সকাল বেরোতে হবে তো | অবশ্য মোটামুটি দক্ষতার সাথেই এই ট্রেনিংটা শেষ করেছি | গ্রেড দিয়ে ইভালুয়েশন করেছে | আমি 'এ' গ্রেড পেয়েই উত্তীর্ণ হয়েছি | তারপরেই এখানে একটা বিভাগে আমাকে পোস্টিং দিয়েছে | একটা বসার জায়গা পেয়েছি | চেয়ার, টেবিল, আলমারি, ল্যাপটপ সব দিয়েছে | কাজও শুরু করে দিয়েছি | আর হ্যাঁ, গতকালই কোম্পানির তরফ থেকে একটা থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে | দুই ঘরের একটা ফ্ল্যাট | ডাইনিং, ড্রয়িং, বাথরুম, টয়লেট সবই আছে | একটা ছোট বারান্দাও আছে | মোটামুটি ভালোই ফ্ল্যাটটা | আর শহরের সম্ভ্রান্ত এলাকাতেই দিয়েছে | তুমি এখানে আসলে তোমারও ভালো লাগবে | কবে আসবে বলো | আসার প্রস্তুতি শুরু করে দাও | এতো খুশির মধ্যেও কিন্তু তোমাকে এতদিন দেখতে না পাওয়ার বেদনা আমাকে ভেতর ভেতর শেষ করে দিচ্ছে | বড্ডো বেশিই কষ্ট পাচ্ছি মনে হচ্ছে | আসলে তুমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছো যে তোমাকে না দেখে আর থাকা যায় না, বড় একা একা লাগে | তোমার খবর বলো | কেমন আছো | আমাকে ছেড়ে তোমার দিন কাটছে কেমন করে জানিও | তন্দ্রারা সব ভালো আছে নিশ্চয়ই | ওদের জানিয়ে দিও যে ওদের মনীশদা প্রতীক্ষা কে ছেড়ে মোটেই ভালো নেই | প্রতীক্ষাকে ছাড়া মনীশদা ভালো থাকতে পারে না | আর হ্যাঁ, এখনই কলকাতায় ফিরতে পারছি না | কাজের যথেষ্ট চাপ আছে | তাছাড়া এখনই বড় ছুটি কিছু পাবো না | সবে জয়েন করেছি তো | সপ্তাহের শেষে একদিনের ছুটিতে তো আর কলকাতা থেকে ঘুরে আসা যায় না | পরে যদি দিন সাতেকের জন্য হলেও ছুটির ব্যবস্থা করে উঠতে পারি তবেই তোমার সাথে দেখা করার সম্ভাবনাটা বাড়বে | দেখা যাক কবে কি করতে পারি | ভালো থেকো | তুমি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো | আজ এই পর্যন্তই | পরের সপ্তাহে আবার চিঠি পাঠাবো | আপাততঃ আসি -- তোমার মনীশ |

চিঠিটা পড়া শেষ করে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলো প্রতীক্ষা | চিঠিটা পেয়ে সত্যিই খুব ভালো লাগছে | অনেক দিনের না দেখা হওয়ার বেদনাটা একটু যেন কমেছে বলে মনে হচ্ছে | একটু অন্যমনস্ক ভাবেই ধীরে ধীরে ক্লাসের দিকে এগিয়ে চললো প্রতীক্ষা | ক্লাসের সময় হয়ে গেছে | একটু চুপ করে কিছুক্ষন বসে থাকতে ইচ্ছে করছে | অবশ্য বন্ধুরা কি আর চুপ করে বসে থাকতে দেবে, চিঠিতে কি লেখা আছে সেটা জানার আগ্রহ ওদের অপরিসীম |

