স্বপ্নের রাজকন্যা
স্বপ্নের রাজকন্যা
সকাল থেকেই এক নাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে একটুও বিরাম নেই। হঠাৎ করেই যেন অকাল বর্ষন শুরু হয়েছে প্রকৃতির বুকে। তখন থেকে বেড়োব বেড়োব ভাবছি কিন্তু বেড়োতে পারছিনা!!! তার ওপর কাল রাত থেকে মায়ের গা টা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, ওষুধও আনতে হবে, আর সব বাড়িগুলোতে বলেও দিতে হবে মা.... এখন দুদিন কাজে যেতে পারবেনা এই শরীরে। আর অপেক্ষা না.... করে বৃষ্টি,,,..... মাথায় নিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম । বস্তি পেড়িয়ে রাস্তার মোড়ে ওষুধের দোকান থেকে মায়ের জন্য দুটো ওষুধ কিনে যত্নে পকেটে ভরে এগিয়ে গেলাম সদ্য ওঠা চদ্দোতলার বিল্ডিং এর দিকে। বিল্ডিংএ ঢোকার আগে দূর.... থেকে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে একবার দেখে নিলাম বাইরের ঝুল বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে কিনা। রোজ বিকেলে একবার করে এখানে এসে দাঁড়ায় আমি একটা অদৃশ্য টানে। ফুটো জং ধরা ছাতাটা কোনরকমে বন্ধ করে জলটা ভালো করে ঝেড়ে ভীতরে ঢুকলাম সামনে এগিয়ে যাওয়ার আগেই একজন সিকিউরিটি আমায় আটকালো.......!!!
-----------এবং গম্ভীর গলায় বলে উঠল, এই ছেলে কোথায় যাচ্ছ তুমি...???
------------আমি হাসি মুখে বললাম, ঐ.... সাত তলার বোস বাবুদের ঘরে, মা আজ কাজে আসতে পাড়বেনা সেটাই বলতে যাচ্ছি.....।
----------লোকটি নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠল, এই নোংরা কাদা মাখা পায়ে ওপরে উঠবি!!! তার থেকে আমি গিয়ে বলে দিচ্ছি তোকে যেতে হবেনা..!!!
----------আমি বললাম না...না.... আমি পা ধুয়ে, জুতো খুলে যাচ্ছি, আসলে কাওকে এক ঝলক দেখার লোভে আমার এই উৎসাহ সেটা তো আর কেউ বুঝবেনা!!!
----------লোকটি বলল, তাড়াতাড়ি চলে আসবি আর কোথাও যাবিনা।
--------আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে এগিয়ে গেলাম এবং দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙ্গতে লাগলাম আর গুনগুন করে গান করতেও লাগলাম।
ফ্ল্যাটের সামনে এসে বেল বাজালাম, সাথে সাথে আমার মনের ভেতটাও কেমন আনন্দে নেচে উঠল। কিছুক্ষনের মধ্যে দরজাটা খুলে যে....... দাঁড়াল তাকে দেখার জন্যই এই উৎসাহ। আমি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম সামনের দিকে এ.... যে..... আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা তিন্নি। সুন্দর টকটকে লাল রঙের একটা ফ্রক পড়ে, পায়ে লোমওয়ালা তুলতুলে জুতো, এলোচুলে কানে হেডফোন আর হাতে মোবাইল নিয়ে আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিন্নি ভ্রু কুঁচকে আমাকে আপাদমস্তক দেখে চলেছে । ওর তাকানো দেখে আমি নিজের দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, একটা ছেঁড়া গেঞ্জি আর একটা অর্ধ ছেড়া প্যান্ট পড়ে এসেছি আমি তারপর খালি পায়ে, ভিজেও গেছি কিছুটা। নিজেকে দেখে আর সামনে রাজকন্যার রূপ দেখে আমার ঠোঁটে যে..... আলতো হাসি এসেছিল সেটাও মিলিয়ে গেল।
---তিন্নি নাকটা চেপে ধরে বলল, উফ কি...... বাজে গন্ধ বেড়োচ্ছে, অসহ্য!
আমি গেঞ্জিটা নাকের কাছে এনে শুকে দেখলাম গন্ধ বেড়োচ্ছে হাল্কা, আসলে কাচা হয়নি অনেকদিন, তারপর ভিজে ভিজে থেকে কেমন একটা বাজে গন্ধ ছাড়চ্ছে।
----তিন্নি একরাশ বিরক্তি নিয়ে ডেকে উঠল, মাম্মাম.... মাম্মাম.... দেখ রমা আন্টির ছেলে এসেছে..... ততঃখনে ওর মা এসেগেছে দরজার কাছে।
-আমি বলে উঠলাম, মায়ের খুব জ্বর দুদিন আসতে পাড়বেনা, তাই বলতে এসেছিলাম।
ম্যাডাম একটু রাগি স্বরে বলে উঠলেন শুনে খুব.... খুশি হলাম!!!! আজ জ্বর, কাল পেট ব্যাথা, এত লেগেই আছে, এইভাবে চলবে না,,..... অন্য লোক দেখতে হবে মনে হচ্ছে, মাসের পর মাস টাকাও গুনছি, আবার কাজও করছি। আর কিছু বলার আছে....?
