সে এক যাজ্ঞসেনী
সে এক যাজ্ঞসেনী
নারী কথা বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয় । আজ যাকে নিয়ে নারীদের চরিত্রের বিবিধ বর্ণনা দেবো সে হলো মহাভারতের অন্যতম চরিত্র ... যজ্ঞের অগ্নি থেকে তিনি উৎপন্ন হয়েছিলেন বলে তার নাম যাজ্ঞসেনী। সে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা । দ্রুপদের কন্যা বলে তার নাম দ্রৌপদী । । মাতৃহীনা রাজকন্যার জীবন যাপন যে বহু কষ্টের প্রথম দিন থেকেই । এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে রাজকুমারীর কিসের অভাব ? তিনি ধ্রুপদ রাজকন্যা , পরবর্তী সময়ে তিনি পঞ্চ পাণ্ডব সহধর্মিনী । দ্রৌপদী হলেন মহাভারত মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র । তিনি বিভিন্ন নামে পরিচিতা পাঞ্চালের রাজকুমারী বলে তিনি পাঞ্চালী, যজ্ঞ থেকে তিনি উৎপন্ন হয়েছিলেন বলে যাজ্ঞসেনী, ভরতবংশের কুলবধু বলে তিনি মহাভারতী এবং তিনি সৈরিন্ধ্রী নামেও পরিচিতা কারণ অজ্ঞাতবাস কালে তিনি মৎস্যরাজ বিরাটের স্ত্রী সুদেষ্ণার কেশসংস্কারকানী ছিলেন । মহাভারতে দ্রৌপদীকে অনিন্দ্য সুন্দরী ও তার সময়ের শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে । দ্রৌপদী তার শ্বশ্রূ কুন্তীর মত পঞ্চকন্যার অন্যতমা এবং তার শাশুড়ি কুন্তীকে খুব ভালবাসতেন । কুন্তী ও পুত্রবধুকে ভালবাসতেন।
তার জন্মের পর আকাশবাণী হয় তার থেকে কুরুবংশ ধ্বংস হবে ।
‘নারদ পুরাণ’ এবং ‘বায়ু পুরাণ’ অনুযায়ী, দ্রৌপদী একাধারে ধর্ম-পত্নী দেবী শ্যামলা, বায়ু-পত্নী দেবী ভারতী এবং ইন্দ্র-পত্নী দেবী শচী, অশ্বীনিকুনারদ্বয়ের পত্নি ঊষা এবং শিব-পত্নী পার্বতীর অবতার। বিগত জন্মে তিনি ছিলেন রাবণকে অভিসম্পাত-প্রদানকারী বেদবতী। তার পরের জন্মে তিনি সীতা। তারই তৃতীয় ও চতুর্থ জন্ম দময়ন্তী এবং তার কন্যা নলযানী। পঞ্চম জন্মে তিনি দ্রৌপদী। পূর্বজন্মে দ্রৌপদী ১৪টি গুণসম্পন্ন স্বামীর জন্য তপস্যা করেন। শিব তাকে সেই মতো বরদানও করেন। কিন্তু একটি মানুষের মধ্যে এতগুলি গুণ থাকা সম্ভব নয়। তখন শিব তাকে জানান, পাঁচজন মানুযের মধ্যে এমন গুণের সমাহার ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে পঞ্চস্বামী বরণ করতে হতে পারে। দক্ষিণ ভারতে দ্রৌপদীকে দেবী কালিকার অবতার মনে করা হয় ।
বার বার বঞ্চিত , অবহেলিত চরিত্র দ্রৌপদী । তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন তার প্রেম , যাকে পেয়েও বার বার হারাতে হয়েছে । তার পঞ্চ সন্তানদের নৃশংস হত্যা হয়েছে । রজস্বলা অবস্থায় নিজ দেবরদের কাছে অপমানিত হতে হয়েছে তিনি দ্রৌপদী । বহু অবহেলা , অপমান যাকে হারিয়ে দেয়নি বরং আরও শক্ত করে তুলেছে নিয়ত । দ্রাপর যুগের শ্রেষ্ঠ নারী তিনি যার সমন্ধে বহু নিপুণ বর্ণনা মেলে । মহাভারতের আদিপর্বের অন্তর্গত চৈত্ররথপর্বের ১৬৬তম অধ্যায়ে এইভাবে দ্রৌপদীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে :
কুমারী চাপি পাঞ্চালী বেদীমধ্যাৎ সমুত্থিতা ।সুভগা দর্শনীয়াঙ্গী স্বসিতায়তলোচনা ।।শ্যামা পদ্মপলাশাক্ষী নীলকুঞ্চিতমূর্ধজা ।তাম্রতুঙ্গনখী সুভ্রূশ্চারুপীনপয়োধরা।।মানুষং বিগ্রহং কৃত্বা সাক্ষাদমরবর্ণিনী ।নীলোৎপলসমগন্ধ যস্যাঃ ক্রোশাৎ প্রবায়তি ।।যা বিভর্তি পরং রূপং যস্যা নাস্ত্যুপমা ভুবি ।দেবদানবযক্ষাণামীপ্সিতাং দেবরূপিণীম ।।যার অর্থ : তখন যজ্ঞবেদী থেকে এক কুমারীও উৎপন্ন হলেন যিনি পাঞ্চালী নামে পরিচিতা হলেন । তিনি সৌভাগ্যশালিনী, সুদর্শনা এবং কৃষ্ণ আয়তচক্ষুযুক্তা । তিনি শ্যামাঙ্গী, পদ্মপলাশাক্ষী, কুঞ্চিত ঘনকালো কেশবতী এবং তাম্রবর্ণ নখ, সুন্দর ভ্রূ ও স্তনযুক্তা । তিনি মানুষের শরীরে সাক্ষাৎ দেবী । তার নীলপদ্মের ন্যায় অঙ্গসৌরভ একক্রোশ দূরেও অনুভূত হয় । তিনি পরম সুন্দর রুপধারিণী এবং সমগ্র বিশ্বে তুলনাহীনা । এই দেবরূপিনী কন্যা দেব, দানব ও যক্ষেরও আকাঙ্ক্ষিত ।
দ্রৌপদী তার পূর্ব্জন্মে পতি লাভের জন্য তপস্যা করছিলেন এমন সময় মহাদেব তাকে বর দিতে আসেন । দ্রৌপদী এ সময় পাঁচ বার "পতিং দেহি" বলেন যার অর্থ পতি দিন । তখন মহাদেব তথাস্তু বলেন । এজন্য পরবর্তী জন্মে তার পাঁচজন স্বামী হয় । ধ্রুপদ রাজের দ্রৌপদীর সয়ম্বর এর শর্ত ছিল শূন্যে ঘুরন্ত মাছের চোখে জলে প্রতিবিম্ব দেখে যে তীর বিদ্ধ করতে পারবে তাকেই কন্যা দান করবেন । ক্ষত্রিয়দের মধ্যে কেউ তা সম্পন্ন করতে পারেননি । কর্ণ এই কাজ সম্পাদন করতে পারতেন কিন্তু তিনি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গেলে দ্রৌপদী উচ্চস্বরে বলে উঠেন " আমি সূতজাতীয়কে বরণ করব না ।" এতে কর্ণ ক্রোধে সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে স্পন্দমান ধনু ত্যাগ করেন । যেজন্য ধৃষ্টদ্যুম্ন পিতার অনুমতি নিয়ে সকল বর্ণের পুরুষকে আমন্ত্রণ জানান । ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশী অর্জুন এই কাজ সম্পন্ন করে দ্রৌপদীকে লাভ করেন। কিন্তু বাসায় ফিরে যখন ভীম কুন্তীকে তারা কী এনেছে তা দেখার জন্য বলেন কুন্তী তখন অজ্ঞাতসারে অথবা হয়ত ইচ্ছা করেই তাদের বলেন তারা যা এনেছে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে এজন্য দ্রৌপদীকে পঞ্চস্বামী গ্রহণ করতে হয়।
কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধের জন্য পরোক্ষভাবে দ্রৌপদী কে দায়ী করা হলেও বাস্তবে শুধুই কি তিনি এই মহাযুদ্ধের কারণ ? না কখনোই না । মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পরিণতি লাভ করে । এই ঘটনার প্রভাবক ছিল দুর্যোধনের পাণ্ডবদের ও দ্রৌপদীকে নিগৃহীত করার বাসনা এবং তার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া । দুর্যোধন তার মিত্র কর্ণ, মাতুল শকুনি এবং ভাইদের নিয়ে পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে পাশা খেলাতে আনার ষড়যন্ত্র করলেন । প্রধান পরামর্শক শকুনি ছিলেন পাশাক্রীড়ায় নিপুণ । স্থির হল শকুনি যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে খেলবেন এবং যুদ্ধে যা জয় করা অসম্ভব তা জয় করবেন । খেলা এগোতেই যুধিষ্ঠির একে একে তার সমস্ত সম্পত্তি হারাতে লাগলেন । সব কিছু হারিয়ে তিনি ভাইদের পণ করলেন এবং তাদেরও হারালেন । শেষে যুধিষ্ঠির নিজেকে পণ রেখে নিজেকেও হারালেন । পাণ্ডবরা সকলে কৌরবদের দাস হলেন । এসময় শকুনি বললেন কিছু ধন অবশিষ্ট থাকতে নিজেকে হারালে পাপ হয় তিনি যেন দ্রৌপদীকে পণ রেখে নিজেকে মুক্ত করেন । যুধিষ্ঠির তখন দ্রৌপদীকে পণ রেখে তাকেও হারালেন । দ্রৌপদী প্রতিকামীর মুখে এই সংবাদ শুনে প্রশ্ন করলেন যুধিষ্ঠির আগে তাকে না নিজেকে হেরেছিলেন । দ্রৌপদীর প্রশ্ন শুনে দুর্যোধন তাকে