        *                 *                   *                   *

ভালোই কাটছিলো | চিঠিপত্রের আদান প্রদানে দুজনে দুজনের মনের কথা উজাড় করে বলতে পারছিলো | দূরে থাকার জন্য যে একটা কষ্ট মনটাকে দুমড়ে মুষড়ে যেমন শেষ করে দিতে পারে, তেমনি মনের টানটাকে আরো তীব্র, আরো শক্ত করে গড়ে তুলতে পারে | সেটা প্রতীক্ষা বেশ ভালো ভাবেই অনুধাবন করতে পারছে | এতো কষ্ট কোনোদিন যে সে পেতে পারে এতকাল সেটা অনুভবই করতে পারেনি | আজ বুকটা একেবারে ফেটে যাচ্ছে | ভেতরের একরাশ বেদনা একসাথে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। কি করবে এখন। বাড়িতে তো প্রচন্ড অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। কি হবে তাহলে এখন। আর কোনোদিন কি মনীশকে দেখতেও পাবে না।

মনীশের হাতে একটা চিঠি এসে পৌঁছলো। প্রতীক্ষা পাঠিয়েছে। ভালোবাসা মাখা একটা সুগন্ধ লেগে রয়েছে কি চিঠিতে | বুকের মধ্যে অনেক উচ্ছ্বাস, অনেক আশা নিয়ে তড়িঘড়ি চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো মনীশ |

সুপ্রিয় মনীশ, আশা করি ভালো আছো | এতগুলো মাস কেটে গেলো, আমরা পরস্পর পরস্পরের চাক্ষুষ সাক্ষাত পাইনি | এতদিন আমরা আমাদের মনের কথা চিঠির মাধ্যমেই উজাড় করে আদান প্রদান করেছি | দূরে থাকার জন্যই বোধহয় আমাদের প্রেম, ভালোবাসা আরো সুদৃঢ় হয়েছে | আমি তো তোমাকে ছাড়া আমার ভবিষ্যৎ জীবন কিভাবে কাটাবো সেটা চিন্তাতেই আনতে পারিনা | অথচ আমার বাড়ির পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আমার ভবিষ্যৎ বিপর্যস্ত হতে বসেছে | মনীশ, তুমি তো জানো আমার বাবার একটা ব্যবসা রয়েছে, যার ওপর নির্ভর করেই আমাদের সংসারটা চলে | কিন্তু ব্যবসা জিনিসটা এমনই যে যখন সেটা ভালোভাবে চলতে থাকে, তখন আমরা সবাই রাজা | খুশিতে ডগমগ, আনন্দে আত্মহারা | আর সেই ব্যবসা যখন ডুবতে থাকে তখন আর থৈ পাওয়া যায় না | আমরা তখন দীন, দরিদ্র | আমাদের তখন হতশ্রী অবস্থা | গত বছর ব্যবসাতে বাবা বড় ধাক্কা খেয়েছে | বাজার পড়ে যাওয়ায় ঠিক সামলাতে পারেন নি | এতো বড় সংসারটাকে কিভাবে চালাবেন সেটা চিন্তা করেই নিজে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যেতে থাকেন | কিভাবে খাওয়ার জোগাড় করবেন, কিভাবে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন, সারাদিন এই সব চিন্তা করেই নাওয়া খাওয়া একদম বন্ধই করে দেন | ফলে তার শরীরও ভাঙতে শুরু করে | অবশেষে কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের পরামর্শে নিজের ব্যবসাকে দাঁড় করানোর জন্য এক বন্ধুর কাছ থেকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ধার হিসেবে নেন | কথা ছিল ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলেই সে সমস্ত টাকা ধীরে ধীরে সুদ সমেত শোধ করে দেবেন | টাকাটা ধার তো নেওয়া হয়ে গেলো, কিন্তু ব্যবসাটা আর আগের মতো জমলো না | লাভ হচ্ছে, কিন্তু পরিমান মতো না হওয়ায় সংসার চালিয়ে, পড়াশোনার খরচ খরচা চালিয়ে ধার শোধ করার মতো আর টাকা বাচঁতই না |  