-আমি মাথা নেড়ে বললাম, না......!!!
সাথে সাথে আমার মুখের ওপর শব্দ করে কারুকার্য করা দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আসলে ভাবতে পারিনি এই রকম ব্যবহার পাবো। আচ্ছা আমার মা..... লোকের বাড়ি কাজ করে, আমরা বস্তিতে থাকি বলে কি.....এই সব লোকেরা আমাদের মানুষ বলে মনে করেনা! কিন্তু প্রথম যেদিন মায়ের সাথে আমি এসেছিলাম সেইদিন এই..... রাজকন্যা আমার দিকে তাকিয়ে অালতো হেসেছিল, আর আজ....!সত্যি বাস্তব বড় কঠিন। সময়ের সাথে সবার মুখ থেকে মুখোশ ঠিক খুলে যায়, এবং আসল চেহারা বেড়িয়ে পড়ে।
আর ওখানে না...... দাঁড়িয়ে আমি বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করে দিলাম, বৃষ্টি তখন কিছুটা ছেড়েছে মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। আমি ঘরে ঢুকে একবার ভালো করে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে মনে মনে বলে উঠলাম, সত্যি ও রাজকন্যা আর আমি.....!!! যার বাবার পরিচয় জানা নেই, তাহলে এই রকম ব্যাবহার তো প্রাপ্য। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে, কালকের বাসি ভাত কটা মাকে পরম যত্নে খাইয়ে দিয়ে ওষুধ দিয়ে শুইয়ে দিলাম। আর ভাঙ্গা জানলার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ করে ঝড়ে পড়া দেখতে দেখতে একটা সাদা খাতা নিয়ে বসলাম। ভেবেছিলাম এক মস্ত উপন্যাস লিখব আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা কে নিয়ে, কিন্তু ভাষারা সব যেন হারিয়ে গেছে আজ
'প্রকৃতির বুকে সন্ধ্যা নামার
ঠিক প্রাক্কালে,
দাঁড়িয়ে থাকো তুমি এলোচুলে।
কানে হেডফোন গুজে দুচোখ বন্ধ
করে সুরের গভীরে যাও হারিয়ে,
আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে দেখি
তোমায় দূর থেকে দাঁড়িয়ে।
সিঁদুরে মেঘের রক্তিম আলোয়
তোমায় লাগে অপরূপা,
এই ছবি আমার মন ক্যানভাসের
সাদা পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে
চিরজীবন আঁকা।
আচ্ছা তোমারও কি রবি ঠাকুরের গান
পছন্দ নাকি আধুনিক?
মনে উঠেছিল প্রশ্ন
কিন্তু মুখ ফুটে সে বেরোয়নি!
আচ্ছা তোমার কাছে ভোর নাকি
পড়ন্ত বিকেল কোনটা লাগে ভালো?
কি জানি!
তবে আমার কাছে ভালো লাগে
ভোরের শান্ত শীতল পরিবেশ পাখির
কুহুতান আর সূর্যের মৃদু আলো।
তোমার আমার পরিচয় ঠোঁটের
কোনে আলতো হাসিতেই সীমাবদ্ধ,
তুমি তোমার নিজের জগতে আর
আমি কঠিন বাস্তবের বেড়াজালে আবদ্ধ।
তুমি হলে রাজকন্যা, আদরের দুলালি,
আর আমার জন্মের সাক্ষী রাতের
এক অন্ধকারাচ্ছন্ন চোরাগলি।
আমার কাছে তুমি হলে আকাশের
বুকে একফালি রূপোলি চাঁদ,
যার জোৎস্না গায়ে মাখা যায়
কিন্তু তাকে নিজের করে পাওয়ার
চিন্তা করাও পাপ।
তোমার ঐ আলতো হাসির টানেই
রোজ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা,
দূর থেকে নিজেকে আড়ালে
রেখে তোমায় দেখা।
তোমার চদ্দোতলার বিল্ডিংএর পিছনে
ঐ নোংরা বস্তিতে আমার বাস,
আমার মাথার উপর আছে
সুন্দর খোলা আকাশ।
তুমি হয়তো জানোনা আমি
আসি রোজ বিকেলে!
আমার ভালোবাসার খোঁজ কোনদিনও মিলবেনা
তোমার কাজল কালো চোখে।
তোমার জীবন এগিয়ে চলুক
তোমার সুন্দর গতি পথে,
আমি না হয় থাকব
পরের জন্মের অপেক্ষাতে'।