সভায় উপস্থিত হয়ে তার প্রশ্ন করতে বললেন । প্রতিকামী আবার গেলে দ্রৌপদী বললেন ধর্মাত্মা নীতিমান সভাসদগণ তার কর্তব্য নির্দেশ করুন । তারা যা বলবেন তিনি তাই করবেন । প্রতিকামী পুনরায় সভায় এসে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানালে সবাই নীরব থাকলেন । দুর্যোধন পুনর্বার প্রতিকামীকে পাঠাতে চাইলে সে ভীত হয়ে বলল দ্রৌপদী না আসলে সে কী করবে । তখন দুর্যোধন তার ভাই দুঃশাসনকে আদেশ দিলেন দ্রৌপদীকে নিয়ে আনতে । দুঃশাসনকে দেখে দ্রৌপদী ব্যাকুল হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধুদের কাছে চললেন কিন্তু দুঃশাসন তর্জন করে তার কেশ ধরলেন যা রাজসূয় যজ্ঞে মন্ত্রজলে সিঞ্চিত হয়েছিল ।দ্রৌপদী বললেন তিনি একবস্ত্রা ও রজস্বলা তাকে এই অবস্থায় যেন সভায় না নেওয়া হয় কিন্তু নিষ্ঠুর দুঃশাসন তার কথা শুনলেন না । দ্রৌপদী সভায় এসে ভরতবংশের ধর্মকে ধিক্কার দিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন । এসময় ভীষ্ম বললেন “ ভাগ্যবতী, ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ম আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছিনা । ” দ্রৌপদী আবারও নিজের বিজিত হবার উপর প্রশ্ন তুললেন । এমন সময় দুর্যোধনের এক ভাই বিকর্ণ সভাসদদের দ্রৌপদীর প্রশ্নের জবাব দিতে বলেন । তিনি বলেন দ্রৌপদী ধর্মানুসারে বিজিতা হননি কারণ তাকে পণ রাখার পূর্বে নিজেকে হারিয়েছিলেন তাছাড়া সকল পাণ্ডবই দ্রৌপদীর স্বামী একা যুধিষ্ঠির নন । এই কথা শুনে কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন যুধিষ্ঠির সর্বস্ব পণ করেছিলেন যার অন্তর্গত দ্রৌপদী; তিনি স্পষ্ট বাক্যে দ্রৌপদীকেও পণ রেখেছিলেন । পাণ্ডবরা তাতে আপত্তি করেননি । তিনি আরও বলেন স্ত্রীদের এক স্বামীই বেদবিহিত যেহেতু দ্রৌপদীর অনেক স্বামী তাই তিনি বেশ্যা । তিনি দুঃশাসনকে পাণ্ডব ও দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে আদেশ দিলেন ।দ্রৌপদী তার স্বামীদের তাকে রক্ষা করতে অক্ষম দেখে বিষ্ণু, কৃষ্ণ, নর প্রভৃতি দেবতার স্তব করতে লাগলেন । এসময় কৃষ্ণ ধর্মরূপে অবতীর্ণ হয়ে অদৃশ্য হয়ে স্বয়ং বস্ত্ররূপে দ্রৌপদীকে আবৃত করতে লাগলেন । দুঃশাসনের আকর্ষণে নানা রঙের বস্ত্র নির্গত হতে থাকল । ভীম দুঃশাসনের রক্তপানের প্রতিজ্ঞা নিলেন । তখন দুঃশাসন ক্লান্ত ও লজ্জিত হয়ে বসে পড়লেন । সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্র রাশীকৃত হল । এরপর দুর্যোধন তার ঊরু দেখিয়ে অপমান করলে ভীম যুদ্ধভূমিতে তার ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা করলেন কিন্তু বস্ত্রহরণের আরও একটি কাহিনী রয়েছে। ‘শিব পুরাণ’ থেকে জানা যায়, দ্রৌপদী এই চরম অসম্মান থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন দুর্বাসা মুনির বরে। সেই কাহিনী অনুযায়ী, দুর্বাসার চিরবাস গঙ্গাবাহিত হয়ে অপমানিতা দ্রৌপদীর কাছে পৌঁছায়। দ্রৌপদী সেই বস্ত্র থেকে খানিকটা ছিঁড়ে নেন। দুর্বাসার বরে সেই ছিন্ন বস্ত্রখণ্ড অনন্ত বস্ত্রে পরিণত হয়।
এত কথা ভাগ করে নিলাম কারণ আমাদের সাধারণ নারীদের বা পুরান বর্ণিত অসামান্য নারীদের সকলেরই মনের ভাব হয়ত কোথাও গিয়ে এক । আমাদের বোঝা সহজ নয় । নারীর মনের গোপন কথা বোঝে এমন পুরুষের দেখা মেলা ভার ।