এই ভাবেই একটা বছর পার হয়ে গেছে | ধার শোধ করার সময় সীমাও পার হয়ে গেছে | প্রায় প্রতিদিনই বাবা তার সেই বন্ধুর কাছে গিয়ে অনুনয় বিনয় করেছেন আরও কিছু সময় দেবার জন্য | অবশেষে সেই ভদ্রলোক সেদিন বাবাকে বলেই দিলেন যে, 'টাকা পয়সা নিয়ে অতশত চিন্তা করতে হবে না, শোধ দেবার কথাও উঠবে না যদি বাবা তার মেয়ে প্রতীক্ষাকে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন তার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে | তুমি তো জানোই মনীশ, ভদ্রলোকের ওই একটিই ছেলে | রত্নই বলতে পারো | স্কুলের গণ্ডিটাই পার হতে পারেনি | এখন তো সে দিনরাত মস্তানি করেই বেড়ায় | তোলা আদায় করে | মারদাঙ্গা করার জন্য দুএকবার জেলও খেটে এসেছে | বাবার বন্ধু বাবাকে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন যে, তার ছেলের সাথে প্রতীক্ষার বিয়ে দিয়ে দিলে ধারের টাকা আর শোধ করতে হবে না | বরং মেয়ে আর তার বাপের বাড়ির সকলেই সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে | কোনোদিন কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতেই হবে না | মুখের ওপর না বলে দিয়েই বাবা সেদিন চলে এসেছিলেন | ঘরে এসে সমস্ত কথা জানাতেই মা একেবারে ভেঙে পড়েন | আমি চোখের সামনে অন্ধকার দেখতে থাকি | ঘোর একটু কাটতেই বাবাকে বললাম যে তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে | তারা জানতে চাইলেন কি কথা | মনীশ, তোমার কথা, আমাদের কথা, আমাদের এই ভালোবাসার কথা, তোমার চাকুরীর কথা, তুমি যে বেঙ্গালুরুতে আছো সে সমস্ত কথাই আমি তাদের জানালাম | এমন কি তোমার পাঠানো উপহার ও সমস্ত চিঠিগুলোও দেখালাম | বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরপরে তুমি আমাকে কি করতে বলো | বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন | মা চোখের জল মুছতে মুছতে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন | আমি হতাশ হয়ে বসে থাকলাম |

বাবার ওপর চাপ আসতে শুরু করলো | যত শীঘ্র সম্ভব মেয়ের বিয়ে দিয়ে আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দাও, এতে উভয় পক্ষেরই মঙ্গল | অবশেষে এই চাপের মুখে পড়ে একদিন বাবা তোমার কথা, আমাদের ভালোবাসার কথা তার বন্ধুকে জানিয়ে দিলেন | বললেন যে তার মেয়ে এই ছেলেটিকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে | ওরা দুজনেই পরস্পর পরস্পকে এতো ভালোবাসে যে ওদের স্বপ্নকে এইভাবে শেষ করে দিলে বাবা হিসেবে তার এ ঘোরতর অন্যায় হবে | ওদের আন্তরিক ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে তিনি তার মেয়ের এইভাবে বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন না | এটা তার পক্ষে বড় অনৈতিক কাজ হবে বলেই তিনি মনে করেন | তিনি তার মেয়ের স্বপ্নকে এইভাবে নিজে হাতে শেষ করে দিতে পারবেন না | বন্ধুকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন বাবা | অনেক অনুনয় বিনয় করে বললেন যে টাকা পয়সার ব্যাপারটা তাদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক না | ছেলেমেয়ের জীবনগুলো হঠাৎ করে এই ঘটনার মধ্যে টেনে এনে নষ্ট করে দেওয়া তো উচিত হবে না |

বাবা তার বন্ধুর সাথে যখন কথা বলছিলেন তখন তার ছেলেও সেখানেই ছিল | সব শুনে সে অপদার্থতা বলে উঠলো, 'ওহ, সে তো এখন তাহলে বেঙ্গালুরুতেই আছে | তা আসুক না এখানে | কলকাতার মাটিতে যেদিন পা রাখবে সেদিনই শেষ করে দেবো | তখন তা আর তাহলে ভালোবাসা টালোবাসা বলে কিছু থাকবে না | অগত্যা আমাকেই ভালোবাসতে হবে’ |

‘মনীশ, তোমাকে আমি একটাই অনুরোধ করছি, প্লিজ, তুমি এখন কলকাতায় এস না | আসলেই ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে | ওরা পারে না এমন কোনো কাজই নেই | সব পারে | আমার জন্য তুমি চিন্তা করো না | আমার যা হবার হবে | শুধুমাত্র আমার কারণেই আমি তোমাকে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারি না | প্লিজ, আমার কথাটা শুনবে লক্ষ্মীটি | জানি, এই চিঠি পেয়েই তুমি ভেঙে পড়বে | মনের হতাশা আর চেপে রাখতে না পেরে হয়তো সেদিনই কলকাতার দিকে রওয়ানা দেবে । কিন্তু প্লিজ তুমি এসো না । সে ছেলেটি হুমকি দিয়ে রেখেছে যে তার সাথে বিয়ে না দিলে আমাদের সংসারটা একেবারে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে । বিয়েটা না হলে বাবাকেও প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রেখেছে ।

বাবা তো এমন ভেঙ্গে পড়েছেন যে বারে বারে বলছেন 'আমার সোনার প্রতিমাকে আমি নিজে হাতে কি ভাবে বিসর্জন দিয়ে দেবো' । মনীশ এখন আমি কি করবো বলো । বিয়ে না দিলে বাবাকে ওরা মেরে ফেলবে । আমার ভবিষ্যত কি হবে, কোথায় গিয়ে পড়বো সে সব চিন্তা করে বাবাকে তো মরতে দিতে পারিনা । তোমাকেও কলকাতায় দেখলেই ওরা তোমায় মেরে ফেলবে । আমি তো কিছু বুঝেই উঠতে পারছি না এই অবস্থায় আমার করণীয় কি । আমি বাবা-মাকে জানিয়ে লুকিয়ে তোমার ওখানে চলে যেতেই পারি কিন্তু সেক্ষেত্রে ওরা বাবাকে মেরে ফেলবে । সংসারটা তছনছ করে দেবে । আর যদি সেটা হয় তাহলে তো আমি আমার সারা জীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না । আমি বুঝতেই পারছি না কি করলে দুকূলই রক্ষা পাবে । মনীশ প্লিজ আমার অবস্থাটা অনুধাবন করার চেষ্টা কোরো । আমাকে সব দিক রক্ষা করার একটা উপায় বলে দাও । আমি আর পারছি না’ -- 'তোমার প্রতীক্ষা ।তোমার ভালোবাসা’|

চিঠি পড়া শেষ করে মনীশ বেশ কিছুক্ষন স্থির হয়ে বসে থাকলো | বুঝতে পারছে না এমতাবস্থায় ঠিক কি করা উচিত হবে, কি বলা ঠিক হবে | ভাবতে থাকে, চিঠি লিখবো ? কিন্তু কি লিখবো | অবশ্য এখন চিঠি লেখার তো কোনো মানেই হয়না | প্রতীক্ষার বাড়িতে তো সবাই জেনেই গেছে | তাহলে তো ফোনটাই করা যায় |

প্রতীক্ষা ফোনটা তুলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে | মনীশ সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে চলে | কিন্তু এ কান্না তো শুধু সান্ত্বনা দিয়ে থামানো যায় না | অন্তরের গভীরতম স্থান থেকে ব্যর্থতার বেদনা, সব হারানোর বেদনা ঝরনা ধারার মতো অবিরাম বেরিয়ে আসতে চাইছে | সে ফল্গুধারাকে অবরুদ্ধ করা মনীশের পক্ষে সম্ভব নয় | তবুও চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে |

মনীশ বলে উঠলো,'আচ্ছা, পুলিশে তো জানানো যেতেই পারে হুমকির কথাটা | সেটা করছো না কেন তোমরা'|

ও প্রান্ত থেকে কান্না ভেজা গলায় প্রতীক্ষা বলতে থাকে,'হ্যাঁ, হুমকির কথাটা পুলিশকে জানালে হয়তো প্রাথমিক ভাবে পুলিশ ওদের এরেস্ট করতেও পারে, কিন্তু তারপরে তো প্রমাণাভাবে ছেড়ে দিতেই হবে | না দিলেও, যদি জেলও হয়, পয়সার জোরে কিছুদিন পর ঠিক বেরিয়ে আসবেই | তারপর আমাদের কি ওরা ছেড়ে দেবে ? শয়তানের মন, যা ইচ্ছে তাই করতে পারে’ |

'তাহলে তুমি বলছো যে কোনোভাবেই ওদের হাত থেকে তোমাদের রেহাই নেই | তাহলে তো আমার একটা কথাই বলার আছে | তুমি ওই ছেলেটাকে বিয়ে করে নাও | তোমাদের সংসারটা বাঁচবে আর তোমার কথা অনুযায়ী আমিও বাঁচবো - কলকাতায় নির্ভয়ে যেতে পারবো' | মনীশ বলে উঠলো |

'তুমি এ কথাটা আমায় বলতে পারলে ? এই আমাকে তুমি এতো ভালোবাসো ? আমাদের এতো দিনের প্রেম, ভালোবাসা নিছকই মিথ্যে ছিল ? আমাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে তুমি নিজের বাঁচার কথা চিন্তা করছো' ? অভিমানী গলায় প্রতীক্ষা বলতে থাকে |

'কি মুশকিল, আমি তো আমার বাঁচার কথা বলছি না | তোমাদের সংসারটাকে তো বাঁচাতে হবে’ | মনীশ বলতে থাকে |’ তাছাড়া তুমি আমাকে যে কথাগুলো জানিয়েছে, তোমাদের সংসার তছনছ হয়ে যাওয়ার কথা, তার পরিপ্রেক্ষিতেই তো বলতে হচ্ছে এই কথাগুলো | সবকিছু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো আমি তোমাকে ঠিক পরামর্শই দিচ্ছি | এটা ঠিক যে, তোমাকে, তোমার জীবনটাকে, আমাদের ভালোবাসাকে, আমার সাথে ঘর বাঁধার রঙিন স্বপ্নগুলোকে জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে, স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে তোমার পরিবারকে বাঁচানোর জন্য | আর আমার মনে হয় পরিবারকে বাঁচানোই তোমার এখন মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত | ধারের টাকা শোধ করতে না হলে তোমাদের পরিবারটাও সবদিক থেকেই বেঁচে যাবে | প্রতীক্ষা প্লিজ, আমার জন্য তোমাদের সংসারটাকে এইভাবে তছনছ হয়ে যেতে দিও না | সেটা আমাদের কারো পক্ষেই ভালো হবে না | তোমাদের সংসারটাও ধ্বংস হয়ে যাবে আর আমরাও ভবিষ্যতে একসাথে হলেও অনুতাপের আগুনে সারাজীবন দগ্ধ হতে থাকবো | তুমি তোমার বাবাকে জানিয়ে দাও আমার অনুরোধের কথা | আমার কথা ভেবো না | আমার প্রতীক্ষা আমার হৃদয়ের যে স্থানটা দখল করে রেখেছে, সে সেখানেই থাকবে | তাকে আমার মনের ভেতরের স্থান থেকে কোনোভাবেই উদ্বাস্তু করতে আমি পারবো না |চিরজীবন আমার প্রতীক্ষা আমার মধ্যেই থাকবে | আমি তাকে নিজের মতো করে না পেলেও সে প্রতীক্ষাকে আমি কোনোদিন হারাতে পারবো না | আমার জীবনে আমি আর অন্য কোনো প্রতীক্ষাকেও আপন করে নিতে পারবো না | শুধু জেনে রাখো তোমার জীবন যেমন এক অন্ধকারে কাটবে, তোমার এই মনীশের মনটাও এক গহণ অন্ধকারে ডুবে থাকবে | সেখানে আলোর প্রবেশ চিরতরে নিষিদ্ধ হয়ে গেলো | মনের সূর্য্য চিরকালের জন্য অস্তমিত হয়ে গেলো' |

প্রতীক্ষার হাত থেকে ফোনটা সশব্দে মাটিতে পরে গেলো | একটা আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসলো মনীশের কানে | ভিজে যাওয়া চোখের জলটাকে হাত দিয়ে একটু মুছে নিয়েই মোবাইল ফোন সুইচ অফ করে রেখে দিলো মনীশ |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance